মুসলিম জাহানের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্যবাহী আনন্দোৎসব ঈদ। শুরু হয়েছিল নবী মুহাম্মদ সা. এর সময়। রাসূল সা. সর্বপ্রথম ঈদের নামাজ আদায় করেন রমযানের সিয়াম (রোযা) ফরজ হওয়ার পর অর্থাৎ দ্বিতীয় হিজরির সাওয়াল মাসের ১ তারিখে। মদিনায়। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে। মুহাম্মদ সা. ঈদ উদযাপান করার নির্দেশ পেয়েছিলেন আল্লার পক্ষ থেকে। এই ঈদই ছিল মুসলিম উম্মাহর প্রথম উদযাপন করা ঈদ। ঈদের নামাজ প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ওয়াজিব। রাসূল সা. ঈদের দিন যেভাবে নিজেকে প্রস্তুত রাখতেন সেভাবে প্রস্তুত থাকাটা মুসলমানদের জন্য সুন্নাত। ঈদের প্রস্তুতি ফজরের নামজ থেকে আরম্ভ করা উত্তম। যেমন খুব ভোরে বা সকালে ঘুম থেকে ওঠা। মেসওয়াক করা। গোসল করা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরা। সুগন্ধি ব্যবহার করা। ফজরের নামাজের পর বেশি বিলম্ব না। আগে আগে ঈদগাতে যাওয়া। যাওয়ার আগে মিষ্টিদ্রব্য আহার করা। ফিৎরা আদায় করা। ঈদগাহে নামাজ পড়া। প্রাকৃতিক কোনো দূর্যোগ না থাকলে ঈদের নামাজ মসজিদে না পড়া। পায়ে হেঁটে এক রাস্তা দিয়ে গিয়ে অন্য রাস্তা ধরে ফিরে আসা। সমস্ত রাস্তায় মৃদুস্বরে তাকবির পড়া। কিন্তু ঈদুল আযহার দিন উচ্চস্বরে তাকবির পড়া। ঈদুল আযহার কুরবানি করা।

ঈদুল আযহার দিন; পর দিন; তারপর দিন কুরবানি করা যায়। কুরবানির গোস্ত ধনীগরিব সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। এক সন্ধ্যা সকলেই পেট পুরে আহার করে। এটি আনন্দের। কিন্তু গরিব দুঃখি মানুষের জন্য ঈদুল ফেৎরের আনন্দ ঈদের আগে। কেননা ঈদের আগে তাদের হাতে ফিৎরার নগদ টাকা এসে যায়। এ জন্য ঈদের নামাজ পড়ার আগে ফিৎরা আদায় করা জরুরি। ফিৎরার অর্থ আগেভাগে দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো, ঈদের দিন গরিব মিসকিনরা যেন অনাহারে না থাকে। ফিৎরার টাকা পয়সা দিয়ে তারা যেন নিজের জন্য, ছেলে-মেয়েদের জন্য নতুন জামাকাপড় কিনতে পারে। গরিব-ধনী সবার গায়ে যখন নতুন জামা ওঠে; সকলের ঘরে যখন খাবার জোগার হয় তখন ঈদের আনন্দও নির্মল আনন্দ হয়ে ওঠে। এভাবে ঘরে ঘরে অনাবিল আনন্দ বয়ে আনে মুসলমানদের ঈদ।
ঈদ কীভাবে উদযাপান করতে হয় তা শিখিয়েছেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা.। নবীর সাহাবি হযরত আনাস রা. বলেছেন, ঈদুল ফিতরের দিন কিছু না খেয়ে রাসূল সা. বাইরে বের হতেন না। একটি বর্ণনায় আছে, তিনি বেজোড় সংখ্যক খেজুর খেয়ে ঘর থেকে বের হতেন (বুখারি)। আবার ঈদুল আযহার দিন নামাজের আগে কোনো কিছুই খেতেন না। বুখারির অন্য একটি হাদিসে রয়েছে- রাসূল সা. ঘর থেকে তাকবির দিতে দিতে বের হতেন। তাকবির দিতে দিতে পায়ে হেঁটে যে পথে ঈদগাহে যেতেন; নামাজ শেষ করে তাকবির দিতে দিতে অন্যপথে ফিরতেন। বুখারির আর একটি হাদিস থেকে জানা যায়, রাসূল সা. ঈদের নামাজ আদায় করতেন আযান ছাড়া। ইকামাত ছাড়া। নামাজের পরে খুৎবা পড়তেন। ছহি হাদিসের গ্রন্থ মুসলিমে রয়েছে, রাসূল সা. ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের দিন সূরা কাফ ও সূরা কামার পড়তেন। পুরা রমযান মাস রোযা রাখার পর শাওয়াল মাসের এক তারিখ সকালের দিকে ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়তেন। যিলহাজ্জ মাসের দশ তারিখ দুপুরের আগেই ঈদুল আযহার নামাজ পড়তেন। এভাবে মুহাম্মদ সা. ঈদ উদযাপন করতেন।

ঈদ খুশির বার্তা নিয়ে ফিরে আসে। আর খুশি মানেই আনন্দ। ঈদ আনন্দের উৎসব। আনন্দ ও খুশির সেই বার্তা হচ্ছে, ঈদের দিন আল্লাহ মুসলমানদের অপরাধসমূহ (আল্লাহর সাথে অংশীদারিত্ব, খুন, ধর্ষণ, অধিকার হরণসহ বড় অপরাধ ব্যতীত) ক্ষমা করে দেন। ক্ষমা আনন্দের। সে কারনে ঈদ মুসলিমদের জন্য আনন্দের উৎসব। খুশির উৎসব। অপরাধের দায় থেকে মুক্ত হতে পারলে মানুষ নিজেকে প্রফুল্ল মনে করে। নিজের ভেতরে একধরনের পুলক অনুভূত হয়। আনন্দ অনুভব করা যায়। ঈদের দিনে সাধারণ ক্ষমাপ্রাপ্তি মুসলমানদের জন্য অপার আনন্দের। অপরাধের শাস্তি থেকে মুক্তি পাবার যে আনন্দ সেটিই মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দের।
ঈদ হৈহুল্লোড় ও রঙ তামাশার উৎসব নয়। ঈদ শান্তি ও সৌহার্দ্যরে উৎসব। ঈদে ইবাদত পরিপূর্ণ করার অবকাশ থাকে। যেমন- গরিব-মিসকিনদের ফিৎরা দেওয়া ইবাদত। ঈদগাহে নামাজ আদায় করা ইবাদত। কুরবানি করা ইবাদত। আঁতশবাজি পোড়ানো, পটকা ফাঁটানো, ঢাক-ঢোল-কাঁসাই বাজানো কিংবা রঙ ছিটানো, গানের আসর, মদের আড্ডা বসানোর মতো কোনো বাজে কাজ ঈদ আনন্দের সাথে করা যাবে না। আনন্দের নামে এসব করা মানে অপরাধ করা। এসব করলে ঈদের ইবাদত নষ্ট হয়ে যায়।

ঈদ মুসলিমকে ত্যাগের শিক্ষা দেয়। ত্যাগের মধ্যে রয়েছে নির্মল আনন্দ উপভোগের অপার সম্ভাবনা। ত্যাগী মানুষ সুখি মানুষ। স্বার্থবাদীতা, পরশ্রীকাতরতা মানুষকে অসুখি করে তোলে। স্বার্থবাদীদের কারনে সমাজ অস্থির হয়ে ওঠে। মানুষের সুখ নষ্ট হয়। ঈদ মুসলমানদের অসুখের বিশৃঙ্খলা থেকে বের করে আনে। ঈদুল ফিতরের দিন ত্যাগের শিক্ষা মানুষ অর্জন করতে পারে। ঈদুল ফিতরে আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। সে আনুষ্ঠানিকতার যাত্রা শুরু করা হয় সওম ও ছদাকাতুল ফিতরা আদায়ের মাধ্যমে। ঈদগাহে যাবার পূর্বেই ফিতরার অর্থকড়ি গরিব-মিসকিন আত্মীয়-অনাত্মীয়দের মধ্যে বিলিবণ্টন করে ঈদের নামাজ পড়তে হয়। এখানেই ত্যাগের আনন্দ নিহিত। নিজের অর্থকড়ি অন্যের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে আনন্দ আছে। অর্থকড়ি ত্যাগের শিক্ষা পৃথিবীর অন্য কোনো উৎসবের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। ঈদুল আযহাও ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল। এখানেও পরার্থে নিজের আনন্দকে ভাগাভাগি করার শিক্ষা পাওয়া যায়। কুরবানির পশু জবাইয়ের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা বান্দাদের অর্থমোহ থেকে ফিরাতে চায়। আল্লাহ কোরবানির রক্তগোস্ত কিছুই চায় না। তিনি চান বান্দার অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগুক। আযহার ঈদেও কুরবানির গোস্ত বিলিয়ে দেওয়া; চামড়া বিক্রির অর্থ সমাজের অবহেলিত মানুষের জন্য উৎসর্গ করার শিক্ষা পাওয়া যায়। সমাজের প্রত্যেকটি মানুষ যেন মহিমান্বিত ত্যাগের এই উৎসবে নিজেকে যুক্ত করতে পারে। সে ব্যবস্থা ঈদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। এসব আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে ঈদের আনন্দ অন্তর্ভূক্ত। অনেক মানুষ মোটাতাজা বড়সর পশু কুরবানি করে। সামান্য কিছু গোস্ত মানুষকে দিয়ে সমস্ত গোস্ত ফ্রিজে রাখে। নিজেরা গোটা বছর খায়। এরকম করা ঈদের আনন্দ নয়। গোস্ত বিলিয়ে দেওয়া আনন্দের।

ঈদকে আনন্দ ও ইবাদত দুই অর্থে গ্রহণ করা হয়। ঈদ পালনের মাধ্যমে ইবাদত করা যায়। ঈদে সর্বস্তরের মানুষকে মর্যাদার সাথে গ্রহণ করতে পারা যায়। যদি পারা যায়, তাহলেই ঈদ সবার জন্য আনন্দের ও খুশির হয়ে ওঠতে পারে। কিন্তু ঈদকে যদি নিছক উৎসব হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তবে অনেকের ক্ষেত্রে ঈদ বিড়ম্বনার কারণও হতে পারে। ঈদের মৌলিক বিষয় বাদ দিয়ে উৎসব আর আনন্দ মানে যদি নতুন নতুন জামাকাপড়, শাড়ীগহনা, পাজামা-পাঞ্জাবি, ঘুরে বেড়ানো, নাটক সিনেমায় যাওয়া, মদের আসর, গানের কনসার্ট, জুয়ার আসর ইত্যাদিকে মনে করা হয়, তবে ঈদ মনোকষ্টের কারণ হতে পারে। সেক্ষেত্রে নতুন জামাকাপড়, শাড়ীগহনা না পেলে মনে কষ্ট লাগতে পারে। এ কষ্ট গরিব ধনী, ছোটলোক বড়লোক সবার হতে পারে। নাটক সিনেমায় যাওয়া, ঘুরে বেড়ানো না হলে কষ্ট বাড়তে পারে। মদের আসর, গানের কনসার্ট, জুয়ার আসরে না যেতে পারলে ঈদকে ঠিক ঈদ মনে না-ও হতে পারে। ঈদের আনন্দ মানে এসব মনে করার কারনে সংসারে অশান্তি দেখা দিতে পারে। সংসার ভাঙ্গতেও দেখা যায়। এমনকি অনেকে আত্মহত্যাও করে। ঈদকে যখন শুধুই উৎসব মনে করা হয় তখন ঈদ আসার সাথে সাথে নিদারুন গরিবদুঃখী মানুষ সন্তানসন্ততি নিয়ে মনোকষ্টে ভোগেন। বাইরে অন্য মানুষের জাঁকজমক দেখে তারা নিজেকে সবচেয়ে অসহায় অবহেলিত মনে করতে থাকেন। অথচ সভ্যতা বিনির্মাণে গরিবদুঃখিদের অবদান আছে। গরিবরাও গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। ঈদের অর্থ ভিন্ন করার কারনে গরিব দুঃখি গুরুত্বপূর্ণ সেই মানুষগুলো নিজেদেরকে বঞ্চিত অসহায় অবহেলিত ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। এটি মুসলিম জাতির জন্য দুঃখজনক। একজন মুসলিমের অর্জিত ধনসম্পদ অন্য মুসলিমের কল্যাণে না লাগলে সেই সম্পদ অন্য মানুষের কষ্টের কারণ হয়। এমন সম্পদের কারনে নিজের পরিবারের মধ্যেও অশান্তির আগুন জ্বলতে পারে। সময়ের ব্যবধানে মানুষের ধনসম্পদ একই রকম থাকে না। পৃথিবীর এ বড় নিষ্ঠুর খেলা। এ নিষ্ঠুরতায় নিজেকে না জড়ানোই ভালো। নিজেকে সুখি দেখতে চাইলে বেশি বেশি দান-সদকা ও যাকাতের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

ঈদের দিন আপনজন, প্রিয়জন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে। এই আকর্ষণ যেন সমস্তবছর জুড়েই থাকে। অন্যের সুখকে বাড়িয়ে দিতে পারলে নিজের সুখও বাড়ে। ঈদের দিন যেমন সবাই সবাইকে সমাদর করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করে, বছরের অন্য দিনগুলোতেও সেই অভ্যাসটি বজায় রাখা কর্তব্য। কর্তব্যের সেই বার্তা নিয়েই ঈদ বার বার ফিরে আসে॥

Share.

মন্তব্য করুন