সৃষ্টি সুন্দর। পৃথিবী সুন্দর। জীবন সুন্দর। ফুল সুন্দর। ¯িœগ্ধতার পরশ মাখা। স্পর্শময় পাপড়ির সুখানুভব। পৃথিবীর সৌন্দর্যের এক আনৌখি রূপ ফুল- নানা রঙ ধারণ করে আছে। প্রতিটি ফুলের পাপড়ির আলাদা এক রূপ এক বচন। যেন হৃদয় খুলে রাখে জীবনের তরে। প্রতিটি সকালের চিত্র মনোহর। আকাশ তার রূপ মেখে সাজিয়ে তোলে পৃথিবী। অবাক পৃথিবীর বুকে ফুলের গাছেরা পরম আদরে প্রকৃতির বুকে তুলে ধরে তার সৌরভ। প্রাণ হয় উচ্ছ্বাসময়। আনন্দের। ভালোবাসার। প্রকৃতির প্রতিটি ঋতুই আলাদা আলাদা বিশেষত্বে বিরাজমান। অনুভব-অনুভূতির এক অন্য আলোকপ্রাপ্তি। বলার সুখ। নাম ধরে ডাকার আনন্দ। কবিতা হোক বা গল্প সবখানেই বাধাহীন যাত্রা। বিশেষণে বিচলিত হওয়া। সুখী হয়েও দুঃখ পাওয়া। দুঃখের মাঝেও শুভকামনা থাকা। ইস কি মিষ্টি। জীবন তো এমনই। টক-ঝাল-মিষ্টি। পাল্টিয়ে-উল্টিয়ে ভাবনা- জীবন হোক জীবনের। শান্তির। আনন্দের। প্রেরণার। প্রাপ্তির। আকাক্সক্ষার। এসব ঘিরেই পথ ঘুরে ঘুরে আসে ফুলের সৌরভ। আসে সমৃদ্ধ করতে। সুখ সাজাতে। আসে দুঃখ ভোলাতে। কত শত নাম নিয়ে। গন্ধের তীব্রতা নিয়ে হাজির হয় বীরদর্পে।

আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা। তবুও কেন জানি গোলাপকেই ফুলের রাজা মনে হয়। আর রাণী রজনীগন্ধা। কি মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে মনকে মাতিয়ে তোলে। প্রতিটি পাপড়ির ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে সৌন্দর্য। সাদা, গোলাপি, লাল আরো কত রঙের গোলাপ। সকালের শিশির ভেজা পাপড়িতে ছোঁয়া দিলেই মন হবে শুদ্ধ। কিছু কিছু সৌরভ বা সৌন্দর্য আছে যা আনন্দের অনুষঙ্গে যুক্ত। বাগানের মালীদের মধ্যেও খেলা করে উৎসবের ঢেউ। রকমারি ফুলের বাহারে সাজবে বাগান। ফুলেদের মেলায় হাসবে মালী। তারপর বাকিসব। চুপিচুপি দুখাকুল বেয়ে নামবে আনন্দের শব্দবীণা। জায়গায় জায়গায় ভিড় করবে নানা বয়সের মানুষেরা। উৎসবের আমেজ খেলা করবে। রাতের লালিমা কেটে পুব আকাশ যখন হালকা রঙ ছড়িয়ে দেয় পৃথিবীর বুকে তখনই সব কলি তাদের মেলে ধরে আপন সৌন্দর্যে। একটু একটু করে ছোট্ট কলি যখন প্রস্ফুটিত হয় এর রূপের বুঝি ব্যাখ্যা নেই কোনো। বহুবছর আগের কথা- তখন ফুল বলতেই গোলাপ আর রজনীগন্ধার কথাই মনে পড়ে। নানারঙের গোলাপ নানা অবয়বে নানা জায়গায় সুশোভিত হয়। বলা যায়, প্রতিটি ঘরেই ছিল গোলাপ আর রজনীগন্ধার গাছ।

ছোট থেকে বড় সবারই খুব শখ হয় ফুলগাছ লাগানোর। গোলাপ থেকে বেলি বাদ যায় না কোনকিছুই। কিন্তু সেই ছোট্ট বয়সেই কেন জানি গোলাপের সাথে সখ্য ছিল খুব। কলি থেকে পুরো ফুল ফুটে ওঠার দৃশ্য ছিল উচ্ছ্বাসময়। বইয়ের ভাঁজে গোলাপ রেখে দেয়ার স্মৃতিরা আজও জীবন্ত। বিয়ে থেকে জন্মদিন সবজায়গাই দখল করে আছে ফুলের রাজত্ব। নতুন বা পুরাতন সব বয়সের বন্ধুরা ফুল দিয়ে নিজেদের বিশেষত্ব প্রকাশ করে। কত ভাবেই ফুলেরা তাদের জানান দেয়। উৎসবই সব আনন্দের প্রতিধ্বনি। খুশিময় জীবনের এক অন্যরকম মিলনমেলা। তা যদি হয় ঈদের খুশি। এর তো কোনো ঠিকানাই থাকে না। একটি ঈদ আনন্দের অপেক্ষা থাকে সারাটা বছর ধরে। কে কোন জামা কিনবে? তার সাথে ম্যাচিং কী কী হবে? কোন বন্ধু আবার দেখে ফেলল কিনা। কারণ ঈদের আনন্দ বলে কথা। এখানে কোনরূপ ছাড় দেয়া হবে না। শবেবরাতের রাত শেষ হওয়ার পর থেকেই চলে নানারকম স্বপ্ন বোনা। মনে হয় বুঝি এরই রূপ ফুল হয়ে ফোটে বাগানের প্রাচুর্যতায়। জীবন্ত অনুভব। চোখ মেললেই যেন দেখা হবে রহস্যময় সুন্দরের সাথে। যে জীবন সত্যিকারের সুন্দরের প্রতীকীরূপ।

এমনিভাবে ঈদের খুশি আসে ফুলের মতো শিশুদের কলকাকলিতে। এখনও যখন ভাবি- কোন ঈদটা স্মৃতিময়। কোন সে আনন্দ যা মনে এলে অজান্তেই মন ফুলে ওঠে আনন্দে। ছোটবেলার ঈদ আনন্দ। আজ যখন শিশুদের আনন্দময়তা দেখি। দেখি কেমন ছিল শিশুর জগৎ। কেমনইবা ছিল শৈশবের সেই দিনগুলো। তখনই মন বলে ওঠে শিশুর জগৎ আনন্দের জগৎ। রহস্য ভালোবাসে শিশুরা। তাদের ঘিরে থাকে ভয়ের নানাগল্প। রহস্যময় পৃথিবীর বুকে শিশুদের থাকে না কোন শঙ্কা। কাউকে মেনে চলার ধার ধারে না শিশুরা। তারা শুধু তাদের ভেতর জগতের রাজা। তারা শুধু নিতে শিখেছে। ভালোবাসতে শিখেছে। উচ্ছ্বাসময় প্রাণময়তার আদলে ঘেরা শিশুর পৃথিবী। তাই তো তারা ফুলের মতো। নাজুক। কোমল। শিশুর পৃথিবী সবসময়ই রঙিন। রঙ তাদের ভীষণ প্রিয়। উৎসব উৎসাহের সাথে জীবনকে দেখার সহজতা আছে তাদের। যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে তারা কোন বিবেচনায় যায় না। সরল মনে চলে। কোমল হৃদয়ে মধুর ভাষায় প্রকাশ করে নিজেদের। খোলা মনে আকাশ দেখে। পাখিদের ওড়াউড়ি তাদের মনকে জাগ্রত রাখে। মেঘময় বৃষ্টির টাপুরটুপুর শব্দের তালে তালে নেচে বেড়ায় চঞ্চল মন। গাছেদের সাথে সখ্য গড়ে তোলে সহজেই। প্রকৃতির অনুষঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে নিজেদের জানান দেয় ফুলের মতো শিশু-কিশোর। ভাবতে ভালো লাগে আজ লিখছি শিশুদের কথা। নিজেই একসময় দুরন্ত শিশু ছিলাম। ভয়কে জয় করার সাহস দেখিয়েছি অসংখ্যবার। একবার তো এমন হলো- পদ্ম ফুল নিবো বলে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছি কিন্তু খেয়ালই নেই যে সাঁতার জানি না। এমনই আসলে শৈশবস্মৃতি। যা মনে পড়লে জীবনকে বড্ড বেশিই আনন্দের মনে হয়।

বলবো ছোট্ট মেয়ে জুঁই এর গল্পকথা। যার ভীষণ পছন্দ ফুলের সাথে মেতে থাকা। গন্ধ নেয়া। জুঁইদের বাসার ছাদে সে ছোট্ট একটি বাগান করেছে। সেখানে ক্যাক্টাস, রজনীগন্ধ, বেলি, মাধবীলতা, গোলাপ, জবা, অর্কিড এসব গাছের সমারোহ। স্কুল ছুটির পর তার প্রিয় জায়গা এই গাছগুলো। মায়ের কাছে তার একটাই আবদার- তার আরও ফুল চাই। চাই নানান রঙের বাহারি গোলাপ ও জবা। এই গাছগুলোই তার বন্ধু। প্রতিদিন সে ফুলের সাথে গাছের সাথে সময় কাটায়। কথা বলে। গন্ধ নেয়। পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকে। খুব ভালোবাসে সে তার বাগানটিকে। একদিন তাদের বাসায় একটি পরিবার এলো বেড়াতে। তাদের সাথে এলো ওরই বয়সী দুটো বাচ্চা। তারা জুঁইয়ের ছাদবাগানে গিয়ে ফুলগুলো থেকে অনেকগুলো ফুল ছিঁড়ে ফেলল। স্কুল থেকে ফিরে জুঁই ছাদবাগানে গিয়ে দেখে তার গাছদের ভীষণ মন খারাপ। ফুলগুলো ছিঁড়ে নিয়েছে কেউ। সে ভীষণ কষ্ট পেয়ে নীরবে কাঁদতে লাগল। সে অবাক হয়ে ভাবল, কেমন করে পারল কেউ গাছের বুক থেকে ফুলগুলোকে আলাদা করতে? একবারও মনে হয়নি গাছ কতটা কষ্ট পাবে। কাঁদতে কাঁদতে সে তার মাকে বলল, আচ্ছা মা আমাদের যদি কেউ এসে আঘাত করে আমাদের কেমন কষ্ট হবে। কেন তবে ফুলগুলো ছিঁড়ে ওরা গাছগুলোকে কষ্ট দিলো। অনেক বুঝিয়েও মা যখন জুঁইকে খাওয়াতে পারলো না তখন সেই বাচ্চাদেরকে নিয়ে আসল জুঁইয়ের কাছে। জুঁইয়ের এভাবে কষ্ট দেখে তারাও ভীষণ অবাক। আরও বেশি আশ্চর্য হলো জেনে যে, গাছেরও জীবন আছে সেও কষ্ট পায়। তাদের বাবা-মাও জুঁইয়ের কথাগুলো শুনে তাদের বাচ্চাদের বোঝালো এবং তারা নিজেরাও শিখল। প্রকৃতির নিসর্গরূপ ফুলের প্রতি জুঁই তার ভালোবাসা দিয়ে এক নতুন ভাবনার আকাশ তৈরি করল। নতুন আনন্দ যোগ হলো জীবন নদীতে। ছোট্ট একটি মনের আকাশ এতটা বিস্তৃত। এতটা গভীর। জুঁইকে খুশি করতে তারা নানার রঙের গোলাপ আর জবা গাছ এনে জুঁইকে উপহার দিলো। বাচ্চা মেয়েটির আনন্দে তারাও আনন্দিত হলো। এবং ওরাও সিদ্ধান্ত নিলো আসছে ঈদের খুশিতে তাদের বাসায়ও এমন ফুলের গাছ লাগাবে। এমন সংবাদে জুঁইও আনন্দে তাদের জড়িয়ে নিলো। একটি দশ বছরের বাচ্চা কত সুন্দরভাবে শিখিয়ে দিলো গাছেরাও শুনতে পায়। তাদেরও আছে অনুভব এর তীব্রতা। তাই ফুল গাছেই সুন্দর। জুঁই যেন তার নামের মতোই সুবাস ছড়িয়ে দিলো।

প্রকৃতির রহস্য উপলব্ধি খুব সাধারণ বিষয় নয়। ফুল, গাছ, নদী, মেঘ সবই প্রকৃতির শক্তিশালী অনুষঙ্গ। সাহিত্য এবং কবিতায় এর অন্তহীন উৎস দৃষ্টি কাড়ে। আশা ও স্বপ্নের হাটবাজার জমে ওঠে প্রকৃতির কোলে। যেখানে কবি-সাহিত্যিকেরা তাদের আবিষ্কারের সুখ অনুভব করে। এবং পৃথিবী পায় সাহিত্যের নিগূঢ় রস আস্বাদনের। পৃথিবীর সব দেশেই প্রকৃতির বিভিন্নতায় মুগ্ধ মানবমন। মানুষ প্রাণের উচ্ছ্বাস-আনন্দে ছুটে যায় দূর-দূরান্তে। ভালোলাগা ফুলগুচ্ছ ও প্রকৃতির বিভিন্নতা ঘরের শোভাবর্ধনে ভূমিকা রাখে। বেড়ে উঠার সময়ে কচিমনে বারবার উঁকি দেয় নানাপ্রশ্ন। নানা জিজ্ঞাসা। কত কি জানতে চায় মন। কত কি দেখার ইচ্ছে। শিশুরা ফুলেরই মতোন। নরম। আদুরে। তাদের মনোজগতে থাকে শুধু আনন্দের ভাবনা। কিন্তু বর্তমান সময়ে প্রকৃতির সৌন্দর্যের জায়গায় প্রযুক্তি আমাদের বেশি আকর্ষণ করছে। ফলে সত্যিকারের আনন্দের অনুষঙ্গ থেকে বাচ্চারা আজ বঞ্চিত। জুঁইয়ের মতো প্রকৃতির অনিন্দ্য সৌন্দর্যতাকে মন থেকে গ্রহণ করতে হবে। ভালোবাসতে হবে। তবেই একটি আলোকিত সুন্দর দিন আসবে। ভোর হতে অন্ধকারের রেখায় যুক্ত হবে আনন্দের নানাবিধ চিহ্ন। কবি জাকির আবু জাফর কত সুন্দর করে বলেছেন,
‘ভোরের আগে যখন দেখি নতুন ভোরের চিক
আলোর আলোয় আনন্দময় তোমার চতুর্দিক।
তখন তখন সুখ পবনের গল্প আঁকে ভোর
মেঘের শিকায় ঝুলতে থাকে কী মায়াবী ঘোর!
ভোরের ভেতর জ্বলতে থাকে নতুন পথের বাঁক
হঠাৎ দেখি পাতার ফাঁকে ছাতিম ফুলের ঝাঁক।
কেউ কি জানে ফুলের লোভে কে আসে কে যায়
মৌমাছিদের জলসা যখন ফুলের বিছানায়।’

Share.

মন্তব্য করুন