সিয়াম পালনের মাধ্যমে বান্দার আনন্দের সুযোগ রয়েছে। রোজাদার ইফতারের সময় ও সাহরির সময় যে অনাবিল আনন্দ উপভোগ করে, যে সিয়াম পালন করে না, তার ভাগ্যে এ আনন্দ জোটে না। সিয়াম যে শুধু আধ্যাত্মিক সাধনারই সুযোগ এনে দেয় তা নয়। সিয়াম দৈনিক সক্ষমতা বিধানে ও স্বাস্থ্য রক্ষায় অমোঘ মহৌষধের কাজ করে। রক্তচাপ, বহুমূত্র, বাতজ্বর এবং উদর ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া সচল ও স্বাভাবিক করে। সিয়াম প্রাকৃতিকভাবে বান্দার দৈহিক হিত সাধনের অমোঘ চিকিৎসা করার সহায়তা করে। বছরে এগারো মাস সাধারণ নিয়মে খাওয়া দাওয়া ও চলাফেরার পর এক মাসের সংযম-ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাধ্যমে মুমিন নতুন জীবন প্রাপ্ত হয়। কৃচ্ছ্রতার মাধ্যমে দেহ ও মনের, শারীরিক ও আধ্যাত্মিক মোক্ষণের সহায়তায় মুমিন আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য লাভের সুযোগ পায়। আর এই পরম সুযোগই তো মানুষের কাম্য। আদম সন্তান মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে জন্মলাভের পর তার সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে কামিয়াব হওয়ার চাইতে আর কী আশা করতে পারে? এইতো তার পরম সাফল্য।
এই পরম সফলতার সৌভাগ্য যার, তার জন্যই ঈদের খুশি বা আনন্দ। সাফল্যের আনন্দ প্রকাশ করার উপলক্ষে যে উৎসব তারই নাম দেয়া হয়েছে ঈদ। আর এই ঈদ তারই জন্য খুশির খবর নিয়ে আসে যে রহমত লাভ করেছে, ক্ষমা পেয়েছে এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়েছে।

যেহেতু দীর্ঘ এক মাস আহার বিহারে সকল কর্মে-কথায় সংযম পালন করে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে, তাই এর আনন্দ ইফতার বা সিয়াম ভঙ্গ করে খাওয়ার আনন্দ। ফলে এই উৎসবের নাম হলো ঈদুল ফিতর। ইফতারের আনন্দ ও ফিতরা দানের আনন্দ এ উৎসবকে করে তোলে সার্থক।
ঈদের উৎসব আরো একটি কারণে আনন্দের উৎসব। ধনী গরিব সবাই একত্রে মিলে ঈদের জামাতে শামিল হয় ও সালাত আদায় করে। পরস্পর ভাই ভাই বলে একে অপরকে আলিঙ্গন করে। মানুষে মানুষে যে ভেদাভেদ নেই, মানুষ ছোট থেকে বড় হোক, ধনী হোক দরিদ্র হোক সবাই যে সমান এ কথার বাস্তবতা বুঝা যায় এই ঈদের দিনে। ঈদের দিন রোজাদার জাকাত ফিতরা দিয়ে ধনী-গরিবের পাশাপাশি এসে দাঁড়ায়। গ্রহীতার আনন্দের ভাগী হয় দাতা। এভাবে সমাজের মানবতার এক মহা সম্মিলনের প্রক্রিয়া চলে। সে জন্যই বলা হয়েছে, “ঈদ কেবল মুত্তাকির জন্য”। যারা এসবের কোনো কিছুই পালন করলো না, তার জন্য ঈদের আনন্দ কোথায়?

ঈদের আনন্দ পূর্ণ করার জন্য গরিব মিসকিন ও দরিদ্র পাড়া-প্রতিবেশীর প্রতি আমাদের সকলের রয়েছে কর্তব্য। প্রতিবেশীদের ডেকে এনে আমাদের ঘরে খাওয়ানোর, তাদের মুখে হাসি ফুটাবার জন্য তাদের শিশুদের জন্য কিছু নতুন কাপড়, টুপি কিনে দেয়া, সেমাই খুরমা মিষ্টি পৌঁছে দেয়া আমাদের কর্তব্য। মনে রাখতে হবে, তাদের খুশি না করতে পারলে আল্লাহ খুশি হবেন না। তাহলে আমরা সিয়াম সাধনার পরিপক্ব ফলটি থেকে বঞ্চিত হবো।
এই মহান পুণ্যময় দিবসের উদযাপন শুরু হয় আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে। এটি অবশ্য সূর্যভিত্তিক ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী হিসাব। প্রিয় নবী (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের পরই ঈদুল ফিতরের উৎসব পালন শুরু হয়। হিজরত করে মহানবী (সা.) মদিনায় এসে দেখেন, মদিনাবাসীরা দু’টি জাতীয় উৎসব পালন করে থাকে। এর একটির নাম ‘নওরোজ’ আর একটি হলো ‘মিহিরজান’। উল্লিখিত উৎসব দুটির রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার ছিল সম্পূর্ণরূপে ইসলাম পরিপন্থী। শ্রেণীবৈষম্য, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে কৃত্রিম পার্থক্য, ঐশ্বর্য-অহমিকা ও অশালীনতার পূর্ণ প্রকাশে অযাচিতরূপে দীপ্ত ছিল এই দুটি উৎসব। তখন এ দুটি উৎসব পালিত হতো ছয় দিনব্যাপী। এক পর্যায়ে এ উৎসব দুটি পালন বিস্তৃততর পরিধিতে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। ছয় দিনের পরিবর্তে ৩০ দিন ধরে এ উৎসব উদযাপিত হতে থাকে। মহানবী (সা.) তার অনুসারীদের বলেন, ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী কোনো কাজ করা যাবে না। আমরা এই দুই উৎসব পালন করবো আল্লাহকে খুশি করার জন্য। তাই তিনি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা পালনের অনুমতি দিলেন, তখন থেকেই মুসলমানরা এই দুই উৎসব পালন করে আসছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা বিভিন্ন রকমে এই ঈদ উৎসবের আয়োজন করে। চীন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় ঈদের দিন নানা ক্রিয়া কৌতুকের আয়োজন করে। ঘুড়ি ওড়ানোর ব্যবস্থাও করা হয়। আমাদের দেশে আগে হাডুডু, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদি খেলার ব্যবস্থা হতো। ঘোড়দৌড় ছিল আমাদের দেশের ঈদ উপলক্ষে একটি চমকপ্রদ আকর্ষণ। আরব, মিসর ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতেও নানাবিধ খেলার আয়োজন করা হয়। পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মঙ্গোলীয় দেশগুলোতে যুদ্ধের কুচকাওয়াজ ও সে ধরনের দৌড়ঝাঁপের ব্যবস্থা হয়। আমাদের দেশের মতো ঈদ উপলক্ষে কোথাও কোথাও মেলাও বসে। শিশুদের নানাবিধ খেলনা এসব মেলার অন্যতম আকর্ষণ। তুরস্কে ও সাইপ্রাসে শিশুরা বড়দের মতোই বাড়ি বাড়ি গিয়ে সকলের খবর নেয় এবং দুস্থদের দুঃখ দূর করার চেষ্টা করে। ইরানে কাগজের রঙিন গৃহসজ্জাসহ নানা কৌতুকপ্রদ কবিতার আসরের ব্যবস্থা করা হয়। মালদ্বীপে অবস্থাপন্ন লোকেরা অপেক্ষাকৃত গরিবদের বাড়িতে খাবার পাঠিয়ে দেয়। সঙ্গে অর্থ ও নতুন পোশাকও দেয়া হয়। জাপান, ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় বড় বড় হোটেলে পার্টির ব্যবস্থা করা হয়। সেসব পার্টিতে অনেক গরিবকে দাওয়াত করা হয়। বাংলাদেশের ঈদ উৎসবের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। তবে আজকাল পল্লী গাঁয়ের সেই স্বপ্নের রঙিনে মোড়া উৎসব আর নেই। যা হারিয়ে যায় তা আগলে রাখা যায় না। বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে পরিবর্তন ঘটেছে সবকিছুর। পরিবর্তন ঘটেছে ঈদ উৎসবেরও।

এক সময় আমি গ্রামে ছিলাম। পল্লী গাঁয়ে। ছেলেবেলায় যে ঈদ উৎসব উপভোগ করেছি তা আজ কিছুতেই ভোলার নয়। গাঁয়ে প্রতিটি রমজানে ঈদ আসতো এক একটা রূপকথার রাজ্যের পেন্ডোরার বাক্সটি নিয়ে। ঈদ আসার সপ্তাহখানেক আগে থেকে আসন্ন ঈদের আবহে গাঁয়ের মানুষগুলো জেগে উঠতো। গাঁয়ের হাটগুলো সরগরম হয়ে উঠতো। সবার মুখে মুখে থাকতো আজ ঈদের হাট। দুপুর থেকে হাটের উদ্দেশে রওয়ানা করতো সবাই। ছোটরাও হাটে যেতে কান্নাকাটি করতো। বাবা নানা কথা বলে বুঝাবার চেষ্টা করতেন, কাঁদিস না বাপ হাট থেকে তোর জন্য নতুন লাল লুঙ্গি আনমু। হলুদ রঙের গেঞ্জি আনমু। জরির টুপিও আনমু। তারপর হাটে গিয়ে নতুন কাপড় নিয়ে বাড়ি ফেরা। গভীর রাত পর্যন্ত ছোটরা ঘুমাতো না। জামাকাপড় হাতে নিয়ে চমৎকার করে কাগজের প্যাকেটে রেখে দিত। প্রায় প্রতিদিনই একবার ওই মোড়ক খুলে দেখে নিতে ভুলত না। দেখতো জামাকাপড়গুলো ঠিকঠাক আছে কিনা। এদিক থেকে বড়রাও পিছিয়ে থাকতো না। জামাকাপড় নতুন কেনা না হলে ঘরের ভালো জামাটা সুন্দর করে সাবান দিয়ে কেচে বালিশের নিচে ভাঁজ করে রাখতেন। ঈদের দিন এ কাপড় পরতেন। আনন্দ করতেন। রমজানের শেষের দিকে বাড়িতে বাড়িতে ফকির-মিসকিন বেড়ে যেত। তারা জাকাত-ফেতরার জন্য বাড়ি বাড়ি ঘোরাঘুরি করতো। ঈদের দিন পর্যন্ত এরকম চলত। এসব লোককে সেমাই খাওয়ায়ে টাকা পয়সা দিয়ে তবে বিদায় করতো। একে অপরকে আনন্দে জড়িয়ে ধরত। যখন কারো মনে দুঃখ নেই। ঈদের পূর্বরাতে অর্থাৎ চাঁদ দেখার পর পর ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। আনন্দে সবাই অনিদ্রায় রাত কাটাতো।

ভোরে শোনা যেত ঢাকের শব্দ। ঈদগাহে মালি এসে ঢাক বাজিয়ে জানান দিত, আজ ঈদগাহ মাঠে ঈদের নামাজ হবে। আমরা খুব ভোরেই উঠতাম। ফজরের নামাজ পড়ে, গোসল করে, নতুন জামা কাপড় পরে ঈদের মাঠে যাবার জন্য প্রস্তুত হতাম। ইতোমধ্যে মা নানা রকম ঘরে বানানো মিষ্টান্ন এনে হাজির করতেন, আমরা খেয়ে দেয়ে মুরব্বিদের সাথে বেরিয়ে যেতাম ঈদগাহে। ঈদগাহে লোকজন আসতেই থাকত। এদিকে নামাজের আগে বিভিন্ন বক্তা রোজা, ঈদ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। আমাদের ঈদগাহ মাঠটি ছিল খুব বড়। ১০-১২ গ্রামের মানুষ একসাথে এই ঈদগাহে একত্রিত হতেন। নামাজ আদায় করতেন। অবশ্য এখন আর সেই বড় জামাত নেই। মানুষ বেড়ে গেছে। সাথে সাথে বেড়ে গেছে হিংসা বিদ্বেষ। একটা ঈদের জামাত ভেঙে দশটা জামাত হয়েছে। এখন আর আগের মতো কয়েক গ্রামের মানুষ একত্রিত হয় না। এক সাথে হাজার হাজার মানুষ ঈদের মাঠে জামাতে নামাজ আদায় করে না। এখন আর আগের মতো সবার সাথে সবার কুশল বিনিময় হয় না। ঈদের আনন্দ এমন ছিল যে অনেক সময় পুরনো জটিলতাও মীমাংসা হয়ে যেত। হিংসা বিদ্বেষ ভুলে যেত সবাই।
ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলি, মুরব্বিদের পায়ে হাত রেখে কদমবুসি ইত্যাদির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। ঈদগাহ থেকে বাড়ি ফিরে এসেও কোলাকুলি কদমবুসি চলত। সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া হাসি-গল্প আনন্দ ফুর্তিতে দিনটা কেটে যেত। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে সালাম জানিয়ে দোয়া কামনা করা হতো। বিকেলে খোলা মাঠে প্রতিযোগিতামূলক খেলার আয়োজন হতো। এসব খেলাধুলার আয়োজন করতো বড়রা। তারাই বিচারক থাকতেন। গ্রামের বিশিষ্ট কোনো মুরব্বির হাত থেকে পুরস্কার নিতে হতো। গ্রামের শান্ত-শিষ্ট পরিবেশে ঈদ হলো ব্যতিক্রমধর্মী একটি দিন। গ্রামের ছোট বড় সকলেই এদিন বিপুল উৎসাহে মহা আনন্দে উদ্দীপ্ত হতো।
আজ আর সেসব দিনের মতো গ্রামের অনাবিল আনন্দ উৎসবের ঈদ উদযাপন হয় না। সময়ের ব্যবধানে সবকিছুর পরিবর্তন হয়ে গেছে। সেই শৈশবের অবারিত আনন্দ, গ্রামীণ জীবনের ফেলে আসা ঈদের স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। যা আর কোনদিন ফিরে পাওয়া যাবে না।

Share.

মন্তব্য করুন