চরিত্র পরিচিতি
পানু : প্রধান চরিত্র। স্কুলের কিশোর খেলোয়াড়।
মিনু, শীনু ও বিনু : পানুর ভাইবোন
বাবা : পানুর বাবা
মা : পানুর মা
হেডস্যার : স্কুলের হেডমাস্টার
ডাক্তার : হাসপাতালের ডাক্তার
শিক্ষক : খেলার শিক্ষক
অন্যান্য : পানুর বন্ধুরা
জিয়া, চন্দন, দুলাল এবং
স্বপ্নের দৈত্য।

কাহিনী সংক্ষেপ

একজন পাকা খেলোয়াড় হিসেবে স্কুলে পানুর ভীষণ জনপ্রিয়তা আছে। জুনিয়র গ্রুপে সে বরাবরই চ্যম্পিয়ন হয়। কিন্তু ক্লাসে লেখাপড়ার পরিবর্তে পানুর এই খেলা নিয়ে মেতে থাকাটা-বাড়ির কেউ পছন্দ করেন না; বিশেষ করে মা। বাড়িতে প্রায় তাকে শাস্তি পেতে হয়। এজন্য পানুর খুবই কষ্ট হয়। তবু সে খেলা ছেড়ে মায়ের বাধ্য লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকতে পারে না। কেউই বোঝে না তাকে। এটাই তার দুঃখ। কিন্তু বাবা বলেন, শারীরিক এবং মানসিক বৃদ্ধিও বিকাশের জন্য খোলা মাঠে খেলাধুলা করা দরকার। তাতে প্রকৃতির নির্যাস অক্সিজেন প্রাপ্তি হবে সহজেই। কিন্তু খুব পরিশ্রম এবং অনিয়ম করতো পানু।
স্কুলের সেরা খেলোয়াড় পানু। চ্যাম্পিয়নশিপ পুরস্কার পাবার আগের দিন, বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর নিয়ে ঘরে ফিরলো সে। এক পর্যায়ে ওকে হাসপাতালে নেয়া হলো। স্কুলের হেডস্যার পানুর সবকটি পুরস্কার নিয়ে হাসপাতালে এলেন। বিস্মিত সবাই।
পানু সুস্থ হয়ে উঠলো। কিন্তু টাইফয়েটে অবশ হয়ে গেল ওর ডান পা-টা। অশ্রুসজল হয়ে পড়লো সবাই। তুখোড় খেলোয়াড় পানু তার সব খেলার সামগ্রী বন্ধুদের দিয়ে দিল। মাকে বলল, ‘ভালোই হলো মা…। আর কখনো খেলতে যাব না’। স্কুলের সেরা খেলোয়াড় জুনিয়ার গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন পানু এই প্রথম দেখলো আকাশে অনেক পুঞ্জীভূত মেঘ। পানুর দুচোখ ভিজে এলো।

১ম দৃশ্য :
খেলার আনন্দময় মাঠ। মঞ্চে খেলার মাঠের হৈ-চৈ শোনা যাবে। আলো আর মিউজিকের যুগলবন্দি দেখা যাবে। অনেক ছেলেসহ ফুটবল খেলছে পানু। দারুণ উত্তেজনার মুহূর্ত। মুহুর্মুহু করতালি, উল্লাস। চারদিকে সমস্বরে পানু পানু চিৎকার। একসময় ছেলেরা পানুকে কাঁধে নেবে বা উঁচু করে ধরবে। পানুর হাতে খেলার শিল্ড। একটি উজ্জ্বল প্রাণবন্ত দৃশ্য হবে এটি।

২য় দৃশ্য :
পড়ার ঘর। পানুর ভাইবোনেরা পড়ার টেবিলে কথা বলছে। ওদের কথার শেষে পানু ঢুকবে।
বিনু : আজ বাংলা ক্লাসে কি হয়েছে জানিস?
(হাসি)
মিনু : হাসছিস কেন বোকার মতো। কী হয়েছে বলবি তো!
বিনু : বলছি বাপু, বলছি। আর সেটাই তো হাসির কথা।
শীনু : এতো ভণিতা না করে ঝটপট বল তো কী হয়েছে?
বিনু : আমাদের ক্লাসে যে একটা নতুন মেয়ে ভর্তি হয়েছে ও নাকি লন্ডন থেকে এসেছে।
মিনু : ও কি বিদেশী?
বিনু : না। তবে ঠিক করে বাংলা বলতে পারে না।
শীনু : সে আবার কি কথা? বাঙালি মেয়ে অথচ ঠিক করে বাংলা বলতে পারে না,তাকি হয়?
বিনু : আর সেই জন্যই তো হাসি পেল আমার। ওর কথা শুনে সেদিন টিচার বললেন- তোমার বাবা-মা বাঙালি, তার পরেও তুমি শুদ্ধ বাংলা বলতে পারো না। এটা তো খুবই লজ্জার কথা।
শীনু : অবশ্যই লজ্জার কথা।
বিনু : ২১ ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে স্কুলে আমরা সবাই যখন গাইছিলাম- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ ও তখন জিজ্ঞেস করলো, ২১ ফেব্রুয়ারিতে তোমাদের সবার কি ভাই মারা গেছে?
শীনু : তুই কী বললি?
বিনু : বললাম, হ্যাঁ।
মিনু : শুধু হ্যাঁ?
বিনু : এছাড়া ঐ বোকা মেয়েটাকে আর আমি কী বোঝাব? আমাদের দেশের বিজয় দিবস, নববর্ষ দেখে মেয়েটা জিজ্ঞেস করে এই সব ফেস্টিভাল কি নিউ ইয়ার্সের চেয়েও বড়?
আমরা ভাষা আন্দোলন দেখিনি, মুক্তিযুদ্ধও দেখিনি। কিন্তু জেনেছি বাবা-মায়ের কাছে। বইয়ে পড়েছি। কিন্তু মেয়েটা তো কিছুই জানে না।
শীনু : সে দোষ তো ওর নয়। ও বিদেশে বড় হয়েছে। ওকে জানাবার দায়িত্ব বড়দের।
মিনু : কিন্তু হাসছিলি কেন সেটাই তো বলছিস না।
শীনু : কেন, ঐ বাঙালি মেম সাহেবের ইংরেজি সুরে বাংলা বলা শুনে!
মিনু : অনেক হয়েছে হাসি-গল্প, এবার পড়াশোনা শুরু কর তো।
[পানু ঢুকলো ক্লান্ত পায়ে]
মিনু : ভাইয়া, তুমি আজও দেরি করে ফিরেছো?
বিনু : মা তোমার খোঁজ করছিলেন।
শীনু : তোরা থামবি? বেশি কথা বলিস শুধু শুধু।
বিনু : স্যরি!
[কথা বলতে বলতে মা ঢুকলো]
মা : পানু ফেরেনি এখনো। এতো বলি তাও যদি কথা না শোনে। (রুমে ঢুকে) এই যে, এতক্ষণে আসার সময় হয়েছে। খেলাধুলা কি আর কেউ করে না। কিন্তু তাই বলে সন্ধ্যে পেরিয়ে যাবে রোজ রোজ?
পানু : মা আমি…।
মা : কী কী বলতে চাস। এদিকে আয়। আয় বলছি।
উঠে দাঁড়ালো পানু। মা টেনে নিয়ে গেল ভেতরে।
[তারপর চাবুকের শব্দ। পানুর আর্তনাদ আর কথা শোনো যাবে।]
মা : কি হবে এতো খেলাধুলা করে…বড় হয়ে ভালো পাস করতে পারলে ভালো চাকরি পাবি। বাপ এতো খেটে ঘরে দুটো পয়সা আনছে, সে খেয়াল আছে! পোড়া কপাল আমার।
[কথার ফাঁকে ফাঁকে বেতের শব্দ এবং পানুর আর্তচিৎকার শোনা যাবে। মা মা, ছেড়ে দাও মা, ছেড়ে দাও ইত্যাদি।]
ভাইবোনেরা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চমকে চমকে উঠলো। তাকালো ভেতরের দিকে। এক সময় মিনু দু’কানে হাত দিলো। একটু পরে সবাই উঠে চলে গেল একে অন্যকে ইশারা দিয়ে।
একটু পরে চোখ মুছতে মুছতে ক্লান্ত শ্রান্ত পায়ে ঘরে ঢুকলো পানু। দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। দেখলো চারদিকে, তারপর বসে একটা বই টেনে নিলো। তাকালো ভেতরের দিকে। ঠোঁট চাললো।

পানু : গলাটা শুকিয়ে গেছে পিপাসায়। ঝিম ঝিম করছে মাথাট। পানি খেতে ভেতরে গেলে আবার বকুনি খেতে হবে। কী করব আমি? কেন, কেন আমি এরকম? কেন আমি ওদের সবার মতো হতে পারি না? কেন কেন…? কিন্তু…কিন্তু খেলার মাঠে না যাওয়ার কথা আমি ভাবতেই পারি না। আর…আর এটাই আমার অপরাধ। পৃথিবীর কোনো আকর্ষণই আমার কাছে বড় নয়। একমাত্র এটাই যেন আমার জীবনের সব।
মিনু : ভাইয়া, মা খেতে ডাকছে। নিঃশব্দে উঠে দরজায় দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলো পানু। তারপর একসময় ভেতরে গেল।

৩য় দৃশ্য :
স্কুল। পরদিন বিকেলে পানু ব্যস্ত হয়ে এলো বন্ধুদের সাথে। হেডস্যার এগিয়ে এসে পিঠ চাপড়ালেন।
স্যার : এবারকার ফার্স্ট প্রাইজগুলো তাহলে তুমিই পাচ্ছ।
[সলাজ হাসলো পানু।]
পানু : স্যার, আর সবাই কোথায়?
স্যার : আছে আছে সবাই আছে, ওদিকটায় দেখ। আমি একজনকে দেখছি।
১ম বন্ধু রবি : জি স্যার। স্যার চলে গেল।
২য় বন্ধু জিয়া : দুলাল তোকে খুঁজছিল।
পানু : তাই নাকি?
জিয়া : কেন তোর সাথে দেখা হয়নি।
পানু : আরে না। আমিও তো ওকে খুঁজছি। দুলালের কাছে আমার কিছু জিনিস ছিল।
চন্দন : আমার মনে হয়, গেম টিচারের রুমে আছে।
জিয়া : চন্দন ঠিকই বলেছ। খেলার জিনিসপত্র তো সব গেম টিচারের রুমেই রাখা হয়।
রবি : ঠিক বলেছিস।
পানু : চল গেম স্যারের রুমে যাই।
[প্রস্থান]

৪র্থ দৃশ্য :
বাড়িতে। তিন ভাইবোন লুডু বা ক্যারাম খেলছে। মাঝে মাঝে কথা ও হাসি গল্প হচ্ছে।

বাবা এলো :
বাবা : কী ব্যাপার, এতো হৈচৈ কেন?
মিনু : বাবা, এখন তো আমাদের পরীক্ষা শেষ।
বিনু : অনেকদিন পর আজ খেলতে বসলাম।
শীনু : মানা করো না কিন্তু।
বাবা : আরে না-না, মানা করব কেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলারও প্রয়োজন আছে।
মিনু : সত্যি বাবা?
বাবা : হ্যাঁ, আর সেটা হচ্ছে বাইরের খেলাধুলা। যেমন, স্কুল বা পাড়ার মাঠে।
বিনু : মাঠে?
বাবা : এতে করে শরীর মন দুই ভালো থাকে। প্রকৃতির নির্যাস অক্সিজেন আমরা অনেক পেতে পারি।
শীনু : কিন্তু বাইরে খেলাধুলা করে বলে মা যে পানুকে শাস্তি দেয়!
[নাস্তা নিয়ে মা ঢুকলো রুমে এবং টেবিলে রাখলো।]
মা : মায়ের কথা কি হচ্ছে শুনি।
বিনু : না মানে।
বাবা : ওদেরকে বোঝাচ্ছিলাম যে, খোলা মাঠে খেলাধুলা করার উপকারিতা।
মা : হায় রে আমার কপাল। ঐ একজনকে সামলাতে আমি হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। তুমি আবার এদেরকে উসকানি দিচ্ছ!
বাবা : না গিন্নি, না। তুমি ভুল বুঝছো। সময় কাটানোর জন্য ঘরে বসে লুডু-ক্যারাম খেলা মন্দ নয়। তবে শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্যের জন্য বাইরে খেলাধুলার প্রয়োজন অনেক বেশি।
শীনু : কিন্তু বাবা, ভাইয়া বাইরে খেলাধুলা করে বলে বাড়িতে ওকে কেউ পছন্দ করে না। ভালোবাসে না, মাও না।
মা : বড় বেশি কথা বলিস তুই, খেলার জন্য প্রায়ই সন্ধ্যে করে বাড়ি ফেরে। তারপর ঠিকমত পড়তে পারে না, খেতে পারে না। আর সেই জন্যই তো ওকে শাসন করি।
বিনু : সত্যি বাবা? ভাইয়া তাহলে অন্যায় করে না।
বাবা : না-না, ছোটরা কখনো অন্যায় করতে পারে না। শোন, তোমরা হচ্ছো সৃষ্টিকর্তার দূত। পৃথিবীর শান্তি তোমাদেরই হাতে।
শীনু : মা যে তাহলে…!
[বাবা বিশেষ দৃষ্টিতে তাকালেন মায়ের দিকে। মা অপ্রস্তুত হলেন।]
মা : পানু খেলাধুলা নিয়ে একটু বাড়াবাড়িই করে। যেটা আমার অপছন্দ। ওর রোগা শরীর আর লেখাপড়ার কথা চিন্তা করেই আমি রাগ হতাম। আসলে আমারই বোঝার ভুল।
বিনু : তা হলে তুমি আর ভাইয়াকে শাস্তি দেবে না- বল।
মা : আচ্ছা বাবা, আচ্ছা-
বাবা : পানুর প্রতি তোমাদের ভালোবাসা দেখে আমি সত্যি খুব খুশি হয়েছি।
কিন্তু এখন কোথায় পানু?
(সবাই একসাথে চিৎকার) খেলার মাঠে। অক্সিজেন খাচ্ছে (হাসি)…

৫ম দৃশ্য :
ঝড় বৃষ্টির শব্দ। ভিজে একাকার হয়ে ঘরে ফিরলো পানু। ভয়ে ভয়ে তাকালো চারদিকে। কাশলো বার কয়েক।

পানু : এতো ঝড়-বৃষ্টি বাইরে। বাড়ি যে ফিরতে পারব ভাবতেই পারিনি। কাপড়টা বদলানো দরকার। কেমন যেন শীত শীত লাগছে। …কিন্তু কাপড় বদলাতে ভেতরে গেলেই তো মার হাতে ধরা খেতে হবে। থাকগে। খেলায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার খবরটা বাড়িতে আজ কাউকেই বলব না। কালকে প্রাইজগুলো এনে বাড়ির সবাইকে একেবারে চমকে দেব। তখন ওরা বুঝবে- পানুর মূল্যটা। উঃ কি ভীষণ ক্লান্তি আর ক্ষিধে লেগেছে। ভীষণ খারাপ লাগছে শরীরটা। হেডস্যার বলেছিলেন বাড়িতে গিয়ে একগ্লাস দুধ খেয়ে একটা ঘুম দেবে। কিন্তু… উঃ আর যে পারি না। টেবিলে মাথা রেখে ক্লান্ত পানু ঘুমিয়ে পড়লো। স্বপ্ন দেখলো- কেমন অদ্ভুত একটা শব্দ হতে লাগলো। নীল ধোঁয়ায় দেখা যাবে যমদূত প্রায় একটা লোক পানুকে ঘিরে আনন্দে নৃত্য করছে। ছটফট করতে করতে জেগে উঠলো পানু। ভয় পেলো-
পানু : না না আমাকে মেরো না, আমাকে মেরো না। ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও আমাকে।
মেরো না, মেরো না আমাকে।
একসময় যমদূত চলে গেল হাসতে হাসতে। আর্তচিৎকার করতে লাগলো পানু। হাত-পা ছুঁড়তে লাগলো।
পানু : চলে যাও, চলে যাও তুমি। চলে যাও।
[একসময় চেয়ার থেকে মাটিতে পড়ে গেল পানু। মা এলো ছুটে।]
মা : কী হয়েছে, কী হয়েছে পানু? পানু, একি মাটিতে পড়ে আছিস কেন? পানু পানু।…
বাবা : কী হয়েছে? কী হয়েছে পানুর? একি ভেজা কাপড় কেন পরনে-!
মা : গায়েও প্রচণ্ড জ¦র। কী হলো আমার ছেলের? ধর, ভেতরে নিয়ে চল। ডাক্তারকে খবর দাও।
[ধরাধরি করে পানুকে ভেতরে নিয়ে গেল।]

৬ষ্ঠ দৃশ্য :
মঞ্চ। স্কুলের সাজানো টেবিল মঞ্চ। হেডস্যার ও অন্য সবাই। অনেক কোলাহল।

ঘোষক : আজকের এই বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে জুনিয়র গ্রুপের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। এবার
প্রথম পুরস্কার- পানু চৌধুরী।
[বিভিন্ন খেলার নাম, করতালি।]
পানু কোথায়, পানু?
একজন : পানু আসেনি, স্যার।
হেডস্যার : আসেনি? আসেনি মানে?
গেমস্যার : মানে স্যার, পানু অসুস্থ। ও হাসপাতালে।
হেডস্যার : হাসপাতালে? আমাদের স্কুলের জুনিয়র গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন পানু হাসপাতালে!
[মঞ্চে এলোমেলো কোলাহল। সবাইকে থামিয়ে দিয়ে কথা বললেন স্যার-।]
হেডস্যার : সমবেত সুধী এবং প্রিয় ছাত্রবৃন্দ। আপনারা কেউ অস্থির হবেন না। এই স্কুলের-জুনিয়র গ্রুপের খেলোয়াড়, চ্যাম্পিয়ন, এই স্কুলের গৌরব পানু অসুস্থ। এমন একটি দিনে সে পুরস্কার নিতে আসতে পারেনি। আপনারা একেবারেই বিচলিত হবেন না। দোয়া করুন ওর জন্য। আমি দেখছি কী করা যায়।
[প্রস্থান]

৭ম দৃশ্য :
হাসপাতাল। একটু পরে জ্ঞান ফিরলো পানুর। চারদিকে তাকালো কেমন করে।
পানু : আমি কোথায়? কোথায় আমি? আমি বিছানায় কেন…? কী হয়েছে আমার। আমার তো স্কুলে যাওয়ার কথা-। আমি স্কুলে যাব। তোমরা আমায় স্কুলে দিয়ে এসো। ওরা … ওরা আমায় ডাকছে- এখানে থাকলে আমি মরে যাবো।
মা : পানু বাবা আমার- একবারও তো মা বলে ডাকলি না। স্কুলটাই তোর আপন হলো? আমি তোর কেউ নই…! পানু-পানু-বাবা আমার!
[বিস্মিত চোখে মাকে দেখলো পানু।]
পানু : তুমি কাঁদছো কেন মা? আমার জন্যে? কী হয়েছে আমার? আমি তো ভালো আছি। কান্নায় মুখ লুকালেন মা।
পানু : আমি স্কুলে যাব মা। বাবা, আজকে আমার অনেব বড় পুরস্কার পাবার দিন। ওরা আমাকে ডাকছে। বাবা-মা, তোমরা শুনতে পাচ্ছো না- ঐ, ওরা বলছে- পানু আসেনি আজ…? পানু না এলে কে নেবে এতোগুলো পুরস্কার? আমাকে যেতে দাও মা- আমাকে যেতে দাও, যেতে দাও। উত্তেজিত হয়ে উঠতে গিয়ে আবার জ্ঞান হারালো পানু।
বাবা : ডাক্তার, ডাক্তার!
মা : কী হয়েছে আমার ছেলের!
আপনারা অস্থির হবেন না প্লিজ।
আমি দেখছি।
ডাক্তার এগিয়ে গেল-।

৮ম দৃশ্য :
হাসপাতাল। এমনি সময় হেডস্যার পানুর সব পুরস্কারগুলো নিয়ে হাসপাতালে এলেন।

স্যার : পানু-পানু কোথায় কেমন আছে। চৌধুরী সাহেব কেমন আছে আমাদের পানু।
বাবা : (এগিয়ে) আসুন আসুন হেডমাস্টার সাহেব। এই যে আপনাদের পানু ভালো আছে।
পানু : স্যরি, (দু’হাত বাড়িয়ে দিল ক্রন্দনরত কণ্ঠে) আমি পারিনি স্যার। আমি যেতে পারিনি প্রাইজ আনতে।
স্যার : তাতে কী হয়েছে। তুমি যেতে পারনি। কিন্তু ঐ দেখ তোমার বন্ধুরা পুরো স্কুল তোমার কাছে এসেছে। তোমার প্রাইজগুলো নিয়ে। জানেন চৌধুরী সাহেব, আপনার ছেলে এই পানু আমাদের স্কুলের গৌরব। আন্তঃস্কুল জুনিয়র গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আমাদের স্কুলের পানু।
বাবা : আমি যে বিশ^াস করতে পারছি না। হেডমাস্টার সাহেব। আমাদের পানু?
স্যার : হ্যাঁ চৌধুরী সাহেব আমাদের দেশ ও জাতীয় গৌরব এই পানু।
মা : এসব আপনি যা বলছেন সত্যি কি? আমাদের পানু?
স্যার : আপনারা জানেননা কতো সৌভাগ্যবান বাবা-মা আপনারা, যে পানুর মতো ছেলে আপনাদের ঘরে আছে।
মা : এ আমি কি করেছি? কেন আমি আমার ছেলেকে চিনতে পারিনি। কেন…কেন…?
পুরস্কারগুলো চারদিকে রাখলো। বড় শিলটা পানুর হাতে দিলেন স্যার।
স্যার : এ শুধু তোমার নয় আদর্শ বয়েজ স্কুলের বিজয় আমাদের সবার গৌরব।
পানু : আমি আপনাদের সবার সাথে স্কুলে যেতে চাই স্যার। প্লিজ বলুন না স্যার ডাক্তার সাহেবকে।
ডাক্তার : ঠিক আছে যাবে ঠিকই তবে আগে সুস্থ হয়ে নাও।
স্যার : হ্যাঁ পানু। তোমার শরীর এখনও দুর্বল। সবার সাথেই তো তোমার দেখা হলো।
কত্তোগুলো পুরস্কার তোমার কাছে এলো। কত আনন্দ তোমার। আমাদের সকলেরও। তবে আজ নয়।
পানু : স্যার, আমি একটুও দুর্বল নই। তাকিয়ে দেখনু আমি বিছানা থেকে নেমে হেঁটে দেখাচ্ছি। বিছানা থেকে নামতে গেল পানু। খাটটা ধরে এক পা বাড়ালো, দ্বিতীয় পা-টা বাড়াতে গিয়ে বসে পড়লো পানু মাটিতে। সবাই অস্থির হয়ে পড়লো এবং সমস্বরে পানু, পানু, কী হলো, দেখি দেখি বলে উঠল। এগিয়ে এলো ডাক্তার। ধরে দাঁড় করাতে চেষ্টা করলো।
ডাক্তার : প্লিজ আপনারা একটু সরে দাঁড়ান। আমি দেখছি। দেখি পানু এসো আমার হাত ধর। গুড।
একটু দাঁড়াও সোজা হয়ে। বেশ এবার আমার দিকে এগোও।
পানু এবার এগোতে গিয়ে আবার পড়ে যেতে চাইলো। দু’হাত ধরে ফেললেন ডাক্তার। টেনে নিলেন বুকে। তার পর আবার বিছানায় শুয়ে দিলেন।
বাবা : কী হয়েছে ডাক্তার? অ্যানিথিং রং।
ডাক্তার : আপনারা প্লিজ একটু বাইরে গেলে ভালো হয়।
[সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। এবং বাইরে চলে গেল। ডাক্তার গভীর মনোযোগের সাথে পানুকে পরীক্ষা করলেন। তারপর এক সময় পানুর মাথায় হাত বুলালেন গভীর মমতায়।]

শেষ দৃশ্য :
জানালার ধারে হুইল চেয়ারে বসে আছে পানু, বিষণœ ও ক্লান্ত। ঘরে আলো-ছায়া, করুণ সুরের মূর্ছনা। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।

পানু : ভাবছে আর দেখছে। জানালার ওপাশে কামরাঙা গাছে ফুল ফুটেছে অসংখ্য। কতো মেঘ ভেসে চলেছে আকাশে…হালকা সাদা…নরম তুলোর মতো সব মেঘ…চিলগুলো কতো উপরে উঠতে পারে…? কই আগে তো কখনো চোখে পড়েনি? আর পড়বেই বা কেমন করে? আগে তো কখনো অলসভাবে আকাশ পানে তাকাবার অবসরই পাইনি কখনো। এখন অনেক সময় আমার হাতে…। অনেক অবসর…।

[ডাকতে ডাকতে মায়ের প্রবেশ। হাতে দুধের গ্লাস।]

মা : পানু-পানু, তোর দুধ খাবার সময় হয়েছে, এই নে-
(মায়ের হাত ধরে মুখের দিকে চেয়ে)
পানু : মা!
মা : কী বাবা?
পানু : এখন তুমি আমায় আগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসো, তাই না?
মা : কি বলছিস পাগলের মতো?
পানু : সত্যি করে বল না মা। আমি এখন আগের মতো খেলা শেষে সন্ধ্যা করে বাড়ি ফিরি না, তোমার কথার অবাধ্য হই না। এখন তুমি খুশি তো মা।
মা : মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললেন মা।
পানু : কাঁদছো কেন মা? তোমার কাছে থাকার অনেক অবসর এখন আমার…মা। অনেক অবসর…! বলতে বলতে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো পানু।

অঝোরে কাঁদলেন মাও। সেই অন্তর্নিহিত কান্নার ধ্বনি, প্রতিধ্বনি হতে লাগলো চারদিকে।

Share.

মন্তব্য করুন