‘কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিলে কেমন হয়?’ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘দিয়ে কি বলব? রহস্য খুঁজছে?’ হাসতে হাসতে বলল কিশোর।
‘মন্দ হয় না কিন্তু,’ তুড়ি বাজাল মুসা। ‘মজাই হবে।’
সেপ্টেম্বরের সুন্দর এক সকাল। কিশোরদের গ্রিনহিলসের বাড়ির বাগানের দেয়ালে বসে আছে ওরা। শরতের বাতাসে ডালিয়া আর আপেলের সুগন্ধ। ওদের পায়ের তলায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে টিটু।
‘একটু বুদ্ধি খাটানো দরকার তোর, বুঝলি,’ কিশোর বলল।
তার কথা যেন বুঝতে পারল টিটু। লাফিয়ে উঠে সামনের দু’পা তুলে দিলো মনিবের হাঁটুতে।
‘বিরক্ত লাগছে? তোকে আর কি বলব, বসে থেকে থেকে আমাদেরই অবস্থা কাহিল। কাজকর্ম কিছুই নেই, বুঝলি। এ-রকম চললে লধশ আর বেশিদিন টিকবে না।’
‘আজকাল বাবলিও তাই বলে,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল মুসা। বাবলি মুসার চাচাত বোন। পাশের শহরে থাকে। ছুটি পেলেই চলে আসে চাচার বাড়ি বেড়াতে। শুঁটকি টেরির সঙ্গে যেমন ‘তিন গোয়েন্দা’র চিরশত্রুতা, ‘লধশ’ অর্থাৎ ‘রহস্যভেদী দল’-এর সঙ্গে বাবলির তেমন চিরশত্রুতা। ‘বাবলি বলে,’ মুসা বলল, ‘তোমাদের জারিজুরি খতম। রেগে উঠি, তর্ক করি, কিন্তু জোর পাই না।’
‘অত হতাশ হওয়ার অবশ্য কিছু নেই,’ মনে হলো বন্ধুকে ভরসা দিচ্ছে কিশোর, আসলে তো দিল নিজেকেই। ‘দেখো, কারা আসছে।’
পথের মোড় ঘুরে আসতে দেখা গেল ‘লধশ’-এর অন্য দুই সদস্য ডলি আর অনিতাকে। কিশোরদের দেখে এগিয়ে এল ওরা। ময়লা ফেলার একটা ঠেলাগাড়ি ঠেলে নিয়ে আসছে।
‘এই,’ ডেকে জিজ্ঞেস করল ডলি, ‘কোন খবর-টবর আছে? রহস্য-টহস্য?’
‘নাহ্!’ একই সঙ্গে মাথা নাড়ল কিশোর আর মুসা।
‘তাহলে চলে এসো না আমাদের সঙ্গে,’ পরামর্শ দিল অনিতা। ‘খামোখা বসে থেকে থেকে সময় কাটে নাকি?’
বাগানের গেটের কাছে পৌঁছে গেছে দু’জনে। ওদের দেখে অভ্যর্থনা জানাতে ছুটে গেল টিটু।
‘হাউফ!’ করে নিঃশ্বাস ফেলে ঠেলাগাড়ির হাতলটা ছেড়ে দিল ডলি। ‘একেবারে ঘেমে গেছি! জিরিয়ে নিই। ময়লা কুড়ানো যে কী কষ্ট! আর মানুষগুলোই বা কেমন! আরে বাপু কলা খাস, কমলা খাস, ভালো কথা, তা খোসাগুলো একটু দেখেশুনে ফেললেই পারিস। তা না, ফেলবে একেবারে পথের ওপর। এদিকে কুড়াতে কুড়াতে আমাদের জান শেষ। তিনটে মাত্র রাস্তা ঘুরেছি তাতেই এই অবস্থা, আর বাকি তো সব বাদই!’
‘আসলে লিটার-বিন থাকা দরকার,’ কিশোর বলল, ‘তাহলে আর যেখানে সেখানে ময়লা ফেলত না লোকে।’
‘কাউন্সিলের মিটিঙে নাকি এ-পরামর্শ দেয়া হয়েছিল,’ অনিতা বলল, ‘চাচার কাছে শুনলাম। কিন্তু বিপক্ষে ভোট পড়েছে বেশি। লিটার-বিন বসাতে নাকি অনেক খরচ।’
‘কলার খোসায় আছাড় খেয়ে পড়ে কোমর ভাঙলে মজাটা বুঝত! ’ গজগজ করতে লাগল ডলি।
কিশোরও তার সঙ্গে একমত। তার ধারণা, মিটিঙে সে থাকলে বুঝিয়ে-শুনিয়ে সদস্যদের রাজি করাতে পারতই। বলল সে-কথা।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল অনিতা। ‘অ, জানো না। ভিলেজ কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, গ্রামের সবাই মিলে রাস্তাঘাট পরিষ্কার রাখবে। বাবা গিয়েছিল মিটিংয়ে। এসে জানিয়েছে। কি আর করব। পরিষ্কার রাখছি!’
‘সর্বনাশ! তাই নাকি!’ আঁতকে উঠল মুসা। ‘শুনিনি তো!’
‘এখন তো শুনলে,’ ডলি বলল। ‘ভেবো না, তোমাদের পালাও আসবে।’ বলতে বলতে আবার ঠেলাগাড়ির হাতল ধরল। ‘ভালো কথা, মিশা কই? আমাদের সাথে যাবে বলেছিল।’
‘চাচি কাজ করাচ্ছে,’ কিশোর বলল। ‘ঘর ঝাড়–তে লাগিয়ে দিয়েছে।’
মিশা মেরিচাচির বোনের মেয়ে। বোন মারা গেছেন। মিশার বাবা আবার বিয়ে করেছেন। মিশাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন নিঃসন্তান মেরিচাচি। কিশোরেরও বাবা-মা নেই। দুর্ঘটনায় মারা গেছেন দু’জনেই। নিজের সন্তানের মত দু’জনকে মানুষ করেন মেরিচাচি। বলেন, ‘এতিমের দায়িত্ব নেয়ার জন্যই যেন খোদা আমাকে সন্তান দেননি।’ তবে সে-জন্য তার কোনো দুঃখ নেই। কিশোর আর মিশাকে নিয়ে খুব সুখী।
মিশার ঘর ঝাড়– দেয়ার কথা শুনে নিজের দুঃখটা যেন অনেকটা হালকা হলো ডলির। ‘এই অনিতা চলো, দাঁড়িয়ে থাকলে হবে না।’
ওদেরকে চলে যেতে দেখল কিশোরেরা। চুপ করে রইল কয়েক মিনিট। বাগানের এই রোদ আর নীরবতার মাঝে ঝিমুনি আসছে। ফিরে গিয়ে আবার আগের জায়গায় শুয়ে পড়ল টিটু, শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম।
এই সময় চাচি ডাকলেন, ‘কিশোর, এই কিশোর, ভাঙতি আছে তোর কাছে?’
লাফ দিয়ে দেয়াল থেকে নেমে বাগানের পথ ধরে দৌড় দিল কিশোর। পিছনে মুসা। দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন মেরিচাচি। বললেন, ‘অন্ধদের জন্য সাহায্য নিতে এসেছে। আমার কাছে পাঁচ ডলারের নোট। খুচরো আছে তোর কাছে?’
‘দেখি। লধশদের ক্যাশবাক্সে আছে বোধ হয় কিছু।’
ছাউনিতে ঢুকল কিশোর। বাইরে দাঁড়িয়ে রইল মুসা।
‘রাখলাম কোথায়?’ কয়েকটা টিন ঘেঁটে দেখল কিশোর। একটা ফুলদানির ভিতরে দেখল। ‘মিটিংই করি না কতদিন, মনে আর থাকবে কি করে?’
‘তোমার মনে থাকার কথাও নয়,’ মুসা বলল। ‘আমারও নেই। হিসেব রাখে বব, ও-ই জানে…’
‘এই যে, পেয়েছি…’
চামড়ার একটা পার্সের গা থেকে ফুঁ দিয়ে ধুলো ওড়াল কিশোর। নাকের মধ্যে ধুলো ঢুকে যাওয়ায় মুখ বিকৃত করে ফেলল। টাকা নিয়ে ফিরে এল দু’জনে।
হলঘরে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক তরুণ, হাতে একটা চাঁদার বাক্স।
কিশোরের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাড়িয়ে দিলেন চাচি, ‘এই যে।’
টাকাটা নিয়ে কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসল লোকটা। ওটা বাক্সে ফেলে একবার ঝাঁকানি দিল। বাক্সের ভিতরে ঝনঝন করে উঠল খুচরো পয়সা। ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে গেল সে।
‘কাল আমাদের বাড়িতেও একজন এসেছিল চাঁদা নিতে,’ মুসা বলল। ‘ওই লোকটা ভালো ছিল। একে কিন্তু একটুও ভালো লাগল না আমার।’
‘চেহারা দেখে তো আর মানুষ চেনা যায় না। আর না জেনে কাউকে খারাপ বলাও উচিত নয়।’ উপদেশ দিয়ে আবার রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন চাচি।
লোকটার সম্পর্কে কিশোরও একটা মন্তব্য করতে যাচ্ছিল, থেমে গেল ঘণ্টার শব্দে। দ্রুত দরজা খুলতে এগোল সে। ডলি আর অনিতা দাঁড়িয়ে। ভীষণ উত্তেজিত।
‘জলদি একটা মিটিং ডাকো!’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল অনিতা।
‘কি হয়েছে?’ কিশোর আর মুসা দু’জনেই অবাক।
‘ছাউনিতে চলো,’ ডলি বলল। ‘ওখানেই বলব।’
‘চলো,’ পা বাড়াল কিশোর।
‘কিশোর, কে?’ উপরতলা থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করল মিশা।
‘অনিতা আর ডলি। মিশা, আমরা ছাউনিতে যাচ্ছি।’
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। দুড়দাড় করে নেমে এল মিশা, হাতে ঝাড়ন। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘মেলা কাজ! শেষ আর হতে চায় না…’
রান্নাঘরের দরজা খোলা। উঁকি দিলেন চাচি। মিশার কথা কানে গেছে। মৃদু হেসে বললেন, ‘থাক, অনেক হয়েছে কাজ। গেলে যা ওদের সঙ্গে।’
ছাউনিতে ঢুকল কিশোর, মুসা, ডলি, অনিতা ও মিশা।
কিশোর দরজাটা লাগিয়ে দিল।
তুবড়ি ছুটল ডলির মুখে, ‘মিল লেন-এ সাংঘাতিক একটা জিনিস পেয়েছি! এই দেখো!’
নোটবুক থেকে ছেঁড়া একটা কাগজের টুকরো বের করে দিল সে। কি লেখা আছে পড়ার জন্য কিশোরের কাঁধের উপর দিয়ে ঝুঁকে এল মিশা আর মুসা। কয়েকটা শব্দ আর নম্বর লেখা রয়েছে কালো কালিতে: ‘২৮ ২৯ জি. এসএইচ. এল. টিল’
‘খাইছে!’ মুসা বলল। ‘মানে কি এর?’
‘অদ্ভুত বলেই তো আনলাম,’ অনিতা বলল।
‘হুঁ,’ আনমনে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ভাবছে।
‘কোনও ধরনের সঙ্কেত এটা,’ ডলি বলল। ‘হয়তো কোন ডাকাত-টাকাতের দল, ব্যাংক লুট করতে চায়…’
‘আমারও তাই মনে হচ্ছে,’ সুর মেলাল মিশা।
‘অন্য কিছুও হতে পারে,’ বলল অনিতা। ‘যা-ই হোক, অনেক দিন পর মিটিং করার মত একটা কিছু পাওয়া গেল।’
‘কি জানি!’ মুসা বলল। ‘তবে মানে বোঝার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোলে অবাক হব না।’
‘হুঁ,’ আবার বলল কিশোর। ‘আর কিছুু যখন পাচ্ছি না, বসে থাকার চেয়ে এটা নিয়েই বরং মাথা ঘামাই।’

দুই.
লধসের আরও দুই সদস্য রবিন ও বব অনুপস্থিত। আপাতত পাঁচজনেই মাথা খাটাতে বসল। কিছু বুঝতে পারলে অন্য দু’জনকে জানাবে।
‘লেখা দেখে কিন্তু মনে হয় না লোকটা লেখাপড়া তেমন জানে,’ সঙ্কেতটার দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর। ‘হাতের লেখা দেখেছ? এ-রকম একজন মানুষ কঠিন কোন সঙ্কেত লিখতে পারবে না। মাথায়ই ঢুকবে না তার।’
‘তা ঠিক,’ একমত হলো ডলি। ‘এখন ভেবে বের করা যাক, আঠাশ ঊনত্রিশের মানে কি?’
মুসা বলল, ‘দুই হাজার আটশো ঊনত্রিশ হতে পারে। মাঝে ফাঁক রেখে লিখেছে।’
‘কেন?’ মিশা গম্ভীর। ‘কি বোঝাতে চেয়েছে? দূরত্ব? নাকি সময়…’
‘সময়ই হবে!’ বাধা দিয়ে বলল অনিতা। ‘হয়তো দেখা করার একটা সময় ঠিক করেছে ওরা। এক জায়গায় মিলিত হয়ে আলোচনা করবে। দুই হাজার আটশো ঊনত্রিশতম সেকেন্ড। ষাট দিয়ে ভাগ করলে…’
মাথা নাড়ল কিশোর। ‘উঁহু, যে লিখেছে, সে অত কঠিন অঙ্ক বুঝবে না। আরও সহজ কিছু বলো। এক জায়গায় গিয়ে দেখা করার কথাটা মনে হচ্ছে ঠিকই। সময়ের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবা যাক।’
‘চব্বিশের বেশি ঘণ্টা নেই যখন,’ মুসা বলল, ‘হয়তো মিনিট বুঝিয়েছে।’
‘কিংবা তারিখ!’ চেঁচিয়ে উঠল মিশা।
চট করে ঘড়িতে তারিখ দেখল কিশোর। ‘আজ আঠাশ!’ অবাক হয়ে বলল সে। ‘তাই তো! দিনের কথাই বলেছে। আলোচনার সময়টা নিশ্চয় ঠিক করেছে আঠাশ আর ঊনত্রিশের মাঝামাঝি কোন একটা সময়। তার মানে আজ আর কালকের মধ্যে…’
‘মধ্যরাত!’ চিৎকার করে উঠল অনিতা। ‘রাত বারোটার কথা বলেছে!’
‘বলেছিলাম না তোমাকে,’ অনিতার দিকে তাকিয়ে বলল উত্তেজিত ডলি, ‘রহস্য পেয়ে গেছি!’
‘নম্বরের সমাধান না-হয় হলো,’ কিশোর বলল, ‘বাকিগুলোর মানে কি?’
আলোচনা চলল। একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা করছে। কোনটাই সঠিক বলে মনে হলো না কিশোরের।
বাগানের বাইরে কার পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল।
‘কিশোর,’ দরজার বাইরে থেকে চাচি বললেন, ‘একটু আয় তো। মুদির দোকানে যেতে হবে।’
‘দোকান!’ ঊরু চাপড়ে বলল কিশোর, ‘ঠিক! এই তো পেয়ে গেছি! শপ! এস আর এইচ হলো শপ বানানের প্রথম দুটো অক্ষর। জি দিয়ে হয় গ্রোসার। জি. এসএইচ. মানে গ্রোসার’স শপ, অর্থাৎ মুদির দোকান!’
‘কি করছিস তোরা?’ চাচি বললেন আবার। ‘কিশোর, সালাদ ক্রিম লাগবে। চট করে গিয়ে মিস্টার বারবারের দোকান থেকে এক বোতল এনে দিবি?’
কিশোর বলল, ‘এই, সবাই বসো। আমি যাব আর আসব।’ অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেরোতে হলো তাকে।
ফিরে এল খানিক পরেই। ভিতরে ঢুকে দেখল কোন একটা বিষয়ে সবাই উত্তেজিত। কিশোর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে তার আগের জায়গায় বসতেই অনিতা বলল, ‘মুসার কথাই ঠিক। মুদির দোকানে ডাকাতির মতলব করেছে কেউ।’
‘হ্যাঁ,’ মাথা ঝাঁকাল ডলি। ‘জি. এসএইচ. দিয়ে গ্রোসার’স শপ। এল. দিয়ে…এল. দিয়ে…থাক, ওটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আর টিলের মানে তো সবারই জানা, দোকানদারদের দেরাজ।’
‘ঠিক বলেছ,’ কিশোর বলল।
‘কিন্তু এল-এর মানে কি?’ অনিতার প্রশ্ন। ‘কি বোঝাতে চায়?’
‘লক!’ উত্তেজনা ফুটল কিশোরের চোখে। ‘লক মানে তালা। তার মানে বোঝাতে চেয়েছে তালা লাগানো দেরাজ। আজ রাতেই গ্রোসারি শপের দেরাজের তালা ভেঙে ডাকাতির ফন্দি এঁটেছে! সময় কম! জলদি চলো, রবিন আর ববকে খবর দিই। দোকানের মালিককে গিয়ে সাবধান করতে হবে।’

তিন.
নাকে মুখে গুঁজে দুপুরের খাওয়া শেষ করল মিশা আর কিশোর। তারপর ছুটে বেরোল ঘর থেকে। পিছে পিছে চলল টিটু।
কিশোর বলে দিয়েছে, কাগজের টুকরোটা যেখানে কুড়িয়ে পেয়েছে ডলি আর অনিতা, সেখানে সবাইকে অপেক্ষা করতে। তারপর একসাথে যাবে মিস্টার বারবারের দোকানে। মূল সূত্রটা যেখানে পাওয়া গেছে সেই জায়গাটা দেখা দরকার। কিশোরের ধারণা, সূত্রটা কখন পেয়েছে, ঠিক কোন জায়গায়, এ-কথা দোকানদারকে বলা গেলে সেটা অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হবে।
দুই মিনিটেই টিটুকে নিয়ে মিল লেনে পৌঁছে গেল কিশোর আর মিশা। বাড়ি থেকে বেশি দূরে না জায়গাটা। সরু একটা গলি, দু’ধারে উঁচু দেয়াল।
মুসা, অনিতা, বব, রবিন এসে অপেক্ষা করছে। ডলি এল সবার পরে, সব সময়ই দেরি হয় তার।
‘ওদেরকে সব বললাম,’ রবিন আর ববের কথা বলল মুসা। ‘চলো।’
‘এক মিনিট,’ হাত তুলল রবিন। ‘এত শিওর হলে কি করে, মিস্টার বারবারের দোকানই লুট করতে যাচ্ছে? মুদি দোকান তো আরও দুটো আছে। এ-ছাড়া মিসেস লেনিঙের জেনারেল স্টোর আছে। ওগুলো নয় কেন?’
তাই তো! থমকে গেল কিশোর। এ-প্রশ্নটা তো তাদের মাথায় আসেনি? চাচি বললেন তখন মিস্টার বারবারের দোকানে যেতে, ব্যস, তার দোকানের কথাই শিকড় গেড়েছে মনে। কোন সূত্র তো নেই।
না না আছে, ভাবল কিশোর। বলল, ‘তালা লাগানো দেরাজ একমাত্র মিস্টার বারবারের দোকানেই আছে। নতুন ধরনের তালা, দেরাজের ডিজাইনটাও নতুন। জানো না, সুযোগ পেলেই গর্ব করে ওটার কথা সবাইকে শুনিয়ে দেন মিস্টার বারবার? তবে যত নতুন তালাই হোক, ডাকাতদের জন্য কিছু না। ঠিক ভেঙে ফেলবে, দেখো।’
জবাব পেয়ে গেছে রবিন, আর কোন খুঁত বের করতে পারল না। সবাই মিলে রওনা হলো মিস্টার বারবারের দোকানের দিকে।
কয়েক পা এগিয়েই অনিতা থেমে গেল। হাত তুলে দেখাল, ‘ওই জায়গায় পেয়েছি কাগজটা। ওই যে, ঘাস।’
সবাই দেখল। এগিয়ে গিয়ে ঘাসগুলো শুঁকে দেখল টিটু।
গভীর মনোযোগে জায়গাটা পরীক্ষা করল কিশোর। তীক্ষè দৃষ্টি বোলাল আশপাশে। হাত তুলে দেখাল, ‘দেখো, ঘাস মাড়ানো। যে লোক মেসেজটা লিখেছে, সে এখানে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল।’
‘যে লিখেছে সে, না যে নিয়ে এসেছে?’ ববের প্রশ্ন। ‘যদি লিখে থাকে, তাহলে এখানে ওটা পড়ে থাকবে কেন? আমার মনে হয় একজন এখানে ছিল, অন্য আরেকজন নিয়ে এসেছে। যে ছিল, সে মেসেজটা পড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেছে। যুক্তিতে তাই বলে না?’
‘হ্যাঁ,’ ঘাড় নাড়ল কিশোর, ‘ঠিকই বলেছ।’
‘এই দেখে যাও,’ খানিক দূর থেকে ডেকে বলল মিশা, ‘সিগারেটের টুকরো। অনেক।’
অন্যেরাও এসে দাঁড়াল ওখানটায়। নিচু হয়ে একটা পোড়া টুকরো তুলে নিল কিশোর। খালি একটা প্যাকেটও পড়ে থাকতে দেখা গেল।
‘উইনেক্স সিগারেট,’ বিড়বিড় করে বলল কিশোর।
ব্র্যান্ডটা মুসার চেনা।
‘এই, কি সাফ করলে তখন?’ ঠাট্টা করে অনিতা আর ডলিকে বলল মুসা। ‘ময়লা তো সব পড়েই আছে। যাও, তুলে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে এসো।’
জ্বলে উঠল ডলি। ‘ফেলতামই তো! কাগজটা পেয়ে যাওয়ায় আর মনে ছিল না!’
হাত তুলল কিশোর। ‘হয়েছে, হয়েছে, অত রেগে কিছু নেই…’
‘এই,’ তাড়াতাড়ি বাধা দিল অনিতা, ‘পায়ের ছাপগুলো নষ্ট কোরো না! ওই যে, দেয়ালটার গোড়ায়।’
‘বেশ স্পষ্ট তো,’ রবিন বলল। ‘ছাপগুলো চেপে বসেছে।’ আগের রাতে বৃষ্টিতে নরম হয়ে ছিল মাটি, গভীর হয়ে পড়েছে পায়ের ছাপ।
‘ছাঁচ তুলে নিলে তো পারি,’ পরামর্শ দিল বব।
‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, ঠিক,’ মাথা দোলাল মিশা, ‘প্ল্যাস্টারের (প্লাস্টার?) ছাঁচ। কিশোর, কি বলো?’
‘ভালোই হবে।’ কিশোরের দিকে ফিরল রবিন। কিশোরকে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কিশোর, চুপ করে আছো যে? কি ভাবছ?’
‘অ্যাঁ!…হ্যাঁ। বুদ্ধিটা ভালই,’ জবাব দিল কিশোর। ‘ছাউনিতে প্ল্যাস্টার আছে, কিনতে হবে না। এখুনি বানিয়ে ফেলা যাক। বব, রবিন, তোমরা ভাল ছাঁচ বানাতে পারো…’
‘যাচ্ছি,’ বব বলল।
‘দাঁড়াও, আগে কথা শেষ করি। তোমরা ছাঁচ বানাবে। মেয়েরা, শোনো, তোমরা সিগারেট যে সব দোকানে বিক্রি হয়, সে-সব দোকানে গিয়ে জানার চেষ্টা করবে, এখানে উইনেক্স সিগারেট কারা কারা খায়, মানে, কাদের প্রিয় ব্র্যান্ড।’
‘আমার বাবা খায়!’ বলতে গিয়েও বলল না মুসা।
কিশোর বলল, ‘মিস্টার বারবারের দোকানে যাব আমি আর মুসা।’
সে থামতেই ‘হুফ! হুফ!’ করে উঠল টিটু। যেন বলতে চায় কাজের তালিকা থেকে আমাকে বাদ দেয়া হয়েছে কেন? আমি কী দলের কেউ না?
‘আরে যাবি যাবি, তুইও যাবি,’ হেসে বলল কিশোর। টিটুর মাথায় আলতো চাপড় দিল।
কিন্তু যাবার জন্য চিৎকার করেনি টিটু, দৌড় দিল রাস্তার মাথার দিকে। সবাই দেখল ওখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাবলি আর তার বান্ধবী নিনা। গোপনে নজর রাখছিল ওদের উপর।
বিরক্তিতে নাক কুঁচকাল মিশা। ‘ঠিক এসে দেখে ফেলল! ওদের যন্ত্রণায়…’ কথাটা শেষ করল না সে।
‘মাছির কাছে খবর পায় নাকি?’ রবিনও বিরক্ত। ‘এক ঘণ্টাও হয়নি কাজ শুরু করেছি আমরা, ব্যস, পেয়ে গেল খবর!’
পথের মাথায় পৌঁছে গেছে টিটু। গলা ফাটিয়ে ঘেউ ঘেউ জুড়ে দিল। বাবলি আর নিনাকে ওখান থেকে তাড়িয়ে তবে ছাড়ল। জিভ বের করে বেশ গর্বের ভঙ্গিতে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল আবার।
‘চলো, যাওয়া যাক,’ কিশোর বলল। ‘কাকে কি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মনে আছে তো?…গুড। ছয়টায় ছাউনিতে দেখা করব সবাই। কে কী জানলাম, আলোচনা করে ঠিক করব এরপর কী করা যায়। নতুন সঙ্কেত, উইনেক্স।’

চার.
অনেক বড় দোকান মিস্টার বারবারের। হাই স্ট্রিটে। আস্ত কাচ লাগানো বড় বড় দুটো জানালা। উঁকি দিয়ে দেখল কিশোর আর মুসা, এক মহিলার সঙ্গে কথা বলছেন মিস্টার বারবার। মহিলাকে চেনে ওরা, তাঁর নাম মিসেস হেরিংটন।
‘দাঁড়াও,’ মুসাকে বলল কিশোর, ‘মহিলা বেরিয়ে যাক। সারা গাঁয়ের লোককে জানানোর কোন দরকার নেই। চোরের কানে গেলে হুঁশিয়ার হয়ে যাবে।’
দাঁড়িয়েই আছে দুই গোয়েন্দা। মিসেস হেরিংটন আর বেরোন না। বিভিন্ন কোম্পানির টিনজাত মটরশুঁটি দেখছেন, কোনটা যে কিনবেন তা-ই ঠিক করতে পারছেন না। অবশেষ একটা টিন পছন্দ করে কিনলেন তিনি। দাম মিটিয়ে দিয়ে এগোলেন দরজার দিকে। টাকাটা দেরাজে তুলে রাখলেন মিস্টার বারবার।
বাইরে বেরিয়ে দুই গোয়েন্দাকে দেখে আবার দাঁড়িয়ে গেলেন মিসেস হেরিংটন। ‘আরে কিশোর যে। মুসাও আছ। কিনবে নাকি কিছু? দিনটা ভারি সুন্দর, তাই না? কিন্তু হলে হবে কি, বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ পাচ্ছি আমি। নামবে, যে কোন সময় ঝমঝম করে নামবে। হ্যাঁ, ভাল কথা, কোভেলটিতে বন্যা হয়েছে, সে-খবর শুনেছ? সেদিনকার ঝড়ের পরেই নাকি হয়েছে। আবারও যদি বৃষ্টি হয়…’
অতিরিক্তি কথা বলেন মহিলা। ঘাবড়ে গেল দুই গোয়েন্দা। ওদের ভয় হলো আবহাওয়ার কথা না একটানা চালিয়ে যান বিকেল পর্যন্ত! ওদেরকে বাঁচিয়ে দিলেন মিসেস হেরিংটনের বান্ধবী মিস ডেনভার। দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে থামলেন। মিসেস হেরিংটনকে ডাকলেন। দু’জনে আবহাওয়ার কথা আলোচনা করতে করতে চলে গেলেন।
‘বাপরে বাপ!’ জোরে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। ‘মাথা ধরে যাবার অবস্থা!’
দোকানে ঢুকল ওরা। দরজা পেরোতেই একটা ঘণ্টা বেজে উঠল। কেউ ঢুকলে আপনাআপনি বাজে ওটা।
মুখ তুলে ওদের দেখে হাসলেন মিস্টার বারবার। কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরে, তোমরা। কি লাগবে?’
‘না, কিছু লাগবে না,’ মাথা চুলকাল কিশোর। অস্বস্তি লাগছে। কেউ জিনিস কিনবে না বললে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন মিস্টার বারবার। ‘আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে চাই।’
‘আপনাকে সাবধান করতে এসেছি, মিস্টার বারবার,’ মুসা বলল।
‘সাবধান? কি হয়েছে?’ সর্বক্ষণ লেগে থাকা হাসিটা মুছল না তাঁর মুখ থেকে, তবে অবাক হয়েছেন বোঝা যায়।
খুব জরুরি ব্যাপার বলতে এসেছে, ওরকম মুখভঙ্গি করে রেখে পকেট থেকে কাগজটা বের করল কিশোর। মিস্টার বারবারকে দেখিয়ে বলল, ‘পড়–ন।’ (ফন্টের দোষে ফরম্যাট ভেঙে যায়)
পড়লেন তিনি। ‘বোকার মত কি সব লিখেছে?’
‘বোকার মত নয়। আপনার দোকান লুট করার ফন্দি।’
‘আজ রাতেই ডাকাতি করতে আসবে ওরা,’ যোগ করল মুসা।
‘তাই নাকি?’ গুরুত্ব দিলেন না মিস্টার বারবার। বিরক্তি ফুটল চোখে। ‘দেখো, তোমাদেরকে ভালো ছেলে বলেই জানি। যাও এখন, খেলগে। ফালতু কথা বলার সময় নেই আমার।’
বড় করে দম নিলো কিশোর। শান্ত থাকতে চাইছে। বুঝে শুনে কথা বলতে হবে দোকানির সঙ্গে। রেগে গেলে তাঁকে বোঝানো আরও শক্ত হবে। বুঝিয়ে বলল, ‘দেখুন, নম্বরটা দেখুন। এর মানে হলো আটাশ আর ঊনত্রিশ তারিখের মাঝামাঝি সময়। বাকি লেখাটার মানে হলো মুদি দোকান, আর তালা দেয়া দেরাজ।’
কিশোর থামতেই মুসা মুখ খুলল, ‘এই সাঙ্কেতিক মেসেজ লিখে বোঝাতে চেয়েছে আজ এবং কালকের মাঝামাঝি সময় কিছু করতে যাচ্ছে ওরা। তার মানে আজ মধ্যরাত।’
‘মুদির দোকানে,’ কিশোর বলল। ‘রাত দুপুরে তালা দেয়া দেরাজের কাছে কেন যায় বাইরের লোকে? নিশ্চয় জিনিসটার চেহারা দেখার জন্য নয়।’
‘কি বলছ?’ এইবার যেন কিছুটা টনক নড়ল দোকানির। ‘দেরাজ থেকে টাকা লুট করতে আসবে?’
‘তা ছাড়া আর কি?’
আরেকবার মেসেজটা পড়লেন মিস্টার বারবার। হাসি চলে গেছে মুখ থেকে। গভীর হয়েছে কপালের ভাঁজ, কুঁচকে গেছে ভুরু। ‘এখন মনে হচ্ছে তোমাদের কথা ঠিক হলেও হতে পারে। এখানে একমাত্র আমার দোকানেই এ-রকম দেরাজ আছে।’
‘ঠিকই বলছি আমরা,’ জোর দিয়ে বলল কিশোর।
‘তাহলে এখন কি করতে চান?’ মুসার প্রশ্ন। দোকানে খদ্দের ঢোকার আগেই আলোচনা শেষ করে ফেলতে চায়।
ঘণ্টা বেজে উঠল। ঘরে ঢুকলেন বৃদ্ধ মিস্টার মরিস। হাতে একটা শপিং বাস্কেট, জিনিসের ভারে কাত হয়ে পড়েছেন একদিকে। দাঁতের ফাঁকে পাইপ। দেখতে দেখতে ঘরের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল তামাকের গন্ধ। তবে কড়া কিংবা ঝাঁজাল নয়, কেমন মিষ্টি, মধু মধু গন্ধ।
‘এক মিনিট মিস্টার মরিস, প্লিজ,’ হাত তুলে হেসে বললেন মিস্টার বারবার। ‘ওদেরকে বিদেয় করে আসি।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে,’ বৃদ্ধ বললেন। ‘তাড়া নেই আমার। রিটায়ার্ড মানুষ, কাজ নেই, সময় কাটানোই হয়ে গেছে মুশকিল।’
দোকানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে মিস্টার মরিসের। সুন্দর করে সাজানো চকোলেটের প্যাকেটগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
কিশোর আর মুসাকে নিয়ে দরজার দিকে এগোলেন মিস্টার বারবার। বাইরে বেরিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘এখনই পুলিশকে ফোন করব আমি। দেখি, আসুক, কোন ব্যাটা চুরি করতে আসে।’
‘তাই করুন,’ খুশি হলো কিশোর। মিস্টার বারবারের হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলল, ‘কাল খবর জানতে আসব আবার।’
‘এসো। অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে।’
আবার দোকানে ঢুকে গেলেন মিস্টার বারবার।
খুশি মনে ফিরে চলল দুই গোয়েন্দা। ছয়টা বাজেনি এখনও।
মিল লেন-এ পৌঁছে দেখল, পথের মাথায় কড়া পাহারা দিচ্ছে টিটু। বাবলি আর নিনাকে দেখলেই তাড়া করবে। বিরক্ত করতে দেবে না রবিন ও ববকে। ছাঁচ বানাতে ব্যস্ত দু’জনে।
কিশোরদেরকে দেখে আনন্দে ঘেউ ঘেউ করে উঠল টিটু।
এগিয়ে এসে তার মাথা চাপড়ে আদর করল কিশোর। বলল, ‘ভালো ছেলে।’
মুখ তুলে তাকাল বব আর রবিন। পায়ের ছাপের ছাঁচ তোলা শেষ করেনি এখনও।
‘এটাই শেষ,’ জানাল রবিন। ‘বারোটা নিয়েছি। ওগুলো ছাউনিতে শুকোতে রেখে এসেছি। এটাই শেষ।’
‘ছাপের ওপর পাউডার ফেলছ কেন?’ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘জানো না নাকি?’ বব বলল। ‘মাটির রস শুষে নেবে এই পাউডার। তাতে ছাঁচগুলো উঠে আসবে ঠিকমত, নষ্ট হবে না।’
‘ওস্তাদ হয়ে গেছ,’ বব আর রবিনের কাজ দেখতে দেখতে প্রশংসা করল কিশোর। ‘এই, কেউ এসেছিল নাকি? দেখেছে তোমাদের?’
‘না,’ মাথা নাড়ল বব। ‘আসবে কি, টিটু কি ঢুকতে দেয় নাকি কাউকে?’
‘ভাল।’
প্লাস্টার ঠিকমত বসছে কিনা, নখ দিয়ে খুঁচিয়ে দেখল রবিন। বলল, ‘মিনিটখানেকের মধ্যেই হয়ে যাবে। যেতে পারব।’
‘তোমরা কি করে এলে?’ বব জানতে চাইল। ‘মিস্টার বারবার কি বললেন?’
‘ছাউনিতে গিয়ে বলব,’ জবাব দিল কিশোর। ঘড়ি দেখল। ‘ঠিক ছ’টায় মিটিং। এখন কথা শুনতে গেলে সময় নষ্ট হবে। কাজটা সেরে ফেল।’

পাঁচ.
গির্জা থেকে ঘণ্টা শোনা গেল, ছয়টা বাজে।
‘উইনেক্স!’ দরজার বাইরে থেকে চাপা গলায় বলল মুসা।
ছাউনির দরজা খুলে দিল কিশোর।
এক এক করে ভিতরে ঢুকল মুসা, রবিন, বব। মেয়েরা আগেই এসে বসে আছে।
ছিটকানি লাগিয়ে দিয়ে এসে তার জায়গায় বসল কিশোর। গম্ভীর গলায় বলল, ‘এবার রিপোর্ট শোনা যাক। প্রথমে আমাদের কথাই বলি। মিস্টার বারবারের দোকানে গিয়েছিলাম। তাঁকে বোঝাতে পেরেছি, সাবধান করে দিয়ে এসেছি। পুলিশকে ফোন করবেন তিনি। নিশ্চয় রাতে দোকানের আশপাশে লুকিয়ে পাহারায় থাকবে পুলিশ, চোর দেখলেই খপ করে ধরবে। আগামী কাল আবার দোকানে যাব, কি হয়েছে জানতে।’ এক মুহূর্ত থামল সে। ববের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বব, তোমাদের খবর বলো। ছাপগুলো ঠিকমত নিতে পেরেছ?’
‘পেরেছি। মোট তেরোটা ছাপ নিয়েছি আমরা। এই যে শেষটা, শুকায়নি এখনও। বাকিগুলো তোমার পিছনের তাকে তুলে রেখেছি। দেখাচ্ছি একটু পরেই। তবে তার আগে বলি, কি আবিষ্কার করেছি আমরা।’ নাটকীয় ভঙ্গিতে থামল বব।
আগ্রহে সামনে ঝুঁকল কৌতূহলী শ্রোতারা। এমনকি টিটুও কান খাড়া করে ফেলেছে।
‘এক রকম নয়, দুই ধরনের পায়ের ছাপ আছে,’ বব জানাল। ‘তার মানে অন্তত দু’জন লোক একজোট হয়েছে ডাকাতি করার জন্য। মিস্টার বারবারের দোকানে ঢুকবে। পুলিশকে এ-খবরটাও জানিয়ে দেয়া দরকার।’
‘হুঁ! আমিও এটাই সন্দেহ করেছিলাম,’ ঠোঁট কামড়াল কিশোর। ‘দেখি, ছাপগুলো দেখি?’
অনিতার দিকে তাকাল রবিন। ‘অনিতা, ওগুলো দেবে, প্লিজ? তোমার পিছনেই আছে।’
‘নিশ্চয়ই।’
বারোটা ছাঁচ বের করে দিল অনিতা। অন্যেরা তাকে ওগুলো মেঝেতে নামাতে সাহায্য করল।
একটা ছাঁচ তুলে নিয়ে ডলি বলল, ‘গোড়ালি দেখেছ এটার? সাধারণ জুতো নয়, বুটের ছাপ।’
‘হ্যাঁ,’ একমত হয়ে বলল মুসা। ‘উঁচু-নিচু জায়গায় কিংবা পাহাড়ে ওঠার সময় এ-রকম বুট পরে লোকে। জুতোর দোকানদাররা হিল-ওয়াকিং বুট নাম দিয়েছে এগুলোর।’
‘এই ছাঁচটা আবার অন্যরকম,’ শেষ যে ছাঁচটা তুলে এনেছে, সেটা দেখিয়ে বলল রবিন। ‘মাত্র তিনটে পেয়েছি এ-রকম।’
‘হুঁ,’ মাথা দোলাল কিশোর।
অন্য আরেকটা ছাঁচ দেখিয়ে মিশা বলল, ‘আর এই যে এটা, দেখো, সোল কেমন চ্যাপ্টা আর মসৃণ।’
‘যদ্দুর মনে হয় ওয়েলিংটন বুটের ছাপ এটা,’ রবিন বলল। ‘এই যে সোলের গায়ে আঁকা বর্ম-ওয়েলিংটন বুটেই থাকে।’
একটা ছাঁচ হাতে নিল কিশোর। উল্টেপাল্টে দেখল। ‘সোলের গায়ে কিছু লেখা রয়েছে, বোধ হয় ব্র্যান্ডনেম। পড়া যায় না…’
‘আমারটা পড়া যাচ্ছে!’ মিশা বলল। ‘দেখো-দেখো, আমারটায় স্পষ্ট ফুটেছে! এফ…আই…হ্যাঁ-হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি, ফিশারম্যান!’
ফিশারম্যান! ধক করে উঠল মুসার বুক। তার বাবাও ফিশারম্যান বুট পরেন! উইনেক্স সিগারেট, ফিশারম্যান বুট, এভাবে মিলে যেতে আরম্ভ করেছে কেন!
ডলি বলল, ‘আমার বাবারও একজোড়া ফিশারম্যান ব্র্যান্ডের ওয়েলিংটন বুট আছে।’
‘তা থাকতেই পারে। চালু জিনিস,’ রবিন বলল। ‘নাহ্, এভাবে এগোনো যাবে না। ধরা যাবে না অপরাধীকে।’
‘অপরাধটা এখনও ঘটেনি,’ কিশোর বলল। ‘ঘটবে আজ রাতে। তখন দেখা যাবে ধরা যায় কিনা।…এবার তৃতীয় রিপোর্টটা শোনা যাক। মেয়েরা, বলো।’
‘বলার তেমন কিছু নেই,’ মিশা বলল। ‘গাঁয়ে খুব বেশি লোক উইনেক্স সিগারেট খায় না। তামাকের দোকানের মালিক বলল, ওটার গন্ধ নাকি পছন্দ করে না লোকে। তার কাছ থেকে মাত্র তিনজন লোক ওই জিনিস কেনে।’
‘তাদের একজন আমার বাবা,’ মুসা বলল কাঁপা গলায়।
‘হ্যাঁ,’ মাথা ঝাঁকাল মিশা। ‘একজন তোমার বাবা, দ্বিতীয়জন পুলিশ ক্যাপ্টেন স্বয়ং, আর তৃতীয়জন মিস্টার বারবার নিজেই।’
‘তার মানে এত কষ্ট করে এই সূত্র নিয়ে এসে লাভ হলো না কিছু,’ অনিতা বলল। ‘মুসার বাবাকে সন্দেহ করার কথা কল্পনাই করা যায় না। পুলিশ ক্যাপ্টেন তো চোর ননই। আর নিশ্চয় নিজের দেরাজ ভেঙে টাকা লুট করতে যাবেন না মিস্টার বারবার।’
‘হুঁ,’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। ‘এগোনো যাচ্ছে না।’
মুসা বলল, ‘এত ভাবার কি আছে? আজ রাতেই তো সব শেষ হয়ে যাবে। চুরি করতে গেলেই ধরা পড়বে ব্যাটারা। ক্যাপ্টেন রবার্টসনকে মিস্টার বারবার নিজেই খবর দেবেন। কাল সকালে গিয়ে তাঁর কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা কেবল শুনে আসব আমরা, ব্যস।’
কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারল না কিশোর।

সে-রাতে সহজে ঘুমাতে পারল না গোয়েন্দাদের কেউ। রাতে দেরি করে শুইলো। তার পরেও মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে যেতে লাগল উত্তেজনায়। সবার মনেই এক ভাবনা, কি শুনবে সকালে গিয়ে?
পরদিন স্কুলের আগেই মিস্টার বারবারের দোকানে হাজির হলো মুসা ও কিশোর। কিন্তু দোকানে পৌঁছে দেখল বিশাল জানালার সামনে বসানো শাটার তখনও বন্ধ।
‘কী ব্যাপার?’ নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল মুসা। ‘অন্য দিন তো এতক্ষণে খুলে যায়। খুব সকালে দোকান খোলেন মিস্টার বারবার…’
‘নিশ্চয় রাতে কিছু ঘটেছে।’
ভয় ভয় করতে লাগল ওদের। মিস্টার বারবারের কিছু হয়নি তো? ধাতব শাটারে কিল মারতে আরম্ভ করল দু’জনে। বিকট আওয়াজ হতে লাগল। খানিক পরেই খুলে গেল উপরতলার জানালা।
‘অ, তোমরা!’ কঠিন কণ্ঠ শোনা গেল।
জানালায় দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার বারবার। ‘ভালো খেল দেখিয়েছ যা হোক! সারাটা রাত আমাকে জাগিয়ে রেখেছ, কি যে টেনশন গেছে! আবার এসেছ এখন…যাও, ভাগো, নইলে খারাপ হবে বলে দিলাম!’
অবাক হয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল দুই গোয়েন্দা। মেজাজ এত খারাপ কেন দোকানির?
‘খারাপটা কি করলাম আমরা?’ প্রতিবাদ জানাল কিশোর। ‘আমরা তো আপনার ভালই চেয়েছি। সব কিছু জেনে এসে হুঁশিয়ার করে দিয়েছি আপনাকে।’
‘হুঁশিয়ার করেছ, না? বিচ্ছু ছেলে! সব তোমাদের শয়তানি! সারাটা রাত বসে থেকেছি আমি, আমার সাথে সাথে ক্যাপ্টেনও। ভাল চাইলে ক’দিন তাঁর সামনে পোড়ো না। কপালে ভোগান্তি আছে তাহলে।’
মুসা বলল, ‘কিন্তু…কিন্তু আমরা মেসেজটা পেয়েছি…’
ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন মিস্টার বারবার, ‘ছাই পেয়েছ! সব তোমাদের বানানো কথা!’
প্রতিবাদ করতে গেল মুসা। এতই রেগে গেলেন মিস্টার বারবার, জানালায় রাখা একটা ফুলের টব তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারার হুমকি দিলেন। চেঁচিয়ে বললেন, ‘জলদি ভাগো!’
‘খাইছে! সত্যি সত্যি মারবেন নাকি?’ ফিসফিস করে বলল মুসা।
‘বলা যায় না। প্রচণ্ড খেপে গেছেন,’ কিশোর বলল। ‘চলো। এখানে থেকে কোন লাভ নেই আর।’

ছয়.
স্কুলের গেটের কাছে এক তরুণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। হাতে একটা চাঁদা তোলার বাক্স। বাক্সটা নাড়ছে। ঝনঝন করে বাজছে ভিতরে রাখা মুদ্রা। এতিম বাচ্চাদের জন্যে চাঁদা তুলছে।
অনেক মায়েরাই বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে আসছেন। গেটের কাছে থামছেন তাঁরা। টাকা-পয়সা, যার যা ইচ্ছে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন বাক্সের ভিতরে। কিছু কিছু ছেলেমেয়েও চাঁদা দিচ্ছে টিফিনের পয়সা থেকে।
কিশোর আর মুসা গেটের কাছে পা দিতেই ক্লাস শুরু হওয়ার ঘণ্টা পড়ল। গেটের কাছে সেই তরুণ আর ওরা দু’জন ছাড়া অন্য কেউ নেই তখন।
ঘণ্টা শুনে ছেলেরাও তাড়াহুড়ো করে ঢুকতে গেল, লোকটাও আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই ভেবে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল।
‘এই লোকটাই চাঁদা তুলতে গেছিল না সেদিন?’ কিশোরের প্রশ্ন।
কথা বলার সময় নেই। ঘণ্টা পড়ে গেছে। ক্লাসরুমের দিকে ছুটল দু’জনে। এক মিনিট দেরি করে ফেলল। তবে ভাগ্য ভাল, টিচার ওদেরকে দেখেননি। চুপচাপ গিয়ে যার যার সিটে বসে পড়ল দুই গোয়েন্দা। চাঁদা-তোলা লোকটার কথা ভুলে গেল।
নতুন কিছুই ঘটল না সেদিন স্কুলে। অনেক কথা পেটে গিজগিজ করছে লধশদের। ছুটির পর আর তর সইল না, ছাউনিতে হাজির হলো।
‘চোরেরা কেন আসেনি জানো?’ রবিন বলল, ‘আমরা যে সন্দেহ করেছি, এটা ওরা জেনে ফেলেছে।’
‘অসম্ভব!’ মানতে পারল না ডলি। ‘কি করে জানবে? আমরা সাংঘাতিক সতর্ক ছিলাম। কাউকে কিচ্ছু বুঝতে দিইনি।’
‘ঠিক,’ তার সঙ্গে একমত হলো বব। ‘ছাঁচ তোলার সময় কাউকে চোখে পড়েনি আমাদের। কড়া পাহারা দিয়েছে টিটু, দেখলে চেঁচানো শুরু করত।’
‘গ্রোসারি শপে তোমরা কথা বলার সময় কেউ শুনে ফেলেনি তো?’ রবিন জিজ্ঞেস করল।
‘উঁহু!’ মাথা নাড়ল মুসা।
‘শুনেছে!’ হাত তুলল কিশোর। ‘আমরা মিস্টার বারবারের সঙ্গে কথা বলার সময় মিস্টার মরিস ঢুকেছিলেন। আমাদের কথা তাঁর কানে গিয়ে থাকতে পারে। তবে শেষ কয়েকটা কথা, ওটুকু শুনে কিছু বোঝা মুশকিল।’
‘তা ছাড়া তিনি পাইপ টানছিলেন,’ মনে করিয়ে দিল মুসা। ‘চোরদের কেউ নন। উইনেক্স সিগারেট টানেন না তিনি।’
চুপ হয়ে গেল সবাই। জটিল হয়ে উঠেছে রহস্য। বোঝা যাচ্ছে না কিছু। ছাউনির ভিতরে স্তব্ধ নীরবতা। মিনিটের পর মিনিট কাটছে। অসহ্য হয়ে উঠল পরিবেশ। হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে দরজার দিকে ছুটে গেল টিটু। তাজ্জব হয়ে দেখল লধশরা, সাদা একটা খাম ঠেলে দেয়া হচ্ছে দরজার নিচ দিয়ে।
সাধারণ খাম।
কী আছে ভিতরে?
প্রায় উড়ে গিয়ে ওটার কাছে পড়ল যেন কিশোর। ঝড়ের গতিতে গিয়ে দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে গেল রবিন আর মুসা।
বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শরতের শুরুতে রাত নামে তাড়াতাড়ি।
‘ওই যে, ওখানে!’ চিৎকার করে বলল রবিন। ‘কে জানি পালাচ্ছে!’
পাতাবাহারের ঝাড়ের আড়ালে একটা অস্পষ্ট মূর্তিকে হারিয়ে যেতে দেখা গেল। ডালপাতায় ঘষা লেগে মৃদু খসখস শব্দ হলো। চোখের ভুল নয়।
দৌড়ে পিছু নিল রবিন। সঙ্গে মুসা আর টিটু।
‘জলদি করো!’ মুসাকে বলল রবিন। ‘রাস্তায় উঠে গেছে!’
পাঁচ সেকেন্ড পর ওরাও রাস্তায় এসে উঠল। কিন্তু নির্জন, ফাঁকা রাস্তা। কাউকে চোখে পড়ল না।
চেপে রাখা দমটা শব্দ করে ছাড়ল রবিন। ‘দূর, পারলাম না! ঠিকই পালাল!’
গরগর করছে টিটু। হঠাৎ তীরবেগে ছুটতে শুরু করল। পথের মোড়ে একটা স্ট্রিট লাইট জ্বলছে। সেদিকে যাচ্ছে সে। মুহূর্ত পরেই সেটার নিচে এসে হাজির হলো নিনা আর বাবলি। দেখে এগিয়ে গেল মুসা ও রবিন।
‘কি হলো, অত ছোটাছুটি কিসের?’ নিনা জিজ্ঞেস করল।
‘একটু আগে কাউকে দেখেছ এদিকে?’ বাবলিকে জিজ্ঞেস করল মুসা।
‘হ্যাঁ, দেখলাম একটা লোক দৌড়ে চলে যাচ্ছে।’
‘কোনদিকে গেল? দেখতে কেমন?’
মুচকি হাসল বাবলি। ‘বলব কেন?’
অনেক কষ্টে মেজাজ ঠিক রাখল মুসা। ‘জলদি বলো!’
‘বললেও লাভ হবে না। ধরতে পারবে না। যা জোরে দৌড়াচ্ছিল!’
‘গেছে কোনদিকে?’ ধৈর্য হারাল রবিন।
নিনা বলল, ‘মিল লেন-এর দিকে গেছে।’
‘দেখতে কেমন?’ আবার প্রশ্ন করল মুসা।
মনে করার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল নিনা।
বাবলি বলল, ‘পরনে জিনস, গায়ে চামড়ার জ্যাকেট।’
‘চেহারা কেমন?’ চিৎকার করে উঠল উত্তেজিত মুসা। ‘আগে কখনও দেখেছ ওকে?’
‘না। অন্ধকারে ভালমত দেখিনি। তবে মনে হলো বয়স কম।’
‘এই? আর কিছু না?’
‘ও, না না, দেখেছি,’ নিনা জবাব দিল। ‘ওয়েলিংটন বুট। ভাইয়ারটার মত।’
‘তার মানে ওদেরই একজন!’ বিড়বিড় করল মুসা।
‘কাদের একজন?’ জানতে চাইল বাবলি।
‘সেটা তোমার জানার দরকার নেই!’ ধমক দিয়ে বলল মুসা। ‘খবরদার, যা দেখলে, কাউকে গিয়ে বলবে না, যদি ভাল চাও!’
‘কেন, বললে দোষ কি?’ নিনা বলল, ‘কিছু লুকাচ্ছ নাকি?’
মুসার হাত ধরে টানল রবিন, ‘এসো, যাই। পিছু নিয়ে আর লাভ নেই, পাওয়া যাবে না লোকটাকে।’
ছাউনিতে ফিরে এল দু’জনে। থমথমে হয়ে আছে পরিবেশ, সবাই গম্ভীর। নীরবে খামের ভিতরে পাওয়া কাগজটা বাড়িয়ে দিল কিশোর।
রবিন আর মুসাও দেখল। খবরের কাগজ থেকে অক্ষর কেটে নিয়ে পর পর সাজিয়ে শব্দ তৈরি করা হয়েছে, আঠা দিয়ে লাগানো হয়েছে সাদা কাগজের উপর। ইংরেজি লেখাটার বাংলা মানে করলে দাঁড়ায়: ভাল চাইলে আমাদের ব্যাপারে নাক গলাবে না আর সাবধান করব না মনে রেখো।
‘শয়তান!’ গাল দিল বব।
‘মুদির দোকানে কেন চুরি করতে যায়নি বোঝা গেছে এতক্ষণে,’ মুসা বলল। ‘আমাদের ব্যাপারে সব জেনে গেছে ব্যাটারা। চুরি করে চোখ রেখেছিল।’
কাগজটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। বলল, ‘লেখাপড়া কিছুই তো জানে না। এক লাইনে চারটে বানান ভুল।’
‘লেখাপড়া না জানলেও দৌড়াতে পারে ভালই,’ রবিন বলল। ‘ওয়েলিংটন বুট পরে এসেছিল।’
‘কি করে জানলে?’ মিশার প্রশ্ন।
‘বাবলি আর নিনা দেখেছে।’
‘ওদের জ্বালায় আর শান্তিতে থাকার জো নেই! সারাক্ষণই ঘুরঘুর করছে আমাদের ছাউনির আশপাশে।’
‘ঘুরঘুর করাতে এই একটিবার অন্তত আমাদের উপকারই হয়েছে,’ রবিন বলল। ‘ওরা না দেখলে আমরা জানতেই পারতাম না কে এসেছিল, কী ধরনের লোক।’
দরজায় জোরে জোরে থাবা পড়ল। চমকে গেল সবাই। লোকটা ফিরে এল? নাকি নিনা আর বাবলি? না পুলিশ ক্যাপ্টেন?
‘সঙ্কেত?’ চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
‘কালো জামের জেলি!’ বাইরে থেকে জবাব দিলেন চাচি। হাসলেন।
‘কালো জামের জেলি’ লধশদের সঙ্কেত নয়। তবু দরজা খুলতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করল না মুসা। হাত বাড়াল, ‘কই, দিন।’
‘বানিয়েছি নাকি, যে দেব,’ হেসে বললেন চাচি। ‘বলতে এলাম, জাম পেড়ে আনতে পারলে বানিয়ে দিতে পারি। পারবে?’
‘পারব না মানে!’ সমস্বরে চিৎকার করে বলল চার-পাঁচটা কণ্ঠ। কালো জামের জেলির কথা শুনে জিভে জল এসে গেছে ওদের। ‘কাল স্কুল ছুটির পরেই যাব।’

সাত.
পরদিন বিকেল পাঁচটায় স্কুল ছুটির পর গাঁয়ের বাইরে রাস্তার মাথায় জমায়েত হলো লধশরা। কালো জাম আনার জন্য ঝুড়ি নিয়ে এসেছে হাতে করে। দল বেঁধে এগোল পাহাড়ের দিকে। ওদের জানা আছে কোথায় পাওয়া যাবে কালো জাম।
মাঠ পেরিয়ে পাহাড়ি পথে এসে উঠল দলটা। আগে আগে চলেছে টিটু। পথের দু’পাশে গরু-ভেড়া চরছে।
কালো জামের কথা মাথায় থাকলেও আরও একটা কথা ঘুরছে ওদের মনে। ডলি আর অনিতার কুড়িয়ে পাওয়া সেই রহস্যময় মেসেজ।
‘কাল রাতে একটুও ঘুমাতে পারিনি,’ ডলি বলল। ‘সারাক্ষণই কেবল মনে হয়েছে, জানালার বাইরে ঘোরাঘুরি করছে কে যেন!’ শেষ দিকে গলা কেঁপে গেল তার।
‘ভয় তাড়াও। মন থেকে ভয় তাড়াও,’ গম্ভীর কণ্ঠে উপদেশ দিল মুসা। ‘এমনটা চলতে থাকলে শেষে বিছানার নিচেও কেউ লুকিয়ে আছে ভাবতে শুরু করবে। একা ঘুমাতে সাহস পাবে না, বাপ-মায়ের বিছানায় গিয়ে উঠবে, দুদু খাওয়া বাচ্চার মত।’
‘আর তুমি যে ভূতের ভয়ে সারাক্ষণ কাবু হয়ে থাকো!’ জবাব দিতে এক মুহূর্ত দেরি করল না ডলি।
জবাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল মুসা। তর্কটা আগে বাড়তে দিল না কিশোর, ঝগড়া বেধে যাবে। বাধা দিয়ে বলল, ‘একটা কথা কিন্তু ঠিক, আমাদের ওপর চোখ রাখা হচ্ছে। মেসেজে হুমকি দেয়া হয়েছে। কথা না শুনলে ক্ষতিও করবে।’ চট করে তাকাল এদিক ওদিক। ‘এ-মুহূর্তেও নজর রেখেছে কিনা কে জানে!’
তর্ক বন্ধ হয়ে গেল। সাবধানে চারদিকে নজর রাখতে রাখতে এগোল লধশদের দলটা।
পাহাড়ের গোড়ায় পৌঁছে গেছে ওরা। পুরানো একটা মিল দাঁড়িয়ে আছে খানিক দূরে। উঁচু স্তম্ভটা তালগাছের মত খাড়া উঠে গেছে অনেক উপরে। একটা সরু পথ এগিয়ে গেছে ওটার দিকে, পথের দুই ধারে খাড়া টিলা। জায়গাটা খুবই পরিচিত ওদের।
‘ওখানে লুকিয়ে নেই তো কেউ!’ ফিসফিসিয়ে বলল মিশা।
‘লুকানোর মত জায়গাই কিন্তু!’ সুর মেলাল অনিতা।
‘ভয় পাচ্ছ নাকি?’ অভয় দেয়ার চেষ্টা করল কিশোর। ‘লোকগুলো যে-ই হোক, ওরা বলে দিয়েছে ওদের কাজে বাগড়া না দিলে কিছু করবে না। কিন্তু ওরা জানে না বাগড়া দেয়ার মত কোন সূত্র নেই আমাদের হাতে।’
‘ঠিক,’ কিশোরের কথাটা পছন্দ হলো ববের। ‘তা ছাড়া রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা কি আর চোখ রাখা সম্ভব? আর এখন যাচ্ছি আমরা জাম পাড়তে, মোটেও ইন্টারেস্টেড হবে না ওরা।’
‘চোরেরা না হলেও অন্যেরা হচ্ছে!’ গুঙিয়ে উঠল রবিন, ‘দেখো, কে আসছে!’
পথের মোড়ে বাবলি আর নিনাকে দেখতে পেল সবাই। ওদের হাতেও ঝুড়ি।
‘নাহ্, আর পারা যায় না!’ বিরক্ত হয়ে হাত নাড়ল ডলি। ‘একেবারে জোঁকের মত লেগে থাকে! কোত্থাও যাওয়ার উপায় নেই!’
‘মাকে বলেছিলাম জাম পাড়তে যাচ্ছি,’ মুসা বলল, ‘বাড়িতেই ছিল তখন বাবলি। নিশ্চয় শুনেছে। এবার ওর ঘাড় না মটকেছি তো আমার নাম মুসা আমান না!’
কাছে চলে এসেছে বাবলি আর নিনা। মুসার কথা কানে গেছে।
মুচকি হেসে বলল বাবলি, ‘অত রাগ করছ কেন? জাম গাছগুলো কি তোমাদের একার? সবাই নিতে পারে। অনেক আছে, কম পড়বে না তোমাদের ভাগে।’
‘তাই তো,’ বাবলির সঙ্গে গলা মেলাল নিনা, ‘অনেক আছে। তবে আগেভাগে যারা পাড়বে, তারা ভালগুলো পাবে। পাড়তে পারাটাও অবশ্য একটা ক্ষমতার ব্যাপার।’ আড়চোখে মুসার দিকে তাকাল সে।
বাবলিদের গা-জ্বালানো কথাবার্তা টিটু বুঝতে না পারলেও ওদের ভাবভঙ্গি মোটেও পছন্দ হলো না তার। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে গরগর করে উঠল সে।
‘এই কুত্তা, সর!’ ধমক দিল বাবলি। ‘পথ ছাড়!’
‘এই টিটু, সরে আয়,’ ডাক দিল কিশোর। অহেতুক ঝগড়া করতে ভাল লাগছে না এখন।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরে এল টিটু। বাবলি আর নিনার পায়ে একটা করে কামড় বসাতে পারলে ভীষণ খুশি হতো সে।

ঠিকই বলেছে বাবলি। কালো জামের অভাব নেই। ঝুড়ি বোঝাই করে ফেলল। পাড়ার সময় যে যত পারল খেতে থাকল। বেশি খেল ডলি আর অনিতা। ঠোঁট, জিভ কালো করে ফেলল।
ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছে ওরা, এই সময় চেঁচিয়ে উঠল রবিন, ‘আরি কাণ্ড দেখো, এখানেও মেসেজ!’
কাঁটার ভয় না করে একটা ঝোপের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিল সে।
‘কী, রবিন?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।
‘পুরানো খবরের কাগজ! এই কাঁটার মধ্যে ফেলল কে?’
‘খবরের কাগজ! তাই তো, অবাক কাণ্ড!’
হাত বাড়িয়ে ওটার নাগাল পেল না রবিন। ডাল সরিয়ে ঢুকে যাচ্ছে ভিতরে, কাঁটা ফুটছে গায়ে, কিন্তু না বের করে ছাড়বে না। ঝোপের ভিতর থেকেই বলল, ‘পুরানো, তবে নষ্ট হয়নি। বৃষ্টি পড়েনি, এমনকি শিশিরও না। একেবারে শুকনো।’
‘তার মানে আজই ছুঁড়ে ফেলেছে এখানে,’ অনুমান করল মুসা।
হাতে কাগজটা নিয়ে, অনেক কষ্টে কাঁটা বাঁচিয়ে ঝোপ থেকে বেরোল রবিন। ‘এখানে খবরের কাগজ ফেলেছে, ব্যাপারটা কেমন লাগছে না?’
‘হ্যাঁ, কেমনই লাগছে! অদ্ভুত!’ একমত হলো কিশোর। ‘এতদূরে ঝোপের মধ্যে কাগজ ফেলতে এল কে?’
কাগজটা রবিনের হাত থেকে নিয়ে ভাঁজ খুলল মুসা। ‘আরি! কত ফুটো দেখেছ!’
অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে সবাই। চারকোনা ছোট ছোট ফুটোয় ভরা কাগজটা।
উত্তেজিত কথা কানে যেতে কি হয়েছে দেখার জন্যে এগিয়ে এল মিশা, অনিতা, ডলি আর বব। টিটুও এল। নিনা আর বাবলির পিছন পিছন অনেক দূর চলে গিয়েছিল সে। ওরা চলে গেছে এ-ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে ফিরে এসেছে। ছুটতে ছুটতে আসায় জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে।
‘একটা জিনিস লক্ষ করেছ?’ বব বলল। ‘শুধু বড় হাতের অক্ষরগুলো কেটে বাদ দিয়েছে।’
‘অক্ষরগুলো বের করে নিয়েছে মনে হয়,’ মিশা বলল।
হঠাৎ পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল কিশোর। একটা খাম বের করল। ছাউনিতে সেদিন দরজার নিচ দিয়ে এটাই ঠেলে দেয়া হয়েছিল।
খাম থেকে মেসেজ লেখা কাগজটা বের করে ভাঁজ খুলল সে। ঘাসের উপর বিছাল। বলল, ‘রবিন, আমি পড়ছি। তুমি ফুটোগুলো দেখে কোন অক্ষরটা কোনখান থেকে কাটা হয়েছে বের করার চেষ্টা করো।’
কাজটা কঠিন না, আবার সহজও না। কিশোর পড়তে লাগল, বাকি সবাই রবিনকে সাহায্য করল।
মাথা দোলাল কিশোর, ‘হুঁ, আর কোন সন্দেহ নেই, এই কাগজ থেকেই অক্ষর কেটে শব্দ তৈরি করে পাঠানো হয়েছে আমাদের কাছে।’
‘এই লুকাও, লুকাও, জলদি লুকিয়ে ফেলো!’ চোখ বড় বড় করে চারপাশে তাকাতে লাগল ডলি। ‘কেউ দেখে ফেলবে!’
‘কে দেখবে?’ বব বলল। ‘আশপাশে তো কাউকে দেখছি না। এটা যে পেয়ে যাব, কল্পনাই করবে না ওরা। মনে করেছে কাঁটাঝোপে ফেলে গেছে, কে আর খুঁজে পাবে?’
‘ব্যাটারা গাধা,’ রবিন বলল। ‘আমি হলে পুড়িয়ে ফেলতাম।’
‘আমিও,’ কিশোর বলল। ‘খুব বোকামি করেছে।’
‘কিন্তু…’ কথাটা বলতে গিয়েও বলল না অনিতা।
‘কিন্তু কি?’ মুসার প্রশ্ন।
‘এমনও তো হতে পারে, ইচ্ছে করেই এখানে ফেলে রেখে গেছে আমাদের চোখে পড়ানোর জন্যে?’
‘তা কেন চাইবে?’
‘চোখে পড়াতে চাইবে কেন?’ ভুরু কুঁচকাল কিশোর।
‘জানি না! কথাটা মনে হলো, তাই বললাম,’ অনিতা বলল।
‘বড় বেশি কাকতালীয় ব্যাপার মনে হচ্ছে না?’ মিশা বলল। ‘আমাদের চোখে পড়ানোর জন্যেই যদি ফেলে রেখে গিয়ে থাকে, কি করে জানল কালো জাম পাড়তে ঠিক এখানটাতেই আসব আমরা? অন্য কোথাও-ও তো যেতে পারতাম।’
‘হয়তো একটা চান্স নিতে চেয়েছে,’ চোখ বড় বড় হয়ে গেল ডলির। ‘এখানেই আসব কিনা শিওর ছিল না ওরা, তবে জাম পাড়তে যে আসব এ-খবরটা নিশ্চয় জেনে গিয়েছিল। কি করে জানল?’ বলতে বলতে চোখ চলে গেল ঝোপের দিকে। যেন ওটার ভিতরে লুকিয়ে থেকে এখন ওদের উপর নজর রাখছে চোরেরা।

আট.
ডলির সন্দেহটা সবার মাঝে সংক্রামিত হলো। সব চুপচাপ। কোথাও কোন নড়াচড়া নেই। শব্দ নেই। গাছ, ঝোপঝাড় আর পাহাড়ের চূড়ার পুরানো মিলটার উপর ঘুরে বেড়াতে লাগল ওদের দৃষ্টি।
‘কাউকেই তো দেখছি না,’ কিশোর বলল। ‘তবে সাবধান থাকতে হবে আমাদের। আলাদা হয়ে যাওয়া দরকার। মুসা, রবিন, তোমরা দু’জন আমার সঙ্গে এসো। টিটুকে নিয়ে রাস্তার পাশে খুঁজব আমরা। বব, বাকি সবাইকে নিয়ে তুমি সোজা চলে যাও গাঁয়ের মেইন রোডে। আধ ঘণ্টার মধ্যে আমরা না ফিরলে সবার বাড়িতে গিয়ে খবর দেবে।’
সবাই রাজি, শুধু অনিতা বাদে। বলল, ‘কেন, আমি তোমাদের সঙ্গে আসতে পারি না? আমার ইচ্ছে করছে।’
‘ইচ্ছে করলে এসো। তবে ভয় পাওয়া চলবে না।’
‘পাব না।’
জামের ঝুড়ি নিয়ে ঢাল বেয়ে নেমে মেইন রোডের দিকে এগোল বব, মিশা ও ডলি। অন্যেরা খুঁজতে চলল। কি খুঁজবে জানে না ওরা। টিটুকে খবরের কাগজটা শুঁকিয়ে নিল। যে ফেলে গেছে ওটা, তাকে খুঁজে বের করতে বলল। সোজা গাঁয়ের দিকে রওনা দিল টিটু। বহু বলেও তাকে বোঝানো গেল না, গোঁ ধরেছে যেন গাঁয়েই যাবে।
‘আশ্চর্য! কাগজের ব্যাপারে মোটেও ইন্টারেস্টেড নয় ও,’ কিশোর বলল। ‘যা, বিদেয় হ। ববদের সঙ্গে চলে যা। তোকে ছাড়াই খুঁজতে পারব আমরা।’
অনুমতি পেয়ে উল্টো কাজটা করল টিটু। এতক্ষণ যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে গিয়েছিল, এখন দাঁড়িয়ে রইল।
‘চলো, রাস্তা ধরে আরেকটু উঠে দেখি,’ রবিন বলল। ‘দেখি, কিছু পাই কিনা।’
কিছুদূর গিয়ে আরেকটা পথ পাওয়া গেল। আড়াআড়ি কেটেছে প্রথমটাকে। আর এগোনো কঠিন। কাদা হয়ে আছে রাস্তায়। প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। তাতে কাদা হয়েছে। গরু হেঁটে গিয়ে সেটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
‘ইস্, কী কাদা!’ মুখ বাঁকাল মুসা। ‘এর ভেতর দিয়ে যেতে পারব না। ঘুরে গেলে কাঁটাঝোপের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। এই কাঁটা পেরোনো অসম্ভব।’
‘বুট পরা থাকলে কাদা মাড়িয়েও যেতে পারতাম।’ হাত তুলে দেখাল রবিন, ‘ওই দেখো, কাদার মধ্যে জুতোর ছাপ। ওয়েলিংটন বুটের মতই লাগছে।’
‘হ্যাঁ-হ্যাঁ,’ অনিতা বলল। ‘হিল-ওয়াকিং বুটও আছে।’
‘বুট ছাড়াও কাদা পার হওয়া যায়।’ পা থেকে জুতো-মোজা খুলতে আরম্ভ করল কিশোর। ‘কাদা আমাকে আটকাতে পারবে না।’
মুসা, রবিন আর অনিতাও জুতো খুলে ফেলল। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। অন্ধকারের দেরি নেই। তা ছাড়া ববকে বলে দিয়েছে, আধ ঘণ্টার মধ্যে না ফিরলে বাড়িতে খবর দিতে।
জুতো-মোজা বওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। এখানে কেউ জুতো চুরি করতে আসবে না। পথের পাশেই ওগুলো ফেলে রেখে কাদায় পা দিল ওরা। আগে নামল মুসা। তাকে অনুসরণ করল রবিন আর অনিতা। গোড়ালি পর্যন্ত দেবে গেল কাদায়।
ফ্যাঁকড়া বাধাল টিটু। কিছুতেই কাদায় নামতে চাইল না। বাধ্য হয়ে তাকে কোলে তুলে নিল কিশোর।
পিছলে পড়ার ভয়ে মেপে মেপে পা ফেলল সবাই। আছাড় খেয়ে কাদায় মাখামাখি হতে চায় না।
নিরাপদেই কাদার ওপারে এসে পৌঁছল।
ওপাশে জুতোর ছাপ বেশ স্পষ্ট।
‘অনুসরণ করে যাওয়া যাবে সহজেই,’ রবিন বলল।
‘হ্যাঁ, ছাপ খুব পরিষ্কার,’ কিশোর বলল।
‘ভাগ্যিস কাদাটা হয়েছিল,’ সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে মুসাকে। ‘কাজ সহজ করে দিল আমাদের।’
ছাপ অনুসরণ করে নির্জন একটা পোড়ো খামারবাড়িতে এসে পৌঁছল ওরা। একটা পাশ ধসে পড়েছে বাড়িটার। আইভি লতায় ছেয়ে আছে। গাছ গজিয়েছে ভাঙা জানালায়। চিমনির মাথায় কাকের বাসা।
‘খারাপ জায়গা! ভয় লাগে!’ অনিতা বলল। ‘লাখ টাকা দিলেও রাতে একা আসতে পারব না এখানে।’
‘এখন রাত নয়,’ কিশোর বলল। ‘অকারণ ভয় পাচ্ছ, অনিতা। এলেই যখন, ঝামেলা কোরো না।’
বাড়ির কাছে একটা ঝোপের আড়ালে সবাইকে লুকিয়ে পড়তে বলল সে। চুপ থাকতে ইশারা করল। ভিতরে কেউ আছে কিনা বোঝার জন্যে একটা পাথর তুলে নিয়ে দরজা সই করে ছুঁড়ে মারল।
পচে গেছে দরজার কাঠ। নরম হয়ে গেছে। শব্দ হলো ধ্যাপ করে। পাথরের আঘাতে দাগ হয়ে গেল।
ঝোপের আড়ালে চুপ করে বসে অপেক্ষা করতে লাগল গোয়েন্দারা।
পার হয়ে গেল কয়েক মিনিট। কিছুই ঘটল না। সাড়া এল না ভিতর থেকে। কেউ বেরোল না।
‘আমি যাচ্ছি।’ উঠে দাঁড়াল কিশোর।
টিটুকে সাথে নিয়ে সাবধানে এগিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়ল বাড়ির ভিতরে। পিছনে এল অন্য তিনজন।
বড় একটা অন্ধকার ঘরে ঢুকেছে ওরা। আইভি লতায় ছাওয়া একটা জানালার সামান্য যে ফাঁক-ফোকর আছে সেখান দিয়ে ম্লান আলো আসছে ঘরে।
অন্ধকার চোখে সয়ে এলে পাথরের বিশাল ফায়ারপ্লেসটা দেখতে পেল ওরা। কালো হয়ে আছে। একসময় নিশ্চয় গনগন করে জ্বলত ওখানে সতেজ লাল আগুন। এখন ওখানে কাঠ নেই, ছাইয়ের উপর পড়ে রয়েছে ছাদ থেকে ভেঙে পড়া কয়েক টুকরো টালি।
আঙুল তুলে দেখাল কিশোর, ‘পেঁচা!’
অন্যেরাও মুখ তুলে তাকাল।
‘তিনটে!’ মুসা বলল।
ছাতের একটা অংশ বসে গেছে। ওখানে বর্গার উপরে একটা ফোকর। সেই ফোকরে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে পেঁচাগুলো।
‘চোখ পাকিয়ে তাকায় না কেন?’ অনিতা বলল, ‘গোল গোল চোখ?’
‘ঘুমিয়ে আছে,’ কিশোর বলল। ‘খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে দিয়ে দেখো না কি করে।’
‘থাক, জাগানোর দরকার নেই,’ মুসা বলল। ‘ঘুমের মধ্যে খোঁচা দিলে আমিও রেগে যাই।’
‘দেখো!’ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ‘আমাদের আগে কেউ ঢুকেছিল!’
নিচু হয়ে ঘরের কোণ থেকে কি যেন তুলে নিল সে। বন্ধুদের দেখাল। হাতের ছড়ানো তালুতে কয়েকটা উইনেক্স সিগারেটের পোড়া টুকরো। আরও অনেকগুলো টুকরো পড়ে রয়েছে মেঝেতে।
‘গোটা পঞ্চাশেক হবে,’ বলল রবিন। ‘তার মানে বহু সময় কাটিয়েছে এখানে লোকগুলো।’
‘চোরের আস্তানা নাকি?’ মুসার প্রশ্ন। ‘মেঝেতে দেখো, ধুলোর মধ্যে কত পায়ের ছাপ।’
এগিয়ে গিয়ে সিগারেটের টুকরোগুলো শুঁকল টিটু। তারপর দাঁত বের করে মৃদু গরগর করে উঠল।
‘বেরিয়ে যাওয়া দরকার,’ অনিতা তাড়া দিল। ‘কখন আবার এসে পড়ে ব্যাটারা। আর বেরোতে পারব না তাহলে, আটকা পড়ব। বেরোনোর একমাত্র পথ ওই দরজা।’
অনিতার কথায় একমত হতে পারল না কিশোর। যে জানালা দিয়ে আলো আসছে সেটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ঠেলে দেখল খোলা যায় কিনা। কিন্তু আইভির জালের জন্যে নড়াতেই পারল না পাল্লা।
এইবার সায় জানাল, ‘হ্যাঁ, ওটাই একমাত্র পথ। লতাগুলো এখানে শিকের কাজ করছে। বেরোনো যাবে না এদিক দিয়ে।’
‘ওপরে উঠে লুকানো যায় অবশ্য,’ রবিন তাকিয়ে রয়েছে ছাদের দিকে। ‘দেবে গেছে, তবে আমাদের ভারে ছাদটা ভেঙে পড়বে বলে মনে হয় না। ভাল দিকটায় থাকব আমরা। সহজে খুঁজে পাবে না চোরেরা।’
‘তাই মনে হচ্ছে। বীমটা খুব শক্ত, নইলে এতদিনে ভেঙে পড়ত,’ কিশোর বলল। ‘যা দেখার দেখলাম। আর দেরি করে লাভ নেই। চলো বাড়ি যাই।’
বেরিয়ে এল ওরা।
বাইরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন অনিতা। পুরানো বাড়িটার ভিতরের পরিবেশ কেমন যেন অদ্ভুত, গা ছমছম করে।
আঁধার হয়ে আসছে। গোধূলির আলোয় এগিয়ে চলল ওরা। কাদা পেরোনোর সময় আগের মতই সাবধান হলো, ফলে এবারেও পা পিছলে আছাড় খেল না কেউ। ওপাশে এসে তুলে নিল যার যার জুতো-মোজা। তবে পায়ে যে-রকম কাদা লেগেছে পরার আর উপায় নেই।
‘আস্ত একটা সাবান লাগবে এই কাদা তুলতে,’ অনিতা বলল। ‘গরম পানি তো লাগবেই।’
‘ওসব কিছুই লাগবে না,’ কিশোর বলল। ‘যাওয়ার পথে ঝর্না থেকেই ধুয়ে নিতে পারব।’
‘জলদি চলো। রাত হয়ে যাচ্ছে,’ সময় নষ্ট করতে রাজি নয় মুসা। বেশি রাত করে গেলে মা বকা দেবেন।
ঝর্নাটা বেশি দূরে না। ওখানে এসে পা ধুয়ে নিল সবাই। টিটুর ওসব বালাই নেই, সে প্রাণভরে পানি খেয়ে নিল।
কিশোরদের বাড়িতে উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে মিশা, ডলি আর বব। ওদেরকে জানানো হলো সব। সবাই মিলে ঠিক করল আগামীকাল আবার যাবে খামার-বাড়িটাতে। দিনের আলোয় দেখবে, আরও কোন তথ্য জানা যায় কিনা। ছাউনির দরজার নিচ দিয়ে ঠেলে দেয়া সেই চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে অস্বস্তিতে ভুগছে ওরা, কেবলই মনে হচ্ছে, অদৃশ্য থেকে কে যেন চোখ রাখছে ওদের উপর!

নয়.
পরদিন শনিবার। দুটো নাগাদ বেরিয়ে পড়তে পারল দলটা খামার-বাড়ির উদ্দেশে। এবার আর টিটুকে নিল না সাথে। লুকিয়ে থাকার সময় শব্দ করে সব ফাঁস করে দিতে পারে, এই ভয়ে। অনেক কুঁই-কাঁই করল বেচারা যাওয়ার জন্যে, কিন্তু দেখেও দেখল না কিশোর।
বাড়িটাতে যাওয়ার আরও পথ আছে। কাদা না মাড়িয়েও যাওয়া যায়। সেই পথই ধরল ওরা আজ। সাইকেল চালিয়ে এল পুরানো মিলটা পর্যন্ত, সেখানে একটা খাদের মধ্যে সাইকেলগুলো রেখে বনের ভিতর দিয়ে এগোল পায়ে হেঁটে।
এসে দাঁড়াল বাড়িটার পিছন দিকে। দরজাটা সামনে। কেউ চোখ রাখলে ওদিক দিয়েই রাখবে। গোয়েন্দাদের উপর তার নজর পড়ার কথা নয়। চিমনির উপর কা-কা করছে কয়েকটা কাক। ঝগড়া করছে। উড়ে যাচ্ছে। আবার গিয়ে বসছে।
‘লুকানোর একটা ভাল জায়গা বের করতে হবে,’ ফিসফিস করে বলল কিশোর। ‘তারপর চোখ রাখব দরজার ওপর।’
‘কতক্ষণ বসে থাকতে হবে কে জানে?’ রবিন বলল। ‘না-ও তো আসতে পারে আজ ওরা।’
‘তা পারে,’ মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ‘তবে আসার সম্ভাবনাই বেশি, যদি এটা ওদের আস্তানা হয়ে থাকে।’
‘ভেতরে গিয়ে দেখলেই তো পারি,’ মুসা পরামর্শ দিল। ‘আমরা কাল যাওয়ার পর আর এসেছিল কিনা?’
‘বেশি ঝুঁকি নেয়া হয়ে যাবে। ভেতরেই হয়তো আছে এখন।’
‘কিংবা আমরা ভেতরে ঢুকলে এসে হাজির হতে পারে,’ বব বলল।
‘সাথে পিস্তল-টিস্তল রাখে না তো?’ ভয়টা চাপা দিতে পারল না মিশা।
‘রাখতেও পারে,’ বলল রবিন।
আরও ভয় পেয়ে গেল মিশা। চিঠিতে দেয়া হুমকির কথা ভাবছে। অন্যেরাও ভয় পাচ্ছে ভিতরে ভিতরে, তবে প্রকাশ করছে না।
দরজায় চোখ রাখতে হলে পাশ দিয়ে ঘুরে আসতে হবে। কিশোরের পিছনে এগোল সবাই। দরজাটা দেখা যেতেই দাঁড়িয়ে গেল।
‘ভাগাভাগি হয়ে যাব আমরা,’ নিচু কণ্ঠে বলল কিশোর। ‘রবিন, বব, তোমরা রাস্তা ধরে খানিকটা গিয়ে লুকিয়ে পড়ো। কাউকে আসতে দেখলেই পাথর ছুঁড়ে মারবে বাড়ির দেয়ালে। আমরা বুঝে যাব।’
‘আচ্ছা,’ রবিন বলল।
‘আর একদম নড়বে না, আমি বললে তারপর যা করার করবে।’
রবিন আর বব রওনা হয়ে গেলে মেয়েদের দিকে ফিরল কিশোর। ‘তোমরা ছড়িয়ে পড়ো। একেকজন একেক জায়গায় লুকাবে। বেশি দূরে যাবে না। যাতে সবার সঙ্গে সবাই যোগাযোগ রাখতে পারি আমরা। আমি আর মুসা বসছি বাড়ির কাছে।’
‘ঠিক আছে,’ অনিতা বলল। পা টিপে টিপে এগোল।
কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে ফিরে তাকাল একবার ডলি। তারপর ঢুকে পড়ল একটা ঝোপে।
ছড়ানো, মস্ত একটা ঝোপের মধ্যে ঢুকল কিশোর আর মুসা। উবু হয়ে শুয়ে পড়ল মাটিতে। এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে দরজাটা।
দ্রুত কেটে গেল প্রথম একটা ঘণ্টা। চুপ করে আছে গোয়েন্দারা। খামার-বাড়ির চিমনিতে মহা হট্টগোল বাধিয়েছে কয়েকটা কাক। এক জিনিস বেশিক্ষণ ভাল লাগে না। একঘেয়ে হয়ে গেল ব্যাপারটা। বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেল রবিন। শেষে সময় কাটানোর জন্যে পকেটনাইফ বের করে ঝোপের একটা ডাল কেটে সেটাকে চাঁছতে আরম্ভ করল। চ্যাপ্টা একটা বড় পাথরের উপর শুয়ে পথের দিকে তাকিয়ে রয়েছে বব। দূরের মেইন রোডটা দেখা যায় এখান থেকে। গাড়ি আসছে-যাচ্ছে, করার মত আর কোন কাজ না পেয়ে সেগুলো গুণতে (গুনতে?) লাগল সে।
ঘাস ছিঁড়ে দাঁতে কাটছে অনিতা। মিশা আর ডলি বসেছে খুব কাছাকাছি। একে অন্যের দিকে চকোলেট ছুঁড়ে মেরে খেলতে শুরু করল ওরা। মাঝে মাঝে মুখে পুরছে দু’একটা।
তবে কিশোর আর মুসা চুপচাপ রয়েছে।
দুই ঘণ্টা পেরোল। খামার-বাড়ির ধারে কাছে এল না কেউ। আসবে না নাকি?
পেরোল আরও একটা ঘণ্টা।
পায়ে খিল ধরে যাচ্ছে রবিনের। নড়ানো দরকার। গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঝিমুনি এসে যাচ্ছে ববের। মেয়েরা আর নীরব থাকতে না পেরে কথা শুরু করে দিল। ইতোমধ্যে ঘাস দিয়ে একটা ছোট ঝুড়ি বানিয়ে ফেলেছে অনিতা, সেটা অন্য দুই বান্ধবীকে দেখাল।
ধমক লাগাল কিশোর। চুপ করতে বলল।
আবার নীরবতা।
মিনিট পনেরো পরে হঠাৎ ঠুক করে একটা পাথর এসে লাগল দেয়ালে। চমকে উঠল কিশোর আর মুসা।
‘সঙ্কেত!’ ফিসফিসিয়ে বলল কিশোর। ‘কেউ আসছে!’
মুসার কাছাকাছি রয়েছে মিশা। তার কাছে খবরটা চালান করে দিল সে।
মিশা জানাল ডলিকে।
এভাবেই খবরটা আবার ফেরত গেল ববের কাছে, পাথরটা সে-ই ছুঁড়েছিল।
পায়ের শব্দ শোনা গেল। পাথরের উপর থেকে নেমে পড়ল বব। রাস্তাটা আর চোখে পড়ছে না এখন। অনেকটা নিচে বসেছে রবিন, তার চোখে পড়ছে পায়েচলা পথটা। উত্তেজনায় বুকের মধ্যে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে মিশা, অনিতা, ডলির। নিঃশ্বাস বন্ধ করে পড়ে আছে কিশোর আর মুসা। কান চেপে ধরেছে মাটিতে, যাতে এগিয়ে আসা পায়ের শব্দ শুনতে পায়। পথের মোড় থেকে কণ্ঠস্বর কানে এল আবছাভাবে। একটু পরেই দেখা যাবে কারা আসছে।
সূর্য ডুবছে, লম্বা হচ্ছে ছায়াগুলো। খামার-বাড়ির দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর আর মুসা। দুটো লম্বা ছায়া পড়তে দেখল দেয়ালে। চোখের পাতা সরু হয়ে গেল দু’জনেরই, রাস্তার দিকে তাকাল। কিন্তু চোখে রোদ পড়ায় দেখতে অসুবিধে হলো। ধীরে এগোচ্ছে রহস্যময় আগন্তুকেরা, ভারি পদশব্দ। যে-কোন মুহূর্তে গোচরে এসে যেতে পারে…
‘ধুর!’ দাঁতে দাঁত চাপল মুসা। ‘বাবলি!’
‘চুপ!’ চাপা গলায় ধমক দিল তাকে কিশোর।
রাস্তা ধরে খামারবাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে বাবলি আর নিনা। পা টেনে টেনে এগোচ্ছে, কারণ পায়ে বড় মানুষের ভারি বুট।
বাবলির পায়ে ওয়েলিংটন বুট। ফিশারম্যান ব্র্যান্ড। একবার দেখেই চিনে ফেলল মুসা, ওগুলো তার বাবার জুতো। নিনার পায়ে হিল-ওয়াকিং বুট। ওর বড় ভাইয়ের।
এই তাহলে ব্যাপার! সব রহস্যের পিছনে ওই শয়তান মেয়ে দুটো! চকিতে সব বুঝে ফেলল কিশোর।
ডলি আর অনিতাকে রাস্তা থেকে জঞ্জাল সাফ করতে দেখেছিল ওরা। তাড়াতাড়ি একটা মেসেজ লিখে ফেলে রেখে এসেছিল এমন জায়গায় যাতে সহজেই চোখে পড়ে দু’জনের। ইচ্ছে করেই ভুল বানানে লিখেছে সত্যিকারের চোর-ডাকাতের কাজ বোঝানোর জন্যে। তারপর সূত্র হিসেবে কাঁটাঝোপের মধ্যে রেখে এসেছে অক্ষর কেটে নেয়া খবরের কাগজটা। সিগারেটের টুকরো আর বুটের ছাপ ফেলে এসে বোঝাতে চেয়েছে, ওসব বড় মানুষের কাজ।
বুঝতে পারছে মুসাও। গত কয়েক দিনে কি হেনস্তাটা হয়েছে, মনে করে রাগে জ্বলছে সে। এতক্ষণে বুঝতে পারল, প্রতিটি ঘটনা ঘটার পর পরই কেন বাবলি আর নিনাকে দেখা গেছে। ছাউনির দরজার নিচ দিয়ে চিঠিটাও ওরাই রেখে এসেছিল। একটা লোককে দৌড়ে যেতে দেখার কথাটাও ওদের বানানো। ঝোপের মধ্যে পাওয়া খবরের কাগজের গন্ধ শুঁকে এ-জন্যেই গাঁয়ের দিকে যেতে চেয়েছিল টিটু। নিনা আর বাবলির পিছু নিতে চেয়েছিল কুকুরটা।
কী ঠকানটাই না ঠকিয়েছে লধশদের! মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেলল মুসা, প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বে না। কিন্তু কিভাবে নেবে? পিছন থেকে চুপি চুপি গিয়ে কাঁচি দিয়ে এক পোঁচে বাবলির বেণীটা কাটবে? হ্যাঁ, তাই করবে। আর নিনাকে কি শাস্তি দেয়া যায়? চুলের খুব অহঙ্কার মেয়েটার। মাথা ন্যাড়া করে মাথায় পচা ডিম ভাঙলে ঠিক হয়। আরেক কাজ করা যায়। পায়ে দড়ি বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে দেয়া যায় গাছের মাথায়, সিনেমায় দেখা জংলীরা বন্দিকে যেভাবে শাস্তি দেয়…
উঠতে গেল মুসা। হাত টেনে ধরে বসিয়ে দিল কিশোর। ফিসফিস করে বলল, ‘যাবে না। শোধ আমরা নেব, তবে অন্যভাবে।’
চোখ বন্ধ করে ফেলল মুসা। জোরে দম নিয়ে বের করে দেয়ার চেষ্টা করল রাগটা। শয়তানগুলোর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে মাথা দুটো ঠুকে দেয়ার ইচ্ছেটা দমন করা খুব সহজ নয়।
খামার-বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছে বাবলি আর নিনা। দু’জনের হাতেই বড় শপিং ব্যাগ।
‘এত্ত ভারি!’ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল বাবলি। ‘চাচা যে কি করে হাঁটে এগুলো পরে!’
ভিতরে ঢুকে পড়ল দু’জনে। খোলা রইল দরজাটা। ওদের কথাবার্তা শুনতে পেল কিশোর আর মুসা।
‘কদ্দিন খেলব এ-খেলা?’ নিনার কণ্ঠে বিরক্তি। ‘আর পারিনে বাপু, পায়ে বড় বড় ফোসকা পড়ে গেছে।’
‘ইচ্ছে করলে অনেকদিন চালিয়ে যেতে পারি,’ বাবলির জবাব। ‘ছাগলগুলো বুঝতেই পারেনি কিছু। ভাবছে, না জানি কি জটিল রহস্য পেয়ে গেছে! তদন্ত চালিয়েই যেতে থাকবে। আর আমরাও ওদেরকে সূত্র দিয়েই যেতে থাকব। বাঁদর-নাচ নাচিয়ে ছাড়ব।’
‘এত বোকা ওরা, আগে বুঝিনি। আহারে, কিশোরের জন্যে দুঃখই হচ্ছে। নিজেকে শার্লক হোমস মনে করে। অথচ এই সামান্য রহস্যের কিনারা করতে পারছে না…হি-হি!’
ঝোপের ভিতরে শুয়ে রাগে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে কিশোরের। রাগটা সামলাল অনেক কষ্টে।
‘আজকের দিনটা পুরানো মেসেজ নিয়েই ভেবে মরুক,’ বাবলি বলছে। ‘কাল নতুন আরেকটা দেব। কিশোর পাশার রোম খাড়া করে দেব। …কাল সন্ধ্যেবেলা এসে আরেকটা মেসেজ ফেলে যাব এখানে।’
‘আমার ভয় করছে রে। কখন আবার চলে আসে ওরা। মুসাকে ভয় লাগে আমার, ধরে যা মারে না…’
‘সব কিছুতে গায়ের জোর খাটাতে চায় গাধারা। তবে ভয় নেই, আসবে না। মুসা বলেছে, কিশোরের চাচি আজ বিকেলে কালো জামের জেলি বানাবেন। সবাই সাহায্য করবে তাকে।’
মনে মনে হাসল মুসা। মিথ্যে গল্পটা বানিয়ে বলে ভালই করেছে, খুশি লাগল তার। দেখল, ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে আবার বাবলি ও নিনা। মুসার কানে কানে কিশোর বলল, ‘চুপ করে থাকো। একদম নড়বে না!’
রাস্তায় নেমে হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়াল নিনা। ‘নাহ্, আর পারছি না! খুলে ফেলি?’
‘খোলো। তবে খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটবে না, ছাপ পড়তে পারে। ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটো।’
নিনা জুতো খোলার পর কি ভেবে বাবলিও বুট খুলে রাস্তা থেকে নেমে গেল। জুতোগুলো ভরে নিয়েছে শপিং ব্যাগে। হাসাহাসি করে কথা বলতে বলতে চলেছে। আগের দিন কি করে বুট এনেছিল, বুঝতে অসুবিধে হলো না কিশোর আর মুসার। কালো জাম পাড়াটা ছিল ছুতো। ও ঝুড়িতে করেই জুতোগুলো এনেছিল।
বাবলি আর নিনা দূরে চলে গেলে ঝোপ থেকে বেরোল কিশোর আর মুসা। অন্যদেরকে বেরোতে বলল।
বেরিয়েই রাগে ফুঁসে উঠল মিশা, ‘এত বিচ্ছু মেয়ে জীবনে দেখিনি আমি!’
ডলি আর অনিতা এত রেগেছে, কথাই বলতে পারছে না। রাগে সাদা হয়ে গেছে ববের মুখ।
‘শান্ত হও,’ কিশোর বলল। ‘প্রতিশোধ আমরা ঠিকই নেব। মাথা গরম করলে চলবে না। ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে এখন একটা প্ল্যান ঠিক করতে হবে আমাদের।’
আলোচনা করতে করতে বাড়ি চলল লধশরা। গাঁয়েও পৌঁছল, প্ল্যানও ঠিক হয়ে গেল ওদের। এখন শুধু সেটা প্রয়োগের অপেক্ষা।

দশ.
অনেক ঘটনা ঘটল সেদিন সন্ধ্যারাতে।
ন’টার সময় হাই স্ট্রিটের পাশ দিয়ে, ছায়ায় গা ঢেকে, আলো এড়িয়ে হেঁটে চলল কিশোর, বব ও রবিন। পরনে গাঢ় রঙের পোশাক, অন্ধকারে ভালমত দেখা যায় না। পায়ে নরম সোলের জুতো।
অবশেষে নিজেদের স্কুলে পৌঁছল ওরা। রাতের এ-সময়ে বাড়িটায় মানুষ থাকার কথা নয়, নেইও। কোন শব্দ নেই। আলো নেই স্কুল বাড়ির কোন ঘরে। শুধু একধারে কেয়ারটেকারের ঘরের জানালায় দেখা যাচ্ছে ম্লান নীলচে আলো।
‘টেলিভিশন দেখছেন,’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। ‘কিছু শুনতে পাবেন না।’
‘টিভি দেখলে আওয়াজ নেই কেন?’ রবিনের প্রশ্ন। ‘সাইলেন্ট ফিল্ম দেখছেন?’
‘শব্দ কমিয়েও রাখতে পারেন,’ বলল বব।
দাঁড় করিয়ে রাখা দুটো গাড়ির আড়ালে এসে বসে পড়ল ওরা। ভালমত দেখে নিশ্চিত হয়ে নিল আশপাশে আর কেউ আছে কিনা। হঠাৎ পিস্তলের আওয়াজ শোনা গেল। চমকে গেল ওরা। চারপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল আওয়াজটা কোনখান থেকে এসেছে। বোঝা গেল, কেয়ারটেকারের ঘর থেকে। গুলির শব্দ। টেলিভিশনে ছবি চলছে। ভলিউম ঠিকই বাড়ানো আছে, এতক্ষণ ছবির নীরব অংশ চলছিল বলে কোন শব্দ শোনেনি গোয়েন্দারা।
‘নিশ্চয় ওয়েস্টার্ন কিংবা মারামারির ছবি চলছে,’ ফিসফিস করে বলল কিশোর। ‘ভালই হলো। দরজা ভাঙার শব্দ শুনতে পাবেন না।’
শেষবারের মত আরেকবার চারপাশটা দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে।
খেলার মাঠের কিনারে দেয়াল, সেটার কাছে চলে এল তিনজনে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ঠেস দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াল বব, যাতে তার কাঁধে ভর দিয়ে উপরে উঠে যেতে পারে কিশোর। লাফ দিয়ে নামল অন্য পাশে, খেলার মাঠে।
কিশোরের পর দেয়ালে উঠল বব। নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে প্রায় টেনে-হিঁচড়ে তুলল রবিনকে। দু’জনেই লাফিয়ে নামল মাঠে।
রওনা হয়ে গেছে ততক্ষণে কিশোর। স্কুল বাড়ির বাঁ-দিকে। খোয়া বিছানো পথ এড়িয়ে চলছে, শব্দ হওয়ার ভয়ে। মাঠের ঘাসের উপর দিয়ে নিঃশব্দে চলা সহজ। বাঁ-দিকেই রয়েছে সায়েন্স ল্যাবরেটরি। ফিজিকস আর কেমিস্ট্রি ল্যাবের পাশ কাটিয়ে এসে বায়োলজি ল্যাবের সামনে থামল।
প্রয়োজনটা ওদের এখানেই।
সাবধানে ল্যাবরেটরির দিকে এগোল ওরা। ভাগ্য ভালই বলতে হবে। একটা জানালা খোলা পাওয়া গেল। রবিনের মনে পড়ল, শুক্রবার বিকেলে বায়োলজি টিচার ওটা খুলেছিলেন রাসায়নিক পদার্থের বিশ্রী গন্ধ বের করে দেয়ার জন্য। তারপর আর বন্ধ করা হয়নি। নিশ্চয় লাগাতে ভুলে গিয়েছিলেন।
তাতে সুবিধেই হলো ওদের। ঢুকে পড়ল সহজে। ঘরের কোথায় কি আছে ওদের জানা, কাজেই আলো জ্বালানোর ঝুঁকি নিতে হলো না। তা ছাড়া ছাদের স্কাইলাইট দিয়ে চাঁদের আবছা আলো আসছে। তাকে সাজিয়ে রাখা অসংখ্য জারের উপর পড়ে অদ্ভুত ভাবে চমকাচ্ছে সেই আলো। একটা জারের সামনে এসে থমকে গেল বব, যদিও চেনা, তবু এই পরিবেশে ওটাকে দেখে কিছুটা ঘাবড়েই গেল সে। ফরমালডিহাইডে ভেজানো একটা সাপ। দিনের আলোয় একরকম লাগে, রাতে চাঁদের আলোয় লাগছে পুরোপুরি অন্যরকম।
ল্যাবরেটরির পিছন দিকে এগিয়ে গেল ওরা। যা নিতে এসেছিল পেয়ে গেল এখানে।

বাড়ির চিলেকোঠায় বসে পুরানো ছেঁড়া চাদর দিয়ে পোশাক তৈরি করছে মিশা আর ডলি। অদ্ভুত পোশাক।
‘গোল করে কাটা খুব কঠিন,’ মিশা বলল।
সতর্ক করল ডলি, ‘বেশি বড় করে ফেলো না আবার।’
ছোট দুটো গোল ছিদ্র করল মিশা। ‘এবার?’
‘নিচটা এ-রকম করে কাটতে হবে।’ কাঁচি দিয়ে কেটে দেখিয়ে দিল ডলি। ‘দেখে যাতে মনে হয় সত্যি সত্যি।’
গভীর মনোযোগে ওদের কাজ দেখতে দেখতে হঠাৎ ঘাউ করে উঠল টিটু। যেন কি করে কাটতে হবে সে-ও বোঝাতে চাইছে মিশাকে।
মিশা বলল, ‘চুপ থাক। পণ্ডিতি করতে হবে না আর।’

অনিতা তখন ওদের বাড়ির গ্যারেজে বাবার যন্ত্রপাতির বাক্স ঘাঁটছে। হাঁফিয়ে গেছে খুঁজতে খুঁজতে। কালিতে মাখামাখি হাত। যে জিনিস খুঁজছে, পায়নি এখনও।
হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়ার যখন অবস্থা, তখন পাঁচ নম্বর বাক্সটায় পেয়ে গেল ওগুলো। চওড়া হাসি ফুটল মুখে। নিঃশ্বাস ফেলল বড় করে।
চারটে লম্বা লম্বা শিকল বের করে আনল। নিয়ে গিয়ে বসল ওয়ার্ক-বেঞ্চে। রঙ করতে হবে এখন ওগুলোয়।

খুব স্বাভাবিক চেহারা করে বাবা-মা আর বাবলির সঙ্গে বসে টেলিভিশন দেখছে মুসা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে লধশের সবাই জরুরি কাজে ব্যস্ত হলেও কেবল তারই যেন কোন কাজ নেই। কিন্তু টেলিভিশন দেখতে বসে সবচেয়ে জরুরি কাজটাই করছে সে। বাবলিকে চোখে চোখে রাখছে।
টিভি দেখা শেষ হলে উঠে পড়ল সে। শোবার ঘরে চলল। তার পিছু নিল বাবলি। সিঁড়িতে উঠে উসখুস করতে লাগল।
‘কি, কিছু বলবে?’ জিজ্ঞেস করল মুসা।
‘আচ্ছা, চোরগুলোকে ধরতে পারেনি পুলিশ, না? মুদি দোকানে যারা চুরি করার ফন্দি করেছিল?’
‘না,’ হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মুসা। ‘ধরবে কি? কোন সূত্রই পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘আশ্চর্য! এতই চালাক!’ হাসল বাবলি। হাসিমুখে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে।
কোনমতে রাগ চেপে ঘরে এসে ঢুকল মুসা। দরজায় ছিটকানি লাগিয়ে এসে বসে পড়ল বিছানায়। বালিশে কিল মেরে গায়ের ঝাল কিছুটা কমাল। ওই বাবলি শয়তানটার জন্য যত হেনস্তা তার। নইলে সবাই যখন মজার কাজে ব্যস্ত, সে একলা কিনা ঘরে বন্দি, বিছানায় শুয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। কাল সব চুকেবুকে যাক! তারপর দেখাব মজা! মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে গায়ের জোরে আরেকটা কিল মারল বালিশে।
মন অনেকটা শান্ত হলে বিছানা থেকে উঠল সে। পর্দা টেনে দিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস তার। জানালার কাছে গিয়েই বাগানে চোখ পড়ল, একটা আলোর ঝলক দেখল বলে মনে হলো! প্রথমে ভাবল চোখের ভুল, কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন আবার দেখল তখন আর ভুল বলে উড়িয়ে দিতে পারল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। আবার দেখা গেল আলো। নির্দিষ্ট একটা সময় বিরতি দিয়ে দিয়ে জ্বলতেই থাকল আলোটা। ফিরে এসে ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে আবার জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে।
বাবলি!
নিজের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে টর্চের সাহায্যে সঙ্কেত দিচ্ছে। মর্স কোড!
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। ঘন মেঘের আড়ালে চলে গেছে চাঁদ। তাকে দেখেনি বাবলি।
ওই সঙ্কেত মুসাও বোঝে। বাবলি জানাচ্ছে: আগামীকাল সানডে মার্কেটে দেখা করবি। অপারেশন লধশের ব্যাপারে তখন আলোচনা করব। গুড নাইট। বাবলি।
রাস্তার ওপাশের আরেকটা বাড়িতে জ্বলে উঠল আবার টর্চ। নিনাদের বাড়ি ওটা। মর্স কোডে জবাব দিল নিনা: ঠিক আছে। ন’টায় বাস্কেট স্টলে দেখা হবে। গুড নাইট। নিনা।
বাবলির জানালা বন্ধ হয়ে গেল।
মুচকি হাসল মুসা। বিড়বিড় করে বলল, ‘যেয়ো ওখানে, কপালে দুঃখ আছে তোমাদের!’

এগারো.
গাঁয়ের বাইরে বন্ধুদের সাথে দেখা করল মুসা। সিনেমায় যাবার কথা বলে বাবলিকে ফাঁকি দিয়ে এসেছে সে।
মলিন হয়ে আসছে দিনের আলো। আগে আগে চলেছে কিশোর। তার পিছনে বব আর রবিন, কালো কাপড়ে মোড়া একটা বোঝা বয়ে নিয়ে চলেছে। স্কুলের ল্যাবরেটরি থেকে নিয়ে এসেছে। ডলি আর মিশার হাতে সাদা কাপড়ের দুটো পুঁটলি। তাদের পিছনে মুসা আর অনিতা, ভারি একটা ক্যানভাসের ব্যাগের দুই হাতল ধরে বয়ে নিয়ে চলেছে দু’জনে।
পুরানো মিলটার কাছে এসে কাদা এড়ানোর জন্য মোড় নিয়ে রাস্তা থেকে নেমে বনের ভিতর দিয়ে এগোল।
পুরানো খামার-বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে সূর্য ডুবে গেল। টর্চ জ্বেলে ভিতরে ঢুকল কিশোর। বব আর রবিন বাদে বাকি সবাই ঢুকল ওর সঙ্গে।
ভিতরে ঢুকে অবাক হলো গোয়েন্দারা।
হাত তুলে দেখাল মিশা, ‘দেখো, আগুন জ্বেলেছিল কেউ!’
ঘরের কোণে পড়ে থাকা কয়েকটা টিন দেখাল অনিতা, ‘কাল ওগুলো ছিল না!’
‘নিনা রেখে গেছে,’ কিশোর বলল। ‘বাবলি আসতে পারেনি। তাকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রেখেছে মুসা।’
‘যদি না আসে ওরা?’ ডলির প্রশ্ন।
‘আসবেই। বলেছে যখন আসবে, কিছুতেই না এসে থাকতে পারবে না,’ মুসা বলল।
‘জলদি রেডি হওয়া দরকার আমাদের,’ তাগাদা দিল কিশোর।
কাটা চাদরগুলো খুলল মিশা আর ডলি। দুটো চাদর দেখিয়ে মিশা বলল, ‘এ-দুটো রবিন আর ববের জন্য।’
‘আর এই যে শিকল,’ ক্যানভাসের ব্যাগ খুলে বের করে দিয়ে বলল অনিতা। রূপালি রঙ করেছে, চকচকে। ‘রঙ এখনও ভালমত শুকায়নি। আস্তে করে ধরো।’
ডলি, অনিতা আর মিশাকে নিয়ে উপরতলায় উঠে গেল মুসা। ছাদ যেখানটায় বসে গেছে, সেখান থেকে দূরে রইল।
‘তাড়াতাড়ি করো,’ নিচে থেকে সিঁড়ির মাথায় টর্চের আলো ধরে রাখল কিশোর।
দ্রুত শেষ হয়ে গেল পোশাক পরা। সাদা চাদর পরা চারটে ‘ভূত’কে দেখে হাসি সামলাতে পারল না কিশোর। ভূতগুলোর হাতে আবার একটা করে রূপার শিকল। ‘দারুণ! দারুণ! দেখেই কলজের পানি শুকিয়ে যাবে ওদের!’
ঘর থেকে আবার বেরিয়ে এল সে। বব আর রবিনকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে ঢুকল একটা বড় ঝোপের ভিতরে। কালো কাপড়ে মোড়া জিনিসটা মাটিতে নামিয়ে রেখে বব আর রবিনও ভূত সাজতে আরম্ভ করল। জিনিসটার কালো কাপড়ের মোড়ক খুলল কিশোর। বেরিয়ে পড়ল একটা কঙ্কাল।
‘কাজ শেষ করে আবার চুপে চুপে রেখে আসতে হবে ল্যাবে,’ কিশোর বলল। ‘নইলে বায়োলজি স্যারের ধোলাই আছে কপালে…’
কথা শেষ হলো না। কণ্ঠস্বর কানে এল। নিনা আর বাবলি আসছে।
কঙ্কালটার পাশে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। দুটো টর্চের আলো দেখা গেল। বড়দের বুট পরে পা টেনে টেনে এগিয়ে আসছে বাবলি আর নিনা। কোন সন্দেহ জাগল না ওদের মনে। সোজা এগোল খামারবাড়ির দিকে।
উপর থেকে ওদেরকে ঘরে ঢুকতে দেখল মুসারা। নীরব হাসিতে ফেটে পড়ল চারজনেই।
‘আরি, এই টিনটা এল কোত্থেকে?’ অবাক হয়ে বলল নিনা।
‘আগুনও জ্বেলেছে দেখি!’
‘কার কাজ?’
‘কি করে বলব? আশ্চর্য! লধশরা করেনি। মুসা সারাদিন আমার সঙ্গে ছিল।’
‘এই বাবলি,’ শঙ্কা ফুটল নিনার কণ্ঠে, ‘আমার ভাল্লাগছে না! ভয় করছে!’
ওদের কথাবার্তা শুনে উপরতলার চার ভূতও অবাক। সত্যিই তো, কে টিন এনে ফেলল? আগুন জ্বালল কে? ওরা ভেবেছিল, নিনার কাজ।
দ্রুত হাত চালাল বাবলি। পকেট থেকে নোটটা বের করে ফায়ারপ্লেসের উপর ফেলল।
কাজ শেষ করে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরেছে, এই সময় কানে এল মোটর সাইকেলের শব্দ।

বারো.
পাথরের মূর্তি হয়ে গেল যেন বাবলি আর নিনা।
‘কে আসছে!’ কঁকিয়ে উঠল নিনা।
টর্চ নিভিয়ে একছুটে ঘরের কোণে গিয়ে লুকাল দু’জনে। উপরতলায় ‘ভূতে’রাও অবাক।
ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থেকে হেডলাইটের আলো দেখতে পেল কিশোররা। খামারবাড়ির সামনে গিয়ে থামল একটা মোটরসাইকেল। এঞ্জিন বন্ধ করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল দু’জন লোক।
‘হাতে কি?’ ফিসফিস করে বলল কিশোর।
‘পিস্তল?’ বলল রবিন।
‘উঁহু। বাক্সের মত লাগছে,’ বব বলল।
ভিতরে ঢুকে টর্চ জ্বালল লোকগুলো। চিনতে পেরে অবাক হলো বাবলি, নিনা আর চার ভূত। লোকগুলো চাঁদা সংগ্রহকারী।
দরজা বন্ধ করে দিয়ে এল একজন। তারপর হাসতে লাগল। দু’জনের হাতে দুটো বাক্স। নাড়া দিতে ঝনঝন করে উঠল।
‘আজ একেবারে বোঝাই হয়ে গেছে,’ বলল একজন।
‘মানুষ যে এত গাধা, জানতাম না,’ হাসতে হাসতে বলল দ্বিতীয়জন। ‘চাইলেই দিয়ে দেয়।’
‘হ্যাঁ, যতদিন ওরা বোকা থাকে, আমাদের জন্যই ভালো।’
চুপ করে রয়েছে চার ভূত।
ঘরের কোণে ভয়ে কাঁপছে নিনা আর বাবলি।
টর্চ জ্বেলে বোধ হয় আগুন জ্বালার জন্যই ফায়ারপ্লেসের দিকে এগোল প্রথম লোকটা। বাবলির মেসেজের উপর চোখ পড়তেই থমকে গেল। নিচু হয়ে তুলে নিল কাগজটা। জোরে জোরে পড়ল।
চমকে গেল দ্বিতীয় লোকটা। ‘ঘটনাটা কি?’
‘কি আবার!’ ধমকে উঠল প্রথম লোকটা, ‘আগেই তো বলেছিলাম, জায়গাটা ভাল না! অন্য কোথাও আস্তানা গাড়ি। শুনলে না…’
‘এই দেখো, আরও সিগারেটের টুকরো!’
‘চলো, সময় থাকতে পালাই! আর একটা মিনিটও এখানে না…’
‘আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও! ভেদ করে ফেলেছি রহস্য,’ দ্বিতীয় লোকটার টর্চের আলো গিয়ে পড়েছে ঘরের কোণে ঘাপটি মেরে থাকা নিনা আর বাবলির উপর। ভয়ে মুখ সাদা হয়ে গেছে দু’জনের।
হা-হা করে হেসে উঠল প্রথমজন। ‘সাবধান না হলে খুন হয়ে যাব, না? এসো, এদিকে এসো, জলদি! দেখি, কে খুন হয়।’
সোজা দরজার দিকে দৌড় দিল নিনা আর বাবলি। কিন্তু বেরোতে পারল না। ধরে ফেলা হলো ওদের।
উপর থেকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রয়েছে চার ভূত। বাবলিকে যত অপছন্দই করুক, এখন তার ক্ষতি হবার কথা ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠেছে মুসা। কিন্তু কি করবে বুঝতে পারছে না। কিশোর থাকলে ভাল হতো।
বাইরে থেকে সবই শুনতে পেল কিশোররা। এতিম আর অন্ধদের নাম করে চাঁদা তুলে মানুষকে ঠকাচ্ছে বুঝে লোকগুলোর উপর ভীষণ রেগে গেল।
‘গাঁয়ে গিয়ে লোক ডেকে আনার সময় নেই!’ রবিন বলল।
‘গায়ের জোরেও ওদের সঙ্গে পারব না আমরা,’ আফসোস করল বব।
‘একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়!’ নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে হঠাৎ বলে উঠল কিশোর।

পুরানো দড়ি খুঁজে বের করল লোকগুলো। নিনা আর বাবলিকে বাঁধতে শুরু করল।
নিনার হাতের বাঁধনে শেষ গিঁটটা দিয়ে একজন বলল, ‘ব্যস, হয়েছে, আর ছুটতে পারবে না।’
বাবলিকে বাঁধা শেষ করেছে অন্যজন। ‘গাঁয়ের লোকে তোমাদেরকে খুঁজে বের করতে করতে অনেক দূরে চলে যাব আমরা, বুঝলে।’ ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল লোকটা বাবলির গালে।
একটা কথাও বলল না নিনা কিংবা বাবলি। তর্ক করলে আরও মার খেতে হবে, এই ভয়ে।
দরজার দিকে পা বাড়াল লোকগুলো।
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল নিনা, ‘ভূত! ভূত!’
চমকে ফিরে তাকাল লোকগুলো। ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করল একজন, ‘এই, চেঁচাও কেন? কোথায় ভূত? চালাকির আর জায়গা পাওনি…’
‘ও-ওই যে, ওখানে!’ ছাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে নিনা। চোখ ছানাবড়া।
‘সত্যিই তো! মাগো!’ বাবলিও চিৎকার শুরু করল। ‘ছেড়ে দিন আমাদের! ছেড়ে দিন! দোহাই আপনাদের! ঘাড় মটকে মেরে ফেলবে!’
আবার চিৎকার করে উঠল নিনা। পাগলের মত বাঁধন খোলার চেষ্টা করছে। দেখে মনে হচ্ছে চোখ উল্টে দিয়ে পড়ে যাবে।
উপর দিকে তাকাল লোকগুলো। হাঁ হয়ে গেল। ওরাও দেখেছে। সাদা পোশাকের ঝুল নাচিয়ে নাচানাচি করছে ভূতেরা, হাতে রূপার শিকল।
‘এই, জলদি চলো! কুইক!’ কাঁপা গলায় বলল একজন লোক। ‘জায়গাটা সত্যিই ভালো না!’
দরজায় থাবা পড়ল তিনবার।
স্তব্ধ হয়ে গেল লোকগুলো। পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল। কি করবে বুঝতে পারছে না। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে নিনা আর বাবলি। হঠাৎ চুপ হয়ে গেল, একটা লোককে ছুরি বের করতে দেখে।
‘আমি দরজা খুলছি,’ সঙ্গীকে বলল লোকটা। ‘বিপদ দেখলেই ছুরি চালাব! তুমি আমাকে সাহায্য করবে।’
পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল লোকটা। আস্তে করে ছিটকানি নামিয়ে এক টানে খুলে ফেলল পাল্লা। দরজার বাইরে দাঁড়িয়েছিল কঙ্কালটা। পড়ল একেবারে লোকটার গায়ের উপর। বিকট চিৎকার দিয়ে গা থেকে কঙ্কালটাকে ঠেলে ফেলে দিল লোকটা। লাফ দিয়ে সরে গেল।
আতঙ্কে বাবলি আর নিনার মতই গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে শুরু করল দ্বিতীয়জন।
কঙ্কালটাকে মাটিতে ফেলে আর দাঁড়াল না প্রথমজন। ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। দ্বিতীয়জনও পিছু নিল তার।
বাইরে বেরিয়ে আবার চিৎকার করে উঠল প্রথমজন, ‘সর্বনাশ! চাকা বসে গেছে! দুটো চাকাই লিক! বাবারে, কী ভূতুড়ে জায়গা-গো!’
মোটরসাইকেল ফেলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই বুঝতে পেরেও দ্বিধা করতে লাগল লোকটা। ঠিক এই সময় তার বুক আরও কাঁপিয়ে দিতে ঝোপের ভিতর থেকে ভূতের সাজে বেরিয়ে এল কিশোর, রবিন আর বব। কঙ্কালটাকে দরজায় ঠেস দিয়ে রেখে আবার ঢুকেছিল ঝোপের ভিতরে।
আতঙ্কে রীতিমত কাঁপতে শুরু করল লোকগুলো। মোটর সাইকেলের মায়া কাটাতে দেরি হলো না। এমন দৌড় দিল যেন অলিম্পিক গেমে অংশ নিয়েছে।
ঘরে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। মেঝেতে পড়ে রয়েছে লোকগুলোর টর্চ দুটো। আলো নেভেনি। দেয়ালে আলো-ছায়ার খেলা। মেঝেতে পড়ে আছে হাত-পা বাঁধা বাবলি আর নিনা। ওদের কাছ থেকে সামান্য দূরে কঙ্কালটা। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে চার ভূত।
বাবলি আর নিনার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে ওদের চারপাশ ঘিরে বিচিত্র ভঙ্গিতে নাচানাচি শুরু করল ভূতেরা।
অনিতা গোঙাচ্ছে। যেন কবর থেকে উঠে এসেছে রক্তলোভী ভয়ঙ্কর এক অতৃপ্ত প্রেত।
হঠাৎ চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে ‘ভউ ভউ’ করে উঠল মিশা। ডলি ডেকে উঠল, ‘মিয়াঁওঁ! হিঁ-হিঁ-হিঁ হুঁ-হুঁ-হুঁ হাঁ-হাঁ-হাঁ-হাঁ-হাঁ-হাঁ!’ এমন বিকট চিৎকার করে উঠল রবিন যে কিশোর পর্যন্ত থমকে গেল।
কাঁদতে ভুলে গেছে বাবলি আর নিনা-কান্নার ভঙ্গিতে হাঁ হয়ে রয়েছে শুধু মুখ। কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখ। ভয়ে পাথর হয়ে গেছে।
মুসা আর ববকে কঙ্কালটা তুলে নিয়ে এগোতে দেখে হাত তুলে থামতে বলল কিশোর। বলল, ‘ব্যস, ব্যস, যথেষ্ট হয়েছে। এবার থামো সবাই।’ ভূতের পোশাক খুলে হাসল সে।
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল বাবলি আর নিনা। স্বস্তি তে! ক্ষোভে! দুঃখে! অপমানে!

লধশদের দেয়া তথ্যের সাহায্যে দিন কয়েক পরে পাশের এক শহর থেকে দুই ভুয়া চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করল পুলিশ। মানুষকে ফাঁকি দিয়ে যে টাকা জোগাড় করেছিল, বেশির ভাগটাই রয়ে গেছে। খুব একটা খরচ হয়নি। সেই টাকা চাঁদাবাজদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে এতিমখানায় পাঠিয়ে দিল পুলিশ।
তার পরদিন এসে লধশদের সঙ্গে দেখা করলেন বিশালদেহী ক্যাপ্টেন রবার্টসন। বললেন, ‘কাউন্সিল তোমাদের একটা পুরস্কার দিতে চায়। দেখা করতে বলেছে।’
‘যাব,’ জবাব দিল কিশোর।
‘কি পুরস্কার চাইবে?’
ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে সরে গিয়ে দ্রুত আলোচনা সেরে নিল লধশরা। ফিরে এসে কিশোর বলল, ‘দুটো লিটার-বিন।’
‘লিটার-বিন!’ অবাক হলেন ক্যাপ্টেন।
‘হ্যাঁ,’ মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ‘গাঁয়ের লোকের ময়লা ফেলতে খুব অসুবিধে হচ্ছে। দুটো লিটার-বিন বসিয়ে দিলে ভালো হয়। অসুবিধে আর থাকবে না।’
চুপ করে এক মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইলেন ক্যাপ্টেন। ধীরে ধীরে হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুখে। মাথা ঝাঁকালেন, ‘খুব ভালো জিনিস চেয়েছ। তোমাদের হয়ে আমি নিজে সুপারিশ করব কাউন্সিলকে। চলি এখন, গুড বাই।’

Share.

মন্তব্য করুন