কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনটা ছাড়তে প্রায় একঘণ্টা লেট হয়ে যায়। ঠিক সময় ছাড়লে ট্রেনটা নিঝুমপুর পৌঁছাতে রাত দশটা বেজে যেত। সাধারণত দেরিতে ট্রেন ছাড়লে একটা না একটা কুফা লেগে যায়। পথে পথে নানা সমস্যা হয় প্রচুর, ঝামেলা বাড়ে। এভাবেই নানাভাবে পিছিয়ে পড়তে থাকে রেলগাড়িটা। মহিন এর আগেও তেমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে অনেকবার। আজও তার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। তবে আজকের ট্রেনটি লেট করার ক্ষেত্রে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে। বিরক্তির চরমে পৌঁছে গেছে সে।
মুহিনের ইচ্ছে করে ট্রেন থেকে নেমে পড়ে পথে কোথাও, অচেনা স্টেশনে।
কিন্তু কোথায় নামবে সে? নেমে কী করবে?
আজ রাতে তার নিঝুমপুরে পৌঁছানোর কথা। আগে কোনো সময়ে নিঝুমপুর যায়নি সে।
বহু দিনের পুরনো নিঝুমপুর রেলস্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে কিছুদিন আগে। এখন আর কোন রেলগাড়ি এখানে থামে না। নিঝুমপুর স্টেশন এক সময় বেশ জমজমাট ছিল। প্রতিদিন কত ট্রেন এখানে থামতো। শত শত যাত্রী ওঠানামা করতো। রাতদিন বেশ জমজমাট থাকতো গোটা স্টেশন। যোগাযোগব্যবস্থার নানা পরিবর্তনের কারণে নিঝুমপুর স্টেশনের যাত্রীসংখ্যা কমে যাওয়ায় এক সময় রেল কর্তৃপক্ষ এই স্টেশনের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে।
এখন জনমানবশূন্য বিরান অবস্থায় পড়ে থাকে এক সময়ের প্রাণচঞ্চল ব্যস্ত এই স্টেশন এলাকা। এই স্টেশনকে ঘিরে অনেক কিংবদন্তি, নানা চাঞ্চল্যকর কাহিনী শোনা যায়। একবার সিগন্যালম্যানের মারাত্মক ভুলের কারণে এই স্টেশনে দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল। অনেক লোকজন মারা গিয়েছিল সেই দুর্ঘটনায়। আর একবার নিঝুমপুর স্টেশন ছেড়ে যাবার আগে একটি ট্রেনে আগুন ধরে গিয়েছিলো। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিল না সেই ভয়াবহ আগুন। ট্রেনটা থামাতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছিলেন ড্রাইভার। কয়েক মাইল এভাবে ভয়াবহ আগুন নিয়ে ট্রেনটা ছুটতে ছুটতে নকশি নদীর ওপর ব্রিজ থেকে নিচে পানিতে পড়ে গিয়েছিল। হতভাগ্য যাত্রীদের অনেকের লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি তখন। উদ্ধারকারী দলের লোকজন নদীতে নেমে বহু খোঁজাখুঁজি করেও বারবার ব্যর্থ হয়েছে। এ ধরনের বেশ কিছু রহস্যজনক অস্বাভাবিক অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে নিঝুমপুর রেলওয়ে স্টেশন।
রেল কর্তৃপক্ষ স্টেশনটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার পর এখন তেমন কারও পদচারণা নেই এখানে। দিনের বেলায় গ্রামের ক্লান্ত রাখাল অথবা কোন পথচারী এখানে বসে বিশ্রাম নেয় মাঝে মধ্যে। তা না হলে জনমানবশূন্য নীরব নিঃসঙ্গ সুনসান অবস্থায় পড়ে থাকে নিঝুমপুর স্টেশন। কুঁউ ঝিক ঝিক করে সারা দিন কতো ট্রেন এ পথ দিয়ে ছুটতে ছুটতে চলে যায়। কিন্তু কোন ট্রেন থামে না, কোন যাত্রীও ওঠানামা করে না এখানে।
সন্ধ্যা নামতেই এখন ভুতুড়ে পরিবেশ আরও জাঁকিয়ে ধরে গোটা স্টেশন এলাকায়। এখানে রাতের অন্ধকারে ভূত আর প্রেতাত্মারা হাঁটাচলা করে, নানা কাণ্ডকীর্তি করে বলে এখন লোকমুখে বিচিত্র গল্প কাহিনী শোনা যায়। বহু আগে থেকেই নিঝুমপুর স্টেশনটা ভূত প্রেতদের আস্তানা ছিল। এখানে রেলস্টেশন হওয়ায় ভূত প্রেতরা মহাবিরক্ত হয়। তারাই বিভিন্ন সময়ে ট্রেন অ্যাকসিডেন্টের ঘটনা ঘটায়। ট্রেনে আগুন লাগার ঘটনাগুলো তারাই ঘটিয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। যে সিগন্যালম্যানের ভুলের কারণে দু’টি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়ে অনেক যাত্রী প্রাণ হারিয়েছিল সেই মানুষটি ঐ দুর্ঘটনার পর পাগল হয়ে গিয়েছিলো। দিনরাত স্টেশনে বসে থাকতো। আবোল-তাবোল নানা কথা বলতো। সেই বলেছিল, এই রেলস্টেশনে ভূত পেত্নীর আড্ডা আছে, তারা রাতদিন এখানে ঘুরে বেড়ায়, কেউ তাদের না দেখলেও সে ঠিকই তাদের আনাগোনা দেখতে পায়। তারাই গভীর রাতে ভুল সিগন্যাল দিতে অদ্ভুত সব কাণ্ড করেছিল। অনেক চেষ্টা করেও ভূতের আছর থেকে মুক্ত হতে পারেনি সে। তার কারণে এতোগুলো মানুষ প্রাণ হারালো অনুশোচনার আগুনে জ্বলে পুড়ে লোকটা উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলো। একদিন ভোরে নিঝুমপুর স্টেশনের আউটার সিগন্যালের কাছে বড় আমগাছের ডালে পাগল হয়ে যাওয়া সিগন্যালম্যানের ঝুলন্ত মৃতদেহটা পাওয়া গিয়েছিল। প্রথমে অনেকেই মনে করেছিলো পাগল মানুষটা হয়তো আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু হাসপাতালে নেয়ার পর ময়নাতদন্ত করে ডাক্তাররা যে রিপোর্ট দেন তাতে দেখা যায়, কেউ তাকে মেরে আমগাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখেছিল। কারা পাগল হয়ে যাওয়া সিগন্যালম্যানকে মেরেছে সেই রহস্যের কূলকিনারা করতে পারেনি তদন্তকারী পুলিশ। মারা যাবার আগে লোকটা কেবলই বলতো, ‘অ্যাকসিডেন্টে যারা মরছে, তারা সবাই আমারে রাইতে মারতে আসে। গলা টিপ্পা ধরে, আমি শ্বাস নিতে পারি না, তাগো একেক জনের চেহারা ভূতের মতো, দেখলেই ভয়ে বুকের ভেতরটা শুকাইয়া যায়। ওরাই আমারে আর বাঁচতে দিবো না, অনেক বার বলছে। ওরা নাকি আমাকে চরম শাস্তি দিবো বলছে।’
পাগল হয়ে যাওয়া সিগন্যালম্যানকে কোনো মানুষ খুন করেনি। ভূত প্রেতের হাতে তার মৃত্যু হয়েছে-লোকমুখে এ নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা চলেছে বেশ কিছুদিন। রেলওয়ে পুলিশসহ স্থানীয় থানা এ বিষয়ে অনেক তদন্ত অনুসন্ধান করেও কোন কিছু সুরাহা করতে পারেনি। পাগল হয়ে যাওয়া সিগন্যালম্যানের মৃত্যুটা রহস্যের বেড়াজালে রয়ে গেছে।
এর পরেও এই রেলওয়ে স্টেশনের আরও কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে নানাভাবে। প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনায় অদ্ভুত সব রহস্যময় ব্যাপার ঘটেছে। যার কূলকিনারা করতে পারেনি কেউই।
সেই থেকে নিঝুমপুর রেলওয়ে স্টেশনটাকে অভিশপ্ত এক জায়গা বলে ধরে নিয়েছে এ এলাকার মানুষজন। রেলগাড়ির স্টপেজ না থাকায় স্টেশনের অফিসিয়াল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এর পর থেকে এখানে পারতপক্ষে কেউ আসে না। সবার আশঙ্কা, নিঝুমপুর স্টেশনে পা দিয়ে আবার কোন বিপদ আপদে পড়ে না বসে।
নিঝুমপুর রেলওয়ে স্টেশনের নানা রহস্যময় অলৌকিক ঘটনাবলি নিয়ে একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতেই মুহিন সেখানে যাচ্ছে। কাজ করে সে দেশের একটি জনপ্রিয় দৈনিকে। এর আগেও তেমনি কিছু অনুসন্ধানী রিপোর্টের কারণে তরুণ সাংবাদিক মুহিন খান বেশ আলোড়ন তুলেছে। বিভিন্ন জনের কাছে নিঝুমপুর রেলওয়ে স্টেশনের নানা ঘটনার গল্প কাহিনী শুনে সে নিজেই উৎসাহী হয়েছে ওখানে গিয়ে নিজের চোখে সব কিছু দেখেশুনে একটা এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট লেখার ব্যাপারে।
নিঝুমপুর স্টেশন থেকে দু’মাইল উত্তরে বালিগাঁওয়ে মুহিনের এক বন্ধু রতন থাকে। ওখানে একটা এনজিওতে চাকরি করে সে। সে-ই চম্পানগর স্টেশনে হোন্ডা নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে।
নিঝুমপুর স্টেশনের পরেই চম্পানগর। ওখানে ট্রেন থামে। মুহিনকে স্টেশন থেকে নিজের বাসায় নিয়ে যাবে রতন। ওখানে রাতটা থাকবে। পরদিন সকাল থেকে পরিত্যক্ত নিঝুমপুর রেলওয়ে স্টেশনে অপারেশন চালাবে মুহিন। সঙ্গে থাকবে রতন। স্থানীয় আরও কয়েকজনকে সঙ্গে রাখতে বলেছে মুহিন। যারা অতীতে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা সম্পর্কে বলতে পারবে।
একটা চাঞ্চল্যকর এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট করার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে নিঝুমপুরে যাচ্ছে সে। রতনের সঙ্গে মুহিনের বেশ কয়েকবার মোবাইলে কথা হয়েছে। ট্রেন লেটের ব্যাপারটা মুহিন জানিয়েছে রতনকে। ট্রেনটা চম্পানগর পৌঁছাতে রাত বারটা হয়ে যেতে পারে- জানিয়েছে মুহিন। রতন জানিয়েছে, যত গভীর রাতেই ট্রেন চম্পানগর স্টেশনে পৌঁছাক সে হোন্ডা নিয়ে মুহিনের জন্য অপেক্ষা করবে। এ কারণে ততোটা টেনশনে ভুগছে না মুহিন।
আর বেশি সময় নেই। আধা ঘণ্টার মধ্যে ট্রেনটা চম্পানগর পৌঁছবে। ট্রেনের একজন কর্মচারীর কাছ থেকে জানার পর মুহিন আবার তার বন্ধু রতনের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও রতনকে টেলিফোনে ধরতে পারে না।
কিছুুক্ষণ আগেও মোবাইলের ভালো নেটওয়ার্ক ছিল। বেশ ভালোভাবেই মোবাইলে কথা বলেছে সে বিভিন্নজনের সঙ্গে। মোবাইলের নেটওয়ার্ক হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা খানিকক্ষণের জন্য হলেও মুহিনকে ভাবিয়ে তোলে, কিছুটা আনমনা হয়ে পড়ে সে।
এ সমস্যা তেমন গুরুতর না হলেও আগামীতে বড় কোনো বিপদের আগাম সঙ্কেত দিচ্ছে না তো- ভ্রু কুঁচকে চিন্তা করতে থাকে সে।
হঠাৎ ট্রেন একটা স্টেশনে থেমে যায়। মুহিন ভাবে চম্পানগর এসে গেছে। এখানেই তো তাকে নামতে হবে। কিছু না ভেবেই হাতের ব্যাগটা নিয়ে দ্রুত ঝটপট নেমে পড়ে সে স্টেশনে।
এতো রাতে ট্রেনে তেমন যাত্রী নেই। সে একাই নামে স্টেশনে।
অবাক ব্যাপার, মুহিন ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমে পড়তেই ওটা সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেয়।
অন্ধকার স্টেশনে দাঁড়িয়ে ট্রেনটার দ্রুত চলে যাওয়া দেখে মুহিন। ট্রেনটা চলে যাবার পর হঠাৎ করে সম্বিত ফিরে পায় মুহিন। একটা নীরব, সুনসান, অন্ধকার স্টেশনে জনমানবহীন পরিবেশে নিজেকে আবিষ্কার করে ভীষণ অবাক হয় সে। সে ছাড়া এই রেলস্টেশনে আর কেউ নেই। ব্যাপারটা তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়।
এমন তো হবার কথা নয়। তার বন্ধু রতনের পাত্তা নেই। সে তো হোন্ডা নিয়ে এখানে থাকার কথা। রেলওয়ে বিভাগের কোনো লোকজনও নেই স্টেশনে। পয়েন্টসম্যান, সিগন্যালম্যান এমনকি স্টেশন মাস্টারকেও দেখা যাচ্ছে না অন্ধকার স্টেশনের কোথাও। খটকা লাগে মুহিনের মনে।
পুরো স্টেশনজুড়ে ঘন অন্ধকার ছড়িয়ে আছে। অনেক কষ্টে একটু এগিয়ে গিয়ে স্টেশনের সাইনবোর্ডটা পড়ে চমকে ওঠে মুহিন। সাইনবোর্ডে লেখা আছে, নিঝুমপুর। এখানে তো ট্রেন থামে না!
পরের স্টেশন চম্পানগরেই নামার কথা তার। হঠাৎ ট্রেনটা থেমে পড়ায়, অন্ধকারে কিছু না দেখে হুট করে নেমে পড়েছিল মুহিন। মোবাইল নেটওয়ার্কের চিন্তায় কিছুটা আনমনা ছিল সে তখন। আনমনা থাকার কারণেই কিছু না দেখে, না বুঝে হুট করে নেমে পড়াটাই মারাত্মক ভুল হয়েছে- এটা উপলব্ধি করতেই ভয়ে আতঙ্কে মুহিনের সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে।
এই পরিত্যক্ত নিঝুমপুর রেল স্টেশনে বন্ধু রতনসহ আগামীকাল সকালে আসার কথা তার। এই মুহূর্তে সে কী করবে, হঠাৎ করে বুঝে উঠতে পারে না। পুরো স্টেশনজুড়ে গা ছমছম করা ভুতুড়ে পরিবেশ। গাঢ় অন্ধকার ছেয়ে আছে পুরো এলাকাজুড়ে। মস্ত বড় একটা ভুল করে ফেলেছে সে। যার মাশুল দিতে হবে এখন তাকে। নিজের ভুলের জন্য মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে মুহিনের।
পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে বন্ধু রতনকে ফোন করতে গিয়ে অবাক হয় মুহিন। অফ হয়ে আছে মোবাইলটা। সে তো মোবাইলটা অফ করেনি। অন করার জন্য বোতাম টেপাটেপি করতে থাকে সে। নাহ, কোনোভাবেই অন করতে পারে না সে তার মোবাইলটা। ফুল চার্জ করে এনেছিল। ব্যাটারিটাও বেশ নতুন- এ অবস্থায় মোবাইল ফোনটা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা মুহিনকে বেশ ঘাবড়ে দেয়।
পর পর বেশ অনেকগুলো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে গেছে কিছুক্ষণের মধ্যে। কোনটিই মুহিনের কাম্য নয়। বরং একটা ভয়াবহ বিপদের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে সে, এটা উপলব্ধি করতেই তার মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের ঠাণ্ডা শীতল স্রোত বয়ে যায়।
শো শো বাতাসের শব্দ ছাড়া এখন আর কিছুই নেই পরিত্যক্ত এই রেলস্টেশনে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে এদিকে-ওদিকে তাকায় মুহিন। নাহ, এখানে এতো রাতে কারও থাকার কথা নয়। তারপরও হঠাৎ কারো ছায়ামূর্তিকে ওপাশে বড় একটা গাছের নিচে এ পাশ থেকে ওপাশে সরে যেতে দেখে সে। ভয়ে মুহিনের সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে।
কিছুুক্ষণ আগে নিঝুমপুর স্টেশনে ভুল করে নেমে পড়লেও তার কেন জানি মনে হয় অদৃশ্য কোনো শক্তির অশুভ ঈঙ্গিতেই ট্রেনটা স্টপেজ না হলেও বন্ধ হয়ে যাওয়া এই পরিত্যক্ত রেলস্টেশনে হঠাৎ থেমে পড়েছিল। তার আনমনা হয়ে পড়াটাও সেই অদৃশ্য অশুভশক্তির প্রভাবেই ঘটেছে। নিঝুমপুর স্টেশন নিয়ে লোকমুখে শোনা অদ্ভুত গল্প কাহিনীগুলো এতদিন নিছক কল্পকথা ভেবে এসেছে মুহিন। এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই, কিছু মানুষ হয়তো তাদের স্বার্থ উদ্ধারে এসব কল্পকাহিনী ছড়াচ্ছে- এসব বিষয় অনুসন্ধান করে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের জন্য মুহিন ঢাকা থেকে এখানে এসেছে। কিন্তু নিঝুমপুর রেলস্টেশনে পা রাখার অনেক আগে থেকেই ধারাবাহিকভাবে একের পর এক যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তা নিয়ে দ্রুত ভাবতে লাগলো।
কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়তে এক ঘণ্টা লেট হওয়া, পথে পথে নানা স্টেশনে থেমে আরও লেট করা, হঠাৎ মোবাইল নেটওয়ার্ক আউট অফ রিচ হয়ে যাওয়া, না থামার কথা থাকলেও নিঝুমপুর স্টেশনে ট্রেনটা বিনা নোটিশে থেমে পড়া, আনমনা হয়ে নির্জন পরিত্যক্ত অন্ধকার স্টেশনে তার নেমে পড়া এবং মোবাইল ফোনটা অকেজো হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবতে গিয়ে মুহিন টের পায় প্রতিটি ঘটনা বিচ্ছিন্ন মনে হলেও এগুলো আসলে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। একটির সঙ্গে কোথায় যেন আরেকটির যোগসূত্র রয়েছে।
একসঙ্গে এতগুলো বিষয় নিয়ে ভাবতে গিয়ে কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিল মুহিন। হঠাৎ সামনে কিছুদূরে রেললাইনের পাশে প্ল্যাটফর্মে মাথায় ঘোমটা দেয়া এক মহিলাকে এক মনে ঝাড়– দিতে দেখে অবাক হয়ে যায় সে। কিছুক্ষণ আগেও তো মহিলাকে স্টেশনে কোথাও দেখা যায়নি। তার ঝাড়– দেয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, দীর্ঘ সময় ধরে সে এখানে ঝাড়– দিচ্ছে।
হঠাৎ করে এই নির্জন রেলস্টেশনে মহিলা এলো কিভাবে। আর এতো গভীর রাতে এই পরিত্যক্ত রেলস্টেশনে ঝাড়– দিয়েই বা কী লাভ? ব্যাপারটা অদ্ভুত রহস্যময় মনে হয় মুহিনের। মহিলার কাছ থেকে সমস্ত প্রশ্নের জবাব জেনে নেয়া যায়। তার দিকে এগোতে গিয়ে মনে মনে বেশ চমকে ওঠে মুহিন। যাকে সে ওখানে ঝাড়– দিতে দেখেছে সে কি আসলেই জীবন্ত কোনো নারী? নাকি নারীর বেশ ধরে আসা কোনো অশরীরী? কথাটা ভাবলেও মুহূর্তেই তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে সাহস করে মুহিন এগিয়ে যায় মহিলার দিকে।
‘এই যে শুনছেন, আপনি কে, এতো রাতে এখানে কী করছেন?’ মুহিন কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে।
‘আমি কে, তোমার জানার দরকার নাই, দেখছো না আমি পরিষ্কার করছি, এখানে অনেক মানুষের রক্তের দাগ, আমি সেগুলো পরিষ্কার করছি।’ মাথা না তুলে ঝাড়– দিতে দিতে ঘোমটার আড়ালে থেকে অদ্ভুত ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে জবাব দেয় মহিলাটি।
‘রক্তের দাগ? কোথায়? আমি তো কিছুই দেখছি না?’ মুহিন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
‘তুমি এখানে এতো রাতে কেন এসেছ, জানো না তুমি কোথায় এসেছে, তাড়াতাড়ি পালাও এখান থেকে। তা না হলে ওরা তোমাকে শেষ করে ফেলবে, এটা একটা অভিশপ্ত জায়গা, এখানে এত রাতে কোন মানুষ আসে নাকি? একই ভঙ্গিতে ঝাড়– দিতে দিতে কথাগুলো বলে ঐ মহিলা। তার কণ্ঠে মহাবিরক্তির ঝাঁঝ অনুভব করে মুহিন।
‘আমি ভুল করে ট্রেন থেকে এই স্টেশনে নেমে পড়েছি, এখন এতো রাতে কোথায় যাবো?’ মুহিন বলে।
‘কে বললো, তুমি ভুল করে এখানে নেমেছ। তুমি তো এখানেই আসার জন্য ট্রেনে চড়েছিলে, মিথ্যে কথা বলবে না, মিথ্যে বললে ধরা পড়ে যাবে এখানে।’
মহিলার এবারের কথায় বেশ ভড়কে যায় মুহিন। অবস্থা সুবিধের মনে হচ্ছে না। সে যা আশঙ্কা করছিল সেটাই ঠিক। এই ঝাড়–দার মহিলার চেহারা দেখা না গেলেও সে কোন রক্ত মাংসের মানুষ নয়, অশরীরীদের মধ্যে কেউ হবে- সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যায়। দ্রুত অনেক কিছু চিন্তা করতে থাকে সে।
মুহূর্তের মধ্যে প্ল্যাটফর্ম থেকে মহিলা অদৃশ্য হয়ে যায়। আশপাশে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোথাও কাউকে দেখা যায় না তাকে। এ ঘটনায় মুহিন আরও অনেক বেশি ভয় পেয়ে যায়। তার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। এ সময় আশপাশে কোথাও নিশাচর কোনো পাখি অদ্ভুত শব্দ করে ডাকতে থাকে। ভয়ে আতঙ্কে শরীর কাঁপতে থাকে মুহিনের।
হঠাৎ স্টেশনের একটা রুমে আলো জ্বলতে দেখে সে। এখানে তো কারও থাকার কথা নয়। তাহলে আলো জ্বলছে কেন?
আলোর উৎস খুঁজতে মুহিন স্টেশনের ঐ ঘরের দিকে ছুটে যায়। কিন্তু ছুটতে গিয়ে অবাক হয় সে। প্রাণপণে শক্তিতে ছুটতে চাইলেও সে দৌড়াতে পারে না। পা দুটোর ওজন হঠাৎ অনেক বেড়ে গেছে। ছোটা তো দূরের কথা হাঁটতেও তার কষ্ট হচ্ছে। কিছুদূর গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় সে। তখনই তার সামনে গেরুয়া রঙের কাপড় পরা কাউকে দেখতে পায় মুহিন।
বেশ লম্বা মতো লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে তিন চারগুণ লম্বা সাইজের মানুষটা তাকিয়ে আছে সরাসরি তার দিকে। তার দু’চোখে আগুন জ্বলছে। তবে শীতল দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। মুখের চেহারা ক্ষত-বিক্ষত, মাংস খুলে খুলে পড়ছে। বীভৎস চেহারার মানুষটি কিছু বলে না তাকে। মুহিন আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। ভয় পেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে আসে। কিন্তু পিছু হটতেই পেছনে অন্য কারো উপস্থিতি অনুভব করে সে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই সাদা শাড়ি পরা এক নারীমূর্তিকে দেখতে পায়। সামনে দাঁড়ানো বিশাল আকৃতির পুরুষমূর্তির মতো তার শরীরের গঠন না হলেও তার চেহারাও বীভৎস। সারা মুখে ক্ষত, চুলগুলো ধবধবে সাদা, একটা চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে পড়েছে। মহিলার বীভৎস চেহারা দেখে মুহিন আরও বেশি ভয় পেয়ে যায়। এত বীভৎস, ক্ষত-বিক্ষত চেহারা হলো কিভাবে, ওরা কি আসলে জীবন্ত কেউ- মনে মনে ভাবতে থাকে সে।
তখনই অদ্ভুত ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে মহিলা বলতে থাকে, ‘তুমি মনে মনে ভাবছো আমরা কারা, তুমি তো এই অভিশপ্ত রেলস্টেশনের কথা জানতে এসেছ। দেখো, আমরা এই স্টেশনের প্রাচীন পাহারাদার। তোমরা বলো দুষ্টু জ্বিন। আমাদের সবার অতৃপ্ত আত্মা প্রতিশোধ নিতে এখন রাতদিন ঘুরে বেড়ায় এখানে। সব ঘটনাই কেউ জানে, আবার কেউ জানে না। আমাদের মতো অতৃপ্ত আত্মাদের প্রতিশোধের শিকার হয়েছে তারা, সেই সিগন্যালম্যান পাগল হয়ে গিয়েছিল। আমরাই আমগাছে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরেছি তাকে, তার ভুল সিগন্যালের কারণেই তো দুটো ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিলো, শত শত মানুষ মারা গিয়েছিল। অবশ্য ঐ সিগন্যালম্যানের মাথা খারাপ করে দিয়েছিল এই স্টেশনে থাকা কিছু দুষ্ট আত্মা, তারাই এ জন্য দায়ী। ওরাও নানা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটায় এখানে। ওরা বেশ শক্তিশালী। তাদের সঙ্গে আমাদের অনেক সময় যুদ্ধ হয়। এখন ওরাও তাছে এই স্টেশনে। আজও ভয়ঙ্কর কিছু ঘটনা ঘটবে এখানে, তুমি শিগগির পালাও, তা না হলে মারা পড়বে, কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না, ঐ তো ওরা এসে গেছে।
হঠাৎ করেই তখন ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে। স্টেশনে অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে আসে। আশপাশে এখন কাউকে দেখতে পায় না মুহিন। এতক্ষণ যে নারীমূর্তি কথা বলছিলো তাকেও দেখা যায় না। সেও অদৃশ্য হয়ে গেছে। জীবনে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে মুহিন। কিন্তু আজকের এমন পরিস্থিতিতে কখনও পড়েনি। মায়ের কাছে, দাদী-নানীর কাছে ছোটবেলায় অনেক ভূতের গল্প শুনেছে সে। বেশ কিছু হরর মুভিও দেখেছে সে সিনেমা হলে। গা ছম ছম করা বিভিন্ন ঘটনা আর দৃশ্য দেখে তখন শিহরিত হলেও পরক্ষণেই ভয় চলে গেছে মন থেকে। সিনেমার পর্দায় দেখে ভূত প্রেতদের গল্পগুলো বানোয়াট মনে হলেও এই মুহূর্তে সে তেমনি বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। নিঝুমপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে নামার পর একের পর এক অবিশ্বাস্য এবং শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনা ঘটছে। তেমন ঘটনার কথা এতদিন লোকমুখে শুনলেও নিজে কখনও তেমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি।
অদ্ভুত শো শো শব্দে ঝড়ো হাওয়া বইছে নিঝুমপুর স্টেশনজুড়ে। কালবৈশাখীর ঝড়, টর্নেডোর মতো গাছপালা বাড়িঘর যেমন ভেঙেচুরে তোলপাড় করতে চাইছে কেউ। অনেক কষ্টে দৌড়ে স্টেশনের মধ্যে ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত একটি রুমে আশ্রয় নেয় মুহিন।
অন্ধকার ঘরের মধ্যে কিছুই দেখা যায় না। এখানে কারও থাকার কথা নয়। হঠাৎ সে লক্ষ্য করে ঘরের মধ্যে কেউ যেন কান্নাকাটি করছে। মেয়েলি কণ্ঠের কান্না ক্রমেই আরও স্পষ্ট হয়। এ ঘরে কে কাঁদছে এতো রাতে, মুহিন ভাবতে থাকে। একবার কার কাছে যেন সে শুনেছিলো, যেসব দুষ্ট জ্বিন পিশাচ হয়ে যায় তারা গভীর রাতে ঘুরে বেড়ায় কবরস্থান আর শ্মাশানঘাটের আশপাশে। কখনও কুকুর বেড়ালের বেশে ঘুরে বেড়ায়। ঐ সময় ওখানে কোনো জীবিত মানুষকে পেলে তার ওপর চড়াও হয়। এভাবে কতো মানুষ প্রাণ হারায় পিশাচদের কবলে পড়ে তার হিসাব নেই।
হঠাৎ নাকে অদ্ভুত বিশ্রী বোঁটকা গন্ধ লাগতেই মুহিনের গা গুলিয়ে আসে। বমির উদ্রেক হয়। এ গন্ধটা তার কাছে বেশ অপরিচিত মনে হয়। গন্ধের উৎস কোথায় জানতে কৌতূহলী হলেও ভয়ে আতঙ্কে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে আছে সে। তার নড়াচড়া করার শক্তি কে যেন জোর করে কেড়ে নিয়েছে।
মেয়েলি কণ্ঠের কান্নাটা থেমে গেছে ততক্ষণে। তার বদলে অদ্ভুত খল খল শব্দে হাসছে যেন কেউ। হাসির শব্দ এতটা ভয়াবহ হতে পারে- আগে কোনোদিন শোনেনি মুহিন। বাইরে তোলপাড় হচ্ছে প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ায়। মাঝে মাঝে পুরো স্টেশনটাই কেঁপে উঠছে।
হঠাৎ বাতাসের তোড়ে রুমের জানালা খুলে যায়। জানালার বাইরে এতো অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। ভয়ে মুহিন বাইরের দিকে তাকায় না। হঠাৎ শুনতে পায়, কিন্তু কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকছে খুব কাছ থেকে। তখনই কৌতূহলী হয়ে জানালার বাইরে তাকায় মুহিন। কাউকে দেখা যায় না ওখানে। পর পর আবারও বেশ কয়েকবার মুহিন সেই ডাক শুনতে পায়।
এখন রাত কত কে জানে। হাতে ঘড়ি পরে না মুহিন। মোবাইলটা চালু থাকলে সময়ের ধারণা নেয়া যেত। ট্রেন থেকে নামার পর কতটা সময় পেরিয়েছে, তার হিসাব করতে থাকে সে। সেই হিসাব মতো এখন রাত দুটো বাজতে পারে। তার মানে রাত শেষে ভোর হতে আরও ম্যালা সময় বাকি রয়েছে। এই নিঝুমপুর স্টেশনে রাতের বিভীষিকা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। এরপর আর কী ঘটতে পারে, ভাবতে গিয়ে কিছুটা আনমনা হয়ে পড়ে মুহিন।
হঠাৎ ঘাড়ের কাছে কারো স্পর্শ টের পেতেই ভয়ে আতঙ্কে লাফ দিয়ে ওঠে মুহিন। ঘাড় ফেরাতেই দেখে দুটি চোখ জ্বল জ্বল করছে। আগুন জ্বলছে যেন ঐ দুটি চোখে। দিগি¦দিকশূন্য হয়ে পড়ে সে। ঐ রুম ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ আগে কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকছিল। তাই স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বেরিয়ে পড়তেই প্রচণ্ড ভয় আবার গ্রাস করে তাকে। শরীরের সমস্ত শক্তি একসঙ্গে জড়ো করে ছুটতে শুরু করে সে। ছুটতে ছুটতে আউটার সিগন্যালের দিকে এগিয়ে যায়। আউটার সিগন্যালের কাছে বড় আমগাছটার সামনে এসে হঠাৎ থেমে পড়ে মুহিন। ধবধবে সাদা কাপড় পরা কাউকে দেখা যাচ্ছে। গাছের উঁচু একটা ডালে কেউ যেন ঝুলছে। তার সাদা শরীর কাফনের কাপড়ে ঢাকা। মুখটা দেখা যায়। অন্ধকারে সেই মুখটা স্পষ্ট দেখা যায় না।
তখন হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করে আকাশে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঝড় বৃষ্টি শুরু হবে আরও জোরেশোরে। তারই আলামত দেখা যাচ্ছে। মুহিন তাকিয়ে আছে বড় আমগাছটার দিকে। সাদা কাফনে ঢাকা কারও মৃতদেহ ঝুলছে গাছের উঁচু ডালে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘন ঘন। তার আলোতে এবার গাছে ঝুলতে থাকা মৃতদেহের মুখটা স্পষ্ট দেখতে পায় সে। মাঝবয়সী একটা মানুষের মৃতদেহ ওটা। সারা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, মৃতদেহটার চোখ দুটো বোজা এবং মুখ বন্ধ থাকলেও মাঝে মধ্যে দেখা যাচ্ছে তার জিহ্বা অনেকখানি বেরিয়ে এসেছে। তার চোখ দুটো খোলা, বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে লোকটা। ভয়াবহ এ দৃশ্যটি দেখে ভয়ে মুহিনের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। দম নিতে পারে না। পানির পিপাসায় বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে।
হঠাৎ একটা ট্রেন আসার শব্দ শুনতে পেয়ে কান খাড়া করে মুহিন। সে রেললাইনের দিকে তাকায়। পূর্ব দিক থেকে একটা ট্রেন আসছে এ দিকে। ট্রেনটা দ্রুতগতিতেই আসছে এ দিকে। বেশ আশাবাদী হয়ে ওঠে মুহিন। এই বিভীষিকাময় অবস্থা থেকে এবার হয়তো রক্ষা পাওয়া যাবে।
ট্রেনটি কাছাকাছি আসতেই মুহিন লক্ষ্য করে, কোনো আলো জ্বলছে না ট্রেনটাতে। আলো না জ্বালিয়ে ড্রাইভার রাতের অন্ধকারে রেললাইনের ট্র্যাক ধরে ওটা চালাচ্ছে কিভাবে? ব্যাপারটা তার কাছে অদ্ভুত মনে হয়।
এক সময় ট্রেনটা এসে নিঝুমপুর স্টেশনে থামে। মুহিন ছুটে গিয়ে একটা বগিতে চড়ে। যেখানেই যাক না কেন ট্রেনটা, এই নিঝুমপুর স্টেশন ছেড়ে তো যেতে পারবে। এখানকার ভয়ঙ্কর পরিবেশ থেকে তো বাঁচতে পারবে- তেমন আশায় খালি একটা সিট দেখে বসে পড়ে। অন্ধকারে সব কিছু স্পষ্ট দেখা না গেলেও ট্রেনের বিভিন্ন সিটে কিছু কিছু যাত্রী বসে আছে- দেখতে পায় মুহিন। অনেকটা হাঁফ ছেড়ে যেন বাঁচে সে।
মুহিন যে সিটে বসেছে তার মুখোমুখি সিটে একজন যাত্রী বসে আছে। লোকটার চেহারা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারে। তারপরও অনেকটা আন্তরিক সুরে তার কাছে মুহিন জানতে চায় ‘ভাই, এ ট্রেনটি কোথায় যাবে? আপনি কোথায় নামবেন?’
তার প্রশ্নের জবাবে প্রথমে কিছু বলে না লোকটি। মুহিন লোকটার আচরণে কিছুটা অবাক হয়। সে উঠে গিয়ে অন্য একটি সিটে বসে। পাশেই একজন যাত্রী বসে আছে। তার মতোই কম বয়সী একজন যুবক।
‘ভাই, এ ট্রেনটি কোথায় যাবে, আর আপনি নামবেন কোথায়? অনেকটা মরিয়া হয়ে প্রশ্ন করে মুহিন।’
‘তুমি জানো না এই ট্রেনটা কোথায় যাবে, তাহলে না জেনেই চড়েছ কেন? নিঝুমপুর থেকে ট্রেনটি ছাড়বে কিছুক্ষণের মধ্যে। এটা কিছুদূর যাবার পর আগুন ধরে যাবে গোটা ট্রেনে। তারপর এই ট্রেনে নকশী নদীর ব্রিজ থেকে নিচে পানিতে পড়ে তলিয়ে যাবে। এভাবেই তো চলছে দিনের পর দিন। তুমি জানো না বুঝি- বলতে বলতে যুবক হাসতে থাকে।
তার হাসিতে অদ্ভুত এক নির্মমতা ঝরে পড়ছে, মুহিন অনুভব করে। এবার তার খেয়াল হয় আরও ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে পড়ে গেছে সে। এই ভুতুড়ে ট্রেনের কথা আগে কয়েকজনের কাছে শুনেছিল সে। হঠাৎ হঠাৎ মাঝে মধ্যে নাকি এ লাইনে জ্বলন্ত ট্রেনটাকে গভীর রাতে ছুটে যেত দেখে অনেকেই। নিঝুমপুর স্টেশনে এসে থামে। আবার এখান থেকে চলে যায়।
কিছুক্ষণ আগে যে বিপদের মধ্যে ছিল এখন তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ বিপদের মধ্যে পড়ে গেছে, মুহিন ঠিক বুঝতে পারছে। এই ট্রেনের মধ্যে যারা বিভিন্ন সিটে বসে আছে কিংবা হাঁটাচলা করছে তারা সবাই প্রেতাত্মা। যারা একদিন এই ট্রেনে যাত্রী হয়ে চড়েছিল। সেই ট্রেনে আগুন ধরে গিয়েছিলো। আগুনে পুড়ে তারা মারা গিয়েছিলো। পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিলো সবার দেহ। সেই যাত্রীদের প্রেতাত্মারা এখন এই ট্রেনে চড়ে নিঝুমপুর স্টেশনে আসে। আবার চলে যায়। নকশী নদীতে গিয়ে ঠাঁই নেয় তারা।
ভয়ঙ্কর বিপদ আঁচ করতে পেরে মুহিন সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, দরজার দিকে ছুটে যায়।
অবাক ব্যাপার, আগেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছে কেউ!
অন্য বগিতে ছুটে যায় সে খোলা দরজার আশায়। এভাবে পুরো ট্রেনের প্রতিটি বগিতে গিয়ে দরজা বন্ধ দেখতে পায় মুহিন। ট্রেন থেকে নামার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এবার আরও অনেক বেশি ভয় পেয়ে যায় সে। ততক্ষণে ট্রেনটা চলতে শুরু করেছে। নিঝুমপুর স্টেশন ছেড়ে ট্রেনটা পশ্চিম দিকে ছুটছে। ট্রেনের গতিও বাড়ছে ক্রমশ।
এখন কী করবে সে, ভাবতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে যায় মুহিন।
এই ট্রেন থেকে নামতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ছুটতে ছুটতে ট্রেনটা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে- ভাবতেই মনে পড়ে যায় কিছুক্ষণ আগে একজন যাত্রী ভূত বলছিল, নিঝুমপুর স্টেশন ছাড়ার কিছুক্ষণ পর গোটা ট্রেনে আগুন ধরে যাবে। তারপর এই ট্রেন নকশী নদীর ব্রিজ থেকে নিচে পানিতে পড়ে তলিয়ে যাবে। এভাবেই নাকি চলছে দিনের পর দিন। কথাগুলো মুহিনের কানে বারবার বাজতে থাকে।
তখনই ট্রেনে আগুন দেখা যায়। প্রথমে একটি বগিতে আগুন ধরে। তারপর একে একে ছড়িয়ে পড়তে থাকে অন্য বগিগুলোতে। আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমশ গ্রাস করতে করতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। অনেক নারী-পুরুষ আর শিশুর আর্তচিৎকার শোনা যাচ্ছে।
বীভৎস এক পরিবেশ। আগুনে পুড়ছে বিভিন্ন যাত্রীর দেহ। কিন্তু পরক্ষণেই তা আবার আগের আকৃতি ধারণ করছে। অগ্নিদগ্ধ যাত্রীরা ছুটে আসছে তার দিকে। আত্মরক্ষার্থে তারা মুহিনকে জড়িয়ে ধরতে চাইছে। ওরা তাকে জড়িয়ে ধরলে আর রক্ষা নেই।
মুহিনের মনে পড়ে যায় তার বাড়ির কথা। বাড়িতে তার বাবা মা ভাই বোন কেউ জানে না এখন সে কোন অবস্থায় রয়েছে। কত ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে তার সময় কাটছে। সবার মুখের ছবি মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। প্রিয়জনদের সঙ্গে জীবনে আর কখনও দেখা হবে না বুঝতে পারছে সে। কারণ, এখন যে অবস্থায় রয়েছে সে তার চেয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থা আর হতে পারে না।
মৃত্যুর ঠিক মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে সে। এখান থেকে রক্ষা পাবার আর কোনো উপায় নেই। নিঝুমপুর স্টেশনের চাঞ্চল্যকর নানা ঘটনা নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট করতে এসে এখন সে নিজেই ভয়ঙ্কর পরিণতির শিকার হচ্ছে। আগুনের লেলিহান শিখা খুব বেশি দূরে নেই। আর মাত্র কয়েক মিনিট। তারপর মুহিনকে গ্রাস করবে ট্রেনের সর্বগ্রাসী ভয়ঙ্কর আগুন।
মহান সৃষ্টিকর্তাকে মনে মনে স্মরণ করলো সে। মুখে শুধু উচ্চারণ করলো, ‘হে আল্লাহ আমাকে তুমি এ বিপদ থেকে রক্ষা করো। আমি আর পারছি না।’
তখনই ট্রেনের জানালার কাচ সরিয়ে কোনভাবে নিজের শরীরটা বাইরে বের করে আনতে সক্ষম হলো মুহিন। জ্বলন্ত ট্রেনে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। জীবন বাঁচাতে সে বাইরে চোখ বুজে ঝাঁপ দিলো।
এরপর সব অন্ধকার হয়ে যায়। তারপর কী ঘটছে, জানতে পারে না মুহিন। নিঝুমপুর স্টেশন থেকে কয়েক মাইল পশ্চিমে রাজাপুর গ্রামে তখন মসজিদে মসজিদে ফজর নামাজের আজান হচ্ছে। অন্ধকার ক্রমশ হালকা হয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। প্রকৃতিতে অদ্ভুত এক স্নিগ্ধভাব ছড়িয়ে থাকে এ সময়টাতে। তখন পৃথিবীটাকে দারুণ পবিত্র এবং সুন্দর মনে হয়।
রাজাপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে আরও পশ্চিমে দিকে রেললাইন বয়ে গেছে। সেই রেললাইনের পাশে ঢালুতে সবুজ ঘাসে প্যান্ট শার্ট পরা একজন যুবককে পড়ে থাকতে দেখা যায়। সে এই গ্রামের কেউ নয়, বেশভূষা দেখে মনে হয়। অপরিচিত আগন্তুক এই যুবক এখানে কিভাবে এলো কেউ জানে না। ট্রেন থেকে হয়তো পড়ে গেছে, নয়তো কেউ তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে দেখে অনুমান করা যায়।
গ্রামের কয়েকজন মুসল্লি বাড়ি থেকে বেরিয়ে মসজিদের দিকে রওনা দিয়েছেন। রেললাইনের পাশ দিয়ে যাবার সময় তারা প্যান্ট শার্ট পরা অপরিচিত এক যুবককে পড়ে থাকতে দেখে এগিয়ে যান। কাছে গিয়ে দেখেন, যুবকের শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। তার মানে সে মারা যায়নি।
‘আরে, দেওয়ান সাহেব দেখেন, মানুষটা বাঁইচা আছে, কেউ বোধ হয় ট্রেন থেইক্যা ফালাইয়া দিছে, আপনেরা ধরেন তো একটু। ওরে হাসপাতাল নিতে হইবো এখুনি।’ অপরিচিত কিছু মানুষের কথা আবছাভাবে শুনতে পায় মুহিন। তার কাছে মনে হয়, দীর্ঘ একটা ঘুমের পর ভোরের স্নিগ্ধ ঠাণ্ডা হাওয়ার স্পর্শে জেগে উঠছে।
তখনই নিঝুমপুর স্টেশনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো একের পর এক মনে পড়তে থাকে তার। ছুটে চলা জ্বলন্ত ট্রেন থেকে প্রাণ বাঁচাতে লাফ দিয়ে নিচে পড়ার কথা মনে হতেই চোখ মেলে তাকায় সে। বেশকিছু উদ্বিগ্ন অপরিচিত কৌতূহলী মুখ তাকে পর্যবেক্ষণ করছে দেখতে পায় সে।

Share.

মন্তব্য করুন