৪ মার্চ ২০২২। রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্ট খেলতে নামে সফরকারী অস্ট্রেলিয়া। ২৪ বছর পর পাকিস্তান সফর করেছে অজিরা। ক্রিকেট বিশে^র জন্য এটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ দিন। তবে এই দিনটি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো অস্ট্রেলিয়ার ওপেনার উসমান খাজার জন্য। কারণ পাকিস্তান যে তার মাতৃভূমি। সেই পাকিস্তানের মাটিতে তিনি পাকিস্তানেরই বিপক্ষে খেলতে নেমেছেন, অস্ট্রেলিয়া দলের হয়ে।
পরিসংখ্যানের খাতায় কিংবা ইতিহাসের পাতায় এর বিশেষ কোন গুরুত্ব হয়তো নেই; কিন্তু একজন উসমান খাজার জীবনে দিনটি অবশ্যই স্মরণীয়। তাকে নিশ্চয়ই আবেগতাড়িত করেছে এই ম্যাচ। তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে রাওয়ালপিন্ডিতে। ম্যাচের আগের দিন খাজা তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি ছবি শেয়ার করেছেন। তার ছোট বেলার ছবি। ছবিতে দেখা যায় ছোট্ট খাজা রাওয়ালপিন্ডি স্টেডিয়ামের প্র্যাকটিস গ্রাউন্ডে ক্রিকেট অনুশীলন করছেন। এত বছর পর সেই রাওয়ালপিন্ডিতেই তিনি অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে খেলতে নেমেছেন পাকিস্তানের বিপক্ষে।
উসমান খাজার জন্ম ১৯৮৬ সালের ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ইসলামাবাদ শহরে। তখন পাকিস্তান ক্রিকেটে ইমরান খান যুগ চলছে। যে কারণে আর দশটা শিশুর মতো ক্রিকেটের নেশা পেয়ে বসে তাকে; কিন্তু কয়েক বছর পর উন্নত জীবনের আশায় তার পরিবার অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমালে ছেদ পড়ে ক্রিকেট চর্চায়। উসমান খাজার বয়স তখন ৫ বছর। তবে দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না উসমান। অস্ট্রেলিয়ায় পরিবার একটু থিতু হতেই আবার শুরু করেন ক্রিকেট চর্চা।
কিছুদিন পর স্থানীয় অনুর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ আসে। প্রথম সুযোগেই নিজের প্রতিভার প্রমাণ দেন। ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার অনুর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার জেতেন। এরপর ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ^কাপও খেলেন এই বামহাতি টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। ২০০৮ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট অভিষেক ভিক্টোরিয়া রাজ্য দলের হয়ে।
ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের পর রান করতে থাকলেও জাতীয় দলে সুযোগ আসে অনেক দেরীতে। একে তো ওই সময় অস্ট্রেলিয়া ছিলো তারকায় ভরপুর এক দল। রিকি পন্টিং, মাইক হাসি, স্টিভেন স্মিথরা ছিলেন দলে। এছাড়া খাজা একে তো অভিবাসী ক্রিকেটার, দ্বিতীয়ত মুসলিম হওয়ার কারণে অনেকটা উপেক্ষার শিকার হয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে।
শেষ পর্যন্ত ২০১০-১১ অ্যাশেজ সিরিজে রিকি পন্টিং ইনজুরি আক্রান্ত হলে সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট অভিষেক হয় উসমান খাজার। তিনিই অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট খেলা প্রথম মুসলিম ক্রিকেটার। এর দুই বছর পর ওয়ানডে অভিষেক হয়েছে মেলবোর্নে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। এরপর অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট ও ওয়ানডে দলে খেলে গেছেন ধারাবাহিকভাবে। রানও পেয়েছেন। তবে ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ^কাপের পর থেকে হঠাৎ করেই উসমান খাজার ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়েন অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচকরা।
ওই বিশ^কাপে ব্যক্তিগত ৩১৬ রান করেছিলেন খাজা। ৮৮ ও ৮৯ রানের দুটি মূল্যবান ইনিংসও ছিলো। তবু অজ্ঞাত কারণে খাজাকে দলের বাইরে ঠেলে দেয়া হয়। টেস্ট ওয়ানডে, কোন দলেই আর সুযোগ হয়নি ২০১৯ সালের পর। যদিও উভয় ফরম্যাটেই তার গড় ৪০ এর বেশি। এই সময়টা ঘরোয়া ক্রিকেটেও প্রচুর রান পেয়েছেন। দুই বছর পর সর্বশেষ গত অ্যাশেজে ট্রাভিস হেডের করোনা আক্রান্তের ঘটনায় খাজাকে দলে নেয়া হয়।
৫ জানুয়ারি সিডনিতে সিরিজের চতুর্থ টেস্টে সুযোগ পেয়েই করেন জোড়া সেঞ্চুরি। প্রথম ইনিংসে ১৩৭ রানের ইনিংসের পর দ্বিতীয় ইনিংসে খেলেন অপরাজিত ১০১ রানের ইনিংস। অবহেলার জবাবটা এভাবেই দিয়েছেন তিনি।
এরপর নিজের মাতৃভূমি পাকিস্তান সফরের দলে আর খাজাকে উপেক্ষা করতে পারেননি নির্বাচকরা। যে কারণে জন্মভূমি পাকিস্তানের খাজা ফিরেছেন পাকিস্তান দলের প্রতিপক্ষ হয়ে। রাওয়ালপিন্ডিতে নিজের আত্মীয় স্বজনদের সামনে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে খেলেছেন ৯৭ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। তবে দুর্ভাগ্য তার, সুন্দর ইনিংসটাকে সেঞ্চুরিতে রূপ দিতে পারেননি।
পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেললেও উসমান খাজার হৃদয়ে এখনো পাকিস্তানের জন্য অনেকটা জায়গা। নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাড়িতে সবাই উর্দুতে কথা বলেন। বাসায় পাকিস্তানি স্টাইলে খাবার তৈরি হয়। গত ত্রিশ বছরে একাধিকবার পাকিস্তানে বেড়াতেও গিয়েছেন আত্মীয়-স্বজনদের কাছে। যে কারণে পাকিস্তানের মাটিতে খেলার জন্য মুখিয়ে ছিলেন এই ক্রিকেটার। সেই সুযোগটা পেলেন অবশেষে।
এবারের পাকিস্তান সফরের আগে সব মিলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উসমান খাজা ৪৬ টেস্টে ১০ সেঞ্চুরিতে করেছেন ৩ হাজার ১৪২ রান। ৪০ ওয়ানডেতে ২ সেঞ্চুরি ও ১২ হাফ সেঞ্চুরিতে করেছেন ১ হাজার ৫৫৪ রান। ৯টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে রান করেছেন ২৪১ রান।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার রয়েছে ৩৪টি সেঞ্চুরি। এছাড়া লিস্ট এক ক্রিকেটে ১৪টি ও ঘরোয়া টি-টোয়েন্টিতে ৩টি সেঞ্চুরি আছে।
ব্যক্তিগত জীবনে এক সন্তানের জনক উসমান খাজা ক্রিকেটের বাইরে একজন পেশাদার বিমান চালক। নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটি থেকে এভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি নেয়ার পর পেয়েছেন বাণিজ্যিক বিমান চালানোর লাইসেন্স। তবে ক্রিকেটটাই তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়।

Share.

মন্তব্য করুন