গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া উৎসব যেন সোনারগাঁওয়ে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের বিশাল চত্বরে উৎসব আমেজে জমে উঠছে এ উৎসব। এখানে বসেছে মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা। গ্রামকে কে না ভালবাসে! নয়নালোভা গ্রামগুলো আমাদের দেশের প্রকৃতির লীলানিকেতন। গ্রামে কত সৌন্দর্য, কত স্মৃতি লুকিয়ে আছে তা না দেখলে বোঝা বড় কঠিন। গ্রামে এত প্রাণের চঞ্চলতা আছে, আছে হারিয়ে যাওয়া অনেক কিছু, অনেক স্মৃতি। সেই গ্রামের হারিয়ে যাওয়া সব এখন পাওয়া যাবে সোনারগাঁওয়ে গেলে। মেলা চত্বরে প্রবেশের সময় দেখা যাবে যেন একটি গ্রামে এসেছি। গ্রাম বাংলার ব্যবহৃত বাশেঁর সব কারুপন্য যেন স্বাগত জানাচ্ছে তোমাকে। প্রকৃতির ছায়া ঘেরা নয়ানাভিরাম স্থানটিতে বৃক্ষরাজির সমাহার, সাঁকো, লেক, পুকুর, নৌকা, এখানে সেখানে গ্রাম বাংলার নানা নিদর্শন সবই আছে ফাউন্ডেশন চত্ব¡রে।
ঐতিহ্যবাহী লোক সংগীত, কারুশিল্পীদের সৃষ্টিশীল কর্মের প্রদর্শন, বিলুপ্ত প্রায় গ্রামীণ খেলাধুলার প্রচার প্রসারের পাশাপাশি দেশীয় সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন লোক কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবের আয়োজন করে আসছে।

ইতিহাসের নানা ক্রান্তিকালে এদেশের অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। সময়ের চাকা বেয়ে অনেক ঐতিহ্য আজ বিলুপ্ত। সেই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য পুনরায় আনয়ন করে সোনার বাংলাকে ভরিয়ে তুলতে সোনারগাঁওয়ের প্রাণকেন্দ্র নৈসর্গিক পরিবেশে লোক কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের এ মাসব্যাপী মেলা বসেছে। এ মেলার বৈশিষ্ট্য গ্রাম বাংলার লোকজ তৈজসপত্র পন্যসামগ্রী, প্রাকৃতজনের আচার আচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশ এবং পিতামহ ও মাতামহদের যুগের খাদ্য সামগ্রী তথা বাতাসা, খই, কদমা, উখড়া, জিলাপী ইত্যাদি আধুনিক যুগের কাছে উপস্থাপন করা। দেশের কৃষিজীবি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত লোক ও কারুশিল্পের ঐতিহ্যকে তুলে ধরার লক্ষ্যে এ বছর গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী এ মেলা। এবারে করোনা মহামারীর জন্য মেলা পেছানো হয়েছে। প্রতিবছরই জানুয়ারিতে এ মেলা হয়। তবে এবারের মেলায় একটু ভিন্নতা এনেছে মেলার আয়োজকরা। এবারের মেলায় শুধুই লোকজ ঐতিহ্যের পণ্য নিয়ে সাজানো হয়েছে। লোকজ কারুপন্য ছাড়া অন্য কোন কিছুই প্রদর্শন ও বিক্রি হবে না। এদিকে করোনার জন্য এবারে মেলায় কারুশিল্পীও কম এসেছে। স্টল বসেছে কম। তারপরেও এ মেলা যেন পুরো বাংলাদেশকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
মেলার চিরায়ত আকর্ষণ বাংলার মাঠে ঘাটে প্রান্তরে নদী বনান্তরে ঘুরে বেড়ানো লোকজ শিল্পীদের জারি-সারি-বাউল, পালাগান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, কবি গান, হাসনরাজার গান, লালন সঙ্গীত, বিয়ের গান, আলকাপ গান, বিচ্ছেদ গান, শরিয়াতি, মারফতি, গম্ভীরা, লোকজ গীতিনাট্য, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মেলায় আগত দর্শকদের একদম মাতোয়ারা করে তোলে।

মেলার বিশেষ আকর্ষন হলো আয়োজক প্রতিষ্ঠানের বিশেষ প্রদর্শনী দেশের প্রথিতযশা কারুশিল্পীদের শিল্পকর্ম নিয়ে ‘কর্মময় কারুশিল্পী’ প্রদর্শনী। এটি মেলার মূল চত্বরের মাঠের মাঝে অবস্থান। এ বিশেষ প্রদর্শনীতে ২৪টি স্টলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ৪৮ কারুশিল্পী দেশের হারানো ঐতিহ্যকে আবার নতুন করে আবিস্কার করছে। প্রদর্শনীর গ্যালারিগুলো কারুশিল্পীরা তাদের স্বহস্তে তৈরি করছে সোনারগাঁওয়ের দারুশিল্পের কারুকাজ, হাতি ঘোড়া, মমী পুতুলের বর্ণালী-বাহারি পণ্য, জামালপুরের তামা-কাঁসা-পিতলের শৌখিন সামগ্রী, সোনারগাঁওয়ের বাহারি জামদানি শিল্প, বগুড়ার লোকজ বাদ্যযন্ত্র, কক্সবাজারের শাঁখা ঝিনুক শিল্প, মুন্সিগঞ্জের শীতলপাটি, ঢাকার কাগজের শিল্প, রাজশাহীর মৃৎশিল্প- মাটির চায়ের কাপ, শখের হাঁড়ি, বাটিক শিল্প, খাদিশিল্প, মণিপুরী তাঁতশিল্প, রংপুরের শতরঞ্জি শিল্প, টাঙ্গাইলের বাঁশ-বেতের কারুপণ্য, সিলেটের বেতশিল্প, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুজনিকাঁথা, কিশোরগঞ্জের টেরা কোটা পুতুল, খাগড়াছড়ি ও মৌলভীবাজারের ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর কারুপণ্য, মৌলভীবাজারের বেতের কারুশিল্প, ঠাকুরগাঁয়ের বাশেঁর কারুশিল্প, মাগুরা ও ঝিনাইদহের শোলাশিল্প, চট্টগ্রামের তালপাতার হাতপাখা, পাটজাত কারুপণ্য, লোকজ অলংকার শিল্পসহ ইত্যাদি কারুপন্য। এখানে শিল্পীরা বসেই তাদের নিপুন হাতে নিজস্ব মেধা ও মননে তৈরি করছে বাহারী কারুপণ্য এবং তা প্রদর্শন ও বিক্রি করছে। প্রদর্শনীর গ্যালারীগুলোতে থরে থরে সাজানো কারুপণ্যের পসরা দেখে কেউ কেউ লোভ সামলাতে না পেরে কেনাকাটা করছেন শখের চিত্রিত হাড়ি, শোলা শিল্প, কাঠের সামগ্রী, শতরঞ্জি, নকশী কাঁথাসহ বিভিন্ন কারুপন্য সামগ্রী। এখানে শিল্পীরা বসেই তাদের নিপুন হাতে নিজস্ব মেধা ও মননে তৈরি করছে বাহারী কারুপণ্য এবং তা প্রদর্শন ও বিক্রি করছে।

মেলায় আবহমান বাংলার গ্রাম্য শালিশ, কনে দেখা, গায়ে হলুদ, বরযাত্রা, জামাইকে পিঠা খাওয়ানো ইত্যাদি লোকজীবন প্রদর্শনী কারুশিল্প মেলার একপাশে চলছে। আবহমান বাংলার লৌকিক আচার এবং ঐতিহ্যগত সংস্কৃতিই ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে এ প্রদর্শনীতে। সোনারগাঁওয়ের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এতে অংশগ্রহণ করছে। মেলা বরাবরেই নাগরদেলা, বায়োস্কোপ, বিমান চড়কি, সাপ খেলাতো রয়েছেই।
মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক ড. আহমেদ উল্লাহ জানান, গ্রামের অতি সাধারণ মানুষ গভীর মমতা দিয়ে তাঁদের সৃষ্টিশীলতায় কারুশিল্প তৈরি করে। এসব কারুশিল্প আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। এ বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির ঐতিহ্য নিয়ে লোক কারুশিল্প এ মেলার আয়োজন করেছে। লোক কারুশিল্পের প্রসারের জন্য প্রতি বছরের মত আকর্ষণীয় বিভিন্ন খেলা, গান, প্রদর্শনী অনুষ্ঠান ছাড়াও এবারের উৎসবে গ্রাম বাংলার আর্থসামাজিক জীবনের প্রতিচ্ছবি উপস্থাপন করা হয়েছে বৈচিত্রময়ভাবে। এছাড়া সোনারতরী লোকজ মঞ্চে প্রতিটি বিকেলে বাউল, চর্যাগান, লোকগল্পবলা, লালন, হাসনরাজাসহ নানা গান হচ্ছে। মেলা ও উৎসবে বিলুপ্তির অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে বাঙালীর শৈশবের সম্পদ গ্রামীণ খেলাধুলা যেমন- কানামাছি, বৌচি, এক্কা-দোক্কা, লাঠিখেলা, সাপের খেলা, গোল্লাছুট, দাড়িঁয়াবান্দা, হাডু-ডু, ওপেনটি বায়োস্কোপ, মোরগ লড়াই, আঁকুনি টুকুনি, ইছোনবিছোন প্রভৃতি খেলাও পরিবেশিত হচ্ছে।
এবারের মেলায় মোট স্টল রয়েছে ১০০টি। মুড়ি মুড়কি, মণ্ডামিঠাই থেকে শুরু করে গ্রামীণ হস্তশিল্প, বাঁশ-বেত, কাঠ-লোহা, পাটজাত দ্রব্যসামগ্রী বিলুপ্তপ্রায় কুটির শিল্পের পসরার বসেছে মেলায়। মেলা চলবে আগামী ২৩ মার্চ পর্যন্ত। বন্ধুরা, সুযোগ পেলে একবার যেও কিন্তু!

ছবি : মো. শফিকুর রহমান

Share.

মন্তব্য করুন