কয়েকদিন হলো রিনা ম্যাম ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গেছেন। যখন রিনা ম্যাম ছুটিতে যান, কমপক্ষে এক মাস ছুটি নিয়ে যান। কারণ ম্যামের বাড়ি নাকি বহুদূর। ম্যামকে যেতেই প্রায় দুই দিন লাগে। আবার আসতেও দুই দিন লাগে। তাই বছরে একবারই ছুটিতে যান।
রিনা ম্যাম না থাকলে ইশকুলটা কোনও ছাত্র-ছাত্রীর কাছে ভালো লাগে না। যতদিন ম্যাম না আসেন ততদিন উদাস উদাস লাগে সবার মনে। অন্য স্যারদের কেউ না থাকলেও ভালো লাগে না। কিন্তু ম্যামের প্রতি সবার টানটা অধিক।
ম্যামের যাওয়ার ঠিক এক মাস পূর্ণ হলেই তারপর দিন ইশকুলে সবাই বেশ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। এবারও সবাই খুব আনন্দ আর উৎফুল্ল হয়ে ইশকুলে গেলাম। আমরা শ্রেণিকক্ষে উন্মুখ হয়ে বসে আছি। সেকেন্ড পিরিয়ডে ম্যামের ক্লাস থাকে আমাদের। ম্যাম আমাদের গণিত ও বিজ্ঞান ক্লাস নেন। ইশকুলে গিয়েই অফিসকক্ষে কয়েকবার উঁকি মেরে আসি। কিন্তু ম্যামকে দেখতে পেলাম না। তখন ভেবেছিলাম, ম্যাম মনে হয় গ্রাম হতে ফেরেননি। প্রথম ক্লাসটা কোনরকম করেছি। দ্বিতীয় ক্লাসের সময় কয়েক মিনিট পার হয়ে গেল ম্যাম বা কোনও স্যারও আসছেন না। তাই মন খারাপ করেই বেঞ্চের ওপর মাথা রেখে বসেছিলাম। হঠাৎ কয়েকজন ক্লাসমেট হুড়মুড় করে শ্রেণিকক্ষে ঢুকছে। আর তারা আওয়াজ করে বলছে রিনা ম্যাম আসছেন। তখন আমি ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ালাম। ম্যাম ঘরে ঢুকলেন। সবাই বলছে, ম্যাম কেমন আছেন? কিন্তু আমার মুখ দিয়ে কোনও কথা বের হচ্ছে না। আমি অপলক দৃষ্টিতে ম্যামের দিকে তাকিয়ে আছি। আর মনে মনে বলছি, এই এক মাসের মধ্যে ম্যামের এতো পরিবর্তন কেন? ম্যাম সবাইকে বসতে বলে প্রথমেই আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর আমার দিকে মিটমিটিয়ে হেসে বললেন, কী রে রবিন… এভাবে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে কী দেখছিস?
ম্যামের কথায় যেন আকাশ হতে পড়লাম। ম্যামের কণ্ঠের বেশ পরিবর্তন! এ কী করে সম্ভব! নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বললাম, না ম্যাম, আপনাকে সুদীর্ঘ এক মাস পর দেখছি তো। তাছাড়া আপনার ভেতরে অনেক পরিবর্তন দেখছি।
আরে তেমন না। গ্রামের বাড়িতে বেশ করে খেয়েছি তো, তাই একটু আধটু পরিবর্তন মনে হচ্ছে। মা প্রতিদিন, কত্ত রকমের খাবার খাইয়েছেন।
কিন্তু ম্যাম, আপনি তো বলেছিলেন আপনার মা-বাবা বেঁচে নেই। এখন বলছেন আছে। এ কেমন কথা?
এবার ম্যাম কিছু একটা ভেবে বললেন, আরে হ্যাঁ। আমরা চাচা-চাচিকেও মা, বাবা বলে ডাকি। তাই বললাম আর কী!
তারপর ম্যাম ক্লাস করাতে লাগলেন।
সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করলেও আমার পড়াতে কোনও মন নেই। যখন ম্যাম ব্ল্যাকবোর্ডে লিখছেন বা অন্যদিকে তাকিয়ে পড়াচ্ছেন, তখন আমি ম্যামের দিকে তাকিয়ে থাকি। মাঝে মধ্যে ম্যাম আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছেন। সেই হাসিটাও আমার কাছে অচেনা লাগছে। কারণ রিনা ম্যামের হাসিটা অন্যরকম সুন্দর। আমার মনে আরও ঘুরপাক খেতে লাগল এটা আসল রিনা ম্যাম না। হয়তো রিনা ম্যাম তাঁর পরিবর্তে কাউকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু রিনা ম্যাম তো একদিন বলেছিলেন, তাঁর একটা ভাই আছে। কোনও বোনও নেই। তবে কী ম্যাম তাঁর চাচাতো বোনদের কাউকে পাঠিয়েছেন। ভাবছি আর ভাবছি।
ক্লাস শেষ হয়ে গেছে কখন বুঝতে পারিনি। ম্যাম ক্লাস শেষ করে বের হয়ে যাবার সময়, আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন টের পাইনি। ম্যামের কণ্ঠ শুনে বাস্তবে ফিরে আসি।
রবিন, তুই কিন্তু আজ বড়ই অন্যমনস্ক! তোর মতো একজন ভালো ছাত্র ক্লাসে মনোযোগ না দিলে আর কে দেবে? তুই বাইরে আয়, আমার সাথে।
ম্যামের পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে গেলাম। অফিস কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, আমাকে দেখে মনে হয়, তুমি খুব অবাক হচ্ছো। আমার কি খুবই পরিবর্তন হয়েছে?
আমি কী বলব, বুঝতে পারছিলাম না তখন। শুধু মাথাটা নিচু করে বললাম, হ্যাঁ ম্যাম। আপনার বাম গালে একটা তিল ছিল সেটা এখন নেই। কপালের ডান কোণে একটা কাটা দাগ ছিল সেটাও নেই। আর আগের চাইতে বেশ চিকন লাগছে।
আচ্ছা, এইসব ভাবনা মন হতে মুছে ফেল। আগামীকাল হতে যেন আর অন্যমনস্ক না দেখি।
জি, ম্যাম। বলেই শ্রেণিকক্ষে ফিরে এলাম। ভাবতে লাগলাম, যদি ম্যাম অন্য কেউও হয় কিন্তু আমার নামটা কেমনে জানলো। তাহলে কি আমারই ভুল হচ্ছে?

পরদিন হতে ক্লাসে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঠিকমত হচ্ছে না। সেটা ম্যামকে বুঝতে দেই না। তবুও কিভাবে ম্যাম বুঝে নিতেন। আমি অন্যমনস্ক হলেই ম্যাম বলেন, এই রবিন পড়ায় মন দে। এভাবে একদিন দু’দিন নয় তিন তিনটা মাস পার হয়ে গেল। কেউ কিছু বুঝল কিনা জানি না। কিন্তু আমার কাছে চিরচেনা রিনা ম্যামকে মনে হচ্ছে না। বন্ধুদের এই কথা বললে, আমার কথা শুনে হাসাহাসি করে। আর বলে, তোর চোখের সমস্যা হয়েছে। একটা ভালো চক্ষু বিশেষজ্ঞকে দেখা।
প্রায় চার মাস পর হঠাৎ সেই চিরচেনা রিনা ম্যাম ক্লাসে। আমি হতভম্ব হয়ে ম্যামকে জিজ্ঞেস করলাম, ম্যাম, এতদিন পর আপনার গালের তিল আর কপালের দাগ কোথা হতে এলো? প্রায় চার মাস আগে আপনার তো এগুলো ছিল না।
আবার, আমার কথা শুনে বন্ধুরা হো হো করে হেসে উঠল। তখন ম্যাম সবাইকে ধমক দিয়ে থামিয়ে আমার সামনে এলেন। আর বললেন, কী ব্যাপার রবিন? এতদিন আমার এইগুলো দেখনি মানে। আমি তো প্রায় পাঁচ মাস পর ইশকুলে আসলাম। এবার ছুটিতে বাড়ি যাবার সময় হঠাৎ একটা দুর্ঘটনা ঘটে। তাতে আমার বাম পা-টা ভেঙে গেছিল। তাই ইশকুলে আসতে পারিনি। হেডস্যারকে চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলাম।

এবার আমি একটু নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে ম্যামকে সবকিছু খুলে বললাম। ম্যাম তো শুনে অবাক! ম্যাম বললেন, আমি তো এতদিন ইশকুলে আসিনি। তাহলে আমার রূপ ধরে এসে কে তোমাদের ক্লাস করালো? কিন্তু আমি আসার সময় পথে একজনের সঙ্গে দেখা হলো। সে প্রায় আমার মতো দেখতে। আমাকে দেখে সে এগিয়ে এসে বলল, রিনা ম্যাম, কেমন আছেন?
আমি বললাম, ভালো। কিন্তু আপনি কে? আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না। সে তখন মুচকি হেসে বলল, আমি এলিয়েন। ফোরক্যান টিটি নামক গ্রহ হতে এসেছিলাম। আপনি চলে এসেছেন, তাই চলে গেলাম। বলেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সবাই রিনা ম্যামের কথা শুনে ‘থ’ হয়ে গেলাম। অবাক হয়ে সবাই তাকিয়ে রইলাম ম্যামের দিকে। তখন রিনা ম্যাম অট্টহাসি দিয়ে বললেন, তাহলে তোমরা এতদিন এলিয়েন ম্যামের কাছে পড়েছ!

ইশকুল ছুটি শেষে বাড়ি ফিরছি। সারা রাস্তা রিনা ম্যামের কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সত্যিই কি রিনা ম্যামের মতো করে যে এই কয়েকটা মাস পড়ালেন, সে এলিয়েন ম্যাম। আমার ভাবনাটা গভীর হতে গভীরতর হচ্ছে। যা হোক, এভাবে দিনটা পার করি। সন্ধ্যার পর পড়তে বসলাম পড়ার ঘরে। কিন্তু পড়াতে মন বসছে না। বারবার এলিয়েন ম্যামের চেহারাটা আমার সামনে ভাসছে।
তখন রাত দশটা। একটু একটু ঘুমের ঘোর আসছে। পাশের রুমে মা-বাবা আমাকে নিয়ে কী যেন গল্প করছে। তা পুরোটা স্পষ্ট শোনা না গেলেও বুঝতে পারছি আমাকে নিয়েই গল্প হচ্ছে। মাথা ঘুমে ভারী হয়ে আসছে। চোখ দুটোও ঘুমের টানে ছোটো হয়ে আসছে। পড়তে পড়তে টেবিলের ওপর মাথাটা রাখতেই, পাশে যেন কেউ এসে দাঁড়ালো বুঝতে পারলাম। কিন্তু মাথা তুলে দেখতে ইচ্ছে করছে না। তবে ভাবলাম, আম্মু ছাড়া আর কে আসবে আমার ঘরে? ভাবতেই আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, রবিন, চোখে কি খুবই ঘুমের চাপ?
জি, আম্মু। টেবিলের ওপর মাথা রেখেই উত্তর দিলাম।
আমি তোমার আম্মু নই, রবিন। আমি তোমাদের এলিয়েন ম্যাম।
এই কথা শুনে, আমার বুকের ভেতরে বিদ্যুৎগতিতে কী যেন একটা খেলে গেল! মাথা তুলে তাকালাম।
কী দেখে খুব অবাক হচ্ছো, তাই না?
জি, ম্যাম।
রবিন, তুমি খুবই চালাক ছেলে। মেধাবী তো বটেই। তোমাদের ইশকুলে এতদিন ক্লাস করালাম। সবাই রিনা ম্যাম ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেনি। কিন্তু তুমি প্রথম দিনই চিনে ফেলেছিলে যে, আমি তোমাদের সত্যিকারের রিনা ম্যাম নই।
আমি অনেক কিছুতেই আপনার পরিবর্তন দেখেছি ম্যাম। চলাফেরা, ওঠাবসা, কণ্ঠস্বর আর গালের তিল ও কপালের কাটা দাগ নেই দেখে।
তোমার তীক্ষè বুদ্ধিতে তোমার চোখে আমি ধরা পড়েছি। আমাকে নিয়ে তুমি আর ভেবো না। মাঝেমধ্যে তোমার সাথে দেখা করতে আসব। লেখাপড়ায় আর ফাঁকি দেবে না। দুই মাস পড়েই তোমার পিএসসি পরীক্ষা।
ম্যাম, আপনি কি সত্যিই ভিনগ্রহের প্রাণী?
হ্যাঁ, রবিন। আমি ফোরক্যান টিটি নামক গ্রহ হতে এসেছি।
ম্যাম, আমি আপনাদের গ্রহ দেখতে যেতে চাই। সেখানের সবকিছু অবলোকন করতে চাই। সেটা কি আমাদের পৃথিবীর চাইতেও সুন্দর?
তোমার পরীক্ষার পর নিয়ে যাবো। আর হ্যাঁ, তোমাদের পৃথিবীর মতো কোনও গ্রহই এতো সুন্দর না। তাই তো তোমাদের এই সুন্দর গ্রহে মাঝেমধ্যে ভ্রমণে আসি। ভালো থেকো রবিন। অন্যদিন এই সময়ে এসে, তোমার সমস্যার সমাধান করে দেব।
চলে যাবেন ম্যাম? আর কিছুক্ষণ থাকলে হয় না।
না, রবিন। ভালো থেকো। বাই বাই…
বলেই এলিয়েন ম্যাম অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ম্যামের চলে যাবার পর, বেশ কিছুক্ষণ বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

Share.

মন্তব্য করুন