শিশুসাহিত্যের ভাষা কেমন হওয়া উচিত? এই প্রশ্নের উত্তর ভাষাবিজ্ঞানীরা ভালো বলতে পারবেন। তবে যারা শিশুসাহিত্য করেন, তারাও ভালো বলতে পারবেন বলে আমার ধারণা। কারণ, শিশুর মানসিকতা, তাদের বুদ্ধি ও মেধার বিষয়ে তারা কম-বেশি জানেন। শিশুর বুদ্ধি ও বিকাশের ধারাবাহিকতা আছে। শারীরিকভাবে যেমন শিশুর বৃদ্ধি ঘটে থাকে, তার পাশাপাশি তার মেধারও বিকাশ ঘটতে থাকে। তবে সবারই যে মানসিক ও শারীরিক বিকাশ একই রকম হবে, তা বোধহয় ঠিক নয়। শারীরিক বৃদ্ধির সঙ্গে তার মিলিয়ে মানসিক বিকাশের যোগসাজশ থাকলেও সবসময়, সবক্ষেত্রে ঘটে না।

এসব বিষয়ে শিশুর মনোজগতের খবর রাখেন শিশুসাহিত্যিকরা। তবে, ব্যতিক্রমও আছে। শিশুর সাইকোলজির সঙ্গে তার প্রতিবেশের প্রভাব পড়ে। শিশু তার চারপাশে যা দেখে, তাই সে শেখে। যা সে শোনে তাই সে আয়ত্ত করে উচ্চারণ করার চেষ্টা করে। এই ব্যাপারে তার প্রধান বন্ধু হচ্ছে তার মা এবং বাবা। পাশাপাশি তার ভাইবোনেরাও শিশুর প্রথম ও প্রধান শিক্ষক। মা-বাবা-ভাইবোনেরা তাকে হাঁটতে শেখায়, কথা বলতে শেখায়। ঘরের সব কিছু চেনায়। কথা বলতে শেখায়। ওই পাঠটিই তার আসল শিক্ষা, প্রথম ও প্রধান শিক্ষা। আমরা যখন শিশুর আধফোটা শব্দ বলা শুনি, তখন আনন্দ পাই। ওই শিশুই যখন আরো বড় হয়ে ওঠে, তখন আমরা ওই আধবুলি শুনলে বলি শিশুটির বিকাশ হয়নি। অর্থাৎ ওই শিশুটির বয়োবৃদ্ধি ঘটেছে, কিন্তু তার মানসিক বিকাশ ঘটেনি। মানসিক বিকাশ না ঘটলে তাকে আমরা প্রতিবন্ধী বিবেচনা করি। সমাজে এরকম অনেক শিশুরই দেখা মেলে যারা শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। আমি একটি শিশুকে জানি, যে শিশুটি জন্মের সময় ব্রেনে অক্সিজেন পায়নি বলে সে প্রতিবন্ধী হয়েছে। সে শারীরিক প্রতিবন্ধী নয়, মানসিক প্রতিবন্ধী হয়েছে। যারা শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশু, তাদের কষ্টের সীমা-পরিসীমা নেই।

এইসব শিশুর মনমানসিকতা নিয়ে কোনো শিশুসাহিত্যের লেখক কোনো গল্প বা উপন্যাস লিখেছে কিনা, আমি জানি না। তাদের সাইকোলজি নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নিশ্চয়ই গবেষণা হয়েছে এবং এখনো হয়, কিন্তু তার প্রতিফলন কি শিশুসাহিত্যের গল্পে-উপন্যাসে পড়েছে? আমি অন্তত জানি না। তবে আমাদের বাংলা ভাষায় যারা শিশুসাহিত্য চর্চা করেন, তারা ওইসব প্রতিবন্ধীকে নিয়ে গল্প-উপন্যাস না লিখলেও আমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম উপাদান জিন-পরীর কাহিনী-কেচ্ছা লিখেছেন অনেক। সেগুলোতে কল্পনার অনেক দিগন্তই আমরা দেখতে পাই। সেই সব কাহিনীতে জটিল কোনো কিছু নেই, সহজ-সরল গল্পই উপস্থাপিত হয়। শিশুর মনোজগতে একটি পরিচ্ছন্ন সামাজিক ছবির শেকড় গেড়ে দেয়ার মানসিকতা আমরা লক্ষ্য করি সেসব গল্পে। শিশু যাতে একটি আনন্দময় ভুবনের ছবি নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে, ওইসব গল্পের লক্ষ্য সেটা। লোকগল্পগুলো থেকে শিশুরা ভালো ও মন্দ বিষয়ে জানতে পারে। তারা ভালো-মন্দের ফারাক বুঝতে পারে। তাদের মনোজগতে তার ছাপ পড়ে, যা শুভবোধক।

এসব শিশুর জন্য লিখিত গল্পগাঁথার ভাষা কেমন তা কি আমরা জানি? গল্পের ভাষাভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত সেটাও জানা উচিত। কেননা, চাইল্ড সাইকোলজি কোন শব্দ কিভাবে গ্রহণ করতে পারে, তার ব্যাখ্যা দেয়। গল্প তো আর ব্যাখ্যার ধার ধারে না। তবে শিশু যাতে সহজেই বুঝতে পারে, লেখকরা তাই কঠিন শব্দ ব্যবহার করেন না। তারা যুক্তাক্ষরও পরিহার করতে চান। যুক্তাক্ষর উচ্চারণে শিশুর জন্য কষ্টসাধ্য এবং সেই শব্দের অর্থও তার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকবে, তাই পরিহার করে অপেক্ষাকৃত সহজ শব্দ ব্যবহার করেন।

‘রোদেলার সঙ্গে বুড়ো লোকটার সম্পর্ক বেশ মজার। আশপাশের বুড়ো লোক একটাও দেখেনি রোদেলা। বুড়ো লোক দেখেছে সে টেলিভিশনে। বুড়ো মানুষদের মাথার চুল সব পেকে সাদা হয়ে যায়। রোদেলার কাছে তাই পাকা চুল মানেই বৃদ্ধ। রোদেলা বৃদ্ধ বলতে পারে না, বলে বিরিদদো। তো এখন এই বিরিদদো মানুষটাকে সে ডাকবে কী বলে? (পরীর গল্প/হায়াৎ মামুদ/পরীর গল্প : ধ্রুব এষ সম্পাদিত/অন্যপ্রকাশ/২০০২, একুশে বইমেলা)।
প্রজ্ঞাবান প্রবীণ সাহিত্যিক হায়াৎ মামুদ পরীর গল্পের সূচনায় উল্লিখিত বাক্যগুলো লিখেছেন। রোদেলা নামটি একালের এবং নাগরিক নাম। লোকজ বা গ্রামীণ নাম নয়। জিন-পরীর গল্পগুলো মূলত গাঁয়ের শিশুদের নিয়েই অনেকটা হয়ে থাকে। কারণ ওরা জিন ও পরী বিশ্বাস করে। ফলে সেই গল্প তাদের সামাজিক ও মানসিক বিশ্বাসের সঙ্গে মেলে। এতে সুবিধা হলো, তাতে গল্পের ভেতরে তারা ঢুকে যায় এবং কল্পনায় তাদের সঙ্গী হয়। কিন্তু রোদেলা নামের শিশু মেয়েটি কি তা পারে?

রোদেলা বুড়ো লোক দেখেছে টিভিতে। আর গাঁয়ের শিশুরা বুড়োদের পায় তাদের পরিবারে কিংবা পাড়া-প্রতিবেশে। এখানেও পার্থক্য আছে। তবে ভাষার ক্ষেত্রে গ্রামীণ শিশু আর শহুরে শিশুর মধ্যে তেমন কোনো বড় পার্থক্য হয় না। যে কয়টি বাক্য উদ্ধৃত করেছি তাতে কেবল বর্ণনা, যাতে ইনফরমেশন আছে। কিন্তু সেখানে শিশুর ভাষার প্রয়োগ নেই।
‘সেদিন রোদেলা এইরকম খুনসুটি করতে করতে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে, দাদু, তুমি পরী দেখেছো? দাদু বলে, পরী? হ্যাঁ দেখেছি তো।’
এ নাগরিক কন্টেন্ট বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু শিশুর বৌদ্ধিক পরম্পরায় কিন্তু খুব বেশি পার্থক্য রচিত হয়নি। অর্থাৎ নগর ও লোকজীবনের মিশেলেই শিশুর মানবিক ও বৌদ্ধিক জীবন গড়ে ওঠে। আর তা আমাদের শিশুসাহিত্যিকদের কলমের নিবে লেগেই থাকে।
‘আরে, আমি বুড়ামানু। আমার লগে দিদারি করতাছস কেঠা! আমারে ডর দেহায়া লাভ কী?’
না কোনো লাভ নেই।
লাল পরী একবারে সামনে এসে দাঁড়ালো। ওর গোলাপি গাল থেকে যেন লাল আভা বেরুচ্ছে। সাদা ফকফকে ডানা দুটো বৌদ্ধ পূর্ণিমার আলোয় ঝিকমিক করছে।
কেঠা? কিউ গা তুমি?
আতঙ্কে চোখ দুটো যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে আক্কাস আলির।
আমি একজন লাল পরী।
পরী, কও কী? পরী আইবো কইথে?
ভয়ে কাঁপতে থাকে আক্কাস আলি।

(আক্কাস আলি ও পরীর গল্প/ আমীরুল ইসলাম/পরীর গল্প/ ধ্রুব এষ সম্পাদিত)
বাগানের মালী আক্কাস আলি আর পরীর কথোপকথনের ভাষায় কিন্তু বলে দেয় পরী বেশ শিক্ষিত এবং আক্কাস আলি প্রায় নিরক্ষর। এবং সে লোক বাংলারই প্রতিনিধি। পরী মেয়েটি কেবল বাংলা ভাষাই জানে না, এক্কেবারে কলোক্যাল স্ট্যান্ডার্ডে কথা বলে। নাগরিক মানুষের বুকিশ ভাষা এটা। বুকিশ নয় এমন ভাষাও এই মহানগর ঢাকায় বাস করে তাদের সংখ্যা কোটির অধিক হবে। এদের অধিকাংশই গ্রাম থেকে আসা। ক্যারেক্টারাইজেশনের জন্য লেখক বেছে নেন তাকে কোন ভাষার মানুষ হিসেবে দেখাবেন। পরী যেহেতু বাস্তব কোনো জীব নয়, কল্পিত এবং নগর ও লোকজীবনেও তার দেখা মেলে না, তার পক্ষে পরীস্থানের ভাষাই যথার্থ হতো। কিন্তু কথিত কুহিকোস্থানের কোনো সামাজিক ভাষা আছে কি না, শিশুসাহিত্যিকরা তা জানেন না। তাই তার সমাজের যারা নিয়ন্ত্রক শ্রেণি তাদের মুখের ভাষাই তাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন তারা। কারণ, যারা এই পরীর গল্পটি পড়বেন, তারা অবশ্যই সমাজের সেই শ্রেণির মানুষের সন্তান যারা শিক্ষিত ও সুযোগপ্রাপ্ত। কিন্তু যারা পরী বিশ্বাস করে, তাদের বুকিশ জ্ঞান নেই, তাদের শিক্ষা-দীক্ষার ছিটেফোঁটাও নেই, তাই তাদের ভাষায় লেখা হয় না পরীর গল্প। ভাষা তো শাসকশ্রেণির হাতে গড়ে ওঠা একটি সামাজিক-রাজনৈতিক হাতিয়ার, তার ব্যবহার সুনিপুণ হলে যারা অক্ষর-জ্ঞানহীন তারা বুঝতেই পারবে না কী লেখা হয়েছে। কেন গ্রামের শিশুদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখা হচ্ছে, তার কারণ অনুসন্ধান জরুরি। বেশি মানুষ গ্রামে বাস করলেও আমরা তাদের ভাষায় লিখি না। কারণ আমরা জানি তারা পড়তে পারে না। আমরা তাদের স্বাক্ষর বানিয়ে শিক্ষার হারকে উচুতে তুলেছি। এটা একটি রাজনৈতিক ছল। গণমানুষকে ফাঁকি দেয়া এবং সুবিধাভোগীদের পাতে আরো কিছুকাল শোষকের তখতে তাউসে বসবার সুযোগ রেখে দেয়া। আর কতকাল এটা করবে তারা, সেটাই হচ্ছে আসল প্রশ্ন।

শিশুসাহিত্যের ভাষা গল্পে-উপন্যাসে তেমনভাবে না পাল্টালেও কিন্তু ছড়া সাহিত্যে বেশ ভালোরকমই পাল্টে গেছে। কারণ শিশুসাহিত্যের ওই ছড়ার শাখাটা তুতু-মার্কা থেকে রাজনৈতিক সমাজের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকেই। আর পাকিস্তানি শাসনামলে এসে সত্যিকার অর্থেই ছড়ার বাণী হয়ে উঠলো রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিরোধের লাল হাতিয়ার।
ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!
শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে
দুয়োর বেঁধে রাখ।
কেন বাঁধবো দুয়ার জানালা
তুলবো কেন খিল?
আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে
ফিরবে সে মিছিল।

কোথায় পাবো মতিয়ুরকে
ঘুমিয়ে আছে সে!
তোরাই তবে সোনামানিক
আগুন জ্বেলে দে।
(ঊনসত্তরের ছড়া/আল মাহমুদ/পাখির কাছে ফুলের কাছে/বাংলাদেশের ছড়া/ভূমিকা- শাহাবুদ্দীন নাগরী/শিল্পতরু, ১৯৮৮, ঢাকা)
চার ও পাঁচ-এর দশকের ছড়ার থেকে ছয়-এর দশকের ছড়ার চেহারা ও রাজনৈতিক চরিত্র যে গণমানুষের প্রতি দায়বদ্ধ হয়েছে।

২.
ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমাদের চৈতন্যে ভাষা আন্দোলন, তার রাজনৈতিক সামাজিক ও ভাষিক অবদানের কথা আমরা গালভরে উচ্চারণ করি আর তার জন্য একধরনের কান্নার অভিনয় করি। হ্যাঁ, এটাই সত্য। কারণ, প্রকৃত প্রস্তাবে ভাষার বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ যেমন অনুদার, তেমনি তা বাস্তবায়নেও ধীরগতি লক্ষিত হয়। এই তো শুনলাম, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলছিলেন বিচারপতিদের উদ্দেশ্যে, তারা যেন রায় লেখেন বাংলায়। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করছে আর বাংলার আদালতের মাননীয় বিচারকগণ মামলার রায় ইংরেজিতে লিখছেন। এটা যে ব্রিটিশদের অনুকারিতা, এটা যে ব্রিটিশ পদলেহন আমাদের মাননীয় বিচারকগণ এটা বুঝতে পারছেন না। আমরা অতীতে ববারই বাংলায় রায় লেখার অনুরোধ করতে দেখেছি, এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই অনুরোধই করেছেন কিন্তু বিচারকগণ বাংলায় রায় লিখবেন কি না, তা তারাই ঠিক করবেন। সাংবিধানিকভাবে বিচার বিভাগ প্রশাসনিক বিভাগ থেকে আলাদা। সে কারণেই রাজনৈতিক সরকার কোনো নির্দেশ দিতে পারেন না। বিচারপতিদের ন্যায়বোধ কি এই সত্য ধরা দেয় না যে আমাদের সাধারণ মানুষ যেন মামলার রায় ঠিকমতো বুঝতে পারেন, সেই ভাষায়ই রায় লেখা উচিত!

সাহিত্যের ভাষা নিয়ে আরো ব্যাপকভাবে গবেষণা হওয়া জরুরি। শিশুসাহিত্যের ভাষা নিয়েও ভাষাবিদদের গবেষণা জরুরি। সমাজ যেমন পাল্টে যাচ্ছে, তেমনি পাল্টে যাচ্ছে শিশুকিশোরদের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিবেশও। ভাষাও যাচ্ছে পাল্টে। সেসব নিয়েও গবেষণা হওয়া উচিত। আমরা সেটাই চাই।

Share.

মন্তব্য করুন