বিশ্ব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কালকে মধ্যযুগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কখন থেকে এটি শুরু হয় এবং কখন এটি শেষ হয়, সর্বোপরি এর পরিব্যাপ্তি নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। ইউরোপীয় ইতিহাসের আলোকে মধ্যযুগ বিবেচনা করা হয় ৪৭৬ হতে ১৪৯২ সালের আগ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বছর সময়কালকে। এ সময়ে রোমান সাম্রাজ্যের পতন, আধুনিক ইউরোপের নব যাত্রা, ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নতুন বিশ্ব আবিষ্কার, ইউরোপীয় রেনেসাঁ যুগের সুচনাসহ ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। অপরদিকে এ সময়টিতেই ইসলামের আবির্ভাব, ইসলামী সোনালি যুগের প্রবর্তন ও সমাপ্তি, বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের পতন, ক্রুসেডের যুদ্ধ ও এর প্রভাবসহ নানা ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আরব দেশের পবিত্র মক্কা নগরীতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাব হয়। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন এবং ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় হিজরত করেন এবং সেখানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্ব ইতিহাসের এক জটিল পরিস্থিতিতে তাঁর আবির্ভাব হয় এবং তিনি জাহেলিয়াতের কঠিন চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে আল কুরআনের শিক্ষা ও তাঁর সুমহান চরিত্রের মাধ্যমে তিনি বিশ্বে একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তিনি পরিণত হন বিশ্ব ইতিহাসের সর্বাধিক আলোচিত, প্রশংসিত এবং প্রভাব সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্বরূপে। তাঁর সুমহান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, নেতৃত্বের অসাধারণ গুণাবলি এবং সৌন্দর্য ও সুকীর্তির সমন্বয়ে তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ও মহত্তম ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তাঁর এ আবির্ভাব ও নতুন বিশ্বব্যবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাসে সোনালি যুগ শুরু হয়। তাঁর পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদার সময়কাল, উমাইয়া যুগ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.), আব্বাসীয় যুগ (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.), ফাতেমীয় যুগ (৯০৯-১১৭১ খ্রি.) ইত্যাদির ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ ১৯২২ সালে তুরস্কের উসমানীয় খেলাফতের পতনের মাধ্যমে ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিসমাপ্তি হয়। এ দীর্ঘ সময়কালে মুসলমানরা বিশ্বে এক নতুন সভ্যতার জন্ম দেন। ইসলামের ইতিহাসের এ দীর্ঘ সময়কাল সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে সকল যুগ সমান না হলেও সামগ্রিকভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বিশেষ করে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়কাল হতে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সৃষ্টি ও বিকাশের জন্য ‘সোনালী অধ্যায়’ (The Islamic Golden Age) হিসেবে বিবেচিত হয়।

তথাপি ইসলামী সোনালি যুগের ব্যাপ্তি নিয়ে গবেষকদের নানা মত রয়েছে। তবে অধিকাংশের মতে, সময়টা সপ্তম শতকের মাঝামাঝি থেকে ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিস্তৃত। অর্থাৎ আব্বাসীয় শাসনামলের পতনকাল পর্যন্ত। আবার কেউ কেউ অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীকে ধরেছেন। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, অবশ্য এ সময়কাল পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত দীর্ঘায়িত। তবে অত্র প্রবন্ধে বক্ষমাণ আলোচনা উসমানীয় খেলাফতের পূর্বযুগ (৬২২-১৪৫২ খ্রি.) পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে। আল কুরআনে বারবার জ্ঞান চর্চার তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে মুসলমানরা আন্তরিকভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর জীবদ্দশায় তাঁর সাহাবী ও অনুসারীদের মধ্যে জ্ঞানের চর্চা ও বিকাশের বিরাট কর্মচাঞ্চল্য পরিচালিত হয়। তাঁর সময়ে সাহাবীদের শিক্ষাদানের জন্য মসজিদে নববী কেন্দ্রিক যে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, পৃথিবীর ইতিহাসে সেটাই প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃত। বস্তুত ইসলামের প্রাথমিক কাল থেকে শুরু করে উমাইয়া শাসককাল (৭৫০ খ্রি.) পর্যন্ত মসজিদই ছিল জ্ঞান চর্চার বৃহত্তম বিদ্যাঙ্গন।

এ প্রসঙ্গে ইতিহাস পর্যালোচক ড. আহমদ আমীন বলেন, ‘‘প্রকৃতপক্ষে তখন মসজিদই ছিল জ্ঞান চর্চার বৃহৎ অঙ্গন। মসজিদ তখন নিছক উপাসনালয় ছিল না, সালাত আদায়ের পাশাপাশি সেখানে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড সম্পন্ন হতো। এমনকি কাযী সাহেবের আদালত ও বিচারসভাও বসতো মসজিদেই। অবশ্যই এখানে আমরা এটুকু শুধু বলতে চাই যে, মসজিদ সে যুগে বিদ্যা চর্চার সর্ববৃহৎ ক্ষেত্র ছিল। মিসরের আমের মসজিদ, বসরার মসজিদ, কুফার মসজিদ, মক্কা ও মদিনার হারাম শরীফ প্রভৃতি মসজিদ জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে আধুনিক যুগের বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকাই পালন করত। বস্তুত ইসলামের অন্যতম মূলনীতি হিসাবেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদকে জ্ঞান চর্চার অঙ্গন বানিয়েছিলেন। গোটা উমাইয়া শাসনকাল পর্যন্ত মসজিদের এ ভূমিকা অব্যাহত ছিল।’’ শুধু তাই নয়, উমাইয়া যুগের পরেও ইসলামী সভ্যতায় মসজিদ গ্রন্থাগার জ্ঞান-চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করে। কায়রোর তুলুন মসজিদ, আলেপ্পোর জামে মসজিদ, তিউনিসার যায়তুন মসজিদ, আল আকসা মসজিদ, বাগদাদের যায়দিয়া মসজিদ, কায়রোর আল আজহার মসজিদ, মরক্কোর আল কায়রোয়ান মসজিদ, সিরিয়ার দামেস্ক মসজিদ ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইতিহাস গবেষক ম্যাকারসন মসজিদ গ্রন্থাগারের ভূমিকা সম্পর্কে বলেন-
Books were presented and many scholars bequeathed his library to the Mosque of his city to ensure its presevation and to render the books accessible to the learned who frequented it. And so grew up the great universities of Cordova and Toledo to which flocked Christians as well as Moslems from all over the world, and the famous al-Azhar in Cairo, which after almost a thousand years is still the most famous educational centre of the Mohammedan world Mackensen 1935, 123).’’
মহানবী সা.-এর অর্বতমানে তাঁর অনুসারীগণ কুরআন-হাদীস সংকলন ও সংরক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে রাসূল (সা.)-এর সীরাত বা জীবনচরিত সংরক্ষণের প্রয়োজনে ইতিহাস রচনার দিকে মনোযোগ দেন। এর পরে কুরআন সুন্নাহর নির্দেশনা মোতাবেক জীবন পরিচালনার জন্য ইসলামী আইন শাস্ত্রের উদ্ভব হয়। জ্ঞানের চর্চা ও বিকাশের এ ধারাবাহিকতায় গণিত, ভূগোল, ইতিহাস, মহাকাশ বিদ্যা, চিকিৎসা বিদ্যাসহ জীবনঘনিষ্ট অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞান তারা আবিষ্কার করলেন। মহানবী সা.-এর ইন্তেকালের এক শতাব্দীকালের মধ্যেই ইউরোপ এশিয়া আফ্রিকা তথা স্পেন থেকে আরম্ভ করে ভারতের সিন্ধু নদ পর্যন্ত ইসলামী সভ্যতা বিকাশ লাভ করে। এ বিশাল অঞ্চলজুড়ে মুসলমানরা জ্ঞান সৃৃষ্টি, চর্চা ও বিকাশে এক অনন্য নজীর স্থাপন করেন। এ যুগের মুসলমানরা শুধু দেশ জয় করে ক্ষান্ত থাকেননি বরং তারা বিজিত এলাকায় জ্ঞান চর্চা ও বিকাশের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, গ্রন্থাগার স্থাপন করেছেন, পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গকে জ্ঞান বিতরণের জন্য অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, সম্মানিত করেছেন। মুসলমানদের উদ্যোগেই বাগদাদ, কায়রো, ফেজ, কর্ডোভাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। এমনকি সেগুলোর বিস্তৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ লাভ করেছিল। তারা শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা উন্নত জাতিতে পরিণত হয়েছিল। জন্ম দিয়েছিল আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের।

সার্বিকভাবে বলা যায়, মুসলমানরা মধ্যযুগে জ্ঞান সৃষ্টি ও বিকাশের ক্ষেত্রে একটি সোনালি অধ্যায় রচনা করেছিলেন। ইসলামের নব উদ্দীপনা বলিয়ান হয়ে মুসলমানরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন ভাষায় রচিত মনীষী, বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারকদের গ্রন্থাবলি সংগ্রহ করত তা আরবি ভাষায় ভাষান্তর করেন। বিশেষ করে গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষায় রচিত গ্রস্থসমূহ সংগ্রহ করত তা আরবি ভাষায় ভাষান্তরিত করা হয়। সেগুলোই পরবর্তীকালে বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম গবেষক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিকিৎসকদের আবির্ভাবের পথ তৈরি করে দিয়েছিল। অন্যদিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার এই প্রবহমান ধারায় মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ পাঠাগার। এর মধ্যে বাগদাদ, কায়রো, বোখারা, সমরকন্দ, নিশাপুর, মসুল, মার্ভ, বসরা, ইস্পাহান, শিরাজনগর, কায়রো, কর্ডভা, সেভিল, দামেস্কে, মক্কা, মদিনা প্রভৃতি নগরীতে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারগুলোর কথা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

মুসলমানদের স্পেন বিজয় ইসলামের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যময় ঘটনা। ৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুসা বিন নুসাইর এবং তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে এক ঐতিহাসিক অভিযানে মুসলিমরা স্পেন জয় করে। ৮ম শতক থেকে শুরু করে ১৫ শতক পর্যন্ত প্রায় ৮শ’ বছর মুসলমানদের শাসনামলে স্পেন সভ্যতা ও সংস্কৃতির উচ্চস্থানে উন্নীত হয়েছিল। মুসলিম শাসকরা বিজিত ভূখণ্ডের রাজধানী হিসেবে কর্ডোভাকেই বেছে নেয়। স্পেনের মুসলমানরা বিজিত ভূখণ্ডের সার্বিক উন্নয়নের প্রতি পূর্ণরূপে মনোনিবেশ করেন। খলীফাদের নিয়োগ করা মোট তেইশ জন প্রশাসক এই ভূখণ্ড শাসন করেছিলেন। এই সময়ের স্পেন ঐশ্বর্য ও জ্ঞানবিজ্ঞানের সোনালি যুগ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। জ্ঞানবিজ্ঞানের এ সোনালি অধ্যায় সৃষ্টির মূলেই ছিল গ্রন্থাগার। মুসলিম স্পেনের সামগ্রিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারের অবদান অপরিসীম।

দশম শতাব্দীতে স্পেনের কর্ডোভা নগরীতে খলীফা ২য় হাকামের (৯৬১-৭৬ খ্রি.) সময় একটি বৃহৎ লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ লাইব্রেরিতে যে বিশাল সংগ্রহশালা গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে ধর্মীয় গ্রন্থাদি, গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, দর্শন, আইন ইত্যাদি বিষয়ের পুস্তকাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, সেখানে প্রায় চল্লিশ লাভের অধিক বইপুস্তক সংগ্রহ করা হয়েছিল। সে সময়েও এ গ্রন্থাগার ব্যবহার করার জন্য মধ্য এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল হতে অসংখ্য পাঠক আগমন করতেন। স্পেনের মুসলিম খলীফাগণ এ গ্রন্থাগারের জন্য প্রাচ্যের রাজধানীসমূহ হতে অন্ততপক্ষে চার (মতান্তরে ছয়) লক্ষ পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেন। এই বিরাট লাইব্রেরির পুস্তকের তালিকা তৈরিতে প্রয়োজন হয়েছিল বিরাট বিরাট রেজিস্ট্রার, যার সংখ্যা প্রায় ৪০ খণ্ডের অধিক ছিল বলে জানা যায়। খলীফা দ্বিতীয় হাকাম উপহার হিসেবে বই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন। সে কারণে তার কাছে উপহার হিসেবে অনেক দামি দামি বই আসত, যা তিনি এ গ্রন্থাগারে জমা দিতেন। খলীফার ব্যক্তিগত একটি গ্রন্থাগার ছিল, যেখানে বই এর সংখ্যা ছিল প্রায় ছয় লাখের মতো। পশ্চিমা গবেষকদের গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, দশম শতাব্দীতে ইউরোপে সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি ছিল এ হাকাম লাইব্রেরি। বাগদাদের বায়তুল হিকমাহর পরে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্রন্থাগার ছিল।

এই লাইব্রেরিতে প্রায় ১০০ জনের বেশী কর্মচারী-নকলনবিশ ছিলেন, যাদের কাজ ছিল বিভিন্ন ভাষার বই আরবিতে অনুবাদ করা। এরা প্রত্যেকেই এক এক জন ছিলেন অত্যন্ত বিদগ্ধ জ্ঞানী ও পণ্ডিত লোক। এদের মধ্যে মুসলমান ও ইহুদী উভয় ধর্মের পণ্ডিতই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে খলীফা হাকামের মৃত্যুর পর হতে এই লাইব্রেরিটি জৌলুস হারাতে থাকে। ১০০২ খ্রিস্টাব্দে স্প্যানীয়দের আক্রমণে কর্ডোভা লাইব্রেরিটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
কেবল গ্রানাডাতেই নয়, বরং পুরো মুসলিম স্পেনে এরকম লাইব্রেরির সংখ্যা ছিল সত্তরটি। মুসলিম স্পেনের রাজকীয় গ্রন্থাগারের পাশাপাশি আরো অনেক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তৎকালীন সেই পাঠাগারে সংরক্ষিত ছিল ছয় লাখ গ্রন্থ। এছাড়াও গ্রানাডার আল হামরা প্রাসাদ সংলগ্ন লাইব্রেরি, সেভিল, টালেডো, মালাগো, ভ্যালেনসিয়া প্রভৃতি শহরে গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে। পাশাপাশি কর্ডোভা, সেভিল, মালাগা এবং গ্রানাডাসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বহু গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গ্রন্থাগার জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। সমকালীন যুগের পণ্ডিত ব্যক্তিদের এসব লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হতো। লাইব্রেরির ইতিহাস গবেষকদের মতে-  It was the practice to appoint a librarian to take charge of the affairs of the library. Such a duty was only for the most learned amongst men; those ‘of unusual attainment,’ were selected as custodians of the libraries.

অথচ এ সময়ে ইউরোপ জুড়ে সবচেয়ে বড় যে পাঠাগারগুলো ছিল, তা ছিল মূলত খিস্টান আল হাজরামি (মৃ. ১০০৫/৬ খ্রি.), আবু ওয়ালিদ ইবনে আল মসুল, মানসুরে ক্রীতদাস ফাতিন, আর্কিডোনার প্রখ্যাত লিপিকার কাশিম বিন সাদা (মৃ. ৯৮৫ খ্রি.), আবু আলী আল গাসানী, আল জাহানী (মৃ. ১০০৪ খ্রি.), তরতোসার ইয়াহিয়া বিন মালিক বিন আয়িজ (মৃ. ৯৮৫ খ্রি.), কর্ডোভার মুহাম্মদ বিন আজম ইবনুল সবুনী (মৃ. ১০০২ খ্রি.), আবু বকর বিন জাকায়া (মৃ. ১০৪৩ খ্রি.), ইবনে আওয়াল আল মা’আফিরী (মৃ. ১১১ খ্রি.), ইবনে মুখতার (মৃ. ১১৪০ খ্রি.), কর্ডোভার আহমদ বিন মুহাম্মদের কন্যা আয়েশা (মৃ. ১০০৯ খ্রি.), উমাইয়া সভাসদ পত্নী রাজিয়া (মৃ. আনু. ১০৩২ খ্রি.), জাফরের কন্যা খাদিজা, ইবনুল আহদাব (মৃ. ১০৪৫ খ্রি.), আবু বকর ইবনুল আরাবী মুহাম্মদ ইবনে খায়ের, আল রাজী, কাযী ইবনুল হাজাজ আল লাখমী (মৃ. ১২০৪ খ্রি.), বাদাজোযের অধিবাসী আবু মুজাফফর বিন আল আফতাজ প্রমুখ পণ্ডিত গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব মূল্যবান লাইব্রেরি।

১৪৯২ সালে স্পেনে মুসলমানদের পতনের মাধ্যমে ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয় এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগারের ভাগ্যে নির্মমতা নেমে আসে। মুসলিম সাম্রাজ্য ছোট হতে হতে একেবারে গ্রানাডার মানচিত্রে সীমায়িত হয়ে পড়ে। এ গ্রানাডাই ছিল আন্দালুসের শেষ মুসলিম শহর। ২ জানুয়ারি ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে স্পেনীয় বাহিনী গ্রানাডায় প্রবেশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দালুসের সর্বশেষ মুসলিম রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেয়। দখলকারীরা যখন বিজয়ীর বেশে স্পেনে প্রবেশ করে, তখন তারা প্রথমেই এই লাইব্রেরিকে ধ্বংস করে দেয়। বহুসংখ্যক বই-পুস্তককে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি এবং অবশিষ্টগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। স্পেনে মুসলমানদের পতনের ফলে যে বিরাট বিরাট গ্রন্থাগার ধ্বংস হয়েছে, তা ইতিহাসের এক বিষাদময় ঘটনা।

Share.

মন্তব্য করুন