আমাদের এই বাংলাদেশে নানারকম মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। আমরাও অনেকেই মেলা দেখতে যাই খুব তোড়জোড় করে। মেলায় ঘুরে ঘুরে দেখি কত প্রদশর্নের আয়োজন। কতনা কি দেখা যায় মেলায়। মাটির বানানো হাতের কাজে কত কিছু পেয়ে যাই। পছন্দ হলে কিনে নিতে কেউ দেরি করে না। শিশু-কিশোরদের জন্য কত যে ব্যবস্থা থাকে। খেলাধুলার বিষয় তো থাকেই। সাথে থাকে রাইডার জাতীয় বিভিন্ন বিষয়। খেলনার কতরকম কিছু থাকে। আরও থাকে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা। এসব ভেবে শিশু-কিশোরেরা মেলায় যাওয়ার জন্য পাগলপারা থাকে। অনেক সময় অভিভাবকরা বাধ্য হয় মেলায় যেতে।

এসব মেলার একদম বাইরে হলো বইমেলা। অন্য মেলাগুলোতে শতরকম জিনিসের সমাহার থাকে। কিন্তু বইমেলায় শুধু বই আর বই। ডানে বাঁয়ে সামনে পেছনে শুধুমাত্র বইয়ের উপস্থিতি। ছোট বড় মাঝারি স্টল আর প্যাভিলিয়ন থাকে বইমেলায় বই প্রদর্শনের জন্য। দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে নানারকম পাঠক পাঠিকা। ঢাকা থেকে তো আসেই এবং আসবেই। ঢাকার বাইরে থেকেও আসে পাঠকরা। এখানে বাইরে বলতে দু চারটি জেলার নয়। বরং সকল জেলা থেকেই আসে পাঠক গোষ্ঠী। মেলায় ঘুরে ঘুরে বই দেখে তারা। দেখতে দেখতে এক সময় পছন্দের বই পেয়ে যায়। পছন্দের বই পেলেই কেনার চেষ্টা করে।
আবার অনেকের পছন্দের লেখক আছে। ওই লেখকের বই আছে কিনা খবর নেয়। অথবা আগে থেকে জেনে যায় কোন স্টলে প্রিয় লেখকের বই পাওয়া যাবে। ঠিক সেই স্টলে গিয়ে বলে- অমুক লেখকের বই কি আছে? যখন আছে বলে তো তখনই কিনে নেয় খুব মজা করে। এভাবে বই সংগ্রহ করে পাঠকেরা।

বইমেলা ২০১৪ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে হতো বাংলা একাডেমির ভেতরে। ওখানে খুব ছোট জায়গায় ছোট ছোট স্টল হতো। সামনে জায়গা ছিলো কম। মেলায় লোক বেশি হলে কি যে ঠেলাঠেলি হতো! মানুষের গায়ের সাথে গা লেগে লেগে যেতো। বড়রা শক্তি দিয়ে চলতে পারলেও শিশু-কিশোরদের অনেক কষ্ট হতো। পছন্দের বই দেখার সুযোগও হতো খুব কম। ফলে অনেকের মনে মেলা দেখার সাধ মিটতো না।
কিন্তু এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা হওয়ার কারণে জায়গার আর অভাব নেই মোটেই। এখন স্টলের পাশাপাশি একদম বিশাল আয়তনের প্যাভিলিয়নও থাকে। প্যাভিলিয়নে চারিদিকে সাজানো থাকে বই। দেখতে অনেক সুন্দর এবং সাজানো গোছানো। অনেকে আবার জনপ্রিয় লেখকদের ছবি টাঙিয়ে রাখে। দূর থেকে দেখা যায় কবি উপন্যাসিক ও গল্পকারদের ছবি। ফলে পাঠকগণ সহজে পছন্দের লেখকের বই খুঁজে নিতে পারে।

ফেব্রুয়ারির বইমেলা ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ থেকেই শুরু হয়ে যায়। চলে সারা মাস ধরে। কিন্তু গত দুটো মেলা আর এবারের মেলা আয়োজনে নানান সমস্যা সামনে ছিলো। সমস্যাগুলো এসেছে করোনার ভয়াবহতার কারণে।
এবারের বইমেলা শুরু হয়েছে ফেব্রুয়ারির ১৫ তারখ থেকে। প্রথমে বলা হয়েছিল ১৫ তারিখ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত মেলা চলবে। প্রকাশকদের জোর দাবীর কারণে মার্চের ১৭ তারিখ পর্যন্ত মেলার সময় বাড়ানো হয়েছে।
বইমেলায় বড়দের জন্য বেশি আয়োজন থাকে। কিন্তু ছোটদের জন্যও থাকে আলাদা আয়োজন। শিশু কর্নার থাকে মেলার ভেতর। শিশু কর্নারে শিশু-কিশোরদের উপযোগী বইপত্র সাজানো থাকে। মজার মজার গল্পের বই। রূপকথার বই। উপন্যাসের বই। ছড়া-কবিতার বই। কতরকম বইয়ের সমাহার থাকে বইমেলায়। শিশু-কিশোরেরা বাবা মা বড় ভাই বোন বা কাছের কোনো আত্মীয় স্বজনের হাত ধরে আসে বইমেলায়।
পছন্দের লেখকের বই অথবা দেখে ভালো লাগা বই কিনে নেয় তারা। যদি বইয়ের লেখকের সাথে দেখা হয়ে যায় তো আর কথাই নেই। প্রথমতঃ অটোগ্রাফ নেবেই। তারপর ছবি এবং সেলফি তুলবে। কারণ ফেসবুকে দিতেই হবে এসব ছবি এবং কেনা বইয়ের কাহিনি। মজার বিষয় হলো অনেক শিশু-কিশোর এবং বড়রাও আসে শুধু ছবি আর সেলফি তোলার উদ্দেশ্যে। এরা তেমন করে বই কেনে না।

আমরা সবাই জানি একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষার মাস। কেনো? কারণ এ মাসে ভাষার জন্য শহীদ হয়েছে অনেকেই। আমাদের মাতৃভাষা বা মায়ের মুখের ভাষা হলো বাংলা ভাষা। সেই বাংলা ভাষায় যখন কথা বলতে এবং লেখাপড়া করতে অসুবিধা হতে লাগলো। পাকিস্তানি শাসকেরা অকারণ বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা করলো। বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষা করতে পারলো না। তখন প্রতিবাদ হলো এখানে এই বাংলাদেশে। তখন এর নাম ছিলো পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার দাবীতে মিছিল বের করে। তখন পাকিস্তানি শাসকেরা ১৪৪ ধারা জারি করে। বাংলার তরুণ যুবকেরা মিছিল নিয়ে ভেঙে ফেলে ১৪৪ ধারা। ঠিক ওই মিছিলে গুলি বর্ষন করে পুলিশ। এতে বরকত, জব্বার, রফিক, সালাম ও শফিউর এই পাঁচজন শহীদ হন। ফলে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি জাতীয় ভাবে স্মরণীয় হয়ে গেলো। এখন কিন্তু শুধু জাতীয় ভাবে নয় বরং আন্তর্জাতিক ভাবে সারা বিশ্ব আমাদের এই একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি ভাষা দিবস হিসেবে পালন করে। বিশ্বের সকলেই জানে বাংলা ভাষার নাম। কি মজার বিষয় এটি। আরও মজার বিষয় হলো সারা পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজারের উপরে। এই বিশাল সংখ্যক ভাষার মধ্যে আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা হলো পাঁচ নম্বরে। আহা কি যে আনন্দের কথা। কি যে উৎসাহের বিষয়টি।

এখন আমরা আমাদের ভাষার মান রাখতে হবে খুব করে। নইলে অন্যরা মান রাখবে না।
ভাষার মান রাখার জন্য আমাদেরকে ভাষার বিষয়ে আরও ভালো করে শিখতে হবে। শুদ্ধ করে বলতে লিখতে এবং প্রয়োগ করতে হবে। তাহলেই শুধু ভবিষ্যতে বাংলা ভাষা আরও এগিয়ে যাবে। উন্নত হবে আরও।
বইমেলার আয়োজনের মাধ্যমে আমরা আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের মান বাড়াতে পারবো। বইমেলার মতো এমন জ্ঞানের মেলা আর কোনো বিষয়ের মেলায় নেই। বই মানেই আনন্দ আর সুন্দরের এক মিলমিশ। এখানে লেখক পাঠক দর্শক আর প্রকাশকের সমাবেশ। সবার মুখ কেমন হাসিহাসি থাকে। একটি উৎসব উৎসব ভাব থাকে। মনে হয় সবার মন খোলা। দিল খোলা। আর প্রাণ খুলে এগিয়ে চলার একটি আয়োজন। সুতরাং বইমেলা মানেই হলো আমাদের প্রাণের মেলা।

Share.

মন্তব্য করুন