পাইন্যা মাতবরের দু’টি পাতিহাঁস চুরি করেছে ভেন্ডিভাঙা গ্রামের আতশ। অনেকদিন আতশের শহর দেখার ইচ্ছা ছিল। শহর দেখার জন্য চাই টাকা। সে আধা পাগল মানুষ। চাইলে কেউ তাকে দেবে না। তাই চুরি করে শহরের যাওয়ার বন্দোবস্ত করে ফেলল। বড় বাজার গিয়ে বাস ধরল। বাসে উঠে বসল আরাম কেদারায়। তারপর নাক ডেকে ডেকে, শরীর এঁকেবেঁকে, এক ঘুমে চলে এলো স্বপ্নের শহরে।
লোকমুখে এই শহরটার খবর পেয়েছে সে। গহিন জঙ্গলের ভেতর নদীর ওই পাড়ে শহর। শহরে পৌঁছেই রাত হয়ে গেল। ঘুমের জন্য একটি হোটেলে গিয়ে ঘর ভাড়া নিলো। হোটেলটা জঙ্গলের সঙ্গে। রাতের অন্ধকার চিরে ঘন জঙ্গলের বুক থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসছে। চেনা কোনো আওয়াজ নয়। আতশ ভাবছে মাদল বা ঢাক জাতীয় কিছু। দ্রিম দ্রিম রবটি জঙ্গলে সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বেজে চলেছে। কিন্তু পরক্ষণেই ভুলটা ভেঙে গেল তার। আওয়াজটা বড় গম্ভীর শব্দে ছড়িয়ে যাচ্ছে চারিদিকে। ফলে জঙ্গলের ভেতরে শীর্ণকায় নদীর ধারের এই হোটেলের বারান্দায় বসে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে যাচ্ছে তার মনের মধ্যে। মনটাকে ফেরাতে ডাল ভাতের অর্ডার করল কেয়ারটেকারকে। মিনিট কয়েক পরেই ধূমায়িত গরম ভাতের প্লেটটা নিয়ে যে এলো তাকে ঠিক প্রকৃত মানুষ মনে হলো না। যেন পাথর খোদাই করে কোন দক্ষ শিল্পী একটি কঠিন মূর্তি তৈরি করেছে। আতশ তার কাছে জানতে চাইল, ‘তোমার নাম কী?’
অদ্ভুত ফ্যাসফ্যাসে গলায় লোকটি বলে উঠল, ‘ভিমবুল।’
কেমন আধাভৌতিক লাগলো কণ্ঠস্বরটা। নামটিও যাচ্ছেতাই! আতশ বুঝল, লোকটি বেশি কথা পছন্দ করে না। তাই কোনো কথা না বলে প্লেটের ডালে চুমুক দেওয়ার সময় ফুড়–ত… ফুড়–ত… শব্দ তুলল। প্লেটের ডাল চেটেপুটে খাওয়া শেষ হতেই একটা আলগা সাহস মাথায় আসলো। ডাল খেলে সাহস বাড়ে শহরে এসে প্রথম জানল।
টর্চটা নিয়ে নেমে পড়ল রাস্তায়, রাতের শহর দেখবে। সামনে কুয়াশার চাদরে মোড়া অমাবস্যার জঙ্গল। কানে আসছে নদীর জলের আওয়াজ। নদীর ধার ধরে হাঁটা লাগাল আতশ, লক্ষ বাজনার উৎস। কেমন এক নেশা আছে বাজনার শব্দটায়। খরস্রোতা নদীটি অদ্ভুত জলতরঙ্গ ধ্বনি তুলে এগিয়ে চলেছে। কোনো জনপ্রাণী আছে বলে মনে হচ্ছে না। সহসা সাদা চাদরে মুড়ে ধূমকেতুর মতো সামনে এলো ভিমবুল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘কোথায় যাচ্ছ গ্রামের লোক?’
আতশ এতটাই হতচকিত হয়ে পড়েছিল যে, ভিমবুলের হঠাৎ আবির্ভাবে চট করে মুখে কথা এলো না। একটু আমতা আমতা করে আতশ বলল, ‘জঙ্গলে ঘুরতে যাচ্ছিলাম।’
শুনে ভিমবুল তেমনি কঠিন গলায় বলল, ‘মানুষের পাতিহাঁস বিক্রির টাকায় এত ঘোরাঘুরি ভালো কথা না।’
আতশের বুকের ভেতর কে যেন স্টিমরোলার চালিয়ে দিলো। পাতিহাঁস চুরির খবরটা এখানে পৌঁছাল কী করে বুঝল না। একবার ভাবল সে কিছু ভুল শুনছে। ভিমবুল হাঁস-ফাঁস কিছু বলেইনি। যাওয়া সঙ্কল্প করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল আতশ ভিমবুলের ফেরার অপেক্ষায়। এক হ্যাঁচকা টানে সে তাকে হোটেলে নিয়ে এলো। মনে মনে বলল, হাত তো নয় কঠিন ইস্পাত।
ঘরে এসেও আতশ শান্তি পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, অদৃশ্য দু’টি চোখ প্রতিটি মুহূর্তে অনুসরণ করছে তাকে। বিড়ালের মতো খুব নিঃশব্দে রাস্তায় বেরিয়ে এলো। হাঁটা দিলো জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। সমস্ত পথই তো শেষ হয়ে এলো- ভাবতেই সামনে দেখল দাউ দাউ করে আগুনকে ঘিরে দাঁতে কাটা পশুরা, মাথা ঝুলিয়ে কারা যেন পৈশাচিক এক উন্মাদনায় ঘুরে চলেছে। একটা অদ্ভুত দর্শন ঢাক জাতীয় বাজনা থেকে গুমগুম আওয়াজটা হচ্ছে।
আতশ খুব সন্তর্পণে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। জান্তব শব্দে তাকিয়ে দেখে, শরীরগুলোর মানুষের আকৃতি থাকলেও ঠিক যেন মানুষ নয়। বীভৎস তাদের চেহারা। হঠাৎ মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। থাকতে না পেরে বসে পড়ল সেখানেই। চমকে উঠল গমগমে জান্তব ডাকে। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে ভিমবুল সামনে দাঁড়িয়ে। মুখে ঝুলছে পশুর কাটা মাথা। চোখগুলো থেকে আগুন ঝরছে। জ্ঞান হারাবার আগে শুধু কানে এলো একটি শব্দ- ‘এখানে কেন এসেছিস? পাতিহাঁস চুরি করে এত ঘোরাঘুরি ভালো না।’
সূর্যের আলোয় চোখ খুলে আতশ দেখল পড়ে আছে জঙ্গল মতো জায়গায়। কেউ কোথাও নেই। গত রাতেও যেখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল তার লেশমাত্র কিছু নেই। আতশ ভাবল, তাহলে সবটাই কি আমার চোখের ভুল। না না, স্পষ্ট মনে আছে এখানে গত রাতের পৈশাচিক নৃত্য। বীভৎস চেহারার সব শরীর। দাউ দাউ আগুন। তাহলে ভিমবুল কে? সে কিভাবে জানতে পারল পাইন্যা মাতবরের পাতিহাঁস চুরি করে এসেছে সে! ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে দেখে ভিমবুল এসে হাজির। চাদরে মোড়া ঠাণ্ডা গলার আওয়াজে চারিদিক কেঁপে উঠল। বলল, ‘খুব বেঁচে গেছিস অমাবস্যার রাতটার সময় পেয়েছিল বলে।’
আতশ কিছু না বুঝে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল ভিমবুলের নিষ্প্রাণ শরীরের দিকে। চাদরে জড়ানো কিয়দংশ খোলা মুখের দিকে সাহস করে আর তাকাতে পারল না। এক ঘোরের মধ্যে হোটেলে এসে কাঁধে ঝোলা ঝুলিয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসছে, শুনতে পেল অদ্ভুত পৈশাচিক স্বর- ‘যা যা, আর কখনো কারোর পাতিহাঁস চুরি করবি না। খুব বেঁচে গেছিস।’
হোটেল থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে আসতেই আতশ সামনে দেখতে পেল পিচ রাস্তা। খুব দ্রুত এগিয়ে গিয়ে কোনো যানবাহন পাওয়া যায় কিনা তার চেষ্টা করতে লাগল। তার তখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’র মতো অবস্থা। যা পাব তাতেই চেপে বসব- ভেবে মনে মনে পণ করল আতশ। একটা বালির ট্রাক আসতে দেখে হাত তুলে তাকে থামাল। ড্রাইভার বলল, তারা সামনের গ্রামে যাচ্ছে। আতশ তাদের বুঝিয়ে তাতেই চেপে বসল। ভাবল, যেভাবেই হোক এই ভূতুড়ে শহর থেকে আগে প্রাণ নিয়ে ফিরি, তারপর নিজের শহরে কিভাবে যাব তা ভাবব। মনে মনে আরও একটি প্রতিজ্ঞা করল, কখনও আর কারোর হাঁস-মুরগি চুরি করে নিজের শখ মেটাবে না।
বালির ট্রাক ড্রাইভার তার হেঁড়ে গলায় ভূতুড়ে গান শুরু করেছে। সুনসান রাস্তাটা যেন আরও ভূতুড়ে লাগছে। দেখতে দেখতে ট্রাক গ্রামে চলে এলো। এক জনবহুল জায়গায় ড্রাইভার নামিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিলো কোথায় গেলে শহরের বাস পাওয়া যাবে। তার হাতে কিছু টাকা দিতে চাইলে ড্রাইভার বলল, ‘পাতিহাঁস চুরির টাকায় আমি ভাড়া নিই না।’
আতশ তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগাল। আর এক মুহূর্ত দেরি করলে তার চলবে না। দুইটি পাঁতিহাস কিনে দেবে পাইন্যা মাতবরকে, আর মাফ চাইবে পা ধরে অপরাধের জন্য। এই ভাবনা নিয়েই দ্রুত পা চালাল আতশ নিজের গ্রামের উদ্দেশ্যে।

Share.

মন্তব্য করুন