মহাকাশচারীদের দৈনিক নিয়ম মেনে ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করতে হয়। মনে হতেই পারে শূন্যে ভেসে বেড়ানো তো মজার কাজ? না, শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। যেহেতু সেখানে চলাফেরায় তেমন পরিশ্রম করতে হয় না, তাই পেশি ধীরে ধীরে কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে, হাড় ক্ষয়ে যায়। এ জন্য দিনে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরকে ঠিক রাখতে হয়। মহাকাশ স্টেশনে আছে ব্যায়ামের তিন ধরনের যন্ত্রপাতি। একটি ট্রেডমিল, একটি ব্যায়ামের বাইক এবং সম্প্রতি যুক্ত হওয়া ‘এআরইডি’। ট্রেডমিল তো কেমন হয় জানাই আছে। একই স্থানে দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটার যন্ত্রই হচ্ছে ট্রেডমিল। মহাকাশের ট্রেডমিলে অবশ্য কিছুটা কারিগরি পার্থক্য আছেই। ব্যায়ামের বাইকও মহাকাশের উপযোগী করে তৈরি।

গবেষণা : আইএসএস নিজেই একটি বিশাল গবেষণাগার। সেখানে আছে পাঁচটি ল্যাব মডিউল। রাশিয়ার দুটি, যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডেস্টিনি’, ইউরোপের ‘কলম্বাস’ ও অতিসম্প্রতি যুক্ত হওয়া জাপানের ‘কিবো’। স্টেশনের বাইরে উন্মুক্ত মহাশূন্যে পরীক্ষণের জন্যও আছে ব্যবস্থা। কঠোর শৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে গবেষণা হয় বিভিন্ন পদার্থ ও জীবের, এমনকি ছোটখাটো বিস্ফোরণের ওজনহীনতা নিয়েও। পৃথিবী থেকে সুবিধাজনক স্থানে হওয়ায়, পৃথিবীর ওপর গবেষণা ও ছবি তোলার কাজটাও সেখানে হয়। আগেই বলেছি মহাকাশ স্টেশনে নভোচারীরা মূলত গবেষণার জন্যই যান, ফলে এই কাজটাকে প্রাধান্য দিতেই হয়।

ভ্রমণে বের হওয়া : মাঝে মধ্যে স্টেশনের রক্ষণাবেক্ষণের কাজটা বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। যেমন স্টেশনের বাইরের কোনো অংশ মেরামতের কাজ। তখনই মহাশূন্যচারীকে ভ্রমণে বের হতে হয়, যাকে বলে এক্সট্রা-ভেহিকুলার অ্যাক্টিভিটি (ইভা)। নিঃসন্দেহে এটা মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা তাদের জন্য। তবে এতে ঝুঁকি প্রচুর। একটু এদিক-সেদিক হলেই আছে মহাশূন্যের বিশালতায় হারিয়ে যাওয়ার ভয়। তাই কেউ একা যান না, যান জোড়ায় জোড়ায়। এ জন্য যে পোশাকটি পরতে হয়, তার নির্দেশিকাটিই ১০০ পৃষ্ঠার। শুধু পোশাক পরতেই লেগে যায় চার ঘণ্টা! এরপর টানা আট ঘণ্টার মতো কাজও করতে হয়।

অবসরে : মহাকাশচারীরা শুধু কাজই করেন না, তারা আমাদের মতোই সহকর্মীদের সাথে হাসি-ঠাট্টা-আনন্দে মেতে ওঠেন। তারা অবসর সময় কাটান গান শুনে, সিনেমা দেখে, কার্ড-দাবা খেলে কিংবা বই পড়ে। তবে তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিনোদন বা আনন্দের উৎস হলো মহাকাশযানের ছোট ছোট জানালা দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখা। আন্তর্জাতিক মহাশূন্য স্টেশন পৃথিবীকে ৪৫ মিনিট পর পর ঘুরে আসে বলে সেখানকার মহাকাশচারীরা ২৪ ঘণ্টায় ১৬টি সূর্যাস্ত দেখেন! এই ব্যাপারটা তাদের অনেক ভালো লাগে। রঙবেরঙের আলোয় না জানি কতটা মায়াবী লাগে এই নীল গ্রহটাকে! আমাদের মতো তাদেরও সপ্তাহে দু’দিন ছুটি থাকে। ছুটিতে তারা পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেন। অবশ্য অনেক সময় কাজের জন্য ছুটি উপভোগ করা যায় না, সেকথা আগেই বলেছি। দিনের কাজ শেষে অবসর বিকেলে। তখন নভোচারীরা যা খুশি করার স্বাধীনতা পান।

চাইলে স্লিপিং স্টেশনে গিয়ে প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন ফোনে, পাঠাতে পারেন বার্তা। ইচ্ছা হলে দেখতে পারেন ছবিও। তাদের জীবনধারার সঙ্গে সম্পর্কিত ছবি গ্র্যাভিটি ও দ্য মারটিয়ান সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে সেখানকার ছবির তালিকায়। গিটার বাজিয়ে ও গানের ভিডিও বানিয়ে টুইটারে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন নভোচারী ক্রিস হ্যাডফিল্ড। সে থেকে অন্যরাও অবসর সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটান, পৃথিবীর মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ও তাদের না বলা গল্প শোনানোর জন্য। তবে ট্রাঙ্কুইলিটি মডিউলের গম্বুজ থেকে এমন সুন্দর পৃথিবীটাকে নিজের চোখের সামনে ঘুরতে দেখাটাই নভোচারীদের সবচেয়ে জনপ্রিয় কাজ। শুধু দেখাই নয়, বরং সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে তা ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজটাও তাঁরা আনন্দ নিয়েই করেন।

তবে তারাও অবসর সময়ে আমাদের পৃথিবীর মানুষের মতো স্পেস স্টেশনের সহকর্মীদের সঙ্গে হাসি, ঠাট্টা, আনন্দ করতে পারেন, ফেসবুক বা অন্য সামাজিক মাধ্যমে লগ ইন করতে পারেন। খুব তাড়াতাড়ি হয়তো তারা উচ্চগতির ইন্টারনেট পাবেন, সে রকমই জানা যাচ্ছে। অবসর সময়ে ব্রাউজ করে, গান শুনে, মুভি দেখে, কিংবা বই পড়ে তারা সময় কাটাতে পারেন। ক্রিস হ্যাডফিল্ড হচ্ছেন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একজন মহাকাশচারী যিনি মহাকাশ স্টেশনে রেকর্ড করা গান গেয়ে পৃথিবীবিখ্যাত হয়েছেন।

ঘুম : সারাদিনের কাজ তো শেষ হলো, এবার ঘুমানোর পালা। মহাকাশে কোনো ‘উপর’ এবং ‘নিচ’ নেই বলে একজন মহাকাশচারী যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ঘুমাতে পারেন। তবে ঘুমানোর আগে নিজেকে বেঁধে নিতে হয়, যাতে ওজনহীনতার দরুন মহাকাশচারী ভেসে গিয়ে কোনো কিছুতে আঘাত না করেন বা নিজে আঘাতপ্রাপ্ত না হন। সাধারণত কেবিনগুলোতে ল্যাপটপ, গান শোনার ব্যবস্থা এবং হালকা আলোর ব্যবস্থা থাকে।

মহাকাশচারীদের দৈনিক ৮ ঘণ্টা করে ঘুমানো বাধ্যতামূলক। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, মহাকাশে দিন-রাত বলে কিছুই নেই, তাহলে তারা কিভাবে ঘুমায়? আসলে সবারই ঘুমানোর একটা নির্দিষ্ট সময় বাঁধা থাকে। ঘুম থেকে ওঠার সময় হলে অটোমেটিক অ্যালার্ম বাজে। অনেকেই মহাকাশে থাকার উত্তেজনাবশত এবং মহাকাশযানের ঘূর্ণনের কারণে দুঃস্বপ্ন দেখেন, কেউ বা নাক ডাকেন বলেও জানা যায়। অভিজ্ঞ নভোচারীদের মতে মহাশূন্য এখনো মানবদেহের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক স্থান। মহাকাশে মাধ্যাকর্ষণ নেই, বাতাস নেই, নেই বায়ুমণ্ডল, নেই কোন ওজোনস্তর। তাই অতি উচ্চমাত্রার তেজষ্ক্রিয় রশ্মি, যাকে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র ঠেকিয়ে দেয় বলে সব প্রাণী বেঁচে আছে, মহাশূন্যে তাকে প্রতিরোধের কোন উপায় নেই। সেখানকার তাপমাত্রা হয় অতি উষ্ণ (-১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি), নয় অতি শীতল (-১২০ ডিগ্রি বা তারও নিচে)। এরকম চরম পরিবেশ মোকাবিলা করার ক্ষমতা মানুষের শরীরের নেই। মহাকাশে মাধ্যাকর্ষণবিহীন পরিবেশে দীর্ঘসময় থাকলে মানবদেহের নানা রকম ক্ষতি হয়। তবে সে পরিবেশে বাসের উপযোগী করেই নভোচারীরা যান আর দেহের ক্ষতি কমিয়ে আনারও ব্যবস্থা রয়েছে।

আরো কিছু কাজ : যেহেতু মহাকাশ স্টেশনগুলোতে একসাথে কয়েকজন মহাকাশচারী কাজ করেন, তাই তাদের নিজস্ব পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা খুবই দরকার। প্রথমে আসা যাক, মহাকাশচারীরা কিভাবে নিজেদের পরিষ্কার রাখেন সে ব্যাপারে। পৃথিবীতে আমরা সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে আমরা হাত-মুখ ধুয়ে দাঁত ব্রাশ করি এবং প্রাকৃতিক কাজ সেরে ফেলি। মহাকাশচারীরাও তার ব্যতিক্রম নন। স্পেস স্টেশনগুলোতে মহাকাশচারীদের ব্যবহারের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি দেয়া হয়। পানির এক বিশেষ ধরনের ব্যাগ তারা ব্যবহার করেন, যে ব্যাগের গায়ে চাপ দিলে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি বের হয়। অর্থাৎ পরিমাণটা থাকে খুবই সীমিত, যাতে অতিরিক্ত পানি নষ্ট না হয়। যেহেতু পুরো মহাকাশযান কিংবা স্পেস স্টেশন জুড়ে নানা রকম বৈদ্যুতিক তার এবং যন্ত্র থাকে, তাই এই অতিরিক্ত পানির ফোঁটা সেসব যন্ত্রে বা তারে লেগে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সে ব্যাপারে তাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। আর এর ট্রেনিং তারা পৃথিবী থেকেই করে যান। ফলে তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন।

স্পেস স্টেশনে নভোচারীরা দীর্ঘকাল থাকে কিভাবে?
স্পেস স্টেশনে নভোচারী একটানা ছয় মাস বা এক বছর অথবা তারও বেশি সময় ধরে অবস্থান করেন। প্রশ্ন আসতে পারে তারা এত দীর্ঘ সময় থাকেন কিভাবে। নভোচারীদের দীর্ঘকাল থাকার জন্য ট্রেনিং করানো হয়। মহাকাশচারীরা স্পেস স্টেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার আগে তাদেরকে সব ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মহাশূন্যে বাতাস নেই তাই বায়ুশূন্য পরিবেশে সব সময় থাকতে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য অনেক দিন ধরে নাসার গবেষণাগারে কৃত্রিম বায়ুশূন্য কক্ষে অনুশীলন করতে হয়। মহাকাশচারী হওয়ার জন্য একজন শিক্ষানবিস যখন সব ধরনের যোগ্যতা অর্জন করে তখনই তাকে স্পেস স্টেশনে কাজ করার জন্য পাঠানো হয়। যারা আমেরিকার নাগরিক তারা নাসা থেকে ট্রেনিং করতে পারেন আর ইউরোপের নাগরিকদের ট্রেনিংয়ের জন্য আছে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) যা জার্মানিতে অবস্থিত, এর সদস্যভুক্ত দেশ হলেই তারা সেখানে ট্রেনিং করতে পারেন। নাসার ট্রেনিংয়ের মেয়াদ প্রায় দুই বছর।

মহাকাশে এমন অনেক তেজষ্ক্রিয় রশ্মি আছে, যা মানবদেহের ঠিক কি ক্ষতি করতে পারে তা এখনো অজানা। সে কারণে মহাশূন্যে মানুষকে পরতে হয় বিশেষ ধরনের পোশাক, যাকে বলে স্পেস স্যুট। স্পেস স্যুটের মধ্যে তাপমাত্রা ও বায়ুচাপ নিয়ন্ত্রণ করে পৃথিবীর পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়- যাতে মানুষ তার মধ্যে বেঁচে থাকতে পারে।
কোনও মানুষের মহাকাশে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় কাটানোর রেকর্ড হলো ভ্যালারি পলিয়াকভ এর, তিনি ৪৩৭ দিন অবস্থান করেছিলেন যা প্রায় ২০ বছর আগের ঘটনা। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক চারশ কিলোমিটার উপর থেকে পরিভ্রমণ করে। মহাকাশযানে অভিকর্ষ বল হয় শূন্য। তাই পৃথিবীতে আমরা যতটা স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারি, মহাকাশচারীরা ততটা করতে পারেন না। তাদের চলাফেরা আর স্বাভাবিক কাজকর্মে অনেক কৌশল অবলম্বন করতে হয়।

বিবিসি ও নাসা অবলম্বনে

Share.

মন্তব্য করুন