২০১৮ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছিলো সর্বশেষ ফুটবল বিশ্বকাপ। সময়ের চাকা ঘুরে এসে গেছে আরেকটি বিশ্বকাপের বছর। চলতি বছর নভেম্বরে শুরু হবে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসরটি। এবারের বিশ্বকাপ আয়োজন করবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার। আয়তনে খুবই ছোট্ট একটি দেশ কাতার। দেশটির মোট আয়তন ১১ হাজার ৫৭১ বর্গকিলোমিটার। তোমাদের বোঝার সুবিধার জন্য বলছি, বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের মোট আয়তন ২০ হাজার ৫০৯ বর্গকিলোমিটার। আর বরিশাল বিভাগের আয়তন ১৩ হাজার ২২৫ বর্গকিলোমিটার। এবার নিজেরাই বুঝে নাও কত ছোট একটি দেশ কাতার।
পারস্য উপসাগরের বুকে কাতার একটি উপদ্বীপ। এর তিন দিকে সমুদ্র, আর এক দিকে স্থল সীমান্ত সৌদি আরবের সাথে। আয়তনে ছোট হলে কী হবে- দেশটি খুবই সম্পদশালী। প্রচুর প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন ও রফতানি করে কাতার বিশে^র ধনী দেশগুলোর সারিতে পৌঁছে গেছে। আবার বড় ক্রীড়া ইভেন্ট আয়োজনের মতো সাংগঠনিক কাঠামোও তাদের রয়েছে।

সাধারণত বিশ্বকাপ আয়োজন করা হয় জুন-জুলাই মাসে; কিন্তু ওই সময়টা কাতারের গ্রীষ্মকাল। আর মরুর দেশে গ্রীষ্মকাল মানে অত্যন্ত গরম। ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যায় তাপমাত্রা। যে কারণে এ বছরের বিশ^কাপ আয়োজন করা হবে গ্রীষ্মের পরে নভেম্বর-ডিসেম্বরে। ওই সময়টাতে কাতারের তাপমাত্রা ১৫ থেকে ২৪ ডিগ্রির মধ্যে থাকে। তারপরও দর্শকদের কথা চিন্তা করে স্টেডিয়ামগুলো পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হচ্ছে।
ছোট দেশ কাতারকে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে নিতে হচ্ছে বড় প্রস্তুতি। বিশ^কাপ উপলক্ষে খেলোয়াড়, কর্মকর্তা, সাংবাদিক, দর্শকদের আতিথেয়তা দিতে জোর প্রস্তুতি চলছে দেশটিতে। ৮টি অত্যাধুনিক স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হচ্ছে। চলাচলের সুবিধার জন্য প্রতিটি স্টেডিয়ামের কাছাকাছি এলাকায় বানানো হচ্ছে একটি করে মেট্রোরেলের স্টেশন। এছাড়া বানানো হচ্ছে অনেকগুলো নতুন সড়ক। ছোট্ট দেশ হওয়ার কারণে এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যু যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না। তবুও বিদেশী দর্শকদের চলাচলে যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে অবকাঠামো নির্মাণ করছে কাতার। বিশ^কাপ উপলক্ষে ১২ লাখ মানুষ দেশটি সফর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

বিদেশী অতিথিদের আশ্রয় দিতে বানানো হচ্ছে নতুন নতুন আবাসিক হোটেল। সাগরের মধ্যে বানানো হচ্ছে ভাসমান হোটেল। বেশ কয়েকটি ক্রজ শিপ কোম্পানির সাথে চুক্তি হয়েছে কাতার সরকারের। তাদের ব্যবস্থাপনায় সাগরের বুকে ভাসমান জাহাজে রাত কাটানোর ব্যবস্থাও থাকবে ৪০ হাজার অতিথির জন্য। এ ছাড়া মরুভূমিতে দর্শকদের জন্য তাঁবু বা ফ্যান ভিলেজ বানাচ্ছে কাতার সরকার। হোটেল, মোটেলের বদলে বিদেশী দর্শকদের আতিথেয়তায় ভিন্নতা আনতেই এই উদ্যোগ নিয়েছে তারা।
কাতারের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়ামটির নাম লুসাইল স্টেডিয়াম। যেটির দর্শক ধারণক্ষমতা ৮০ হাজার। এই স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী ও ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনাটির নকশা করেছে একটি বিখ্যাত ব্রিটিশ কোম্পানি। রাজধানী দোহা থেকে কিছুটা উত্তর দিকে সমুদ্র উপকূলের শহর লুসাইলে নির্মিত হয়েছে স্টেডিয়ামটি। সাজানো গোছানো ছোট শহর লুসাইল, তবে উন্নত বিশে^র সব সুবিধাই সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে। ২০ কিলোমিটারের একটি মেট্রোরেল রুট দোহার সাথে সংযুক্ত করেছে স্টেডিয়ামটিকে।
৬০ হাজার দর্শকের এক সাথে খেলা দেখার ব্যবস্থা থাকবে আল বাইত স্টেডিয়ামে। আল খোর শহরের দৃষ্টিনন্দন এই স্টেডিয়ামটি বানানো হয়েছে মরুভূমিতে যাযাবর গোষ্ঠীগুলোর তাঁবুর মতো নকশায়। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, মরুর বুকে তাঁবু গেড়েছে কোন যাযাবর পরিবার। মরুভুমির মাঝে তৈরি হলেও স্টেডিয়ামটির চারপাশে কৃত্রিম লেক, সবুজ ঘাসের গালিচাসহ অনেক কিছু তৈরি করা হয়েছে।

আবার আল থুমামা স্টেডিয়ামটিকে বানানো হয়েছে আরবদের ঐতিহ্যবাহী পাগড়ির নকশায়। আকাশ থেকে দেখলে মনে হবে কেউ যেন পাগড়িটিকে গোল করে রেখে দিয়েছে মাটিতে। স্টেডিয়ামটিতে একবার ব্যবহৃত পানি রিসাইকেল হয়ে আবার বিশুদ্ধ আকারে ফিরে আসবে। যার ফলে অন্য যে কোন স্টেডিয়ামের চেয়ে পানি খরচ হবে ৪০ শতাংশ কম। মরুভূমিতে পানির সঙ্কটের কথা মাথায় রেখে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এছাড়া পুরনো স্টেডিয়ামগুলোর মধ্যে খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম, এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম, আহমেদ বিন আলী স্টেডিয়াম উল্লেখযোগ্য। এই স্টেডিয়ামগুলোতেও বিশ^কাপ উপলক্ষে করা হচ্ছে নতুন সাজসজ্জা, বাড়ানো হচ্ছে আসন সংখ্যা।

এছাড়া দেশটির বিভিন্ন স্থানে সাজসজ্জা ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে দ্রুত। সব মিলে বিশ্বকাপ আয়োজন উপলক্ষে দেশটি খরচ করবে ৩০০ বিলিয়ন বা ৩০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। দেশটির সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্বকাপের এর এসব স্থাপনার যেসব অংশ স্থানান্তর যোগ্য, সেগুলো বিভিন্ন দরিদ্র দেশকে দেয়া হবে। বিভিন্ন স্টেডিয়ামের গ্যালারির প্রায় অর্ধেক চেয়ার দেয়া হবে বিভিন্ন দেশকে। আবার কিছু স্থাপনা স্কুল, হাসপাতাল প্রভৃতি কল্যাণমূলক কাজে লাগানো হবে।

কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি একজন ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ। নিজেও এক সময় ছিলেন পেশাদার টেনিস খেলোয়াড়। ফরাসি ক্লাব প্যারিস সেন্ট জার্মেইন (পিএসজি) এর মালিকানাও কাতার কিনেছে তার আগ্রহের কারণে। শেখ তামিমের আগ্রহেই কাতার ছোট্ট দেশ হয়েও বিশ্বকাপের মতো বড় আসর আয়োজনের সাহস করেছে। যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের মাটিতে প্রথমবারের মতো বসতে যাচ্ছে বিশ^কাপ শিরোপার লড়াই।
গত বছর নভেম্বরে ১৬টি দেশ নিয়ে আয়োজিত ফিফা আরব কাপ টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়েছিলো কাতারে। মূলত ওই টুর্নামেন্টের মাধ্যমে কাতারের সংগঠকরা বড় টুর্নামেন্ট আয়োজনের মহড়া দিয়েছেন। এবার অপেক্ষা নভেম্বর মাসের। ততদিনে প্রস্তুতির বাকি কাজটুকুও শেষ করে আনবে দেশটি।

Share.

মন্তব্য করুন