আব্বা ছিলেন একেবারে নির্জীব। তার গম্ভীর ছবির পেছনে শুধু ভয় আর ভয়। সামনে দাঁড়ানোর সাহস ছিল না মোটেও। বাবার সংবিধানে ‘ভুল’ শব্দটি থাকলেও তার প্রয়োগযোগ্য ব্যবহারের পূর্ণ অধিকার আমাদের ছিল না। এমনকি তিনি ঘরে ফিরলে পরিবেশটাই থমথমে হয়ে যেত।
শিকারি জন্তু এলে মুরগি যেমনি বুকের ভেতর বাচ্চা লুকিয়ে ফেলে তেমনি আমরাও ভয় পেয়ে মায়ের আঁচলতলে লোকাতাম।
এমনও হয়েছে যে,অনেকবার ভাত ছেড়ে পালিয়েছি। ছোটবেলায় এত পেটাতেন, এত পেটাতেন সেই দাগ আর বিষ এখনো সগৌরবে উপস্থিতি জানান দেয়।
এভাবে বাবা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চলে গেলাম। ভর্তি হলাম ক্লাস এইটে। থাকলাম হোস্টেলে। আলুভর্তা ডালভাত নিত্যদিনের খাবার।
প্রথম প্রথম চোখজোড়া অশ্রুই টলোমলো করতো। পরে মানিয়ে নিলাম। খরচাপাতি বাবাই দিত। আমি বলতাম মাকে।
বাবার সাথে কথা হয়নি কোনোদিন। এমনকি বিদায়কালেও।
এভাবে একমাস দুইমাস না। গোটা বছর পার হয়ে যায়। বাবার প্রতি অভিমান আর অভিযোগের দূরত্বটা দিনকে দিন অসীম হতে থাকে।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসলাম। রাতে ঘুমালাম ভেতর ঘরে। ঘুমটা হালকা হয়ে এলো। ঘড়ির কাঁটায় ৩টা ৪৭ মিনিট। বারান্দায় ঘুমান আব্বা। গোঙানির অস্পষ্ট শব্দ শোনা যাচ্ছে।
লাইট ধরালাম না, চোর ভেবে। ইচ্ছে ছিল কাছে গিয়ে একদম জাপটে ধরবো।
যত কাছে যাই শব্দ ততই স্বচ্ছ হয়। ভাঙা গলা। কান্নাজড়িত কণ্ঠ।
ঝরঝরে স্পষ্ট হয়ে আয়াতের মতো কানে বেজে যায়।
বাবা বসা জায়নামাজে। মুনাজাতে হাত তোলা। দোয়া করছেন এভাবে,“আমার সন্তানকে মানুষ বানাও,আল্লাহ। দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জাহানে সফল করো। আর এমন কে আছে যারা জান্নাতি তাদের চেয়ে সফল? কে এমন ব্যর্থ আছে জাহান্নামির চেয়ে? রাহমানুর রাহিম, তার জীবনে কোনো দুঃখ দিও না। তার হায়াত দরাজ করো,মওলা। প্রয়োজনে, আমার আয়ুটুকু তাকে দিয়ে দাও।”
তখনও অভিমানের দেওয়ালটি ভেদ করে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে পারিনি। এমনকি চোর ভেবেও ভুল করে জাপটে ধরতে পারিনি। বলতে পারিনি “ভালোবাসি বাবা”।

আবারও না বলে চলে গেলাম। ছুটি শেষ হবার আগেই। বাড়িতে একমুহূর্ত ভালো লাগতো না। অস্বস্তিভাব নিয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করেছি।
না, নিজেকে স্থির করতে পারছিলাম না।
পরিচিত মানুষ। চেনা পথঘাট কোনোটাতেই নিজেকে খাপখাওয়াতে পারলাম না। এমন অসামঞ্জস্য হয়ে গেলাম। মিশতে চাইলেও তেল আর জলের মতো আলাদা হয়ে যেত।
বাবা হাসপাতালে। আজ বাবার সেদিনের সেই জায়নামাজ বিছালাম আমি। এই জায়নামাজটিতেই বাবার দোয়া কবুল হয়েছিল। এখানে বাবার চোখের জল লেপ্টে আছে। বসে আছে সিজদার দাগ।

বাবা মাকে নাকি বলেছিল। আহাদ মানুষ হয়েছে। আহাদ আমার নাম। পাড়ার সবাই আব্বাকে সম্মান করে। খোশগল্প করতে পারলে পুলকিত হয়।
এটাই আব্বার গর্ব। সেই গর্বে আব্বা প্রথমবারের মতো আম্মার সামনে কেঁদে ফেলেছিলেন। সেদিনই মা প্রথম তৃপ্তির অশ্রু দেখেছিলেন বাবার চোখে।
কিন্তু, হায়! আমি কী সেই অভিমানের বেড়াটা ভাঙার সুযোগ পাবো না। আব্বার আয়ুটুকু আমার নামে উইল করে দেওয়ায় তার আয়ু ফুরিয়ে গেল।
এই জায়নামাজে আজ আমার শুধু একটাই প্রার্থনা। আব্বার মুনাজাত ফিরিয়ে নাও, খোদা। আমার কিছুই চাই না। আব্বাকে সুস্থভাবে ঘরে ফিরে যেতে দাও।

Share.

মন্তব্য করুন