১৮ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক। তার চেয়েও বড় কথা বয়স বিশ পার হতেই হয়ে উঠেছেন ব্রাজিলের মতো ফুটবল দলের সবচেয়ে বড় তারকা। নেইমারের ফুটবল ক্যারিয়ার কতটা উজ্জ্বলতা নিয়ে শুরু হয়েছিলো তা সম্ভবত এতেই স্পষ্ট হয়ে যায়। পেলের ব্রাজিল, লুইস রোনালদোর ব্রাজিল, কাকার ব্রাজিল। পাঁচবার বিশ্বকাপ জিতেছে তারা। ব্রাজিল জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন কত শত তরুণের আজীবন স্বপ্নই রয়ে যায়; কিন্তু নেইমার খুব অল্প বয়সেই সেই দলের প্রধান তারকা হয়ে উঠেছিলেন।
যে কারণে তাকে আগামী দিনের আরেক মহাতারকা ভাবা শুরু হয়েছিলো ফুটবল বিশে^; কিন্তু নেইমারের বয়স ৩০ বছর হচ্ছে এই ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখে। সাধারণত একজন অ্যাথলেটের ক্যারিয়ারের সেরা সময় ধরা হয় ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সকে। সে হিসেবে বলা যায় ব্রাজিলিয়ান তারকা তেমন খুব একটা ঝলক দেখাতে পারেননি। তাকে নিয়ে যে প্রত্যাশা ছিলো তা পূরণ করতে পারেননি এখন পর্যন্ত।
একটা সময় ফুটবল বিশে^ তাকে থাকতে হয়েছে তৃতীয় সেরা খেলোয়াড় হয়ে। সেটা লিওনেল মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর দাপটের কারণে। যদিও সেরা দু’জনের তুলনায় নেইমার সব সময়ই অনেক পিছনে ছিলেন পারফরম্যান্সে। তবু মনে করা হতো যে, মেসি আর রোনালদোর সেরা সময়টা শেষ হয়ে গেলে নেইমার সেরা ফুটবলারের জায়গা নেবেন; কিন্তু তিনি সেটা পারেননি তা তো দেখাই যাচ্ছে। মেসি, রোনালদো একের পর এক ব্যালন ডি’ অর জিতেছেন। নেইমারের ঝুলিতে ওঠেনি একটিও। ক্লাবের হয়ে একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপাও জেতা হয়নি তার। অথচ রোনালদো পাঁচবার আর মেসি চারবার জিতেছেন ইউরোপ সেরার শিরোপা। নেইমারের বদলে এখন এমবাপ্পে, লেবানোদস্কি, হরলান্ডরা এগিয়ে যাচ্ছেন সেরা ফুটবলারের জায়গা দখল করতে। আর এক সময়ের নেইমার এখন অনেকটাই আলোচনার বাইরে।
যদিও নেইমারের প্রতিভা নিয়ে কারো এতটুকু সন্দেহ নেই। প্লেমেকিং, ফিনিশিং কিংবা অ্যাসিস্টে তিনি কারো চেয়ে কম যান না। তবু নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। এজন্য যেমন ইনজুরির দায় আছে, তেমনি দায় আছে তার নিজেরও। নানান সময় বিতর্ক হয়েছে তাকে নিয়ে। আলসেমির কারণে ফিটনেসের ঘাটতিও দেখা গেছে। চুলের নতুন নতুন ডিজাইন, নতুন বাড়ি কেনা কিংবা পার্টিতে উচ্ছৃঙ্খলতার জন্য তিনি ছিলেন আলোচনায়। অথচ তার আলোচনায় থাকার কথা ছিলো নতুন নতুন রেকর্ড গড়ে।
কিন্তু নেইমার সেটা পারেননি বরং, ক্রমশই তার পারফরম্যান্স বিবর্ণ হয়েছে। সর্বশেষ ২০২১ সালটি ছিলো তার ক্যারিয়ারের আরেকটি জঘন্য পারফরম্যান্সের বছর। অথচ এই বছর ফরাসি ক্লাব প্যারিস সেন্ট জার্মেইয়ে (পিএসজি) নেইমারের সাথে জুটি বেঁধেছিলেন মেসি। আশা করা হয়েছিলো, নেইমার আর মেসির জুটি একের পর এক ঝলক দেখাবে ফুটবল মাঠে। সেই আশায়ই হয়তো পিএসজি তার চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে ২০২৫ সাল পর্যন্ত; কিন্তু ২০২১ সালে নেইমার খেলেছেন যাচ্ছে তাই। বাঁ পায়ের লিগামেন্ট ইনজুরির কারণে অনেকটা সময় মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে। তবে যতদিন খেলেছেন তাতেও ৪৬ ম্যাচে মাত্র ১৭ গোল করেছেন।
আরেকটা বিষয় নিয়ে ভ্রু কুঁচকেছেন সমালোচকরা। সেটা হলো ২০২১ সালে ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে গোল করেছেন মাত্র ৫টি। যে কারণে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন যে, নেইমার হয়তো ম্যাচের মাঝপথে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ছুটি কাটিয়ে ফেরার পর তার ভুঁড়ি বেড়ে গেছে এমন আলোচনাও হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
ব্রাজিলের সবচেয়ে নামি সংবাদ মাধ্যম ও’গ্লোবোর কলামিস্ট কার্লোস মানসুর লিখেছেন, ‘নেইমার এই বছরের মাঝপথ থেকে শুধু দুশ্চিন্তাই বাড়িয়েছেন। কোপা আমেরিকার শেষে ছুটি কাটিয়ে আসার পর আমরা দেখেছি, তিনি আদর্শ শারীরিক অবস্থা থেকে কতটা দূরে চলে গেছেন। তার টেকনিক আর স্কিল যতই অসাধারণ হোক, এটা খেলায় প্রভাব ফেলেছে।’
ফ্রান্সের মিডিয়াও তাই নেইমারের বেতন আর পারফরম্যান্সের তুলনা করতে শুরু করেছে। নেইমার তার ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা পেছনে ফেলে এসেছে কি না এমন প্রশ্নও তুলছে তারা।
এর আগের দুই বছর অর্থাৎ ২০১৯ ও ২০২০ সালে তার পারফরম্যান্স ছিলো যথাক্রমে ২৬ ম্যাচে ১৭ গোল আর ২৬ ম্যাচে ২২ গোল। ম্যাচ প্রতি গোলের হিসেবে যা মেসি, রোনালদোর তুলনায় অনেক কম। অথচ এক সময় নেইমারের পায়ে শিরোপার স্বপ্ন দেখতো কোটি কোটি দর্শক। ২০১০ সালের বিশ^কাপের আগে নেইমারকে ব্রাজিল দলে নেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন ফুটবল কিংবদন্তি পেলে। দর্শকরাও রীতিমতো আন্দোলন শুরু করেছিলো। অথচ তখন নেইমারের বয়স ছিলো মাত্র ১৮ বছর। এরপর অবশ্য দুটো বিশ^কাপ (২০১৪ ও ২০১৮) খেললেও দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। নেইমরাকে ঘিরেই ছিলো ব্রাজিলের ষষ্ঠ বিশ^কাপ বা ‘হেক্সা’ জয়ের স্বপ্ন; কিন্তু দিনে দিনে নেইমার যেভাবে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছেন তাতে সেই স্বপ্ন পূূরণ হওয়া সহজ নয়।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ যেতার যে স্বপ্ন নিয়ে পিএসজি মেসি, নেইমার, এমবাপ্পের মতো তারকাদের পেছনে কোটি কোটি ডলার খরচ করছে, ক্লাবের সেই স্বপ্নপূরণের দায়বদ্ধতাও রয়েছে নেইমারের। নেইমার কি তার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন? আবার এ বছরই নভেম্বরে কাতারে বসছে বিশ^কাপ ফুটবলের আসর। সেখানেও ফুটবলের দেশ ব্রাজিল তাকিয়ে থাকবে নেইমারের পায়ের দিকে; কিন্তু নেইমারের সাম্প্রতিক সময়ে যা পারফরম্যান্স তাতে তার চ্যাম্পিয়ন রূপটা অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে গেছে।
অবশ্য যারা খারাপ সময় পেছনে ফেলে স্বরূপে ফিরতে পারেন তারাই তো সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন। নেইমার ভক্তদের তাই হতাশ না হয়ে, আশা রাখতে হবে তাদের প্রিয় ফুটবলার আবার ফিরবেন সেরা ফর্মে। পায়ের জাদুতে করবেন একের পর এক গোল।

Share.

মন্তব্য করুন