বলব তো কাজী আনোয়ার হোসেনের কথা। আগে কিছুটা বলে নেই তার বাবা সম্বন্ধে। কেননা তার বাবাকে জানাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়! তার বাবার নাম? হ্যাঁ, কাজী মোতাহার হোসেন।
কাজী মোতাহার হোসেন নামটি বাংলা সাহিত্যে বেশ উজ্জ্বল! আলোকিত! এবং ঐতিহাস খ্যাতও বটে। সাহিত্য জগতের সাথে যাদের কিছুদূর পরিচয় ঘটেছে, এ নামটির গন্ধও পেয়েছেন তারা। মোটামুটি বিচরণ করেন এমন লোকেরাও এ নামটি উচ্চারণে অভ্যস্ত! কারণ তিনি ছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নজরুলের সাথে এ লোকটির স্মৃতি বেশ জ্বলজ্বলে। নজরুল জীবনের বেশ কিছু ঘটনারও সাক্ষী তিনি। কলকাতা থেকে নজরুল ঢাকায় আসতেন। আসতেন নানা কাজে। সাহিত্যের আসর। কবিতা উৎসব! এবং কবিতা ঘিরে নানান জলসায়! এলেই কাজী মোতাহার হোসেনের বাসায় উঠতেন। এভাবে নজরুলের জীবনের সাথে কাজী মোতাহার হোসেন ভীষণভাবে জড়িয়ে মুড়িয়ে একাকার হয়ে আছেন।

এখানে একটি জিজ্ঞাসা মাথা তোলে দ্রুত! কেন নজরুল তার আয়োজনে উঠতেন? উঠতেন, কারণ নজরুল খুব জানতেন তাকে। জানতেন কাজী মোতাহার হোসেন একজন সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, গণিতবিদ এবং শিক্ষাবিদ। সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ছিলেন তিনি। এসব গুণের বাইরে কাজী মোতাহার হোসেনের ছিল একটি বড় হৃদয়। একটি উদার মন। নজরুলের মতো বিশালত্বকে ধারণ করার অনন্য উদ্যম ছিল তার। ফলে নজরুলের জীবনের সাথে কাজী মোতাহার হোসেন নামটি সেঁটে আছে। এই কাজী মোতাহার হোসেনের সুযোগ্য পুত্র হলেন কাজী আনোয়ার হোসেন।
এখন প্রশ্ন হলো- কেন লিখতে বসলাম কাজী আনোয়ার হোসেন নিয়ে! লিখতে বসার কারণ যে খুব লম্বা তালিকার তা নয়! খাটো বা বেঁটে তালিকারই হবে। কিন্তু খাটো তালিকা হলেও সেটি আকারে বেশ স্বাস্থ্যবান। নাদুস নুদুস এবং বলিষ্ঠ। বলব তো বলবই তার গুণের কথা। তার আগে খানিকটা তার বেড়ে ওঠার গল্পটি জেনে আসা যাক।
কাজী আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯ জুলাই ১৯৩৬। ঢাকায়। ঢাকায় মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চৌহদ্দিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি রেস্ট হাউসে যা ছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পূর্ব সীমানায়। এখানে দু’টি রেস্ট হাউজ। দু’টিই দোতলা। একটি উত্তরে। আরেকটি দক্ষিণে। উত্তরের দালানটিতেই তার জন্ম। ১৯৪৩ এ যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয় তখন দক্ষিণের দালানটিতে স্থানান্তর হন তারা। এখানেই শৈশব কেটেছে কাজী আনোয়ার হোসেনের। এর পরে চলে আসেন সেগুনবাগানে। যেটি বর্তমানে সেগুনবাগিচা।

১৯৫২ সালে পুরান ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন কাজী আনোয়ার হোসেন। তারপর জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ এবং বিএ পাস করেন। শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
মজার বিষয় হলো কাজী আনোয়ার হোসেন লিখবেন বা লেখক হবেন এমন কথা ভাবতেন না। বরং তার খুব প্রিয় বিষয় ছিল গান এবং তিনি আক্ষরিক অর্থে গানের শিল্পী ছিলেন। রেডিওর শিল্পী ছিলেন প্রায় ১০ বছর। তারা চার ভাই সাত বোন। তার তিন তিনটি বোন দেশের নাম করা কণ্ঠশিল্পী। সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন এবং মাহমুদা খাতুন। তিনি বিয়ে করেছেন যাকে তিনিও শিল্পী। নাম ফরিদা ইয়াসমিন। তার এক মেয়ে ও দুই ছেলে। মেয়ে শাহরিন সোনিয়াও কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। মেয়েটি পৃথিবী থেকে চলে গেছেন ২০১৫ সালে। ছেলে দুটি লেখালেখি এবং সেবা প্রকাশনীর সাথে জড়িয়ে। সঙ্গীতশিল্পী কাজী আনোয়ার হোসেন রেডিওতে তো বটেই, টেলিভিশন এবং সিনেমায়ও গান করেছেন। চলছিল গানের নানা আয়োজন। সবটাতেই তাজা উপস্থিতি তার। হঠাৎ ঘটনাটি ঘটিয়েছেন তিনি। প্রায় বিনা নোটিশে রেডিও ছেড়ে দিলেন। দিলেন তো দিলেনই। আর ফিরলেন না। নতুন চিন্তা ভর করল মাথায়- তিনি ছাপাখানা দেবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। বাবা টাকা দিলেন দশ হাজার। ছাপার মেশিন কিনে শুরু করে দিলেন প্রকাশনা। নাম রাখলেন ‘সেগুনবাগান প্রকাশনী’। দুজন কর্মচারী নিলেন সঙ্গে। সময়টি ১৯৬৩।
সেগুনবাগান নামটি পরে পরিবর্তন করেন। সেগুন-এর সে এবং বাগিচার বা নিয়ে নাম হয়- ‘সেবা’। এভাবেই যাত্রা শুরু সেবা প্রকাশনীর।

বছর খানেক পেরোল সময়। ১৯৬৪ সাল। হঠাৎ লেখালেখির বিষয়টি মাথায় আসে তার। লিখতে শুরু করেন গোয়েন্দা কাহিনী ‘কুয়াশা’ সিরিজ। প্রকাশ পেলে খুব পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে সিরিজটি। এ সিরিজে মোট ৭৮টি বই প্রকাশ পায়। অবশ্য এর সব বই কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখা নয়। শেখ আবদুল হাকিম নামে একজন লেখকও রচনা করেন অনেক বই।
কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখক জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনাটির যাত্রা শুরু ১৯৬৬ তে। তিনি তখন কুয়াশা সিরিজের জন্য নিবেদিত। লেখেন প্রতিদিন। সেদিনও লিখছিলেন। সন্ধ্যায়। হঠাৎ এলেন তার প্রিয় বন্ধু মাহবুব আমীন। এসেই বললেন- থামো। ওসব লেখার আগে এ বইটি পড়ো। বলেই এগিয়ে দিলেন একটি বই। বইটি ইয়ান ফ্লেমিংয়ের লেখা। ইয়ান ফ্লেমিং একজন ব্রিটিশ লেখক, সাংবাদিক ও নৌ গোয়েন্দা। তিনি একটি কাল্পনিক ব্রিটিশ গোয়েন্দা চরিত্র নির্মাণ করেছেন। লিখেছেন গোয়েন্দা সিরিজ ‘জেমস বন্ড’। এ সিরিজেরই একটি বই- ‘ডক্টর নো’ তুলে দিলেন কাজী আনোয়ার হোসেনের হাতে। বললেন- বইটি দারুণ। মুগ্ধ হবে নিশ্চিত।
সত্যি সত্যি লেখা থামিয়ে দিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। পড়লেন বইটি। পড়ে ভীষণ বিস্মিত তিনি। কি অদ্ভুত কল্পনা! বিস্ময়কর কাহিনী। দুর্ধর্ষ অভিযান। এবং ভাষার জাদুকরি টান। সব মিলিয়ে বইটি কাজী আনোয়ার হোসেনের বুকে নতুন এক স্বপ্নের পৃথিবী জাগিয়ে দিলো। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন- বাংলা ভাষায় এমন একটি সিরিজ রচনা করবেন। করবেন তো করবেন। কিন্তু কিভাবে?

অভিযানে নামলেন তিনি। এ সংক্রান্ত বই তালাশে ছুটলেন। কিন্তু বাংলা ভাষায় গোয়েন্দা সিরিজের তখনো আধুনিক আয়োজন তেমন ছিল না। তেমন উপযোগী ভাষা, বর্ণনা এবং উপস্থাপনা কোনোটিই ছিল না জুতসই। তবুও এগুতে হবে তাকে। লিখতেই হবে রহস্য কাহিনী। বই সংগ্রহ তো বটেই। সাথে ছুটতে লাগলেন পাহাড়ে পাহাড়ে। ঘুরলেন চট্টগ্রাম। রাঙামাটি। পার্বত্য চট্টগ্রাম। ঘুরতে ঘুরতে কল্পনায় প্রস্তুত করছিলেন নিজেকে। তৈরি করছিলেন একটি তুখোড় গোয়েন্দা চরিত্র। এভাবে পাহাড় ঘুরে বই পড়ে লিখলেন সাত মাস ধরে। লিখলেন কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না ভাষা। উপস্থাপনাও। সুতরাং শুরু হলো সেই লেখা এডিটিং। কাটাকাটি। কাটাকুটি। এতটাই কাটাকাটি আর কুটিকাটি হলো তো লেখার চেহারাই বদলে গেল। এরপর ফ্রেশ বা তরতাজা করে লেখার পালা। একবার করলেন। দুবার! নাহ্ হলো না। তিন তিনবার করলেন। তৃতীয়বারে সায় দিলো মন- হ্যাঁ এবার বোধ হয় তেমনটি হলো যা করার স্বপ্নে বিভোর মন। এরপর ছাপা হলো সেই ঐতিহাসিক গোয়েন্দা কাহিনী মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বই- ‘ধ্বংস পাহাড়’।
বইটি প্রকাশ হওয়ার পর তুমুল পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠল। তরুণ কিশোরদের হাতে হাতে বইটি। বাংলা ভাষার পাঠকের কাছে একটি নতুন চরিত্রের উদ্ভব ঘটে। সে চরিত্রটিই মাসুদ রানা। মূলত মাসুদ রানা আইকন হয়ে ওঠে তরুণদের। অন্যায়ের প্রতিবাদে মাসুদ রানা হয়ে উঠতে চাইল অনেকে। দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহসের চর্চা করে মাসুদ রানার মতো। বুদ্ধিদীপ্ত বিষয়ে গ্রহণ করতে লাগল মাসুদ রানার কৌশল। আর গোয়েন্দাগিরিতে তো তার জুড়িই নেই। এভাবে মাসুদ রানা সিরিজ শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে। তরুণ কিশোরদের আলোচনায় নায়ক হয়ে উঠল মাসুদ রানা।

পরবর্তী সময়ে সেবা প্রকাশনী থেকেই আরেকটি গোয়েন্দা সিরিজ জন্ম নিলো। নাম তিন গোয়েন্দা। এ সিরিজটির লেখক আরেকজন খ্যাতিমান গোয়েন্দা চরিত্র নির্মাতা রকিব হাসান। সিরিজটির মাধ্যমে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন রকিব হাসানও। ১৯৮৫ তে যাত্রা শুরু তিন গোয়েন্দা সিরিজের। ২০০৩ পর্যন্ত এ সিরিজে বই প্রকাশ পায় ১৫৮টি। এ পর্যন্ত বইগুলোর লেখক রকিব হাসান। এরপর সিরিজের লেখক বদলে যায়। রকিব হাসানের পরিবর্তে লেখক হলেন শামসুদ্দীন নওয়াব। এখন প্রশ্ন হলো কে এই শামসুদ্দীন নওয়াব? উত্তরটি হলো ইনিও কাজী আনোয়ার হোসেন। তিনি দু’টি ছদ্ম নামে লিখেছেন- একটি শামসুদ্দীন নওয়াব। অন্যটি বিদ্যুৎ মিত্র। মজার বিষয় হলো মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বইটি এই বিদ্যুৎ মিত্র নামেই প্রকাশ পেয়েছিল।

কাজী আনোয়ার হোসেনের আরো কিছু অবদানের কথা বলা উচিত। ১৯৭০ সালে তিনি প্রকাশ করলেন মাসিক রহস্য পত্রিকা। এ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি তৈরি করেছেন বিপুলসংখ্যক লেখক। বাংলাদেশের খ্যাতিমান সব লেখক রহস্য পত্রিকায় লিখেছেন। হুমায়ূন আহমেদও বেশ কিছু লেখা লিখেছেন এই পত্রিকায়। হুমায়ূন আহমেদের ‘অমানুষ’ উপন্যাসটি এখানেই প্রকাশ পেয়েছিল। কাজী আনোয়ার হোসেন বাংলা ভাষায় থ্রিলার উপযোগী ভাষা নির্মাণ করেছেন। পেপারবেক বইয়ের বাজার সৃষ্টি করেছেন। অপেক্ষাকৃত কম দামি কাগজে ছাপা বই পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন। বিদেশী প্রখ্যাত লেখক ও বইয়ের বাংলা অনুবাদ প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন।

মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম ক’টি বই সৃষ্টিশীল বা কাজী আনোয়ারের নিজস্ব রচনা। বাকি বইগুলো বিদেশী বিভিন্ন গোয়েন্দা বইয়ের ছায়া অবলম্বনে রচিত। হলেও কাজী আনোয়ার হোসেন তার নিজস্ব ঢঙে বাংলাদেশী করে তুলেছেন সবগুলো কাহিনী। এক দুই করে প্রকাশ পেতে পেতে মাসুদ রানা সিরিজের বই সংখ্যা দাঁড়ায় সাড়ে চারশ’। ভাবতে অবাক লাগে বৈকি। সংখ্যায় বিশাল হলেও এর জনপ্রিয়তা কমেনি মোটেই।
কাজী আনোয়ার হোসেন একজন কম কথার মানুষ ছিলেন। প্রয়োজনের বাইরে তেমন কথা বলতেন না। নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করতেন। নিজের ভেতর কিছুটা রহস্য জমিয়ে রাখতেন। ধৈর্যের সাথে অবস্থান করতেন। সমালোচনা সহ্য করে এগিয়েছেন। কারো তিরস্কারে থেমে যাননি কোথাও। কখনো।
বাংলাদেশে কলকাতার লেখকদের ঠেকিয়ে দিয়েছেন যে দু’জন লেখক তাদের একজন হুমায়ূন আহমেদ। অন্যজন কাজী আনোয়ার হোসেন। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশী সংস্কৃতিকে ভীষণ ভালোবাসতেন এ মানুষটি।

Share.

মন্তব্য করুন