আশার ঝিলিক

সোমেন, রূপনীল আর দানিশরা কেমন নীরব হয়ে আছে আজ। যেন ওরা কথা বলা ভুলে গেছে হঠাৎ। প্রতিদিনকার উচ্ছ্বসিত ভাবটা নেই। চেহারা নি®প্রভ। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। কেমন একটা আমতা আমতা ভাব। হঠাৎ খুব নিচুস্বরে ডাকলো দানিশ, ‘শওকত, তুই চলে যাবি!’

দানিশের গলার স্বর খুব ধরা, আর্তনাদের মতো শোনালো। হঠাৎ কী হলো, কিছুই বুঝতে পারে না শওকত। এতদিন ধরে সে তাদের সাথে আছে। একসাথে খেলাধুলা, আড্ডা-আনন্দ আর পাহাড়ি নানান অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে সে। তাদের ভাষাও সে খুব ভালোভাবে রপ্ত করে নিয়েছে। ভাষা শেখার ব্যাপারটা যতটা না নিজের ইচ্ছায় হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে রূপনীলের বাবা সর্দার জ্যোতিরিন্দ্রের ইচ্ছায়। ভাষা শেখার ব্যাপারটাও তার কাছে প্রথম দিকে খুব সন্দেহর কারণ হয়েছিলো। এই লোকগুলো তাকে ভাষা শেখাতে চায় কেন? এরা কি তাকে আর বাড়ি ফিরতে দেবে না? যখনই বাড়ির কথা মনে পড়ে ভেতরটা কেমন আকুলিবিকুলি করে। পরিস্থতিও অসম্ভব খারাপ। দাঙ্গা-হাঙ্গামায় অস্থির পাহাড়ি জনপদ। তবু এই পরিস্থিতির মধ্যেও সে এদের কাছে চিকিৎসা পেয়েছে। আপাতত সে নিরাপদই আছে। আর বুনো গাছগাছড়া কোনটা দিয়ে কী ওষুধ হয়, তার অনেকটাই ডাক্তার শুক্রমণি শিখিয়েছে তাকে। বলেছে, ‘তুমি তো অনেক সাহসী ছেলে। বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াও। অ্যাডভেঞ্চার করো।

মরণের মুখ থেকে একবার যেহেতু বেঁচেই গিয়েছো, বড় হতে হতে অনেক অভিজ্ঞতা জমে যাবে তোমার ঝুলিতে। শোনো, আমাদের দেশের পাহাড়ি বনে-জঙ্গলে বুনো প্রাণীরা খুব বেশি ভয়ের নয়, মানুষ যতটা মানুষের জন্য ভয়ের। শুধু বনে-জঙ্গলের কথা কেন বলছি, মানুষ সর্বত্রই মানুষের জন্য ভয়ের। যাকগে সে কথা। তুমি ছোট মানুষ, অতশত বুঝে কাজ নেই।’ বুঝে কাজ নেই বললেও শওকত বোঝে সবই। সেই সঙ্গে তার এটাও বোঝা হয়ে গেছে যে, মানুষ মাত্রই শান্তিকামী। শান্তিকামী কি? শান্তিকামী মানুষেরা কেন মানুষেরই জন্য ভয়ের কারণ হবে? নিজেদের শান্তির জন্য? নিজেদের শান্তির জন্য অন্যের শান্তি কেড়ে নেবে? ভাবতে গিয়ে সব বুদ্ধিশুদ্ধি তালগোল পাকিয়ে ফেলে শুওকত। এতদিনে তার এটা বোঝা হয়ে গেছে যে, জাতিগতভাবে বনের মানুষেরা তাদের শত্রু ভাবে। পাহাড় থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়। সবচেয়ে বড় কথা, তারা দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। তারা স্বায়ত্তশাসন চায়। ব্যাপারটা একটা স্বাধীন দেশের জন্য ভালো কিছু নয়। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। কিন্তু শওকতকে তো তারা মেরে ফেলেনি। এরা সবাই তাকে ভালোবাসে। এতদিনে তাদেরই যেন একজন হয়ে উঠেছে শওকত। অবিরাম, মালাকা, জ্যোতিরিন্দ্র, রামলাল, ডাক্তার শুক্র- সবাই তাকে স্নেহ করে। দানিশ, সোমেন, রূপনীলরা ওর অকৃত্রিম বন্ধু। সবাই ভালোবাসে তাকে।

একটা সময়ে সবকিছুতেই সন্দেহ ছিলো। এখনও যে সন্দেহ নেই তা নয়। ধীরে ধীরে সবার কাছে কেমন আপন হয়ে ওঠে সে। একইসাথে হয়ে ওঠে রুপেশ!শওকত নামটা সে একপ্রকার ভুলেই ছিলো এতদিন। হঠাৎ আজ দানিশের মুখে শওকত ডাকটা শুনে কেমন আঁৎকে উঠলো সে। দানিশকে জিজ্ঞেস করলো, ‘যাবো মানে, কোথায় যাবো দানিশ?’
দানিশ কিছু বলে না। চুপ থাকে। শওকত সবার দিকে তাকায়। রূপনীল বলে, ‘সকালে আব্বু বলেছে, আজ নাকি তোকে কেউ নিতে আসবে।’
‘নিতে আসবে মানে? কে নিতে আসবে?’ জানতে চাইলো শওকত।
‘তা কী করে বলবো? আমরাও তো জানি না। ভাবলাম, তুই বুঝি জানিস।’ বললো দানিশ।
‘না, আমিও তো জানি না।’

শওকতের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। আবার কোন অনিশ্চিত যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে। এতদিন সে পরিবেশ-পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিলো। আর মনে মনে এখান থেকে পালাবার ছক কষছিলো। যদিও বন্দী নয় বলেই তার আস্থা ছিলো। তবু এটা বুঝতে পারছিলো যে দাঙ্গাহাঙ্গামার মাঝে এরাও তাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবে না। শুক্র নিশ্চিত তাদের বাড়িঘরও চেনে। শিকারে গিয়ে বাড়ির কাছের সেই পাহাড়েই তো তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। সরদিন তার বাবার নামও তো জেনে নিয়েছিলো শুক্র। এজন্য একদিন সে ডাক্তার শুক্রমণিকে জিজ্ঞেসও করেছিলো, তার বাড়ি পৌঁছার বিষয়ে। কিন্তু তার থেকে আশানুরূপ উত্তর সে পায়নি। ফলে যতই নিরাপদ আর আনন্দমুখর সময় কাটুক তার, মনের ভেতর একটা সন্দেহ, একটা আশঙ্কা সবসময়ই খচখচ করতে থাকে শওকতের। আজ যখন সে দানিশের কাছে থেকে তার চলে যাবার বিষয়ে কথা শুনছে তখন সঙ্গত কারণেই তার মনে চিন্তা জাগে। কোথায় যাবে সে? নতুন কোনো বিপদ কী? তেমন হলে কী করবে সে? কপালে চিন্তার ভাঁজ। খুব দ্রুত কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করছে শওকত।
‘রুপেশ!’
শওকত মাথা তুলে দানিশের দিকে তাকালো।
‘ওই দ্যাখ, রামলাল এদিকে আসছে। আমার ধারণা তোর খোঁজেই বেরিয়েছেন।’
‘তোদের কোনো কথাই আমি বুঝতে পারছি না দানিশ, সোমেন, রূপনীল!’
ওরা সবাই চুপ। রামলাল কাছাকাছি এসে গেছে। সে এসেই ওদের চারজনের দিকে তাকিয়ে কেমন আছে তা জানতে চাইলো। অবি সর্দার ও জ্যোতি সর্দারের দুই ছেলে, সোমেন আর শওকত। এই চারটা ছেলেকে একসঙ্গে দেখলে মন ভরে যায় রামলালের। শওকতকে সে বললো, ‘আজ তোমার জন্য একটা নতুন খবর আছে রুপেশ। চলো, আমার সঙ্গে। এই জ্যোতি, সর্দারজী ঘরে আছেন?’
‘আছেন।’
‘রুপেশ, তুমি দুপুরে দানিশদের বাসায় যাবে। দানিশের সঙ্গেই যেও। এখন একসঙ্গে তোমরা খেলাধুলা করো। আমি আসি রূপনীলদের বাসা থেকে।’
বলেই হাঁটা ধরলো রামলাম। ওরা তেমন কিছুই বুঝলো না। কথাও তেমন কিছুই হলো না। শওকত তাকিয়ে আছে রামলালের চলে যাওয়ার দিকে। তার মাথায় এখন অন্য একটা চিন্তা। হরিণাদ্রিতে যাওয়া হবে না তার। পুরো অভিযানটাই ব্যর্থ হলো তার। আহত হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচলেও প্রস্তুতি নিয়ে হরিণাদ্রিতে চড়ার যে সাহস তা যুগিয়ে উঠছিলো মনে মনে এতদিন। কিন্তু সেই সময়টি আসার আগেই তাকে আবার নতুন কোনো জায়গায় হয়তো যেতে হবে। ভাগ্যে কী আছে, তার কিছুই জানা নাই তার। এবার কি সে বেঁচে থাকবে? কোন অপরিচিত জায়গায় আবার ঠাঁই হতে যাচ্ছে তার? এদের মধ্যে জাতিগত হিংসা আছে। হিংসা আছে বাঙালিদের মধ্যেও। আর সেই হিংসার আগুনে পুড়ছে পাহাড়। এখানে এসে আটকা না পড়লে এসবের কিছুই জানা হতো না শওকতের। আবার তার এও জানা হতো না- জাতিগতভাবে শত্রুপক্ষ হয়েও আহত ও নিরীহ অবস্থায় পেয়ে সেবাশুশ্রƒষা দিয়ে এরাই তাকে সুস্থ করেছে। এদের কাউকেই তো পর মনে হয়নি তার। বন্ধু হিশেবে দানিশ, রূপনীল আর সোমেনকে সে কোনোদিনই ভুলতে পারবে না। দানিশের সঙ্গে তার একটা জায়গায় মিল আছে। সেও হরিণাদ্রিতে উঠতে চায়! কিন্তু হরিণাদ্রিতে চাইলেই ওঠা যায় না, সহজ নয়। শুধু সাহস হলেই হয় না, লাগে বাস্তবিক জ্ঞান, পাহাড়ের জ্ঞান। সেই জ্ঞান পাড়ার সাধারণ শিকারীদের ছেলেপেলেদের থাকলেও আদুরে সর্দারপুত্রদের তো নেই। শওকত জানে, শুধু সাহসে ভর করে পাহাড়ে ওঠার মতো বোকামি আর দ্বিতীয়টি নেই। সে তো মরতেই বসছিলো। উপজাতিদের কাছে পুরো ঘটনার কিছুই সে বলেনি। যখন তারা, বিশেষ করে সর্দার অবি আর জ্যোতি যখন জানতে চেয়েছে তখন অনেককিছু চেপে গিয়েছে সে। আসল ঘটনাটা কিছুতেই বলেনি। আবার শুক্রমণিও আসল ঘটনা আঁচ করতে পারেনি। তার শুধু বিস্ময় ছিলো, এই ছেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একাকী পাহাড়ে ঢুকলো কেন! এসব সন্দেহ-সংশয় কেটে যেতে সময় লাগেনি। শওকত গ্রামের ছেলে নয়, শহুরে। পাহাড়ে সে অ্যাডভেঞ্চার করতে ঢুকেছে। ভেতরকার ভয় সম্পর্কে, পাহাড়ের রাজনীতি আর টালমাটাল পরিস্থিতি-খুনোখুনি সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। তাছাড়া তাদের বাড়ি যে এলাকাটায়, সেখানে এখনও অবধি বড় কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামা হয়নি। একারণেও পরিস্থিতি শওকতের অনুকূলে চলে যায়। তাকে আর বিস্তারিত কিছু বলতে হয়নি পাহাড়ে চড়ার বিষয়ে। নদীতে কেমন করে এলো, অমন মারাত্মকভাবে আহত হলো কিভাবে- তার জবাবে সে বলেছে, বনে একটা ভয়ঙ্কর প্রাণী দেখে সে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে ঘন কাশবনের ভেতর ঢুকে পড়ে। কিন্তু কাশবনে ঢুকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে গভীর নিচে পড়ে যায়। কমপক্ষে একশো হাত নিচে, একদম পানিতে। তা যে একটা পাহাড়ি নদী, সেটা বোঝার আগে চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আছে তার। এরপর আর কিছুই মনে নেই। কিন্তু বনের সেই প্রাণীটাই ছিলো ভয়ের, সত্যি ভয়ের। এখানেই কৌশলটা খাটিয়েছে শওকত। প্রাণীটা ছিলো একজন মানুষ।

গহীন বনের ভেতর ঢুকে শওকত হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে বিকেল হয়ে যাবার পর তার মনে হয় সে পথ হারিয়েছে। বনও ভয়ানক গভীর হয়ে গেছে। এসময় নিজেকে খুব বিপন্ন মনে হতে থাকে শওকতের। সকালের সেই সাহসটাও কোথায় যেন উবে গেছে। নিজের পায়ের শব্দে নিজেরই ভয় লাগে। একটা সময় মনে হয় তার পেছন পেছন কেউ যেন আসছে। কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে। সে দ্রুত পেছনে ফিরে তাকায়। নাহ, কেউ নেই তো। আবারও সেই একই ব্যাপার মনে হয়, কেউ যেন তার পেছনে আসছে, তাকে অনুসরণ করছে। ভয় তাকে পেয়ে বসেছে। কী করবে সে এখন? কোথায় যাবে? সন্ধ্যা তো প্রায় হয়েই গেলো! রাতে বনের মধ্যে সে যদি ঘুমায়, যদিও ঘুম একদমই আসবে না, তাহলে বনের হিংস্র প্রাণীরা তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলবে না! বনের ভেতর দিয়ে এ পর্যন্ত আসতে আসতে সে আজ অন্তত তিনটি প্রাণীর দেখা পেয়েছে, যাদের সে চেনেই না। তবে তারা যে হিংস্র প্রাণী, তা বেশ বোঝা যায়। পেছনে ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তার মনে হলো, বনের ভেতর একদিকে খুব আওয়াজ হচ্ছে, ডালপালা নড়ার আওয়াজ, পাতার খচখচ শব্দ। সচকিত হয়ে উঠলো সে। আওয়াজটা ক্রমেই বাড়ছে। তার মানে কিছু একটা তার দিকেই আসছে! ভয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হবার জোগাড়। কিছু ভাবার সময় নেই। হাতের দা’টা কোমরের বেল্টের সঙ্গে আঁটকে দ্রুত একটা গাছ বেয়ে উপরে উঠতে থাকলো সে। ভাগ্যিস, সে ভালো গাছ বাইতে পারে। গাছে একদম শীর্ষে উঠে গেছে সে। দ্রুত নিঃশ্বাস পড়ছে তার। একটা ভয়ঙ্কর প্রাণী ছুটে আসলো বনের ভেতর থেকে। আর গাছটার কাছাকাছি এসেই তার গতি কমে গেছে! প্রাণীটাকে সে চেনে না। বইতে বা টিভিতেও কখনও এরকম প্রাণী সে দেখেনি। রাজ্যের সমস্ত ভয় সব একসাথে চেপে ধরেছে তাকে। যদি প্রাণীটা তাকে দেখতে পেয়ে যায়! হতে পারে, প্রাণীটা তার উপস্থিতি টের পেয়েই এখানে এসেছে। তাহলে তো ব্যাপারটা খুবই খারাপ হবে। আচ্ছা, প্রাণীটা যদি তাকে দেখতে পায়! প্রাণীটা কি গাছ বাইতে পারে? শওকত প্রাণীটার পা’গুলো দেখার চেষ্টা করছে। পায়ে থাবা আছে কিনা, নখ আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করছে। নাহ, অন্ধকারে পা’গুলো ঠিকমতো দেখা যায় না। এখন মাগরিবের আজান হয়েছে? হাতের ঘড়িটার দিকে তাকালো সে। অবিশ্বাস্য! ঘড়িটা কি নষ্ট হয়ে গেছে! এখনও মাগরিবের বাকি পৌনে এক ঘন্টা। অথচ প্রায় রাত হয়ে গেছে। প্রাণীটা আস্তে আস্তে হেঁটে একদিকে সরে যাচ্ছে। শওকত চেষ্টা করছে প্রাণীটার থাবা আছে কিনা তা বুঝতে। বোঝা যাচ্ছে না, অন্ধকার। প্রাণীটা আরও দূরে চলে গেলে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয় তার। সে এবার হাতের ঘড়িটার দিকে তাকালো। ঘড়িটা নষ্ট হলো? এই বনের ভেতর তার কাছে দুইটা সম্বলই কেবল আছে। হাতের ঘড়িটা আর তাক্কল দা’টা, যেটা আসার সময় মধু ভাইর কাছ নিয়েছিলো। গাছের ঘন ডালপালার ভেতর দিয়ে দূরের একটা গাছের মাথায় চোখ পড়তেই সে দেখলো, গাছের ডালপালায় লাল রোদ লেপ্টে আছে। নাহ, তার ঘড়ি নষ্ট হয়নি। সব ঠিকঠাকই আছে। বনের ভেতর সূর্যের আলো পৌঁছে না বলেই এখানে এত আগে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সে যে গাছটায় বসে আছে, তাতে জড়িয়ে আছে মোটা মোটা অজস্র লতা। নিচে নামার চাইতে গাছে থাকাটাকেই নিরাপদ মনে হলো তার। সিদ্ধান্ত নিলো, রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার নামার আগেই গাছের উপর লতা পেঁচিয়ে একটা বসার জায়গা তৈরি করবে অন্তত। নইলে এত বড় রাত কাটানো মুশকিল হবে। লতা কাটতে কাটতে খেয়াল হলো, তিনদিক থেকে তিনটা ডাল উঠে গেছে। খুব মোটাসোটা, শক্ত ডালগুলো। মাথায় একটা বুদ্ধি খেললো শওকতের। এখানে সে আড়াআড়ি করে লতা পেঁচিয়ে চমৎকার একটা বসার জায়গা করতে পারে। কাজ যখন প্রায় শেষ, তখন সে দেখলো এখানে চাইলে সে রাতে ঘুমাতেও পারবে!

ভয় তার পিছু ছাড়ছে না। গাঢ় অন্ধকার রাত। বনে বোধহয় জ্যোৎস্না রাত বলে কিছু নেই। যেখানে বিকেল বেলাই রাত নেমে আসে, সেখানে রাতের বেলা জ্যোৎস্না কেবল কল্পনাই করা যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকারে একা একা বসে আছে শওকত। শীত শীত লাগছে তার। তারচেয়ে বড় জিনিশ ভয়। নিঃশ্বাস ফেলতেও হিশেব করে ফেলতে হয়। নির্জন বনে নিজের নিঃশ্বাসের শব্দটাকেও বাড়তি আওয়াজ মনে হয়। মনে হয়, এই বুঝি বনের বাসিন্দারা তার খোঁজ পেয়ে গেলো। ধারালো দাঁত আর নখর নিয়ে এই বুঝি ধেয়ে আসলো একটা কিছু। এমনি করে করে রাত বাড়ে। একসময় সে নানান জিনিশের কল্পনায় ডুবে যায়, তারপর গভীর ঘুমে। ঘুম যখন ভাঙে, তখন চতুর্দিকে নাম না জানা পাখিদের কিচিরমিচির, বানরের চিৎকার-চেঁচামেচি আর মাটিতে পাতা উল্টানি পাখিদের খচখচ। ঘন ডালপালার সূক্ষ্ম সব ফাঁকফোকর গলিয়ে সূর্যের আলোও পড়ছে বনের ভেতর। তবু বনের ভেতরটা অত পরিস্কার নয়। একটা গুমোট ভাব। দূরের দিকে তাকালে কিছুটা বরং অন্ধকারই লাগে। চির অন্ধকারেরই বাসা যেন এই বন। শওকতের পেটে অন্তহীন ক্ষুধা। কী খাবে সে! বনে কী পাওয়া যায় খাওয়ার মতো কে জানে! বাঁশের মোটা মোটা যে শেকড় তার নরম অংশটা খাওয়া যায়। আরও কী পাওয়া যায়, দেখতে হবে। ভাবতে ভাবতে মাটিতে নেমে আসলো সে। প্রচুর ক্ষুধা। ক্ষুধা অবশ্য রাতেই লাগছিলো খুব। কিন্তু ঘন অন্ধকার, ভয়, ক্লান্তি আর ঘুমের কাছে ক্ষুধা হয়তো ঠিকভাবে মাথা তুলতে পারেনি। এখন ঘুম ভাঙার পর তার মনে হলো রাতের বিভীষিকা অনেকটা কমে গেছে। এই সুযোগে ক্ষুধাটা চাগিয়ে উঠেছে। রাতের ঘুমটা খুব কাজে দেবে আজ। এখন কিছু খেয়ে নিলেই হয়। খুব সাবধানে হাঁটতে হবে। চতুর্দিকে খেয়াল রাখতে হবে। আত্মরক্ষার উপায় কেবল হাতের তাক্কল দা আর গাছ বাইতে পারার অভিজ্ঞতা।

খেয়ে না খেয়ে ক্ষুধা, ভয় আর মৃত্যুর সম্ভাবনা নিয়ে, জীবন বাজি রেখে বনের ভেতর দিয়ে এগোতে থাকে শওকত। শেষদিন সে এমন একটা জায়গায় পৌঁছে, যেখানে গিয়ে তার আরেকবার মনে হলো কেউ যেন তার পিছু নিয়েছে। একবার দুইবার তিনবার। গাছের একটা শুকনো ডাল মচাৎ শব্দে ভেঙে গেলে আচমকা আবার পেছনে ফেরে শওকত। এবার সে সত্যিই ভয়ের জিনিশ দেখলো। দেখলো তার পিছু নিয়েছে সেই প্রাণীটা। সেই মানুষ প্রাণীটা! হাতে বন্দুক। সে তার নিজের ভাষায় ধমক দিয়ে হয়তো থামতে বলছে। কিন্তু বলার এমন ভাষা, আর তাক করার এমন ধরন তা দেখে শওকতের মনে হয়েছে এই লোকের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও গুলি খেতে হবে
তারচেয়ে আত্মরক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা হিশেবে দৌড় লাগাতে হবে। বেশি কিছু না ভেবেই অগত্যা সামনের দিকে দৌড় দিলো শওকত। লোকটাও পিছু পিছু দৌড়। গুলি ছোঁড়ার শব্দও হলো। কিন্তু শওকতের গায়ে লাগেনি একটাও। সে দৌড়াচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে সামনে পড়লো কাশবন। কিছু না ভেবেই সে সমান গতিতে ঢুকে পড়লো কাশবনে। কিন্তু এরকম কাশবন আর ঝাড়ু ফুল গাছ পাহাড়ি নদীর খাড়া ঢালেই বেশিরভাগ সময় হয়ে থাকে, তা জানা নেই শওকতের। কাশবনে দৌড়ের গদিতে ঢুকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই শত ফিট নিচের নদীতে পড়ে যাওয়া! বন্দুকধারী লোকটা হয়তো ভেবেছে, সে মরেই গেছে। সেকারণে হয়তো আর খুঁজেও দেখেনি। এদিকে সে চিকিৎসা এবং সেবাশুশ্রƒষা নিয়ে তাদের সমগোত্রীয় লোকদের কাছে আছে দীর্ঘদিন।

দুপুরে দানিশদের ঘরে খাওয়াদাওয়া হলো শওকতের। এদের রান্নাবান্না আগে সে খেতে পারতো না, খারাপ লাগতো। কিন্তু আজকাল তা লাগে না। খাওয়া শেষে সর্দার অবিরাম বললো, ‘রুপেশ, তোমার জন্য আজ জরুরি একটা খবর আছে।’
শওকত মনোযোগী হলো সর্দারের দিকে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মালাকা। দানিশও তাদের সঙ্গেই খেয়ে উঠেছে। অবিরাম বলতে থাকলেন, ‘দ্যাখো, তুমি অনেকদিন ধরে আমাদের মাঝে আছো। আমাদের সর্দার এবং পাড়ার সব লোকই তোমাকে তাদের নিজের লোক হিসেবেই মনে করেছে এতদিন। দানিশ-রূপনীলরা তোমার ভালো বন্ধুও। তুমি চলে গেলে শুধু ওরাই নয়, পুরো পাড়ার মানুষজনই তোমার অভাব অনুভব করবে। তোমার কথা মনে পড়বে তাদের। আশা করি, তুমিও এ পাড়ার মানুষজনকে ভুলতে পারবে না। তোমার বয়স কম যদিও, তবু তোমার জানা আছে, আমাদের মধ্যে আর তোমাদের মধ্যে একটা রক্তক্ষয়ী জাতিগত লড়াই চলছে। এমতাবস্থায় শত্রু পক্ষের একটা ছেলে আমাদেরই ঘরে থাকবে, এটা ভাবাও সহজ নয়। তোমার ভাগ্যে হয়তো খারা কিছুই ছিলো। কিন্তু ভগবানের ইচ্ছাই চূড়ান্ত। তিনি তোমার প্রতি দয়া করেছেন। তারই দয়া তিনি আমাদের পাড়ার সবার মাধ্যমে দেখিয়েছেন। এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। নইলে যখন আমরা জাতিগতভাবে পরস্পরের খুনের জন্য উন্মত্ত হয়ে আছি, ঠিক তখনই শত্রু পক্ষের একটা ছেলে আমাদের কাছে আসবে, আর আমরা তাকে আশ্রয় দেবো, এটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। কিন্তু সংঘাত বাড়ছে রুপেশ। আচ্ছা, তোমার নামটা যেন কী ছিলো?’
‘শওকত।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, শওকত।’ একটু ক্লিষ্টভাবে হেসে বুঝতে পারার মতো করে মাথা নাড়লেন অবিরাম। আমাদের কাছে তুমি চিরকাল রুপেশই থাকবে। তুমি কোনো সাধারণ ছেলে নও, আমরা তা বুঝতে পারি। ওই হরিণাদ্রি থেকে কোনো সাধারণ মানুষ বেঁচে ফেরে না। তোমার বয়সী ছেলের তো ওখানে যেতেই পারার কথা নয়। আমি খুবই আশ্চর্য হচ্ছি রুপেশ। আচ্ছা শোনো, তোমার এই রুপেশ নামের অর্থ হলো সৌভাগ্যবান। এই নামটা তোমার জন্য ঠিক করেছিলেন মূলত জ্যোতিদা। আমাদের জ্যোতি সর্দার। তুমি যখন হরিণাদ্রি থেকে বেঁচে ফিরেছো এবং অত উপর থেকে পড়েও বেঁচে আছো, তার ওপর আবার আমাদের হাতে পড়েছো; যারা কিনা তোমার জাতিগত শত্রু! এই অবস্থায় তোমার ভাগ্যই সহায় ছিলো বলে জ্যোতিদা মনে করেন। ভগবানই তোমার সহায় হয়েছেন। চলো, তোমাকে দিয়ে আসি। এক লোক এসেছেন তোমাকে নিয়ে যেতে। তার কাছ থেকে তোমার জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা নিশ্চিত হয়েছি। আশা করি, তোমার কোনো বিপদ হবে না।’

‘রুপেশ!’
সর্দার অবিরাম যখন তাকে যেতে বলছেন, তখন দরজার পাশ থেকে ধরা গলায় ডাকলো মালাকা। রুপেশ সেদিকে ফিরলো। মালাকার সামনে যেতেই তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো তার। শওকতের চোখ ভিজে এলো। সে শুধু বললো, আমার জন্য দোয়া করবেন আন্টি। মালাকার কিছুটা পড়াশোনা জানা আছে। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারে সে। বললো, ‘তোকে কোনোদিনও ভুলবো না রুপেশ। আমার সাথে কত বাঙালি ক্লাসমেট ছিলো, আমরা বন্ধু ছিলাম। কিন্তু এখন এ কী ধরনের শত্রুতা শুরু জলো আমাদের মাঝে। ভগবান করুক, এসব যেন খুব তাড়াতাড়ি থেমে যায়।’
শওকত মালাকাকে কদমবুসি করে বাইরে বেরিয়ে এলো। দানিশ আর অবিরাম আছে তার সাথে। তারা হাঁটছে। কোথায়, কার সাথে আজ যেতে হবে তার কিছুই জানে না শওকত। শুধু জানে, দিনকাল ভয়ানক খারাপ। প্রথমে একটু সন্দেহ থাকলেও এখন আর সন্দেহ নেই যে, এরা তার ভালোই চায়। সুতরাং এপাড়ায় থাকলে হয়তো ঝামেলা হবে, আর এজন্যই তাকে অন্যত্র পাঠানো হচ্ছে।

সন্ধ্যার আগে আগে তারা যেখানে পৌঁছলো, তা পাড়ার একদম শোষদিকে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো, পাড়ার অধিকাংশ লোকই সেখানে জমায়েত হয়েছে। নারী-পুরুষ-শিশুকিশোর সবাই। এখানে মোটেও দেরি করা যাবে না। সর্দার জ্যোতি এসেছেন। তিনি এক যুবককে কাছে ডাকলেন, ‘দোকালা, এদিকে আসো।’

নাম শুনে শওকত চমকে উঠে সেদিকে তাকাতেই দেখলো, এ যে তার পাড়ার বন্ধু, দোকালা! তার বুকটা সাহসে ভরে গেল হঠাৎ। এক প্রকার দৌড়ে গিয়ে সে জড়িয়ে ধরলো দোকালাকে। দুই বন্ধুর জড়াজড়ি উপস্থিত সবার মাঝে একটা আস্থার বার্তা পৌঁছে দিলো। যারা শওকতের নিরাপত্তা নিয়ে এতক্ষণ চিন্তিত ছিলো তারা এবার আশ্বস্ত হলো যেন। জ্যোতি সর্দার বললো, ‘শোন পাড়াবাসীরা, দিনকাল ভালো নয়। আমি এখনই ওদেরকে বিদায় করতে চাই। তোমরা রুপেশকে সবাই ভালোবাসো তা আমি জানি। আমি এও জানি, রুপেশও আমাদের ভালোবাসে। আর রুপেশ কোনো সাধারণ ছেলে নয়। আশা করি, আমাদের পাহাড়ের পরিবেশ ভালো হলে, আতঙ্ক কেটে গেলে সে আবার একদিন আমাদের মাঝে আসবে। এ পথ সে ভুলে যাবে না, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আসি তোমাদের সবার পক্ষ থেকে এই সাহসী তরুণকে একটা উপহার দিতে চাই। আর তা হলো, এই বহুমূল্য বন্দুক। এটা দিয়ে সে শিকার করতে পারবে।’

সর্দার অবিরাম দিলো পাহাড়ি মেয়েদের হাতে বোনা একটা টুপি। সেটা শওকতের মাথায় পরিয়ে দিয়ে সে বললো, ‘এই নাও, এটা আমার পক্ষ থেকে।’
উপহার আরও এলো। দানিশ দিলো একটা নীল পাথর। এরকম পাথর নাকি পৃথিবীতেই বিরল খুব। রূপনীল আর সোমেন দুজনেই দিলো দু’টা পাহাড়ি জামা। আরও যে কত জনের কতকিছু দেবার ছিলো, কে জানে! কিন্তু সর্দার জ্যোতি সবাইকে থামলে বললেন। বললেন, ‘এইসব নেবার সময় এখন না। আর এতকিছু দিয়ে সে কী করবে? তোমরা ওর জন্য আশীর্বাদ করো। যেন ও ভালো থাকে। ওর এখন বাড়িতে ফেরা দরকার। দোকালা, রুপেশ- তোমরা রওয়ানা হও।’
উপস্থিত সবার দিকে হাত তুলে বিনয়, শ্রদ্ধা ও তার হৃদয়ের গভীর ভালোবাসার কথা জানিয়ে উপজাতিদের ভাষায় সংক্ষেপে কিছু বলে সে বিদায় নিলো। তার মুখ থেকে কথা সরছে না। এতগুলো মানুষ তাকে ভালোবাসে! তার কথার শেষ বাক্যটা আর্তনাদের মতো শোনালো। চোখ মুছতে মুছতে সে হাঁটছে পাহাড়ের পথে, সাথে বন্ধু দোকালা। পেছনে তার চলে যাওয়ার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে নরনারী আর শিশুকিশোরের দল। শোনা যাচ্ছে তাদের কথাবার্তার আওয়াজ। ব্যবধান বাড়ার সাথে সাথে সেই আওয়াজও ক্রমে ক্ষীণ হতে থাকে। শুধু ভারী হয়ে বুকের ভেতর চেপে থাকে একটা সম্পর্ক। যে সম্পর্কের কারণে নিজেকে খুব বিজয়ী মনে হয় তার।

যেতে যেতে দোকালা বললো বিস্তারিত কাহিনী। শওকতের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। তারপর মধুর তথ্য মোতাবেক পাহাড়ে পুলিশের তল্লাশি, গত সপ্তাহে শুক্রমণির গ্রেফতার হওয়া এবং তার দেয়া তথ্যমতে দোকালাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় শওকতকে আনতে। এদিকে এতগুলো মাস তার মা-বাবা হন্যে হয়ে খুঁজেছে তাকে। থানায় জিডি করা থেকে নিয়ে নানান মাধ্যমে খোঁজাখুঁজির চূড়ান্ত করেছে তারা। রাকিবের বাবা-মা, এলাকার মানুষ সবাই চিন্তা করেছে তার জন্য। অবশেষে তাকে পাওয়া গেলো। দোকালার কাছ থেকে এসব শুনে মনটা ভেঙে গেলো তার। বাবা-মাকে সে কতটা জ্বালাতন করছে, এই বোধ তাকে পেয়ে বসলো। নাহ, এরপর থেকে সে একদম ভালো হয়ে যাবে। তারা দু’জন হাঁটছে। পথ যেন ফুরাতে চায় না। পাহাড়ি পথ। পথে পথে ভয়ও আছে। বন্যপ্রাণীর ভয়, মানুষের ভয়।

ঝিমধরা গম্বুজ

শওকতকে আমরা প্রতিটা দিনই মিস করেছি। ও নিখোঁজ হবার পর আমাদের আড্ডা-আনন্দ সব কেমন পানসে হয়ে গেছে। ইশকুলে, পাড়ায়, রাস্তাঘাটে যখনতখন, যে কেউ তার কথা জিজ্ঞেস করছে, তাকে নিয়ে আলাপ করছে। কত দিকে খোঁজা হলো তাকে, তার কি ঠিক আছে! শওকতের কোনো সন্ধান নেই। ওর বাবা-মা, রাকিবের বাবা-মা সবাই তো কেঁদেকেটে হয়রান। অবশেষে ওর সন্ধান মিলেছে। ওর হারাবার খবরের মতোই চাউর হয়ে গেছে সন্ধান পাবার খবরও। যদিও পুলিশ না করেছে খবরটা জানাজানি করতে। কিন্তু কেমন করে যেন কারোরই জানতে বাকি থাকেনি। পথেঘাটে-ইশকুলে যেদিকেই যাই, লোকেরা শওকতের খবর জানতে চায়। বলে, ‘কি রে, শওকতরে নাকি পাওয়া গেছে?’ আমরা বলি, তা তো জানি না! চেপে যেতে চাই আসলে। খবর বেশি জানাজানি হলে ওর যদি কোনো ক্ষতি হয়, সেজন্য। কিন্তু সবাই-ই তো শওকতের কথা জানতে চায়! কবে বাড়িতে আসবে, কোথায় পাওয়া গেছে, কারা নিছিলো, কই গেছিলো- এইসব প্রশ্ন। তাহলে সবাই তো কমবেশি জানেই!
আসলে শওকতের সন্ধান শওকতই রেখে গেছিলো বাড়িতে, বন থেকে কুড়িয়ে আনা সেই জিনিশটার ভেতর। পুলিশ যখন কোনোভাবেই তার সন্ধান করতে পারছিলো না তখন হঠাৎ একদিন ওই জিনিশটা নিয়ে থানায় চলে যায় রাকিব। সঙ্গে আমাকেও নিয়ে যায়। রাকিব বলে, জিনিশটা একদিন হরিণ শিকারে গিয়ে সে বন থেকে কুড়িয়ে এনেছিলো। আমার কাছে রাকিবের এই কাণ্ড খুব হালকা মনে হলো। একটা জিনিশ বন থেকে কুড়িয়ে এনেছে তাতে এমন কী হয়েছে! কিন্তু পুলিশ অফিসার তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে আর জিনিশটা নেড়েচেড়ে দেখছে। এক পর্যায়ে বললেন, ‘রাকিব, তুমি কি এই জিনিশটা সম্পর্কে, বা বনের ভেতর এটা ঠিক কোথায় পাওয়া যায়- এসব কিছু জানো?’
রাকিব মাথা নাড়লো। জানে না সে। পুলিশ অফিসার আমার দিকে তাকালো। আমি তো কিছুই জানি না। আমিও মাথা নাড়লাম- উহু।

একজন পুলিশকে ডেকে কী যেন বললেন অফিসার। তিনি একটা খাতা এনে কীসব লিখতে শুরু করলেন। অফিসার আমাদের বললেন, ‘তোমরা আজ চলে যাও। দেখি, আমাদের চেষ্টা তো চলছে। তোমরা তোমাদের বন্ধুর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে পারো। আর এখন তোমরা যাও। সাবধানে থেকো। দিনকাল মোটেও ভালো নয়।’
তিনদিন পর এক সকালে আমাদের বাড়িতে আসলো রাকিব। আমরা চার ভাইবোন তখন পড়তে বসেছি। জানালায় এসে উঁকি মারলো ও। মেজো আপু বললো, ‘এই, ওই দ্যাখ রাকিব আসছে।’ আমরা সবাই ওদিকে তাকালাম। আপু বললেন, ‘রাকিব, ঘরে আয়।’ রাকিব বললো, ‘না আপু, বাসায় গিয়ে পড়তে বসবো। মানিকের সাথে একটু কথা বলতে আসছি।’
আমি উঠে বাইরে চলে আসলাম। রাকিব ফিসফিস করে বললো, ‘মানিক, একটা ভালো খবর আছে।’
আমি কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। বললাম, ‘কি খবর, বল তো!’
‘ওই যে জিনিশটা থানায় নিয়ে গেলাম না?’
‘হু’।
‘ওইটা তো একটা মাল রে!’
‘ক্যান, কী হইছে?’
‘আরে প্রত্নতাত্ত্বিক একটা দামি নিদর্শন নাকি ওইটা, পুলিশ অফিসার বললো। ওইটা নিয়া গবেষণা চলতেছে। আপাতত জানাইছে, এইটা মুঘল আমল বা তারও আগে-পরের কোনো মুসলিম নিদর্শন। এইটা নাকি একটা গম্বুজ।’
‘ওইটুকু গম্বুজ!’
‘আরে গাধা, মানুষ টেবিল সাজাবার জন্য, ঘর সাজাবার জন্য সোনা-রূপা-পিতলের নানান জিনিশ বানায় না? সেইরকম আরকি। ঘরে রাখার জন্য বানাইছে।’
‘আচ্ছা!’
‘তো, ওইটা যেহেতু দামি জিনিশ, আর যেহেতু বনে পাওয়া গেছে- গতকাল এইজন্য পুলিশ অভিযান চালাইছে বনে। আরও কিছু পাওয়া যায় কিনা, সেটা বোঝার জন্য। শওকতেরও কোনো ক্লু মেলে কিনা সেজন্য। এখন হইছে কী…!’
‘কী?’
‘ওইখান থেকে এক লোক ধরা পড়ছে। তার নাম নাকি শুক্রমণি।’
‘আচ্ছা!’
‘তার কাছ থেকে শওকতের খোঁজ পাওয়া গেছে। আহত অবস্থায় পেয়ে সে-ই নাকি শওকতের চিকিৎসা করছিলো। সে নাকি মস্ত কবিরাজ!’
‘আচ্ছা!’
‘আর অনেকগুলা ওইরকম জিনিশ পাওয়া গেছে ওইখানে।’
‘মানে?’
‘আরে, ওই প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিশগুলা।’
‘আচ্ছা!’
‘এই আরকি। এখন শওকতের সন্ধান যেহেতু পাওয়া গেছে, এইটা একটা ভালো ব্যাপার না?’
‘নিশ্চয়ই! এখন ওকে বাড়িতে আনা হবে কবে?’ শওকতের সন্ধান পাওয়ার খবরে আনন্দে উত্তেজিত হয়ে পড়ি আমি।
‘পুলিশের যতদিন সময় লাগে আরকি, প্রসেস করতে। দোয়া কর এখন। আল্লাহ আল্লাহ কর, যেন তাড়াতাড়ি বাড়িত আসে।’
রাকিব বাসায় চলে গেল।

এরইমধ্যে একদিন শুনলাম দোকালাকে পাঠানো হয়েছে শওকতকে আনতে। আর পুলিশের অভিযানে নতুন পাওয়া সেই প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিশগুলো থেকে বেরিয়ে এসেছে নতুন নতুন তথ্য। গবেষণাগারে পরীক্ষা হয়েছে জিনিশগুলো। গবেষকরা বলেছে, ‘এই জিনিশগুলোর কোনো কোনোটার বয়স দেড় থেকে দুই হাজার বছরেরও বেশি। কোনো কোনোটা আবার সাম্প্রতিক সাত-আটশো বছরের মধ্যে। মানুষের মাথার খুলি পাওয়া গেছে কিছু। সেগুলো প্রমাণ করে, এখানেও একসময় হয়তো মানুষের ঘরবসতি ছিলো। তাদের নাক উঁচু ছিলো। কপালের হাড্ডি, চোখের গর্ত, গালের হাড়, চোয়াল ইত্যাদির সঙ্গে বাঙালিদের আশ্চর্যরকম মিল রয়েছে। গবেষকদের ধারণা, বাঙালিদেরই পূর্বসূরি ছিলো এরা। অনেকগুলো স্কাল পাওয়া গেছে মাটির নিচে। গবেষকরা বলেছেন, ধর্মবিশ্বাসি কোনো জাতির লোক ছিলো হয়তো এরা। যাদের মৃত্যুর পর দাফন করা হতো। আর এ কারণেই এইসব খুলিগুলো মাটির নিচে পাওয়া গেছে। নইলে পাহাড়ের চূড়ায় মাটির নিচে খুলি পাবার কোনো কারণই নেই তো!

দোকালা শওকতকে নিয়ে ফিরে এলো। এই খবরও খুব প্রচার পেলো। চেনা-জানা লোকেরা দূরদূরান্ত থেকে আসছে শওকতকে দেখতে। ইশকুলের স্যারেরাও এসেছেন। পাড়ার মহিলারা দুধ নিয়ে এসেছেন। শওকতকে নাকি দুধ দিয়ে গোসল করাতে হবে! অনেকের বাড়ি থেকে দুধ আসার কারণে এক কলসি দুধ হলো। সেই দুধ প্লাস্টিকের মগে ঢেলে ঢেলে শওকতের মাথায় ঢালা হচ্ছে। শওকত দুধ দিয়ে গোসল করবে না। কিন্তু পাড়ার মুরব্বিদের চাপে তাকে করতেই হচ্ছে। দুধের পর সাবান দেয়া হচ্ছে তার গায়ে। এদিকে একসাথে অনেকের কথার আওাজ শোনা গেলো। আমরা সবাই সেদিকে তাকাতেই দেখলাম, থানা থেকে পুলিশ এসেছে। অনেকের মধ্যে আবার কানাকানি ফিসফিসানি শুরু হলো। পুলিশ আসছে কেন আবার! শওকতকে কি আবার থানায় নিয়ে যাওয়া হবে? কিন্তু না পুলিশ এসেছেন কয়েকটি জাতীয় দৈনিক নিয়ে। সেগুলোতে শওকতের ছবিসহ খবর ছাপা হয়েছে। একজন দুঃসাহসী তরুণের অভিযানের কারণে আবিষ্কার হলো হাজার বছরের ইতিহাস! সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ তাকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছেন। থানা থেকে তাৎক্ষণিক পুরস্কার হিসেবে বিশ হাজার টাকা তার হাতে তুলে দেয়া হলো। রাকিবদের বাড়ি লোকে লোকারণ্য। ইশকুলের স্যাররা তো আছেনই, এলাকার গণ্যমান্য লোকজনও এসে গেছেন। পুরস্কারের টাকা হাতে তুলে দেবার পর শওকতকে সংক্ষেপে কিছু বলতে বলা হলো। শওকত ভালো বক্তৃতা করতে পারে না। ইশকুলের উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, গান-আবৃত্তি কিছুতেই সে অংশগ্রহণ করে না। আমরা কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছি, সে কী বলে তা শোনার জন্য। বাড়িভর্তি লোক, সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। শওকত আমতা আমতা করে উঠে দাঁড়ালো। তারপর সবার দিকে একবার তাকালো। আমাদের দিকে চোখ পড়তে অন্যদিকে ফিরে গেল সে। নিশ্চিত, সে লজ্জা পায় আমাদের দিকে তাকালে। অথচ তাকে নিয়ে আজ আমাদের গর্বের অন্ত নেই। শওকত তার বক্তৃতা শুরু করেছে। সে যা বললো, তার কয়েকটা লাইন খুবই আবেগ স্পর্শ করলো আমাদের। সে বললো, ‘পাহাড়ের মানুষ ভালো নেই। মানুষেরা উপজাতি, সেই মানুষেরা বাঙালি। আমার আজকের এই অর্জন আমি সেইসব মানুষের পায়ের কাছে রাখতে চাই, যারা শান্তির জন্য লড়ছে। বাকিটা জীবন আমি সেইসব মানুষের জন্য কাজ করতে চাই, স্বার্থপর রাজনীতি যাদের মাঝে দেয়াল তুলে দিয়েছে। পরস্পরের হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য করেছে এবং পরস্পরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অথচ আমাদের সবার রক্ত লাল, আমরা সবাই মানুষ। এই যে আজ আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, বেঁচে আছি, সেটা একারণে যে, আমাকে কিছু পাহাড়ি উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ আশ্রয় দিয়েছিলো। চিকিৎসা দিয়েছিলো। আগলে রেখেছিলো। সেই পাড়ার সবগুলো মানুষের কাছে আমি ঋণী হয়ে আছি। আমি আসার সময় তারা আমাকে অনেককিছু উপহার দিয়েছে। আমার কাছে তাদের দেয়া সবচেয়ে দামি উপহার অশ্রু। আমি ঠিক করেছি, বাকি জীবন আমি মানুষের জন্য কাজ করবো। জাতিগত বিভেদ দূর করে ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য, একসাথে বসবাস করার জন্য কাজ করে যেতে চাই বাকি জীবন। আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ হাফেজ।’ ওর বক্তৃতা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্মুহূ করতালিতে মুখর হয়ে উঠলো পুরো পরিবেশ। [সমাপ্ত]

Share.

মন্তব্য করুন