তখন মুসলিম জাহানের খলিফা হযরত ওমর রা.। তাঁর শাসনের সময় ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিলো দূর-দূরান্তে। প্রায় অর্ধেক পৃথিবী এসে পড়েছিলো ইসলামের ছায়াতলে। এ অর্ধ পৃথিবীর শাসক হলেন হযরত ওমর রা.। তাঁর শাসন এখনও পর্যন্ত পৃথিবীবাসীর কাছে এক বিস্ময়! আবার ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রেও তাঁর উপমা অনন্য। তিনি নীতির বিষয়ে ছিলেন অটল। অবিচল। এবং জগতের সকল শাসকের মধ্যে তাঁর শাসন আর বিচার ছিলো শ্রেষ্ঠ।
তাঁর শাসনের এক পর্যায়ে মিশরও জয় হলো। হযরত আবু মুসা আশয়ারী রা. এর সেনাপতিত্বে বিজয় হলো মিশর। আবু মুসা আশয়ারী রা. ছিলেন অসীম সাহসী এক সেনাপতি। শাসক হিসেবেও তিনি উন্নত। মিশর জয় করার পর হযরত ওমর রা. তাকেই মিশরের গভর্নর নিয়োগ করেন।
একবার গভর্নরের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। শহর এবং শহরের বাইরের অনেকেই অংশগ্রহণ করে এ প্রতিযোগিতায়। আবু মুসা আশয়ারী রা.-এর ছেলেও অংশ গ্রহণ করে। তার নাম- মুহাম্মদ।
যে যার মতো তাগড়া ঘোড়া নিয়ে প্রস্তুত! প্রস্তুত আবু মুসা আশয়ারী রা.-এর ছেলে মুহাম্মদও।
প্রতিযোগিতা পরিচালক নিয়ম অনুযায়ী জানিয়ে দিলেন সবাইকে। এক পর্যায়ে শুরু হলো প্রতিযোগিতা। জানপ্রাণ ঢেলে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিযোগীরা। কে কাকে পেছনে ফেলে যাবে, মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে সকল প্রতিযোগী।
এক সময় সবাইকে ছাড়িয়ে দু’জন এগিয়ে থাকলো। সবার আগে আবু মুসার আশয়ারীর পুত্র মুহাম্মদ। কিন্তু তার আগেও আরও তীব্র গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এক যুবক। যুবকটির গায়ের রঙ ভীষণ কালো। হাবশি যুবক। আমরা যাকে বলি নিগ্রো। হঠাৎ মুহাম্মদের মাথায় এলো- আমি একজন নিগ্রো যুবকের কাছে পরাজিত হবো! এটি কী করে হয়! যেই ভাবা সেই কাজ। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো সে। একটি চাবুক তুলে নিলো হাতে। পেছন দিক থেকে কষে একটি বাড়ি বসিয়ে দিলো নিগ্রো যুবকটির গায়ে। অকস্মাৎ চাবুকের বাড়ি খেয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে ধপাস পড়ে গেল মাটিতে। এই সুযোগে শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলো মুহাম্মদ।
বিচারকমণ্ডলী দেখলেন ঘটনাটি। ভালেনও। কিন্তু প্রথম ঘোষণা করলেন মুহাম্মদকেই। কারণ তারা ভেবেছেন- মুহাম্মদ গভর্নরের ছেলে। তাকে প্রথম করতেই হবে। তার অন্যায়টি তারা আমলে নিলেন না।
এদিকে ফলাফল শুনে নিগ্রো যুবকটির মন ভীষণ খারাপ হলো। এর প্রতিকার চাইবে বলে ঠিক করলো। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিচার চাইবে সে। কিন্তু সে ভাবলো এ বিচার মিশরের গভর্নরকে দেবে না। কেননা মুহাম্মদ তো গভর্নরের ছেলে। যদি গভর্নর ছেলের পক্ষে রায় দিয়ে দেয়! এই ভেবে নিগ্রো যুবকটি সিদ্ধান্ত নিলো মুসলিম জাহানের খলিফা হযরত ওমরের দরবারে বিচার চাইবে সে। দেরি না করেই সে রওনা হয়ে গেলো। একসময় পৌঁছে গেলো ওমর রা.-এর দরবারে। যুবকটি সরাসরি বিচার দিলো হযরত ওমর রা.-এর কাছে। ঘটনা শুনলেন হযরত ওমর রা.। ঠিক তখন ওমর রা. একজন দূত পাঠালেন। দূতের কাছে একটি চিঠি। চিঠিটি মিশরের গভর্নর আবু মুসা আশয়ারী রা.-এর বরাবর। ওমর লিখলেন- চিঠিটি পাওয়া মাত্র ছেলে মুহাম্মদকে নিয়ে যেনো মদীনায় হাজির হন।
দূত পৌঁছে গেলো একসময়। চিঠিটি আবু মুসা আশয়ারীর হাতে তুলে দিলেন ওমরের দূত। চিঠি পড়ে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন আবু মুসা আশয়ারী রা.। ভবলেন- কি এমন অপরাধ যে চিঠি পেলেই রওনা হতে হবে। খুঁজে কোনো অপরাধ পাচ্ছেন না তিনি। কিন্তু হযরত ওমরের নির্দেশ। মুহূর্তও দেরি করলেন না তিনি। ছেলেকে নিয়ে রওনা দিলেন হযরত ওমরের উদ্দেশে।
এদিকে হযরত ওমর রা. রাষ্ট্রীয় মেহমানখানায় আদর আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন নিগ্রো যুবকটির!
একসময় আবু মুসা আশয়ারী রা. পুত্রকে নিয়ে হাজির হয়ে গেলেন ওমরের দরবারে। ওমর রা. দেরি না করেই বিচার কাজ শুরু করলেন। ওমর রা. নিজে বিচারকের আসনে।
আসামির কাঠগড়ায় গভর্নরের ছেলে মুহাম্মদ।
আবু মুসা আশয়ারী, তিনি গভর্নর! হলে কি হবে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো তাকেও।
বাদির আসনে নিগ্রো যুবকটি। যুবকটিকে দেখেই ঘটনা বুঝে গেলো মুহাম্মদ। অন্তর কেঁপে উঠলো তার। ওমরের দরবারে আসামি সে। অপরাধ তো করেছেই। এখনই কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে ওকে।
ওমর রা. নিগ্রো যুবকটিকে বললেন- বলো তোমার অভিযোগ। প্রতিযোগিতা নিয়ে যা ঘটেছে বললো ঘটনাটি। শুনে অবাক হলেন মুহাম্মদের পিতা হযরত আবু মুসা আশয়ারী রা.। তিনি তো জানতেন না ঘটনা কী!
ওমর রা. মুহাম্মদকে জিজ্ঞেস করলেন- এই যুবক যে অভিযোগ বললো এটি সত্য?
মুহাম্মদ জবাব দিলেন, জি সত্য। আমি প্রথম হওয়ার জন্য ঘটনাটি ঘটিয়েছি। আমার ভেতর এক ধরনের অহঙ্কার জন্ম নিয়েছিলো তখন। ভাবলাম, আমি গভর্নরের ছেলে। একজন নিগ্রো যুবকের কাছে হেরে যাবো আমি। এ চিন্তা থেকেই কাজটি করে ফেলেছি।
ওমর রা. রায় ঘোষণা করলেন। বললেন- তুমি প্রথমত যুবকটির ওপর জুলুম করেছো। তার শরীরে চাবুক মেরেছো। দ্বিতীয়ত তার অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করেছো। তৃতীয়ত তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছো। সুতরাং এখন তোমাকে একশ চাবুকের আঘাত খেতে হবে। একটি চাবুক হাতে দিয়ে নিগ্রো যুবকটিকে নির্দেশ দিলেন যেভাবে তোমাকে চাবুকের আঘাত করেছে ঠিক সেভাবে আঘাত করো। যুবকটি চাবুক হাতে তুলে মুহাম্মদের পিঠে তেমন করেই আঘাত করলো। এক আঘাতে মুহাম্মদ লুটিয়ে পড়লো আসামির কাঠগড়ায়। কাতরাচ্ছে সে সুখী শরীরে চাবুকের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা কি আছে!
এদিকে ছেলের অবস্থা দেখে কেঁপে উঠলেন পিতা আবু মুসা আশয়ারী রা.। তিনি ওমর রা.কে বললেন, হে আমিরুল মোমেনিন, আমার ছেলেটিকে একশ চাবুক মারলে সে বেঁচে থাকবে না। আমি অনুরোধ করি, চাবুকের বাড়িগুলো তার পরিবর্তে আমাকে দেয়া হোক। বলতে বলতে চোখে অশ্রু এসে গেলো তার। ওমর রা. বললেন, অপরাধীকেই পেতে হবে শাস্তি। শুনে থরথর করে কেঁপে উঠলো মুহাম্মদ।
অবস্থা দেখে নিগ্রো যুবকটি ওমর রা.কে বললো, হে আমিরুল মোমেনিন- আমি ওকে আল্লাহর ওয়াস্তে ক্ষমা করে দিলাম। আপনিও ক্ষমা করুন। মুহাম্মদ যুবকটিকে জড়িয়ে ধরলো। মাফ চাইলো!
ওমর রা. যুবকটিকে বললেন, তুমি যদি ক্ষমা না করতে তবে গুনে গুনে সব কটি চাবুক মারা হতো ওর পিঠে।
এভাবে ওমর রা. ন্যায়ের ঝাণ্ডা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন আজীবন।

Share.

মন্তব্য করুন