‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা
ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে
মামার বাড়ি যাই।’

বন্ধুরা এ মজার ছড়াটি কে লিখেছেন জান? হ্যাঁ, তাহলে শোন। যে কবি তোমাদের জন্য পল্লীগাঁয়ের কথা সুন্দর করে ছন্দের পর ছন্দ দিয়ে সাজিয়ে ছড়া-কবিতা আকারে উপহার দিয়ে গেছেন তাঁর কথাই তোমাদেরকে বলছিলাম। আর এ জন্যই তাকে পল্লীকবি বলা হতো। তাহলে অবশ্যই তোমরা বুঝতে পারছ কে এই কবি? তিনি হলেন আমাদের প্রিয় পল্লীকবি জসীমউদ্্দীন।
ধানক্ষেতের নরম বুকের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝিরঝির বাতাস আর রূপালি নদীর কলকল শব্দের মাঝে কবি জসীমউদ্্দীন খুঁজে পেতেন কবিতার ছন্দ। ডানকানা মাছের কিলবিলে সাঁতার আর উদোম গায়ে গ্রাম্য কিশোরের এলোমেলো দুষ্টুমি তাঁকে যেন ডেকে নিয়ে যেত ছেলেবেলার সেই দিনগুলোতে। হারাধন ঘোষ যখন দইয়ের ভাঁড় কাঁধে নিয়ে হেঁটে যেত পাড়ায় পাড়ায়, বলরাম মিস্ত্রি যখন তুক তাক মন্তর পড়ে ধ্যান করত চোখ বুজে, যখন পুকুর ভরা মাছ ছিল আর গোলা ভরা ধান- সেই দিনগুলো কবির মনে পড়ত। তাই কবি সোনালি ধানের লকলকে শীষ, ডালিম গাছের ফুল আর সোজন বেদের বাউল টানের মাঝে খুঁজে বেড়াতেন তাঁর গাঁয়ের নির্মল দিনগুলোকে।
আচ্ছা তোমরা কি কখনো গ্রামে বেড়াতে গিয়েছ? গ্রামে গাছে গাছে যখন পাখি ডাকে তখন তোমাদের কেমন লাগে? খুব মজা, তাই না? মন উদাস করা ভরদুপুরে বেতুন ঝোপের আড়ালে বসে সে পাখিটি একটানা ডেকে চলে, লেবু রঙের রোদ্দুরের ঝিলমিলে করে হেসে ওঠে যে শিশির বিন্দুটি, কবি তাদের না বলা কথাগুলো হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন। অজপাড়াগাঁয়ের প্রতিটি মানুষ যেন তাঁর অতি নিকটজন ছিল। তারা যেন সবাই কবির আত্মার আত্মীয়। ফলে কবি জসীমউদ্্দীন তাঁর প্রতিটি রচনার মধ্যে দিয়ে পল্লীর সাধারণ মানুষের জীবন কবিতার মাধ্যমে নিখুঁতভাবে এঁকে গেছেন।
তাহলে চল না এ কবি কোথায় জন্মগ্রহণ করেছেন তা আমরা জেনে নিই। ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রাম। এই গ্রামেই ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি কবি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ছাত্রজীবন কাটে ফরিদপুর আর কলকাতায়।
ছেলেবেলায় আর দশটি কিশোরের মতো কবিও ভীষণ দুষ্টু ছিলেন। যেমন একটা ঘটনা বলছি। স্কুল থেকে কবির বাড়ি ছিল প্রায় আড়াই মাইল দূরে। সেখান থেকে তিনি খাওয়া-দাওয়া সেরে নয়টার সময় স্কুলে রওয়ানা করতেন। আর স্কুল ছুটি হতো বিকেল চারটার সময়। এর মধ্যে কবির পেটে খুব ক্ষুধা লাগত। একদিন করলেন কি, পেটে ক্ষুধা পেলে নিজের পাঠ্যবইগুলো বাটা দিয়ে দুই আনার বরফি কিনে খেলেন। কিন্তু বই ছাড়িয়ে নেয়ার পয়সা কোথায় পাবেন? এবার তো খুব চিন্তা। কয়দিন পর বাড়ি থেকে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে বাজারে বিক্রি করে পয়সা সংগ্রহ করলেন। তারপর গেলেন দোকানির কাছে। দোকানি বললেন, আমি তোমাকে না দেখে বইগুলো ছিঁড়ে ঠোঙা বানিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। একথা শুনে তো কবির মাথায় হাত।
ছেলেবেলা থেকেই কবি ছিলেন দারুণ মিশুক প্রকৃতির। শুধু নিজ গ্রামেই নয়, আশপাশের অন্যান্য গ্রামের লোকেরাও তাকে ভালোবাসতেন।
কবির কাব্যচর্চা কখন শুরু হয় জানো? রবীন্দ্র যুগের মাঝামাঝি সময় তাঁর কাব্যচর্চা শুরু হয়। সে যুগের কবিদের মধ্যে যতীন্দ্র মোহন বাগচী, কালীদাস রায়, কুমুদ রঞ্জন মল্লিক ও করুণা নিধি বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও আরও কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক তাদের লেখায় গ্রামীণ জীবনকে উপাদান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই জসীমউদ্্দীনের মতো এমন অন্তর দিয়ে পল্লীর আলো-বাতাসকে ভালোবাসতে পারেননি।
বাংলা সাহিত্যে জসীমউদ্্দীন এক দুর্লভ প্রতিভা। গ্রাম-বাংলার নির্মল পরিবেশ দিয়ে আমরণ ছন্দের মালা গেঁথে গেছেন তিনি। তিনি কখনো কাউকে অনুসরণ করতেন না। তবে অগ্রজদের উপদেশ গ্রহণ করতেন।
একবার বাড়ি থেকে কবি কয়েকটি পাণ্ডুলিপি নিয়ে কলকাতায় চলে গেলেন। তাঁর ইচ্ছা কবি নজরুলকে দেখানো। এই সুবাদে কবি নজরুলের সাথে পরিচয়ও হয়ে যাবে। তাই তিনি গিয়ে হাজির হলেন। কবি নজরুল তখন বন্ধুদের সাথে গল্পের আসরে ছিলেন। জসীমউদ্্দীন ভয়ে ভয়ে নজরুলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। নজরুল দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, তুই কে রে? তিনি বললেন, আমার নাম জসীমউদ্্দীন। আমি ফরিদপুর থেকে এসেছি আপনার সাথে দেখা করতে। এই বলে কবিতার পাণ্ডুলিপিগুলো নজরুলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। কবি নজরুল ২-১টি পাতা উল্টিয়ে বললেন, আমি এখন বাইরে যাচ্ছি তুই পরে আসিস। জসীমউদ্্দীন চলে গেলেন। কবি নজরুল বাসায় ফিরে জসীমউদ্্দীনের কবিতাগুলো পড়লেন। তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। মনে মনে জসীমউদ্্দীনকে খুঁজতে লাগলেন। একদিন জসীমউদ্্দীন গিয়ে হাজির হলেন নজরুলের কাছে। নজরুল দেখেই জসীমউদ্্দীনকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, তুই এতো সুন্দর কবিতা লিখিস! তারপর তিনি পরামর্শ দিলেন, গ্রামকে নিয়েই লিখতে হবে তোকে, ভালো করতে পারবি। এভাবে জসীমউদ্্দীন, নজরুলের ভালোবাসা কুড়িয়ে নিলেন। আরো নিবিড়ভাবে মিশতে লাগলেন গ্রামীণ পরিবেশের সাথে।
কবি জসীমউদ্্দীন শুধু বড় কবিদের নয়, বরং প্রতিটি মানুষের মন কেড়ে নিতে পারতেন। তাই জসীমউদ্্দীন ছিলেন একটি নতুন ধারার বাহক। যে ধারাটি ধীরে ধীরে কবিকে নির্ভেজাল পল্লীকবির আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি চলে গেলেন রহিমুদ্দীর ছোট্ট বাড়িতে আসমানীকে দেখতে। আর আসমানীদের কথা ছড়িয়ে দিলেন তোমাদের কানে কানে। কতো সুন্দর করে ছন্দের মালা সাজিয়ে উপহার দিলেন তোমাদের মতো ছোট্ট বন্ধুদের।
কবি জসীমউদ্্দীন ১৯৩১ সালে বাংলাসাহিত্যে এস.এ পাস করেন। ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দেন। ১৯৬২ সালে অবসর গ্রহণ করার পর থেকেই তিনি নিজেকে বিলিয়ে দেন পল্লীসাহিত্য সংগ্রহ ও রচনার কাজে। তখনকার দিনের খ্যাতনামা শিশু-কিশোর পত্রিকা ‘শিশু সাথী’, ‘মৌচাক’, ‘রামধনু’, ‘সন্দেশ’, ‘আলাপন’ প্রভৃতিতে অনেক অনেক ছড়া-কবিতা লিখেছেন তিনি।
শুধু কি তাই? ‘হাসু’, ‘এক পয়সার বাঁশি’, ‘ডালিম কুমার’, ‘হীরামন’, ‘বাঙালীর হাসির গল্প’ প্রভৃতি সুন্দর বই লিখে ছোটদের হৃদয়-মন জয় করে নিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের গ্রাম, মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা প্রভৃতি বিষয় অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায় আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তিনি ছড়ায়, কবিতায়, গানে এবং নাটকে। গ্রামের শস্য-শ্যামল প্রাকৃতিক পরিবেশ শৈল্পিক সুষমায় অতি নিপুণভাবে রূপায়িত হয়েছিল তাঁরই হাতে।
কবি কতগুলো বই লিখেছেন জান? বাব্বাহ! পঁয়ত্রিশটি বই তিনি লিখেছিলেন। যেমন ধর, রাখালী, নকসী কাঁথার মাঠ, ধানক্ষেত, সোজন বাদিয়ার ঘাট, সকিনা, যে জননী কান্দে, বালুচর, স্মৃতিপট, মাটির কান্না, রূপবতী, সুয়েনী, বোবাকাহিনী, রঙ্গীলা নায়ের মাঝি, চলে মুসাফির, গাঙের পাড়ি, বেদের মেয়ে, মধুমালা, পল্লীবধূ, গ্রামের মায়া ঠাকুর বাড়ীর আঙ্গিনায়, যাদের দেখেছি, জীবন কথা, যে দেশের মানুষ বড়, হলদে পরীর দেশে, জার্মানির শহরে বন্দরে, ওগো পুষ্পধনু ও ভয়াবহ এই দিনগুলো উল্লেখযোগ্য। কবি জসীমউদ্্দীনের লেখা শেষ গ্রন্থটি কি জান? শেষ গ্রন্থটির নাম হলো- ‘মাগো জ¦ালিয়ে রাখিস আলো’।
পল্লীকবি জসীমউদ্্দীন ছিলেন এমন এক মরমী কবি যার কাজের সাথে জড়িয়ে ছিল সবুজ মাঠ, লাউয়ের ডগা, বাঁশপাতার শন শন শব্দ আর পবন মাঝির ভাটিয়ালি গান।
কবি তার লেখার সাথে বাস্তবতাকে মেখে ফেলতেন। তোমরা তার কবর কবিতা নিশ্চয়ই পড়েছ। এই কবিতাটি তিনি যখন বিএ ক্লাসের ছাত্র, তখনই লেখেন। এই কবিতাকে নিয়ে একটা গল্প আছে। একদিন নাকি কবি এক খোলা বিলের মাঝখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন বিলের মাঝখানে এক বাড়ি থেকে এক বৃদ্ধের কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। অমনি কবি ওই বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেন। গিয়ে দেখলেন, বৃদ্ধ তার এক নাতীকে সামনে নিয়ে বিলাপ করে কাঁদছেন। কবি এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলেন আর কেউ নেই। বাড়িটি তার কাছে শূন্য মনে হলো। তিনি বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কাঁদছেন কেন বাবা? বৃদ্ধ বললেন, আমার এই বাড়িতে অনেক মানুষ ছিল। কিন্তু কলেরা রোগ হয়ে সবাই মারা গেছে। শুধু আমি আর আমার এই নাতি ছাড়া আর কেউ নেই। কবি বৃদ্ধের বিলাপের বিস্তারিত জেনে বাড়ি এলেন। তারপর লেখা হয়ে গেল কবির বিখ্যাত কবিতা ‘কবর’।
‘এইখানে তোর দাদীর কবর
ডালিম গাছের তলে
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি
দুই নয়নের জলে।’

বাহ! কি মজার কবিতা তাই না! বাংলার মাটি ও মানুষের মনে যতদিন পল্লীর এই মায়াভরা নির্মল পরিবেশটি সুর ছড়িয়ে যাবে, কবির এই সুন্দর মিষ্টি আবেদনও আমাদের মাঝে ততদিন বেঁচে থাকবে।

কবি জসীমউদ্্দীন আজ আর আমাদের মাঝে নেই। ১৯৭৫ সালের ১৪ মার্চ আমাদের পল্লীর এই প্রিয় কবি চলে গেছেন এই দুনিয়া ছেড়ে। মৃত্যুর মাত্র বাইশ দিন আগে তিনি রাষ্ট্রীয় একুশে পদক পান।

Share.

মন্তব্য করুন