(গত সংখ্যার পর)

পাড়ার ও’দিক থেকে কিশোরদের হইচই আর চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। অবিরাম বাবু সেদিকে ফিরে জোর কদমে হাঁটতে থাকেন। মোড় ঘুরতেই চরের দিকটায় ছেলেদের জটলাটা চোখে পড়লে উদ্বেগ বাড়তে থাকে তার। জটলার হইচই শুনে মোটেও ভালো ঠেকছে না। এতদূর থেকে ভালো দেখাও যায় না। দানিশ কি ওখানেই আছে! ওখানে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। ছেলেরা কী কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে আছে- কে জানে! কত সামান্য ও তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মারপিট করে একেকজনকে আহত করে ফেলতে পারে এইসব কিশোরেরা। বয়েসটাই এমন। এই তুমুল ঝগড়া, এই আবার গলাগলি, সখ্যতা- শিকারে যাওয়া। নিজেদের শৈশবটাও এই দুরন্তপনার বাইরে ছিলো না। সময়ের সাথে সাথে কত কিছু বদলেছে। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের ব্যবধান। হরিণাদ্রি পাহাড়টা তখন যেমন ছিল এখনও প্রায় তেমনই আছে। অথচ নিজে কেমন বুড়িয়ে যাচ্ছেন। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে, চুল-দাড়িতে পাক ধরেছে। কিন্তু হরিণাদ্রি তেমনই আছে। কেবল সে-ই তার তারুণ্য ধরে রেখেছে। কত দীর্ঘ তার তারুণ্য? ঈর্ষা হয় পাহাড়টাকে।

অবিরামকে দেখে ছেলেরা সরে গিয়ে পথ করে দিলো। সবার চোখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দানিশের দিকে তাকালেন তিনি। কিছু বললেন না। তার আগেই পাশ থেকে সোমেন নামের একজন বললো, ‘চাচ্চু, এই ছেলেটা কোথাকার আমরা জানি না। নদীতে পড়ে ছিলো। দানিশ ওকে প্রথম দেখেছে। তারপর আমাদের ডেকেছে।’
অবিরাম বাবু একটুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, ‘কী হয়েছে ছেলেটার? এ তো বাঙালিদের ছেলে! কি সর্ব্বনাশ! তা তোমরা এখানে কী করছিলে?’ দানিশের দিকে ফিরলেন অবিরাম। জবাবটা তার ছেলের কাছ থেকেই জানতে চান আসলে। ছেলেকে খুঁজতেই তার এখানে আসা।
আমতা আমতা করে দানিশ বললো, ‘প্রথমে তো ওকে দেখে ভয় পেয়ে গেছিলাম। পরে দেখি ও কাঁতরাচ্ছে। তারপর ওদেরকে ডেকে নিয়ে কাছে যাই এবং ধরাধরি করে চরে নিয়ে আসি।’
কথা না বাড়িয়ে অবিরাম তাকালেন রূপনীল নামের একটা ছেলের দিকে। বললেন, ‘তুমি এক দৌড়ে বাড়িতে যাও। গিয়ে তোমার বাবাকে এখানে আসতে বলো।’
রূপনীলের বাবা পাড়ার সর্দার। অবিরাম নিজেও সর্দার, কিন্তু রূপনীলের বাবাই প্রধান। ঘটনাটা যেহেতু ছোটখাটো নয়, জটিল- সেহেতু সর্দার প্রধানেরই উপস্থিত থাকা উচিত। তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে। যদিও অবিরামের মতামতের একটা গুরুত্ব থাকে সবকিছুতেই।

ছেলেটার দিকে এতক্ষণ ভালোভাবে খেয়াল করেননি তিনি। এবার তাকালেন। হালকা গড়নের, ফর্সা ও ছিমছাম চেহারার এক কিশোর। প্যান্টের এক পাশ থেকে ছেঁড়া। শার্টও ছিঁড়ে গেছে। ছেঁড়া শার্টটা চরের বালুতে বিছিয়ে তার উপরই শুইয়ে রাখা হয়েছে তাকে। অবিরাম মনোযোগী হলেন ছেলেটার দিকে। পাশে বসলেন তিনি। চোখ টেনে দেখলেন। শ^াস নিচ্ছে, টেনে টেনে, গভীরভাবে। কষ্ট হচ্ছে তার। পেট পিঠের সাথে লেগে আছে ক্ষুধায়। কয়দিন খায়নি কে জানে! হাত দিয়ে সাবধানে ধরে একদিকে সামান্য কাৎ করলেন ছেলেটাকে। ঘাড়ের দিকে একটা গভীর ক্ষত, রক্ত ঝরছে সামান্য সামান্য। হয়তো অনেকক্ষণ ধরে ঝরে ঝরে এখন থিতিয়ে এসেছে। ভয় পাওয়া গলায় বিড়িবিড় করে কী যেন বললেন তিনি। তার চেহারায় উদ্বেগ স্পষ্ট। সেই উদ্বেগ স্পর্শ করলো চতুর্পাশে দাঁড়ানো সব ক’জন পাহাড়ি কিশোরকেও। তারা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। দানিশ ভয়ে ভয়ে ধরা গলায় বললো, ‘আব্বু!’
অবিরাম জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন ছেলের দিকে।
‘ও কি খুব বেশি আহত? আশঙ্কাজনক?’
অবিরাম বাবু দেখলেন- একই প্রশ্ন খেলা করছে অন্যদের চোখেমুখেও। গভীর পিতৃ¯েœহ জেগে উঠলো অবিরামের বুকে। যেমন করে সমুদ্রের সমতল বুকে ফুলে ফুলে ওঠে একেকটা ঢেউ। সেই ঢেউ আছড়ে পড়ে দুগ্ধফেননিভ হয়ে আরেকটা ঢেউয়ের উপর- একটার পর একটা। অবিরামের ভেতরটাও কেমন ফেনায়িত হয়ে উঠলো। দানিশের প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না তিনি। ওদের বোঝার বয়স হয়েছে। তাছাড়া তার এ মুহূর্তের চেহারাই বলে দিচ্ছে ছেলেটার অবস্থা মোটেও ভালো নেই। এতক্ষণ যে বেঁচে আছে- সেটাই আশ্চর্যের।

কী করবেন অবিরাম বাবু? একবার তাকালেন পাড়ার দিকে। হ্যাঁ, ওই তো সর্দার আসছেন। সামনে সামনে হাঁটছে রূপনীল। সর্দার কি ছেলেটাকে আশ্রয় দেবেন, নাকি অন্যকিছু করবেন! অন্যকিছু করলে তিনি নিজে কি কোনো ঝুঁকি নিতে পারবেন? না না- সেরকম ঝুঁকি তিনি কী করে নেবেন? পাড়ার বিপক্ষে, গোষ্ঠী ও রাজনীতির বিপক্ষে তিনি যেতে পারেন না। অনেক সংগ্রামী জীবন তার। জীবনে অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত তাকে নিতে হয়েছে, আর সেকারণেই তো পাড়ার লোকেরা তাকে সর্দার বানিয়েছে। প্রধান সর্দার- রূপনীলের বাবার পর সে-ই হবে প্রধান সর্দার। এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যা করলে তিনি সন্দেহভাজন হয়ে পড়েন। শুধু সন্দেহের ব্যাপার নয়, স্বজাতির লোকেরা তাকে গাদ্দার পর্যন্ত ঠাওরাতে পারেন। এর পরিণতি ভালো হবে না। তার চেয়ে বেশি ভালো হবে- যদি সর্দার রাজি হয়ে যান ছেলেটাকে আশ্রয় ও চিকিৎসা দেবার জন্য। অবিরাম বাবু ছেলেদের দিকে তাকালেন। বোঝা যায়, ওরাও এখন সর্দার প্রধান রূপনীলের বাবাকে নিয়েই ভাবছে।
সর্দার প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র এসেই একবার তাকালেন চরের ওপর শুইয়ে রাখা ছেলেটার দিকে। তারপর অবিরামের চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘অবস্থা তো ভালো নয় দেখছি। কী ভাবলে?’
‘আমি কিছুই ভাবিনি সর্দার। আপনার অপেক্ষা করছিলাম।’

প্রথম থেকে সবকিছু সংক্ষেপে শুনে নিয়ে জ্যোতি তাকালেন ছেলেটার দিকে। বললেন, ‘ওকে পাড়ায় তোলা যাবে না। এদিকে বাঙালিদের কোনো পাড়া নেই। কিভাবে সে এখানে আসলো কে জানে?’ অবিরামকে এক পাশে ডেকে নিয়ে কানে কানে বললেন, ‘ছেলেটা হতে পারে আমাদের খারাপ কোনো দুশমন। হয়তো আমাদেরই অন্য একটা গ্রুপের সাথে লড়তে গিয়ে বা কোনো ক্ষতি করতে গিয়ে এ অবস্থায় পড়েছে। নইলে এতদূর এলো কী করে? আহত হলো কী করে? না জেনে তার ব্যাপারে কোনো কিছুই ভাবতে পারি না। তুমি কী বলো?’
‘আপনার কথা খুবই যৌক্তিক। তবে নির্দোষ হওয়ার সম্ভাবনাও তো থাকে, নাকি! সেটা যদি হয় তাহলে ওর জীবন রক্ষা করাটা খুব জরুরি। প্রচুর রক্তক্ষরণ গেছে ওর শরীর থেকে। ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত সে এখন। আর অতো ছোট একটা ছেলে, হয়তো এইট-নাইনে পড়ে- সে আমাদের শত্রু হলেও খুব খারাপ কিছু হতে পারে না। এ মুহূর্তে ও দুশমন নয়- আশ্রয়প্রার্থী, মুমূর্ষ।’
‘অবিরাম তোমার কথাই সত্য। তোমার মনের অবস্থা বুঝি, কিন্তু আমি ওর ব্যাপারে কিছু করতে পারছি না, দুঃখিত। চতুর্দিকে শুধুই খারাপ খবর। এটা কোনো ষড়যন্ত্রও হতে পারে। হতে পারে পুরো ঘটনাটাই সাজানো, যদিও এ সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। তবু আমি এসব সম্ভাবনাকে এ মুহূর্তে অগুরুত্বপূর্ণ ভাবতে পারি না।’

কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আবার বললেন, ‘একটা কাজ করতে পারো অবি, অবশ্য তুমি নিজে না থেকে; তুমি থাকলে ঝামেলা হতে পারে। ছেলেটাকে পাড়ার শেষ প্রান্তে শিকারীদের চালাঘরে পাঠিয়ে দিতে পারো। শুক্রমণি তো আছেই, ওকে ডাকাবো। আপাতত ছেলেটার পাহাড়ি টোটকা চলতে পারে। আর আমরাও পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। খানিকটা সেরে উঠলে ওর থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য জানা যেতে পারে। সে এবং তার পরিবার, এমনকি তার পাড়ায়ও কেউ আমাদের ক্ষতি করার মতো আছে কিনা সেটা জানা জরুরি। তারপর ওর ব্যাপারে ভাবা যাবে। বাহিনীর কেউ এদিকে এলে এবং ওর ব্যাপারে কিছু জানতে চাইলে তোমার-আমার পক্ষ থেকে এই ছেলের সমর্থনে কিছু বলা হবে না। যা বলার শিকারীরা বলবে। অবস্থা বেগতিক দেখলে প্রয়োজনে বনের ধারে ছেড়ে দিতে হবে ওকে। কিন্তু কোনোক্রমেই সন্দেহের পরিবেশ সৃষ্টি হতে দিয়ে পাড়ার ঐক্য নষ্ট করা যাবে না। কোনোপ্রকার ঝুঁকি নেয়া যাবে না অবি।’

কথাগুলো একটানা ফিসফিস করে বলে থামলো সর্দার প্রধান। ওদিকে ছেলেটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ি ছেলেরা এসবের প্রায় কিছুই বুঝলো না। অবিরাম বললেন, ‘দাদা, ছেলেগুলোর দিকে দেখুন। ওদের কিশোর মনে বিপন্ন ছেলেটির জন্য কেমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।’
‘সেটা আমি তোমার চেয়ে কম বুঝি না অবি। আর সে কারণেই তোমাকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে কথাগুলো বললাম, তোমার সঙ্গে পরামর্শ করলাম। হ্যাঁ, ওদের মনে যেমন বিপন্নের প্রতি দয়া থাকবে, তেমনি শত্রুর প্রতি চূূড়ান্তরকম ঘৃণাও থাকতে হবে। এই শিক্ষাটা ওদের এখনই পাওয়া জরুরি। তা না হলে আগামীতে আমরা নিজেরাই বিপন্ন হয়ে পড়বো, জাতিগতভাবে। আমাদের মধ্যে আর বীর থাকবে না- স্বাধীনতাকামী লড়াকু থাকবে না। এমনকি একজন শিকারী খুঁজেও পাওয়া যাবে না একদিন। শোনো অবি, ওদের আশ্বস্ত করো যে- ছেলেটি সুস্থ হয়ে উঠবে। ওদের বলো, এ ঘটনা যেন জানাজানি না হয়। একদম কাউকেউ যেন না বলে।’
‘এখন কী করবো সর্দার?’
‘শিকারীদের খবর দাও। ওরা এসে নিয়ে যাক। মনে রেখো, তোমার-আমার উপর যেন কোনো দায় না থাকে। আবার শিকারীদের ওখান থেকেও কোনো বিপত্তি না বাঁধে- সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পাড়ার বসতিগুলোতে যেন জানাজানি না হয়।’
অবিরামের জবাবের অপেক্ষা না করে হাঁটা ধরেন সর্দার জ্যোতিরিন্দ্র। রূপনীল থেকে যায় ছেলেদের সঙ্গে। অবিরাম দানিশকে বলেন, ‘তুমি বাড়ি চলে যাও। তোমার মা চিন্তা করছেন। তোমাকে খুঁজতে বেরিয়েছেন। আমিও তোমার খোঁজেই এসেছিলাম।’
অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে দানিশ।
কিছুটা দূরে কারো কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অবিরাম সোমেনের সঙ্গে আরও দু’জন ছেলেকে সেদিকে পাঠালেন। বলে দিলেন, ‘দ্রুত ও’দিকে গিয়ে দ্যাখো তো ওরা কারা। শিকারীরা হতে পারে। সেরকম হলে আমার কথা বলে এদিকে ডেকে নিয়ে এসো।’

অবিরাম বসে ছেলেটার মাথায় হাত রাখলেন। খানিকক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থাকলেন ওর দিকে। যেন কিছু বোঝার চেষ্টা করছেন। ছেলেটা একদমই গ্রামের ছেলেদের মতো না। ক্লান্ত, আহত- তবু সেটা বোঝা যায়। চেহারার দিকে তাকালে তাকে খারাপ কিছু বলেও মনে হয় না। তাছাড়া তার ভালো করেই জানা আছে- বাঙালিদের সশস্ত্র কোনো গোষ্ঠী পাহাড়ে নেই। সেখানে একজন কিশোর যে নিতান্ত নিরীহ তা বলাই বাহুল্য। তবু সর্দার প্রধান কোনোপ্রকার ঝুঁকি নিতে চাননি। সেটা কেন- তা বোঝেন অবিরাম। জানাজানি হলে বিপদটা উপর থেকে আসবে নির্ঘাত। এ মুহূর্তে আর ভাবাভাবি নয়। শিকারীদের বসতিতেই পাঠাতে হবে। আর গোপনে সব খোঁজখবর রাখতে হবে।
নদীর পানিতে পা ফেলে হাঁটার আওয়াজ হচ্ছে, সেই সাথে কথাবার্তা- কাছেই। অবিরাম দেখলেন সাত-আটজন লোক এদিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু এরা কেউই এ পাড়ার নয়। তিনি এদের দেখেছেন বলেও মনে হয় না। একটু ভয় খেয়ে গেলেন তিনি। সোমেনরা গিয়ে কাদের ডেকে আনলো এ? নতুন ঝামেলা নয় তো! হায় ভগবান! কিন্তু ঝামেলার কিছুই হলো না, লোকগুলো কাছে এসেই প্রণাম করলো অবিরামকে। তারপর একে একে নিজেদের পরিচয় দিলেন। শিকারীদের বসতিতে নতুন এসেছেন। তাদেরই আত্মীয়স্বজন। যাক, এদিকের শঙ্কা কেটে গেছে। এ লোকগুলো নতুন হওয়ায় বাড়তি সুবিধা হলো, কেউ কিছু সন্দেহ করবে না। সর্দার অবিরাম পুরো ব্যাপারটা লোকগুলোকে বুঝিয়ে দিয়ে সোমেনকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘সোমেন, এদের সবাইকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাও, আমিও আসছি। তোমার আন্টিকে বোলো এদের জন্য খাবার তৈরি করতে।’

শুধু রূপনীল থাকলো অবিরামের সঙ্গে, সেও তার নিজেরই জোরাজুরিতে। সর্দার প্রধানের ছেলে, থাকুক, মন্দ হয় না। দু’জনে ধরাধরি করে বনের আড়ালে নিয়ে গেলো ছেলেটাকে। তারপর বুনো গাছগাছড়ার লতাপাতা দিয়ে নিজের মতো করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে থাকলেন অবিরাম। রূপনীল সহযোগিতা করছে তাকে। রূপনীল জানতে চাইলো, ‘চাচ্চু, ওকে শিকারীদের পাড়ায় কখন পাঠাবেন?’
‘রাতে। অন্ধকার হলে।’
কৌশলটা বুঝতে পেরে চুপ হয়ে থাকলো রূপনীল।
সারাটা বেলা অবিরামের বাড়িতে থাকার পর সেই লোকগুলো নদীপাড়ের ঝোঁপ থেকে ছেলেটাকে আনতে গেলো। সঙ্গে আছে দানিশ আর রূপনীল। অবিরাম আসেননি। ছোট দুই ছেলেকে রাতে বেরোতে দেবার ব্যাপারে মালাকার অবশ্য অমত ছিলো। কিন্তু রূপনীল আর দানিশ যাবেই। অবিরামও ভাবলেন নিজে না গিয়ে ছেলেপেলে গেলে ঝামেলার সম্ভাবনা কম থাকবে। এদিকে শিকারীদের বসতি থেকেও একজন সরদার গোছের লোককে ডাকিয়েছেন অবিরাম। ওর নেতৃত্বেই ঝোঁপ থেকে ছেলেটাকে বের করে দড়ি আর চটের তৈরি পালকিতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঝোঁপের কাছে পাহারায় ছিলো সোমেন।

অবিরামের নির্দেশমতো শিকারীদের পাড়ায় ওদের কারোরই যাওয়ার অনুমতি নেই। ফলে সোমেন, রূপনীল আর দানিশ তিনজনই নিজ নিজ বাড়ির দিকে চলে গেলো। এসব পথঘাট একা একা হাঁটার অভ্যাস আছে ওদের। শুধু হরিণাদ্রি পাহাড়ে ওঠা নিষধ। বড়রা পর্যন্ত ওই পাহাড়ে ওঠেন না। শিকারীরাও নদীচরের অন্যান্য বনে শিকার করেন। কেউই হরিণাদ্রিতে চড়ার সাহস করেন না। পাহাড়টা নিয়ে নানান কথা চালু আছে এ পাড়ায়। বড়রা বলেন, পাহাড়ের ঘন জঙ্গলে নানান প্রজাতির হিং¯্র প্রাণীরা আছে। শতবর্ষী-সহ¯্রবর্ষী গাছগুলোতে আছে ভূত-প্রেত-ব্রহ্মদৈত্য। কত প্রজাতির এবং কতসংখ্যক যে হরিণ আছে- তার ঠিক ঠিকানা নাই। প্রতিদিনই যখনতখন শোনা যায় হরিণের ডাক। দিনের বেলা ছড়ার পাড়ে গেলেও কখনোসখনো দেখা মেলে হরিণের নাড়িভুড়ি-হাড্ডি-চামড়ার। রাতের বেলা কোনো হিং¯্র প্রাণী হয়তো শিকার করে খেয়েছে। হতে পারে হতভাগ্য হরিণটা কোনো দেওদানবেরই রোষের শিকার হয়েছে। কতকিছুই তো হওয়া সম্ভব। দুঃসাহস করে অতীতে এ পাড়ার কিছু জোয়ান ছেলে ওই পাহাড়টাতে গিয়েছিলো, তারা নাকি আর ফেরত আসেনি। পাড়ার কিশোর-তরুণরা মা-বাবার সাথে রাগ-অভিমান করে প্রায় প্রায়ই হুমকি দেয়- ‘চলে যাবো হরিণাদ্রিতে। আর তোমাদের ঘরে ফিরবো না।’ এরকম কথা একদিন দানিশও বলেছিলো। কিন্তু তা রাগ-অভিমান থেকে নয়। একদম জেনে-বুঝে! তার কথা, পাহাড়টা জয় করতে হবে। ওখানে এই আছে সেই আছে বলে না যাওয়াটা পাহাড়িদের সাজে না। আমরা শিকারে যাবো, যুদ্ধ করবো; ভয়কে জয় করবো। মালাকা তার এই ইচ্ছার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষিপ্ত হয়ে জব্দ করে ফেলেন তাকে। বলেন, ‘খবরদার, ওসব কথা যেন আর কোনোদিন মুখে না শুনি।’ দানিশ হাসতে হাসতে বলেছিলো, ‘যাবো মা, আমি যাবোই।’
একরোখা-জেদি এই ছেলেটাকে নিয়েই মালাকার যত ভয়। আর এ কারণেই ছেলের বাড়ি ফিরতে দেরি হলে বা রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে নানা শঙ্কায় দুলতে থাকে তার মন। অবিরামকে জানান। দু’জনই খুঁজতে বেরিয়ে যান, ঠিক আজও সেভাবে বেরিয়েছিলেন তারা। একটামাত্র ছেলে তাদের।

নতুন পরিচয়

পাহাড়ি চিকিৎসা ও সেবাশুশ্রƒষায় কিছুটা সতেজতা ফিরে আসলেও ক্ষত সেরে ওঠেনি এখনও। ক্ষতটা গভীর। উপর থেকে গাছের চোখা কোনো গুড়ি বা পাথরের উপর আছড়ে পড়ার কারণেই এই ক্ষতটা সৃষ্টি হয়েছে বলে পাহাড়ি উপজাতি লোকদের ধারণা। ছেলেটার কাছ থেকে এখনও কিছুই জানা যায়নি। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু। জংলিদের ধারণা- তাদের ভাষা না বোঝার কারণে বা তার উপর দিয়ে বড় কোনো ধকল যাওয়ার কারণেই হয়তো এরকম আচরণ করছে সে। শিকারীদের প্রায় সবাই-ই খোঁজ রাখে ছেলেটার। রামলাল নামের সর্দার গোছের লোকটা তো আলাদা পাহাড়ারই ব্যবস্থা করেছেন। তার এক কথা- যেখানে অবিরাম সর্দার স্বয়ং এই ছেলের চিকিৎসা এবং সুস্থতার কথা ভেবেছেন, সেখানে কোনো ঘাটতি রাখা যাবে না। খুঁজে খুঁজে পাহাড়ি ফলমূল আর স্বাস্থ্যকর খাবারদাবার নিয়ে আসে ছেলেটার জন্য। পাশে এসে বসে থেকে থেকে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতিটা বোঝার চেষ্টা করে রামলাল। ছেলেটার সঙ্গে কথা বলা দরকার। সে কেমন বোধ করছে এসব জানা দরকার। কী অভাব অনুভব করছে, শরীরের কোথায় কোথায় সমস্যা বোধ করছে তা জানা দরকার। কিন্তু যখনই সে আসে, দ্যাখে- ছেলেটা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। বুনোদের আদিম পদ্ধতির শল্যচিকিৎসক শুক্রমণি অবশ্য বলে গেছেন, তার ঘুমে যেন বিঘœ ঘটানো না হয়। একে তো শরীর দুর্বল, তার উপর উচ্চ মাত্রার বুনো ওষুধপথ্য দেয়া হচ্ছে। ক্ষত ও ব্যথা সারানোর পাশাপাশি এ ওষুধের একটা কাজই নাকি রোগীকে ঘুম পাইয়ে দেয়া। ব্যথা ভুলিয়ে রাখা। নইলে অত বড়ো ক্ষত নিয়ে এইটুকু বয়সের একটা ছেলে কী যে করতো! ভাবতেই ভয় খেয়ে যায় রামলাল। গভীরভাবে তাকায় সে ছেলেটার দিকে। খুব সুন্দর লাগছে আহত, অসুস্থ, ঘুমন্ত ছেলেটাকে। ঘুমালে কিশোরদের এতো সুন্দর দেখায়! দশ বছর আগে মারা যাওয়া নিজের ছেলেটার চেহারা ভেসে ওঠে তার মনের পর্দায়। বেঁচে থাকলে তার বয়সও এখন এরকমই হতো। কিন্তু ভগবানের কী ইচ্ছা- বড়দের সঙ্গে শিকারে গিয়ে বুনো শূকরের হামলায় ছেলেটা মারাত্মকভাবে আহত হয়ে ঠিক এরকমই চিকিৎসাধীন থেকে এক সপ্তাহ অন্তর মারা যায়। তবে ডাক্তার বলেছেন এ ছেলেটার জখম মারাত্মক নয়- শিগগিরই সেরে উঠবে বলে মনে হয়। কী নাম ছেলেটার? বাড়িঘর কোথায়, কী তার পরিচয়- কে জানে। কী দুর্দিন চলছে এখন, আর এই দুর্দিনেই ছেলেটা কোত্থেকে এসে হাজির হলো তাদের পাড়ায়। সর্দার অবিরাম যেরকম সতর্ক করেছেন, তাতে তিনি বলেছেন- ছেলেটাকে সুস্থ করে তুলতে। তার কাছ থেকে নাকি কীসব তথ্য জানবেন। আর বিপদজনক না হলে তার নিরাপত্তার বিষয়েও যত্নবান হতে হবে। আচ্ছা, ছেলেটা যদি সত্যিই আমাদের খারাপ কোনো দুশমন হয়! কিন্তু পাহাড়ি তরুণদের মতো এ ছেলের পেশী দেখে তো যোদ্ধা মনে হয় না। তবু ছেলেটার প্রতি নিজের ভেতরে দায়িত্বের বাইরে গিয়ে বেশি ¯েœহ জন্মাতে দেয়া যাবে না। পরবর্তীতে পস্তাতে হতে পারে। ভাবতে ভাবতে পাশে রাখা তাক্কল দা’টা হাতে নিয়ে রামলাল বাইরে বেরিয়ে পড়লো। যাওয়ার সময় দু’জনকে বলে গেলো ছেলেটার দিকে খেয়াল রাখতে।

‘শওকত, শওকত!’ বহুদিন পরে নিজের নাম ধরে কেউ তাকে ডাকছে শুনে ধড়ফড় করে জেগে ওঠার চেষ্টা করতেই শরীরের কোথাও একটা টান অনুভব করে ব্যথায় ককিয়ে উঠলো শওকত। আবার বিছানায় পড়ে গেল সে। দরজার দিক থেকে দৌড়ে কাছে চলে আসলো পাহাড়ি চিকিৎসক শুক্রমণি। বন্দুকটা পাশে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হলো শওকত? ব্যথা পেয়েছো?’
শওকতের সঙ্গে এতদিনে একবারও মুখোমুখি হননি তিনি। রামলালের মাধ্যমেই সব ওষুধপথ্য দিয়েছেন। রামরালকে সতর্ক করেছেন বারবার- খবরদার, ওর সেবাশুশ্রƒষায় কোনো ঘাটতি হয় না যেন। আঘাত মারাত্মক। ওষুধপথ্য এবং খাওয়াদাওয়া যেন সব ঠিক থাকে। তার চিকিৎসা পাহাড়ি গাছগাছড়ার হলেও তিনি যথেষ্ট শিক্ষিত মানুষ। কিন্তু তার ভরসা বনাজিতে, আদিম পদ্ধতিতেই। তিনি বলেন, ‘ব্যাক টু ন্যাচার। প্রকৃতির মাঝে থেকে যদি প্রকৃতি থেকে আরোগ্য নিতে না পারি তাহলে একদিন এমন আসবে যখন আমরা আর এর সঙ্গে খাপ খেয়ে চলতে পারবো না। প্রকৃতিই আমাদের বের করে দেবে তার সমূহ কল্যাণ থেকে।’ পাহাড়িরাও তার কথা শোনে। এ অঞ্চলে তার নামডাক ব্যাপক। সবার চিকিৎসাই তিনি করেন। তার সাধ্যের বাইরে না হলে কাউকেই শহরের হসপিটালে পাঠান না। কিন্তু আদিম পন্থায় তার দখল এতখানি যে, প্রায় অধিকাংশ লোকের চিকিৎসাই তিনি এখানে দিতে পারেন। তিনি যোদ্ধা মানুষ। বন্দুক নিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘোরেন আর বুনো গাছপালা, লতাপাতা, শেকড়বাকড়ের উপর একস্পেরিমেন্ট চালান। নতুন নতুন ওষুধ বানান তিনি।
শওকত তাকিয়ে আছে চিকিৎসকের দিকে। ইনি তো সেই লোক, যাকে সে প্রথমদিন শিকারে গিয়ে বনের ভেতরে দেখতে পেয়েছিলো। হ্যাঁ, অবিকল সেই লোক। কিন্তু লোকটা তার নাম মনে রেখেছে! এবার ধীরে ধীরে অনেক কিছুই মনে পড়ছে শওকতের। লোকটা সেদিন যখন তার কাছে নাম জানতে চেয়েছিলো। সে নাম বলার পর লোকটা একটা নোটবুকে লিখে নিয়েছিলো নামটা। হ্যাঁ, এটা সেই লোকই। কিন্তু তার চেহারায় তো সেরকম ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। অথচ একটা নিষ্ঠুরতা, ধূর্ততা খেলা করছিলো সেদিন তার চেহারায়। কিন্তু আজ তা কোথায়? চিকিৎসক শুক্রমণি বিছানার পাশে বসে শওকতের মাথায় হাত রাখলেন। বললেন, ‘ওঠো তো দেখি। হ্যাঁ, ঠিক আছে। আস্তে আস্তে…।’
শওকত খুব ধীরে ধীরে উঠে বসলো। এবার আর কোনো ব্যথা পেলো না। শুক্রমণি বললেন, ‘অনেকদিন ধরে বিছানায় শয্যাশায়ী আছো তো এ কারণেই সমস্যাটা হলো। ঠিক হয়ে যাবে ধীরে ধীরে। তবে একটু একটু করে হাঁটতে হবে। দৌড়াবার চেষ্টা করতে হবে। তোমার সঙ্গ দেবে রামলাল। রামলাল, এই রামলাল…!’
দরজার দিকে থেকে দৌড়ে আসলো রামলাল।
‘জি¦ দাদা, বলেন।’
‘এই ছেলের নাম শওকত। এ নামে ওকে ডাকার দরকার নেই। অন্য নামে ডেকো। সেটা পরে ঠিক হবে। তার আগে শোনো- অনেকদিন ধরে বিছানায় শুয়ে-বসে থাকার কারণে ওর কিছু সমস্যা হচ্ছে, উঠতে-বসতে। ওর একটু হাঁটাচলা করা দরকার। যথাসম্ভব দৌড়ঝাঁপও করুক। তবে সাঁতার কাটার এবং পাহাড়ে চড়ার দরকার নাই এখনই। খাওয়াদাওয়ার দিকে খেয়াল রেখো।’
এবার শওকতের দিকে ফিরে বললেন, ‘ঠিক আছে শওকত। ভালো থেকো। পরে কথা হবে।’
শওকতের সঙ্গে সেরকম কোনো কথাই হলো না চিকিৎসক লোকটির। তার আগেই উঠে গেলেন তিনি। শওকত তার চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে চুপচাপ বসে থাকলো। তার ভেতরে কিছুটা ভালো লাগা কাজ করছে। এই লোকটিকে দেখেই সে ভয় পেয়েছিলো একদিন। আর সেই কিনা এখানে চিকিৎসক। কত মারাত্মক অবস্থা থেকে এই লোকই তাকে সারিয়ে তুলেছে। এতদিনে সে বুঝতে পেরেছে এই পাড়াটা দুর্গম পাহাড়ি এলাকার ভেতরে। পাহাড়িদের সঙ্গেই সে আছে। বাড়ির কথা, আব্বু-আম্মুর কথা, রাকিব-জসিম-মানিকের কথা এবং ইশকুলের বন্ধুদের কথা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। কান্না পায় মাঝে মাঝে।

শুক্রমণির পেছন পেছন রামলালও বাইরে চলে গেছিলো। সে এখন ফিরে এসেছে। তার মুখে হাসি খেলছে। শুক্রমণির চেহারার সঙ্গে বাঙালিদের অনেকখানি মিল আছে। প্রথমবার সেই বনে দেখা হওয়ার পর তো তাকে এতদিন বাঙালিই জেনে আসছিলো শওকত! কিন্তু রামলালের চেহারা পুরোপুরি উপজাতি চাকমাদের মতো। সে পাশে এসে বসলো। হেসে হেসে শওকতকে বললো, ‘শোনো, শুক্রদা তোমার নাম পাল্টাতে বলেছে। মানে তোমাকে এই এলাকায় আরো অনেকদিন থাকতে হবে। খুব শিগগিরই বাড়িতে ফেরা হচ্ছে না। এটা তোমার সুস্থতার জন্য যেমন জরুরি, তেমনি আমাদেরও অনেক কিছু বোঝার আছে। তবে তোমার কোনো ভয় নেই। সেরকম কিছু হলে আমরা তো আর তোমাকে এতদিন ধরে চিকিৎসা দিতাম না, তাই না? তুমি মন শক্ত করো। আমার বিশ^াস, শুক্রদা তোমার পক্ষেই আছেন। উনি তোমার নাম জানেন, তাতেই আমি বুঝে গেছি। এখন এই নামটা বদলাতে হবে কিছুদিনের জন্য। তোমার নামটা হবে আমাদের ভাষায়। সেই নামেই এখানকার সবাই তোমাকে ডাকবে। এদের সঙ্গেই মিশে থাকবে তুমি, যতদিন এ পাড়ায় আছো। আশা করি এতদিনে আমাদের ভাষাও তুমি কিছু কিছু বুঝতে পারছো। আমরা বাংলা খুব সামান্য জানি। শুক্রদা ভালো জানেন। উনি শিক্ষিত মানুষ। শহরেও থেকেছেন দীর্ঘদিন। শুক্রদার কাছ থেকে যা শুনলাম তাতে মনে হলো তোমাদের বাড়ি এখান থেকে বহুদূরে। তা অতদূর থেকে তুমি এখানে এসেছো, তাও একা একা! যাকগে শোনো, আমাদের সর্দারের কিছু আশঙ্কা ছিলো তোমার ব্যাপারে। আশা করি, শিগগিরই সেসব কেটে যাবে। আর ডাক্তার তো তোমাকে বাইরে যাবার অনুমতিও দিয়েছেন। সুতরাং এ পাড়ায় তুমি অনেক ভালো বন্ধু পেয়ে যাবে। দানিশ, রূপনীল- আমাদের দুই সর্দারের ছেলে। এছাড়া আছে সোমেন। ওরাই তোমাকে প্রথম উদ্ধার করেছিলো নদী থেকে, আহতাবস্থায়। ওরা তোমার সঙ্গে দেখা করতে উদগ্রীব হয়ে আছে। প্রায় দিনই ওরা তোমার অবস্থা জানতে চায়। কিন্তু ডাক্তারের নিষেধ ছিলো এতদিন। সর্দারও নিষেধ করেছিলেন তোমার সঙ্গে কাউকে দেখা করতে দিতে। আশা করি এখন আর সেরকম সমস্যা হবে না। আর শোনো, শুক্রদা তোমার একটা নাম দিয়ে গেছেন। তোমার পছন্দ হলে এই নামেই তোমাকে ডাকা হবে এখন থেকে। পছন্দ না হলেও অন্য নাম নিয়েও ভাবা যাবে। নামটা বলবো?’
কৌতূহলী হয়ে মাথা কাত করলো শওকত।
‘রুপেশ। কি পছন্দ হলো? সুন্দর নাম এটা। তোমার মতো সুন্দর ছেলের জন্য ঠিকই আছে।’
শওকত আবার মাথা নাড়লো। বললো, ‘অর্থ কী এ নামের?’
‘সুন্দর, মনোযোগী অথবা ভাগ্যবান। আরও কিছু বোঝালেও আমি তোমাকে বলতে পারছি না। বাংলা ভাষা কম জানি খুব। শুক্রদা ভালো জানেন।’ ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললো রামলাল।
‘এটি কোন ভাষার শব্দ?’
‘শুক্রদা ভালো জানবেন। উনি শুধু বলেছেন, এ নামের অর্থ ভালো। সুন্দর, মনোযোগী অথবা ভাগ্যবান- এরকম কিছু।’
নামটা খারাপ লাগলো না শওকতের। ‘রুপেশ’ নামটা মনে মনে দুয়েকবার বললো সে। নিজের নাম রুপেশ হয়ে যাচ্ছে- এটা ভাবতেই ফিক করে একটু হেসে ফেললো সে। রামলাল বললো, ‘কী হলো? নতুন নামের কথা ভেবে হাসছো? ও কয়েকদিন গেলে ঠিক হয়ে যাবে।’
নামের ভাবনার পরই শওকতের মাথায় অন্য একটা ভাবনা ঢুকে পড়লো। সে এখানে বন্দী নয় তো! এদের দেয়া নাম নিয়ে এদের কাছেই থাকতে হবে নাকি? তারা আসলে কী আচরণ করবে তার সঙ্গে? এখনও পর্যন্ত অবশ্য ভালোই মনে হচ্ছে এদের আচরণ। বলা চলে এরাই ওকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে এনে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছে। তবু এখন এদের মধ্যে জাতিগত হিংসারও একটা মনোভাব আছে। সেটাই সন্দেহের, ভয়ের। তাছাড়া বনে সে যে পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলো, তারও কারণ এরাই। শুক্রমণিও তো বেশি কিছু বললো না। অবশ্য তাকে নিয়ে খুব একটা ভয় পাচ্ছে না শওকত। শওকতের কাছে শুক্রমণি হাজির হয়েছে এক নতুন পরিচয়ে- চিকিৎসক। নিজের পরিচয় ‘রুপোশ’ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুর সঙ্গেই সে এখন নতুন পরিচিত হচ্ছে। তবে সেই ছেলেদের সাথে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছাটা প্রবল তার, যারা তাকে মারাত্মক আহত অবস্থা থেকে উদ্ধার করেছে। কারা তারা? রামলাল অবশ্য নামও বলেছে তাদের। কিন্তু এ মুহূর্তে একটা নামও মনে নেই তার।

সবকিছুতে একটা অনিশ্চয়তা। তবে অনেকদিন থাকতে হবে এখানে- এটা নিশ্চিত। কতদিন থাকতে হবে? কেনইবা থাকতে হবে? বাড়ি থেকে বের হওয়াটাই ছিলো নির্বুদ্ধিতা। কিন্তু তার একার এই অভিযান থেকে প্রাপ্তিটাও তো কম নয়। চূড়ান্ত প্রাপ্তিটা অবশ্য পাহাড়েই থেকে গেছে। আবার ওই পাহাড়ে যেতে না পারলে ফলাফল শূন্য। অবশ্য ও বনে একা আর যাওয়া যাবে না। কী করবে সে? চতুর্মুখী চিন্তার সমন্বয় করতে গিয়ে বুদ্ধিটাই গুলিয়ে যায় শওকতের। হাতে-পায়ে শেকল না থাকলেও অচেনা এই জংলি পাড়ায় সে আসলে বন্দীই তো। আব্বু-আম্মু তাকে নিয়ে ভাবছেন, খোঁজাখুঁজি করছেন এবং আরও কী কী করছেন কে জানে? আঙ্কলে-আন্টি, রাকিব, জসিম, মানিক, ইশকুল- সবকিছুই মনে পড়ছে তার। কবে ফিরবে সে কিংবা আদৌ কি ফেরা হবে তার! একটা ব্যাকুল কান্নায় বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে যেতে চায়। ভেতরে লুকায়িত এক বিক্ষুব্ধ সমুদ্র যেন ফুলে-ফেঁপে উঠছে। আবার সে যদি পাহাড়ের অভিযান সফল করে ফিরতেও পারে, তাহলে বাহবা পাবে নিশ্চিত- তাও সে বোঝে। রাকিব-জসিমরা আনন্দ করবে, হাসাহাসি করবে। বন্ধুদের কাল্পনিক সেই হাসি ক্ষীণ হলেও তার ধ্বনি দূরাগত সঙ্গীতের মতো বাজতে থাকে শওকতের কানে।

[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য]

Share.

মন্তব্য করুন