একদা এক কাঠুরিয়া ছিলো। কাঠুরিয়াটি ছিলো খুব গরিব। জায়গা জমি কিছুই ছিলো না। আয় রোজগারও তেমন নেই। বন থেকে কাঠ কেটে যেটুকু আয় করে তা দিয়ে সংসার চলে না। অভাব লেগেই থাকতো সবসময়। সকালে খেলে দুপুরে কোনো খাবার থাকতো না। কিংবা দুপুরে খেলে সকালের জন্য থাকতো না কিছুই। কাঠুরিয়ার তিন ছেলে দুই মেয়ে আর বউ। এই মিলে কাঠুরিয়ার সংসার। অভাবের মধ্যে চলছিলো তাদের দিনকাল। ছেলেমেয়েরা ছোট বলে আয় রোজগার করতে পারে না। ফলে কাঠুরিয়া একাই সংসার চালায়। প্রতিদিন কাঠ কাটতে বনে যায় সে। বনও ছিলো বেশ দূরে। ফলে মাথায় অথবা কাঁধে করে যেটুকু কাঠ আনা যায় তা ই নিয়ে আসতো সে। এ কাঠ বিক্রি করে অল্প টাকা পেতো। সে টাকায় কোনোরকম খাবার নিয়ে আসতো। কিন্তু কোনোদিন অসুস্থতার জন্য বনে যেতে না পারলে উপোস থাকতে হতো সবার।
এতো কষ্টের পরও কাঠুরিয়া ছিলো খুব সৎ এবং আমানতদার। কোনোভাবেই সে নিজের সততা ও আমানতদারিতায় আপস করতো না। বিশ্বাসে এসব লালন করতো কাঠুরিয়া।
একদিন সে জঙ্গলে গেলো। প্রতিদিনের মতো কাঠ কাটবে বলেই গেলো। কিছুটা জঙ্গলের ভেতরেই পৌঁছে গেলো। কাঠ কাটবে সব ঠিক করে নিলো। এ সময় হঠাৎ সামনে একটি গাছের নিচে দেখতে পেলো এক অপরূপা মেয়ে। গলায় হাতে মাথায় নানারকম সোনার গহনা পরা।
মেয়েটি কাঠুরিয়ার দিকেই চেয়ে আছে। কাঠুরিয়া দেখেই চমকে উঠলো। ভাবলো কোনো ভূত-প্রেত কিনা! আবার ভাবলো, ভূত-প্রেত তো এত সুন্দর হয় না! আবার সোনার গহনা পরা।
সাহস করে এগিয়ে গেলো কাঠুরিয়া। কাছাকাছি গেলেই মেয়েটি কথা বলে উঠলো। বললো, আমি পরীর মেয়ে। আমাকে ভয় পাবেন না।
পরীর মেয়ে! তুমি এখানে কেনো? এভাবে একা এ গহিন বনে কি করছো?
মেয়েটি বললো, সব বলবো আমি। আগে বলুন আমাকে আপনি আশ্রয় দিতে পারবেন? আমি খুব বিপদে পড়েছি।
কাঠুরিয়া একটু ভাবলো। বললো, অবশ্যই আমি তোমাকে আশ্রয় দেবো। কি করতে হবে বলো।
শুনে মেয়েটি উঠে গেলো বসা থেকে। বললো, এখান থেকে চলুন তাহলে। ওরা হয়তো এখানে এসে পড়বে! পরী মেয়ের কণ্ঠে বেশ ভয়!
কাঠুরিয়া বললো, ওরা কারা? কেনো আসবে এখানে। এলে কি হবে?
পরী মেয়ে বললো, সব বলছি। চলুন।
কাঠুরিয়া তার কুঠারটি সাবধানে কাঁধে ধরে আছে। এমন ভাবে ধরলো মনে হয় কারো সাথে এখনই মারামারি হবে। এদিক সেদিক দেখে পা ফেলছে সাবধানে। কোনো দিক থেকে কেউ আসছে কিনা। অথবা কাউকে দেখা যাচ্ছে কিনা দেখে চলছে পথ। মেয়েটির চোখও খুব সচেতন। কিন্তু মেয়েটি খুব দৃঢ়তার সাথে পথ চলছে। দেখতে দেখতে বন থেকে বেরিয়ে এলো তারা। বনের কাছাকাছি যদিও কোনো মানুষ নেই তবুও এখন আর আগের মতো ভয় পাচ্ছে না।
একসময় কাঠুরিয়া বললো, বলোতো মা, কি হয়েছে তোমার?
মেয়েটি চোখ তুলে চাইলো কাঠুরিয়ার দিকে। কাঠুরিয়া দেখলো মেয়েটির দুচোখ ভরা পানি। কী যে অসহায় লাগছে তাকে। খুব মায়া হলো কাঠুরিয়ার।
দরদভরা কণ্ঠে বললো, মা তোমার কোনো ভয় নেই। আমি তোমার বাবার মতো। কি হয়েছে বলো আমাকে।
এবার মুখ খুললো পরীর মেয়েটি। বললো, আমি একটি অনুষ্ঠানে যাবো বলে আমার মা আমাকে সাজিয়ে দিয়েছে। এই যে দেখুন আমার গায়ে কত গহনা। এইসব আমার মা আমাকে পরিয়ে দিয়েছে। আমরা অনুষ্ঠানে রওনা হবো। এসময় কি একটি কাজে আমার মা আমাকে বসিয়ে রেখে বললো, আমি আসছি। তুমি এখানেই থাকো। বলে মা চলে গেলেন। একা বসে আছি আমি। কিছুক্ষণ পরই দেখি, হঠাৎ কজন ডাকাত এলো। আমার মুখ চেপে ধরে আমাকে নিয়ে দৌড়ে ছুটতে লাগলো। অনেক চেষ্টা করলাম। কোনোভাবেই ছুটতে পারলাম না। মুখ চেপে রাখার কারণে চিৎকারও দিতে পারছিলাম না। ধস্তাধস্তি আর অনেকক্ষণ মুখ চেপে রাখার কারণে একসময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এই জঙ্গলেরই একজায়গায় আমাকে শুয়ে দেয়া হলো। শোয়ানোর সাথে সাথে আমার সেন্স ফিরে এলো। কিন্তু আমি ওদের বুঝতে দিলাম না আমার জ্ঞান ফিরেছে। বেহুঁশ হওয়ার ভান ধরে শুয়ে আছি আমি। ওরা বলাবলি করছিলো, যাক বেহুঁশ হয়ে আছে ভালোই হলো। চলো এ ফাঁকে আমরা নাস্তা খেয়ে আসি। একজনকে আমার পাহারায় রেখে নাস্তা খেতে গেলো বাকিরা। আমার পাহারায় যে ছিলো, সে আমার ঠিক মাথার পাশে বসা।
কিছুক্ষণ পর দেখি সে ঝিমাচ্ছে। এভাবে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়লো। বসা থেকে সটান শুয়ে পড়লো ও। একসময় শুনি নাক ডাকছে। তখন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। যেভাবেই হোক এখনই পালাতে হবে আমাকে। যেই ভাবা সেই কাজ। খুব সাবধানে অথচ দ্রুত উঠে পালিয়ে এলাম। এসে আড়াল নিলাম গাছটির। ঠিক তখনই আপনার সাথে দেখা।
কাঠুরিয়া জিজ্ঞেস করলো, তুমি পরীর মেয়ে উড়ে যাওনি কেনো?
মেয়েটি বললো, আমার পাখা গজায়নি এখনো। আরও প্রায় তিন চার বছর লেগে যাবে গজাতে। অকস্মাৎ কাঠুরিয়ার হাত ধরে বললো, পাখা গজানো পর্যন্ত আমাকে থাকতে দেবেন আপনার কাছে?
মেয়েটির এই অসহায় অবস্থা দেখে কাঠুরিয়ার চোখ অশ্রুতে ভরে উঠলো। বললো, মা তুমি আমার কাছেই থাকবে। আজ থেকে তুমিও আমার আরেকটি মেয়ে।
বাড়ির কাছাকাছি এসে গেলো দু’জন। দ্রুত হাঁটছে ওরা। যদি কেউ দেখে যায়! এতো গয়নাগাটি পরা একটি মেয়ে! কাঠুরিয়ার সাথে হেঁটে যাচ্ছে এটি অবাক করবে সবাইকে।
বাড়িতে পৌঁছে গেলো ওরা। কাঠুরিয়ার ছেলেমেয়েরা দেখলো নতুন অতিথিকে। ঘর থেকে বেরিয়ে এলো কাঠুরিয়ার বউ। বললো, এ কে গো?
সব ঘটনা বললো কাঠুরিয়া। পরীর মেয়েকে ঘরে নিয়ে গেলো। নিজের ছেলেমেয়েদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো, আজ থেকে তোমাদের একটি বোন যোগ হলো। আপন বোন হিসেবেই জানবে ওকে। কিন্তু ও পরীর মেয়ে এ কথা কারো কাছে বলবে না।
মেয়েটি তার সমস্ত গয়নাগাটি খুলে কাঠুরিয়ার কাছে দিলো। বললো, আমি যখন ফিরে যাবো তখন নেবো। সে পর্যন্ত আপনার কাছেই থাক। কাঠুরিয়া যতেœ রেখে দিলেন গয়নাগুলো।
রাতে ঘুমাতে গেলো সবাই। শুয়ে পড়লো কাঠুরিয়াও। একসময় কাঠুরিয়ার বউ বললো, একটি কথা বলবো?
কাঠুরিয়া বললো, বলো।
খুব নিচু কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বললো, আচ্ছা এতো অলঙ্কার মেয়েটির! এখান থেকে একটি অংশ যদি আমরা নিয়ে নেই তো আমাদের আর কোনো অভাব থাকবে না।
শুনে কাঠুরিয়া তেতে উঠলো। বললো, এ চিন্তা কি করে মাথায় এলো তোমার! এটি তো আমানত! আমানতের খেয়ানত কি করে করবো! এ যে ভারী অন্যায় চিন্তা!
খবরদার এমন চিন্তা কখনও করবে না।
কাঠুরিয়ার বউও চেতে গেলো। বললো, নিজের ছেলেমেয়েদের খাওয়াতে পারে না আবার ধার করে আনে আরও!
কাঠুরিয়া খুব দৃঢ়তার সাথে বললো, রিজিকের মালিক মহান আল্লাহ তায়ালা। কারো হাতে কারো রিজিক নয়। সুতরাং আমাদের যেমন আল্লাহ খাওয়ান। তেমনই ওকেও খাওয়াবেন। চিন্তা করো না আল্লাহ ব্যবস্থা করবেন।
উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো কাঠুরিয়ার বউ।
কিন্তু কাঠুরিয়ার চোখে ঘুম নেই। ভাবছে সে কোথায় এ মেয়ের দেশ। কোথায় মেয়ের মা! কবে ডানা পাবে! কবে উড়ে যাবে!
এসব ভাবতে ভাবতে কাঠুরিয়ার চোখেও নেমে এলো ঘুম। সকালে উঠে রীতিমতো জঙ্গলের দিকে ছুটলো সে। কাঠ কেটে আগের মতো হাটে যায়। বিক্রি করে। খাবার কেনে। শুধু আগের চেয়ে একটু বাড়তি কাঠ কাঁধে নেয় ও। একে কষ্ট মনে হচ্ছে না তার। নতুন মেয়ের জন্য এটুকু কষ্ট স্বীকার করতেই তো হবে।
পরীর মেয়েটি কাঠুরিয়ার ছেলেমেয়েদের সাথে দিব্যি একাকার হয়ে চলছে। পাড়া ঘুরে বেড়ায়। খেলাধুলা করে। হাসি আনন্দে মেতে থাকে।
এভাবে দেখতে দেখতে কেটে গেলো তিন বছর। একদিন কাঠুরিয়া দেখলো মেয়েটির পাখা গজিয়ে গেছে। এবং মানসিকভাবে সে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।
কিন্তু মেয়েটি চলে যাবে এটি ভাবতে বড় কষ্ট হয় কাঠুরিয়ার। কাঠুরিয়া এসব যখন ভাবছিলো ঠিক তখন মেয়েটি পাশে এসে বসলো। বললো- বাবা আমার পাখা গজিয়ে গেছে। আমি আমার মায়ের কাছে যাবো।
শুনে কাঠুরিয়ার চোখে অশ্রু এসে গেলো। কিন্তু যেতে চাইলে মেয়েটিকে বাধা দেয়ার অধিকার তো নেই ওর।
কাঁদো গলায় বললো, মা তুমি তো যাবেই জানি। কিন্তু তোমার এই গরিব বাবাকে দেখতে আসবে না?
মেয়েটির চোখেও অশ্রু। বললো, নিশ্চয় আসবো বাবা। আমার মাকে নিয়ে আসবো। আপনার অবদান আমি ভুলবো না কখনো।
আজ আমাকে বিদায় দিন। খুব তাড়াতাড়ি আসবো আমি আমার মাকে নিয়ে।
কাঠুরিয়া বললো, ঠিক মা একটু দাঁড়াও। বলে কাঠুরিয়া ঘরে ঢুকলো। বেরিয়ে এলো হাতে একটি পোঁটলা নিয়ে। পোঁটলাটি মেয়ের দিকে এগিয়ে ধরে বললো, এটি নাও।
পরীর মেয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি এটি বাবা? কি আছে এতে?
কাঠুরিয়া বললো, এগুলো তোমার সেই সোনার গয়না যা তোমার পরনে ছিলো।
মেয়েটি ভীষণ অবাক হয়ে গেলো! বললো, বাবা এগুলো এখনও এভাবে অক্ষত রেখে দিয়েছেন! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। আর এভাবে এতো বছর ধরে আপনি এগুলো রেখে দিয়েছেন! আমি ভাবতেই পারছি না।
কাঠুরিয়া খুব নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, তুমি তো আমানত রেখেছিলে আমার কাছে। কেনো অক্ষত রাখবো না!
মেয়েটির বুক আনন্দে নেচে উঠলো। কাঠুরিয়ার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, আমার বাবা এতোই আমানতদার! এতোটা সৎ! এ বাবাকে আমি কোনোদিন ভুলবো না। আর আমার এ সমস্ত গয়নাগুলো আমার বাবার জন্য উপহার দিলাম! বাকি উপহার আমার মাকে নিয়ে এসে দেবো! এই বলে সবাইকে সালাম জানিয়ে উড়াল দিলো পরীর মেয়েটি।
কাঠুরিয়া সোনার গয়না বিক্রি করলো। তার সমস্ত অভাব ঘুচে গেলো। রাতে ঘুমাতে গিয়ে বউকে বললো, দেখো সততার পুরস্কার কত বড় হয়!
কাঠুরিয়ার বউ বললো, সত্যি তুমি একজন ভালো মানুষ! একজন সৎ মানুষ!

Share.

মন্তব্য করুন