দীর্ঘ ৯ মাস রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের ঐতিহাসিক বিজয় জাতির ভাগ্যে এক অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। শত শত বছর ধরে বাংলার নিপীড়িত জনগণের আন্দোলন, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের পর এ এক দুর্লভ বিজয় অর্জন। বিজয়ের এ ফসল ঘরে তুলতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছেন। সম্ভ্রম হারিয়েছেন অনেক মা-বোন, কোটি মানুষ হয়েছেন দেশছাড়া, গৃহহারা। মা হারিয়েছেন তার প্রিয় সন্তান, বোন হারিয়েছে তার ভাই, বধূ হারিয়েছে তার স্বামী। চারদিকে হাহাকার। এই অশ্রু সাগরের মাঝেও বিজয় বয়ে আনে অপরিসীম আনন্দ। কিছু লাভ করতে গেলে তো কিছু ত্যাগও করতে হয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদের ভাষায়-
ফুল ফোটাতেও যুদ্ধ লাগে কুঁড়ির মুখে পানি
স্বাধীনতার শব্দ দিয়ে সাজাই বাগানখানি।
গোলাপ কেন রক্ত বরণ গোলাপ কেন লাল
বাংলাদেশের নিশান জুড়ে হাসছে মহাকাল।
যুদ্ধ ছাড়া কেউ কি পারে ফোটাতে লাল ফুল
ফুলের হাসি আড়াল করে বোনের কালো চুল
বিজয় দিবস বিজয় দিবস আজ বিজয়ের মাস
শহীদ প্রাণের রক্তে ভিজে সবুজ হলো ঘাস। (বিজয়ের মাস- আল মাহমুদ)
আমাদের এই বিজয় অর্জিত হয়েছে আজ হতে ৫০ বছর পূর্বে। আজকের আলোকোজ্জ্বল যে বাংলাদেশ তোমরা দেখছ পঞ্চাশ বছর আগে এরূপ ছিল না।
স্বাধীনতার জন্য শত্রুর বিরুদ্ধে পুরো দেশব্যাপী প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে। শুরু হয় যুদ্ধ। ‘শত্রুকে সুযোগ বুঝে আঘাত হানো আর দ্রুত নিরাপদে পালিয়ে যাও-’ গেরিলা যুদ্ধের এই কৌশলে শত্রু বাহিনী একেবারে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। পৃথিবীর দেশে দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এটি একেবারে বিরল, মাত্র ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অতি স্বল্প সময়ে আমরা বিজয় লাভ করেছি। যুদ্ধকালে এ দেশের মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক থাকেনি। রুটি-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যায় অসংখ্য মানুষের। এমনকি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় স্কুল-কলেজও।
অবশেষে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে স্কুলসমূহ খোলা হয়েছিল পুরোদমে। সেখানেও অনেক ভাঙাগড়া হয়েছে। অনেক ছাত্র যুদ্ধের সময় ড্রপআউট বা স্কুল থেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল। আবার অনেকে নতুনভাবে স্কুলে এসেছে। সে বছর অটোপ্রমোশনে পরীক্ষা ছাড়া সকল শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীকে পরবর্তী শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার অবাধ সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সবাই এ সুযোগকে কাজে লাগালেও আমার আব্বু আমাকে উপরের শ্রেণিতে উঠতে দেননি। বলেছিলেন, যুদ্ধের সময় লেখাপড়া হয়নি। তুমি উপরের ক্লাসে উঠলে কাঁচা রয়ে যাবে। ফলে আমি যুদ্ধকালীন বাগডুবি হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও স্কুল পরিবর্তন করে ফেনী জেলার সুপ্রসিদ্ধ দুধমুখা হাইস্কুলে পুনরায় সপ্তম শ্রেণিতেই ভর্তি হয়েছিলাম। নতুন স্কুলে নতুন পরিবেশে আমি একেবারে মিশে গিয়েছিলাম। আমার সৌভাগ্য প্রধান শিক্ষক জনাব মোস্তাফিজুর রহমান সাহেবসহ অনেক শিক্ষকের ¯েœহ লাভে ধন্য হয়েছি।
শিক্ষকরা ছাড়াও মালেক নামের আমার এক বন্ধু ছিল। সে আমাকে নিয়ে বসুরহাট গিয়েছিল তার মায়ের এসএসসি পরীক্ষা দেখতে। মা’র বিয়ে হয়ে ছেলে-সন্তান সব বড় হয়ে গিয়েছে। উনার মেয়ে আঁখিও আমার ক্লাসমেট। বিয়ের পর সংসার করতে গিয়ে এসএসসি পরীক্ষা আর দেয়া হয়নি।
মালেক পরীক্ষার হলে মায়ের সিট তালাশ করে বের করলো। আমি তার সাথে সাথে আছি। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে মাকে জোরে জোরে বলতে থাকলো- ‘মা আর লাইগবো নি, মার আর লাইগবো নি…?’ পরীক্ষার হলের চারদিক বস্তা বস্তা ছেঁড়া বই আর নকলের স্তূপ পড়ে ছিল। চারপাশে শত শত অভিভাবক যেন কোন এক আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠেছে।
এ সময় বিভিন্ন থানায় থানায় অবস্থিত কমিউনিটি ক্লিনিক বা হসপিটালসমূহে বহু বিদেশি এনজিও, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাকর্মী বাংলাদেশে এসেছিলেন।
আমি দাগনভূঞা, দুধমুখা ও বসুরহাট বাজারে এরূপ অনেক পুরুষ-মহিলা চিকিৎসককে দেখেছি। তারা আমাদের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের লোকদের চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন। কেউ কেউ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য এসেছিলেন। একজন কিশোর শিক্ষার্থী হিসেবে ঐসব বিদেশি পুরুষ-মহিলা চিকিৎসকদেরকে দেখে আমার চোখ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যেত। আমার কাছে তাদেরকে ভিনগ্রহের মানুষ মনে হতো। কখনো মনে হতো জোনাথন সুইফটের লেখা গল্পের নায়ক গ্যালিভারের মতো। তারা লম্বা-চওড়ায় ও শ্বেতবর্ণের চেহারা-সুরতে এত বিশালাকার ছিল যে, আমি অনেক লম্বা হওয়া সত্ত্বেও তাদের কোমরের নিচে পড়ে থাকতাম।
ফুফার সাথে আমি ১৯৭২ সালে গ্রীষ্মের ছুটিতে প্রথম ঢাকায় বেড়াতে গিয়েছিলাম আমার আব্বুর কর্মস্থলে। সরাসরি ঢাকা যেতে পারিনি। আমাকে ফজর নামাজের পর যাত্রা করে প্রথমে ফেনী থেকে ট্রেনে লাকসাম, লাকসাম থেকে চাঁদপুর, চাঁদপুর থেকে লঞ্চে পদ্মা, মেঘনা ও বুড়িগঙ্গা নদী পাড়ি দিয়ে মাগরিবের পর ঢাকায় পৌঁছতে হয়েছিল। আব্বুর কাছে যেতে যেতে রাত ৮/৯টা। তখন সড়কপথে ঢাকা যাওয়া ছিল চরম কষ্টকর। ফেনী থেকে ঢাকা বাসে যেতে পাঁচটি ফেরি পার হতে হতো। কাঁচপুর, মেঘনা, দাউদকান্দি ব্রিজ নির্মাণ হয়েছে দুই-তিন দশক পর।
রাতের বেলা আমি ঢাকাকে দেখিনি। সদরঘাট থেকে বাসে যেতে যেতে আধা অন্ধকারে ঢাকাকে ভূতুড়ে শহর মনে হয়েছে। পরদিন নতুন স্বাধীন দেশের যে রাজধানী দেখেছি তা আজকের রাজধানীর সাথে কোনো মিল নেই। দেখেছি ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া যুদ্ধ-বিধ্বস্ত এলোমেলো এক শহর। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বর্তমান সূর্যসেন হল (জিন্নাহ হল), মহসিন হল প্রভৃতির প্রতি হানাদার বাহিনীর ছোড়া গুলিতে ঝাঁজরা হওয়া ক্ষত-বিক্ষত দেওয়াল।
কমলাপুর, শাহবাগ, কাঁটাবন, বিশ^বিদ্যালয় এলাকা, নীলক্ষেত প্রভৃতি ঘন বস্তিঘর ও ঝুপড়িতে ভরা ছিল। তখন জাতীয় জাদুঘর, জসীমউদ্দীন ও জিয়া হল তৈরি হয়নি। ঢাকা ওয়াসার বিরাট বিরাট পাইপগুলোতে ছিল গৃহহারা নিরন্ন মানুষের বসবাস। পাইপগুলো আর পাইপের মুখে মলিন মুখ অর্ধ-উলঙ্গ ছেঁড়া কাপড় পরা মানবশিশুর কুৎসিত কোলাহল লেগে থাকত সারাক্ষণ। তাদের দেখে আমার হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। ভাবতাম আমরা গ্রামে তো যেন স্বর্গেই আছি। গ্রামের মানুষের দুঃখ-কষ্টের চাইতে এই শহরবাসী অন্নহীন, বস্ত্রহীন, গৃহহীন বস্তিবাসী লক্ষ লক্ষ লোকের কষ্ট গ্রামীণ মানুষের চাইতে বহুগুণ বেশি। ঐ সময় কাওরান বাজার হয়ে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় আমার এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সবকিছুই ফাঁকা এলোমেলো। আজকের গগনচুম্বী দালানের সারি, হোটেল সোনারগাঁও, কাওরান বাজার, ফার্মগেট প্রভৃতি দেখে কেউ অনুমান করতে পারবে না স্বাধীনতা-উত্তর এসব এলাকা কেমন ছিল। মাত্র ১০-১৫ বছর আগেও বসুন্ধরা সিটির দক্ষিণ পাশে কাঁঠাল বাগান এলাকা, হাতিরঝিল ও এফডিসির চারপাশ ঘিঞ্জি বস্তিতে নোংরা পড়েছিল।
সে অনেক কথা। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয় ও স্বাধীনতার পূর্ণ সুফল পেতে এ জাতিকে আরও অপেক্ষা করতে হবে। অত্যন্ত বেদনার সাথে তোমাদের বলছি, যারা নিঃস্বার্থভাবে মাতৃভূমির জন্য জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, সে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই দুঃখ-দারিদ্র্যের মাঝে মৃত্যুবরণ করেছেন। যাঁরা এখনো বেঁচে আছেন, সুদূর প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত খুঁজে খুঁজে তাদের খাদ্য, আশ্রয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই এ বিজয়, এ স্বাধীনতা সার্থক হবে।

Share.

মন্তব্য করুন