যাবার আগে সোফিয়া কিছু পরামর্শ দিয়ে গেছে। আমরা যেন গ্রাউন্ড ট্রান্সপোর্ট ডেস্ক থেকে একটি কাগজ নিয়ে বাইরে যাই। সেই কাগজ দেখলেই নিরাপত্তার লোকেরা আমাদের ট্যাক্সি ঠিক করে দেবে এবং ট্যাক্সির নম্বর লিখে কাগজটি তাদের কাছে জমা রাখবে। ও যখন বলছিল তখন বিষয়টি ভালো করে না বুঝলেও ঘটনাস্থলে এসে বেশ বুঝতে পারছি ঠগ-ছিনতাইয়ের একটা ব্যাপার এখানে আছে। তাই এই বাড়তি সাবধানতা। হাঙ্গেরির সেই জৌলুশ তো আর এখন নেই। এটি এখন ইউরোপের দরিদ্র দেশগুলোর একটিই।
আজ ২৩ মার্চ, বিকেল তিনটা। বছরের এ সময়ে বুদাপেস্টের তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ের ঠাণ্ডা হয়ে থাকে কিন্তু আজকের তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিমানবন্দরের বাইরে এসে আমরা ইউরোপীয় গ্রীষ্মের আরাম অনুভব করার চেষ্টা করছি। আকাশে ঝকঝকে রোদ, হাস্যোজ্জ্বল একটি দিন। নতুন কোনো ভূ-খণ্ড এমন হাসি দিয়ে অভিবাদন জানালে বুঝতে পারি সফরটা বেশ ভালো কাটবে। সারি সারি হলুদ ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। নিরাপত্তার লোকেরা আমার হাতের কাগজটিতে ট্যাক্সির নাম্বার লিখে রেখে দিলো। আমরা ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম।
ড্রাইভার ইংরেজি জানে, কাজেই যোগাযোগের কোনো অসুবিধা হলো না। অসুবিধা শুধু একটিই, ও সাফ জানিয়ে দিলো, ক্রেডিট কার্ড নেবে না, ভাড়াটা ক্যাশ দিতে হবে। মিটার অন করে দিয়ে ট্যাক্সি ছুটছে আর্ট হোটেলের দিকে। আর্ট হোটেল যে কোথায়, কোন চুলোয় তা তো আমরা জানি না। হোটেলস ডট কমে সার্চ করে অনেকগুলো হোটেল পেলাম, একটির নাম আর্ট হোটেল দেখে আমি আগ্রহী হলাম। দেখি শিল্পের কোনো ছোঁয়া পাওয়া যায় কিনা।

আমি ট্যাক্সির জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি বাইরে, অযতেœ বেড়ে ওঠা প্রকৃতি, রাস্তার পাশে ছোট ছোট টালির ছাদ, ছোট ছোট ঘর, বেশ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। কোনো কোনোটার নতুন ছাদ, যদিও অধিকাংশই বেশ পুরনো, এতে মনে হচ্ছে এই লোকালয়টির বেশ বয়স হয়েছে। বাড়িগুলোর আঙিনায় তেমন পরিকল্পিত বাগান নেই, পরিচ্ছন্নতার আভাস নেই। এই কী বুদাপেস্ট? আমি বেশ হতাশ। যে আগ্রহ নিয়ে ছুটে এসেছি, যা দেখার জন্য আমার চর্মচক্ষু তৃষ্ণার্ত, সেই বুদাপেস্ট কোথায়? আমি যখন বাইরের আকাশ, প্রকৃতি এবং বুদাপেস্টের গৃহগল্প বোঝার চেষ্টা করছি দেগেমু তখন পলকহীন তাকিয়ে আছে ট্যাক্সির মিটারের দিকে। আমি চোখ ফেরাতেই আমাকে কানে কানে বলে, এতো টাকা বিল কি করে হয়? আমিও ওকে কানে কানে বলি, ডলার নয়, ফরিন্ট। এবার ও আমার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আমি বলি, ফরিন্ট হচ্ছে হাঙ্গেরিয়ান মুদ্রা, প্রায় তিন শ’ ফরিন্টে এক ডলার। তখন দেগেমুর আত্মায় পানি আসে।
নির্জন রাস্তা পেরিয়ে একটি বড় হাইওয়ে ধরে ট্যাক্সি এসে ঢুকল পেস্ট শহরে। কিছুক্ষণ শহরের ভেতরে প্যাঁচ খেলে যখন দানিয়ুবের পাড়ে এসে পৌঁছুল তখন বিস্ময়ে আমি অভিভূত। দানিয়ুব এখন বেশ শান্ত হলেও বুদা এবং পেস্টকে বিভক্ত করে ছুটে চলা এই নদী মাঝে মাঝে প্রমত্তা হয়ে ওঠে। সুপ্রাচীনকালে প্রমত্তা দানিয়ুবের ছোবলে প্রাণ হারিয়েছে শত শত মানুষ।

ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী দানিয়ুব। দৈর্ঘ্যরে দিক থেকে ভলগার পরেই এর স্থান। দানিয়ুবের জন্ম জার্মানির ব্লাক ফরেস্ট অঞ্চলের পাহাড়ে। এরপর অস্ট্রিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, মলদোভা এবং ইউক্রেন হয়ে ঝাঁপ দিয়েছে কৃষ্ণসাগরে। দশটি দেশের ওপর দিয়ে ২,৮৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে ক্ষেপাটে দানিয়ুব। সুপ্রাচীন এই ইউরোপীয় নদীটির নাম ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দ দানু থেকে এসেছে। আয়ারল্যান্ডের অধিবাসীরা প্রাচীনকালে দানু নামের এক দেবীর পুজো করত। তিনি ছিলেন জলের দেবী। সেই জলদেবীর নামেই দানিয়ুব নদীর নামকরণ করা হয়েছে। দশটি দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও মোট দৈর্ঘ্যরে এক-তৃতীয়াংশই প্রবাহিত হয়েছে হাঙ্গেরির ওপর দিয়ে। যার একটি বড় অংশ বুদাপেস্টে পড়েছে। দানিয়ুবকে তাই বুদাপেস্টের নদীই বলে অনেকে। আর বুদাপেস্টকে বলে দানিয়ুবের রানি। দানিয়ুব ছাড়া বুদাপেস্ট বা বুদাপেস্ট ছাড়া দানিয়ুব চিন্তাই করা যায় না।
বুদা এবং পেস্ট দুটো যে আলাদা শহর, গড়ে উঠেছে দানিয়ুবের দুই পাড়ে, তা এখানে আসার একদিন আগে জেনেছি। এখন তা দু’চোখ ভরে দেখছি। বিমানবন্দর, পার্লামেন্ট হাউজ, অধিকাংশ বাণিজ্যিক ভবন, মন্ত্রণালয়সমূহ, বড় বড় শপিং মল পেস্ট শহরে। বুদা গড়ে উঠেছে পাহাড়ের ওপর। দানিয়ুবের অন্য পাড়ে, উঁচু পাহাড়ের ওপর থেকে ক্রমশ বুদা ধীরে ধীরে নেমে গেছে নিচের দিকে। প্রাচীন ধর্মশালা, রাজবাড়িসহ (বুদা ক্যাসেল) সুপ্রাচীন প্রচুর স্থাপনা বুদা শহরে। বুদার পুরাতন ঐতিহ্য আর পেস্টের নতুন জৌলুশ দুই কাঁধে নিয়ে দানিয়ুব ছুটে চলেছে আবহমান কাল ধরে। নতুন আর পুরাতনকে বিভক্ত করে ছুটে চলা দানিয়ুবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বুদা আর পেস্টের মিলন ঘটিয়ে দিয়েছে সাতটি নয়নাভিরাম সেতু।

প্রথম সেতুটি নির্মিত হয় ১৮৪৯ সালে। চেইন সেতু নামে এটি পরিচিত। চেইন সেতু শুধু দুটি শহরের হৃদয়কে সংযুক্তই করেনি, আজ বুদাপেস্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থাপনায়ও পরিণত হয়েছে। চেইন সেতুর স্থাপত্য-নকশা করেন একজন ব্রিটিশ স্থপতি উইলিয়াম ক্লার্ক এবং নির্মাণ করেন প্রকৌশলী অ্যাডাম ক্লার্ক। ১৯৪৯ সালে, ঠিক একশ বছর পরে, সেতুটি পুনঃনির্মাণ করা হয়। চেইন সেতু নির্মাণের ২৭ বছর পরে দ্বিতীয় সেতুটি নির্মিত হয় ১৮৭৬ সালে, যার নাম মার্গারেট সেতু। মার্গারেট সেতু বুদা এবং পেস্টকে সংযুক্ত করার পাশাপাশি দানিয়ুবের বুকে জেগে ওঠা মার্গারেট দ্বীপকেও সংযুক্ত করেছে। রানি মার্গারেটের নামানুসারেই মার্গারেট দ্বীপ এবং মার্গারেট সেতুর নামকরণ করা হয়। ইংরেজদের পরে এবার বুদা-পেস্টকে যুক্ত করল ফরাসিরা। মার্গারেট সেতুর স্থাপত্য-নকশা করেন ফরাসি স্থপতি এর্নেস্ট গুই এবং নির্মাণ করেন গুইয়ের নিজের কোম্পানি যার নেতৃত্বে ছিলেন ফরাসি প্রকৌশলী এমিল নুগুইয়ে। উনিশ শতকের প্রধান দুই ঔপনিবেশিক শক্তি ইংরেজ এবং ফরাসি জাতি সারা পৃথিবীকে লুণ্ঠন করলেও সভ্যতার কিছু স্তম্ভও তৈরি করে দিয়ে গেছেন। কালের সাক্ষী হয়ে আজ সেসব স্তম্ভ সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। ঊনিশ শতকে বুদা এবং পেস্টকে আরো খানিকটা দক্ষিণে যুক্ত করেছে লিবার্টি সেতু। প্রাচীনকালে দানিয়ুবের পশ্চিমতীর ছিল অপেক্ষাকৃত অনুন্নত, বড় হাসপাতাল, ডাক্তার সবই ছিল পূর্ব তীরে, পেস্টে। বুদার বহু লোক সময় মত নদী পাড় হতে না পারার কারণে চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে।

এরই মধ্যে আমরা চালকের সঙ্গে টুকটাক কথা বলতে শুরু করেছি। যুবকের নাম এলেক। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। ট্যাক্সিতে ওঠার সময় ও যখন আমাদের ব্যাগগুলো গাড়িতে তুলছিল তখনই মাত্র ওর পূর্ণ অবয়ব দেখেছি। বেশ লম্বা, ছয় ফুট না হলেও কাছাকাছি উচ্চতা। মুখে তেমন ধারালো ভাব নেই, এতে ওকে একটু বোকা বোকা লাগছিল। আমি অবশ্য খুশিই হয়েছি, বিদেশ বিভূঁইয়ে চতুর ট্যাক্সি চালক নিয়ে এক/দুবার বেশ বিপদে পড়েছিলাম। এই শহরেই জন্ম, বেড়ে ওঠা এলেকের, তবুও বুদাপেস্ট দেখে ওর তৃষ্ণা মেটে না। আমাদের দানিয়ুব পেরুতে হবে। আর্ট হোটেল দানিয়ুবের অন্য পাড়ে। এতে এলেক বেশ খুশি। আমরা তো আগন্তুক, রাস্তা-ঘাট কিছুই চিনি না, ও আমাদের যেদিক দিয়ে নিয়ে যাবে সেটাই আমাদের রাস্তা। এলেক চেইন সেতুর ওপরে উঠে গাড়ির গতি কমিয়ে দিল। আমি এতে খুশি। ডানে বায়ে তাকিয়ে দানিয়ুবের ওপর থেকে বুদাপেস্টকে দেখার চেষ্টা করছি। প্রায় ৪০ ফুট নিচে শান্ত নদীটি বয়ে চলেছে। তখনই এলেক বলে, আপনাদের এই অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্যটি দেখাবো বলেই একটু ঘোরা পথে চেইন সেতুর ওপর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। ও তখন আঙুল তুলে দূরের পার্লামেন্ট হাউস দেখায়, বিশাল এক রাজপ্রাসাদের মত জ্বলজ্বল করছে, যেটি এই শহরের আইকন। লক্ষ করছি দেগেমু রাগে কটমট করছে। দেগেমু মার্কিন নাগরিক, সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াবার মত একটি পাসপোর্ট বহন করলেও এই প্রথম ইউরোপে এসেছে। ঘোরাপথে এসে এলেক যে মিটারের বিল বাড়াচ্ছে সেটা ভেবেই দেগেমু ওর ওপর ক্ষেপে আছে, বাইরের সৌন্দর্য ওকে খুব একটা টানছে না। উত্তর দিকে, যেখানে মার্গারেট সেতু, সেখান থেকে দানিয়ুব পূর্ব দিকে বাঁক নিয়েছে, যার আভাস তৈরি হয়েছে আরো মাইলখানেক দক্ষিণ থেকেই, ফলে দু’পাড়ে তৈরি হওয়া শহর ও নদীর শৈল্পিক বাঁকটি এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যেন রোলার কোস্টার বাঁক নিয়ে ছুটে চলেছে। পড়ন্ত বিকেলের আলো সুপ্রাচীন ক্যাথিড্রালের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেলেও তার যে আভা উপচে পড়ছে তাতেই দানিয়ুব আরো বেশি রূপবতী হয়ে উঠেছে। আমি এলেককে বলি, ট্যাক্সি থামাও, ছবি তুলবো। এলেক এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ে, না এখানে থামানো যাবে না। আপনাদের হোটেল থেকে চেইন সেতু খুব একটা দূরে নয়, সন্ধ্যায় হেঁটে এসে ছবি তুলতে পারবেন। টের পেলাম এলেকের এই বক্তব্যে দেগেমু বেশ খুশি হয়েছে। ও ছবি তুলতে পছন্দ করলেও বাড়তি কিছু ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে তা কিছুতেই নয়।
[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য]

Share.

মন্তব্য করুন