‘স্বাধীনতা ছাড়া বেঁচে সুখ কিছু আছে?
স্বাধীনতা ছাড়া বলো কে বা কবে বাঁচে?’

সত্যিই তো তাই! স্বাধীনতা ছাড়া মানুষ কিভাবে বাঁচতে পারে? মানুষ তো আর পাখি নয়, মানুষ তো আর ফুল নয়। যেখানে সেখানে, যখন তখন সে উড়াল দিতে পারে, যেখানে সেখানে যত্রতত্র সে ফুটে থাকতে পারে! মানুষ কোন বৃক্ষও নয়, যে যেখানে সেখানে বীজের অঙ্কুরোদগমের মাধ্যমে তাকে অচল অবস্থায় মহীরুহে পরিণত করা যায়। মানুষ হলো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এক স্বাধীন প্রাণীর নাম। যে প্রাণী স্বাধীনতা ছাড়া বাঁচতে পারে না, আত্মমর্যাদাহীনভাবে বেড়ে উঠতে পারে না কোনদিন। তাকে জীবন্ত মরে থাকতে হয়। তাকে আজীবন জন্মের পাপ বহন করতে হয়। তাই আমাদের পূর্বসূরিরা স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে যুদ্ধ করেছিল তাদের জীবন বাজি রেখে। যুদ্ধ করেছিল তার মায়ের সম্ভ্রমের জন্য, তার মাটির জন্য, তার অধিকার, তার অর্থনীতি, তার শিক্ষা, তার চিকিৎসা, তার ধর্ম, তার বাসস্থান, তার পেশা, তার ফুল, তার পাখি, তার কাঁটাতার, তার ফসলের জন্য। তার উত্তরাধিকারদের স্বাধীনভাবে মাথা উঁঁচু করে বাঁচবার জন্য, ভালো রাখবার জন্য। সে তার দেশকে বর্গী মুক্ত করতে যুদ্ধ চালিয়েছিলো আঙুলের ফাঁকে বজ্র নিনাদে। অস্ত্রের মুখে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলো হুঙ্কারে, জীবনকে বাজি রেখে। হাতের মুঠোয় রেখেছিলো প্রাণ আর ঊর্ধ্বে রেখেছিলো তার সম্মান, তার স্বাধীনতার ঘ্রাণ।
সেই স্বপ্নের স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিলো ১৯৪৭ সালের আগেই। আরও একটু খোলাসা করে বললে বলা যায়, আরও দুই’শ বছর আগে ১৭৫৭ এর আম্রকাননে যেদিন স্বাধীন সূর্যটা অস্তমিত হচ্ছিলো লজ্জা আর অপমানে। সেদিন থেকেই। তারপর নানা ঘটনাপ্রবাহে কেটে গেলো দুই’ শ বছর। কিন্তু থেমে থাকেনি যুদ্ধের ঝনঝনানি। আবার নতুন করে শুরু হলো ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের মাধ্যমে, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ আন্দোলনের ভেতর দিয়ে। এইসব আন্দোলনের প্রবল প্রচণ্ডতায় ১৯৬৯ সালে বাঙালির স্বাধিকার চেতনা গণ-অভ্যুত্থানের রূপ নেয়। সেদিন পাকিস্তানি সামরিক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে অদম্য প্রতিরোধে ফুঁসে উঠেছিলো ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি। স্বাধীনতার অগ্নিশপথ নিয়ে তারা ফুঁসে উঠেছিল অদম্য সাহসে।

বাঙালির স্বাধিকারের ন্যায্য দাবিকে চিরতরে নির্মূল করবার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পশ্চিমা সামরিক জান্তা বাহিনী বাঙালি নিধনের নিষ্ঠুর খেলায় মেতে ওঠে। আবালবৃদ্ধবনিতা, নারী, পুরুষ সকলের রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার মাটি। এভাবে দীর্ঘ নয় মাস ধরে চলে যুদ্ধ। ফলশ্রুতিতে, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী-সাহিত্যিক, নারী-পুরুষ, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্মিলিতভাবে সবাইকে নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী। যার যা আছে তাই নিয়ে একযোগে শত্রুসেনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অবশেষে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেলাম স্বাধীনতার স্বপ্ন সুখের বিজয়োল্লাস, বিজয়ের সার্থক পরিণতি। আমাদের শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, পেশা এবং নেশায় বুঁদ হয়ে উড়ন্ত পায়রার মতো আকাশে মেলে দিলাম আমাদের প্রসারিত ডানা। বাকুম বাক শব্দে নেচে উঠলো আমাদের প্রকৃতি। তাই আমাদের জাতীয় জীবনে ১৬ ডিসেম্বর সবচেয়ে আনন্দ ও গৌরবের একটি দিন। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের এই দিনে প্রিয় স্বদেশ বিজয়ের স্বাদ পেয়েছিল। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম। পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলাম। এই দিনটি আমাদের সবচেয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় দিন।
তবে, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হলেও বিজয়ের স্বাদ আমরা সেভাবে পাইনি। গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম করতে হয় লড়াকু বাঙালি জাতিকে। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে এখনও পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ। জাতীয় জীবনের পরতে পরতে ঐক্যের বদলে সঙ্ঘাত, সুস্থিতির বদলে অস্থিরতা, শান্তির বদলে নৈরাজ্য দিনকে দিন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।

একুশ শতকের এই ডিজিটাল সময়ে নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের নানামুখী অগ্রগতিও কম নয়। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার উপরে অবস্থান করছে। দেশের সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, কৃষি খাতে স্মরণকালের বিপ্লব, শিল্প, কুটির শিল্প এবং শিক্ষায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। এই করোনাকালীন প্যান্ডামিকের সময়ে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থাসহ বিভিন্ন শ্রেণির অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা প্রভূত উন্নতি লাভ করেছে। এই দীর্ঘ কোয়ারেন্টাইনের মাধ্যমে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনোবৈকল্য রোধে শিক্ষকরাও তাদের মেধার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে ক্লাসমুখী করে শিক্ষার অবদানে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও বিজয়ের এত বছর পরেও আমরা কি সত্যিকারের সুখী হতে পেরেছি? স্বাধীনতার মূল্য দিতে জেনেছি? পরস্পর পরস্পরকে সম্মান দিতে জেনেছি? বুকের রক্ত মেখে যেভাবে আমরা স্বাধীন হলাম, সেই স্বাধীনতার স্বাদ নিতে শিখেছি? রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি এবং আরও আরও বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি আজ আমাদের রক্তের সাথে মিশে আছে। আমরা সময় এবং সুযোগ পেলেই সে অনধিকার চর্চার বাড়াবাড়ি করে সমাজে হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি করছি। ভাই হয়ে ভাইয়ের বিরুদ্ধে লড়ছি, অপমান করছি, অবদমন করছি, রক্ত ঝরাচ্ছি। জাতিকে করছি অপমানিত। আমাদের হাত কাঁপছে না, আমাদের বুক কাঁপছে না। আমরা অহং আর জিঘাংসায় অধঃপতিত হয়ে কালের অকাল গহ্বরে অকালে হারিয়ে যাচ্ছি। আহা! কেন এমন হয়? কেন, আমরা পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হই না। কেন আমরা পরস্পর পরস্পরের ধর্মকে সম্মান করি না? কেন আজ যত্রতত্র পবিত্র ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মের অবমাননা হয়। কেন, তুচ্ছ কারণে পৃথিবীতে নেমে আসে অশান্তি, অরাজকতা? কেন অমানবিক রক্তে রঞ্জিত হয় আমার ভাইয়ের শরীর? আসুন, আমরা মানবিক হই, আমরা মহানুভব হই। পরস্পর পরস্পরের প্রতি আন্তরিক ও মানবিক হই। অন্যের ধর্মের প্রতি, অন্যের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই। ধারণ করি মানবতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তাহলেই আমাদের পূর্বসূরিদের রক্তে কেনা স্বাধীনতা সত্যিকার বিজয়ের স্বাদ পাবো আমরা। বর্তমান সমাজের তরুণ সমাজের কাছে স্বাধীনতার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। তাদেরকে বোঝাতে হবে এদেশ আমাদের, এদেশ সবার। মহান মুক্তিযুদ্ধে এদেশে আবালবৃদ্ধবনিতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছে। তাই এই স্বাধীনতার সুখ ভোগ করার অধিকারও আমাদের সবার, সকলের। তাহলেই আমাদের স্বাধীনতা অর্থবহ ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অলিতে গলিতে, সর্ব সময়ে, সর্বকালে।

Share.

মন্তব্য করুন