কিছু শব্দ নিজের করে পেতে চায় মানুষ। পেতে চায় একান্ত আপনার করে। যেসব শব্দ নিজের হয়ে উঠলে মানুষের একটি পরিচয় দাঁড়িয়ে যায়! যেসব শব্দে মানুষ নিজেকে আবিষ্কার করে একটি মর্যাদার গৌরবে! এবং যেসব শব্দে তার জন্য অপেক্ষা করে সম্মানের মুহূর্তগুলো! তেমনই একটি শব্দ বিজয়! এ শব্দটি মানুষকে উজ্জীবিত করে! উজ্জ্বল করে! প্রণোদনা দেয় ভীষণভাবে। শাণিত করে বোধের জায়গা! সক্রিয় করে বিপুলতায়! ফলে মানুষ হয়ে ওঠে আত্মবিশ্বাসী! রচনা করে নিজস্ব গল্পের পাণ্ডুলিপি! তার চারপাশ তার কাছে ধরা দেয় সহসা! নিজস্ব ক্ষমতার সাথে পরিচয় ঘটে তার! বিজয় শব্দটির শরীরে জড়িয়ে আছে তেমনই সাফল্যের ঘ্রাণ! চূড়ান্ত আনন্দের অনন্য অনুভূতি! ভালোলাগার নিখাদ রসদ! আছে নতুন করে নিজেকে দেখার প্রেরণা! একটি শব্দে এতো বিস্ময়! এতো উৎসব এবং এতোটা স্বচ্ছন্দ! আহা, এই তো বিজয়ের গোপন বীণা! যা বেজে ওঠে প্রতিটি মানুষের অন্তরতলে!
হ্যাঁ, ছিনিয়েই আনতে হয় বিজয়-মাল্য! কখনো লড়াই, কখনো সংগ্রাম, কখনো জীবন বাজি রাখা। আমরা তাই করেছি! তাই দিয়েছি বিজয় পেতে! আরও বলতে গেলে বলতে হয়- আমরা কিনেছি বেশ চড়া দামে! রক্ত, শ্রম, ঘাম ও জীবন দিয়ে শোধ দিতে হলো বিজয়ের দাম!

আমরা বিজয়ী জাতি। এ ভাবনা আনন্দ জোগায়। প্রেরণা জোগায়! শিরশিরে অনুভূতি আনে! চাঙ্গা হয়ে ওঠে মন! ভাবি, বিজয় আমাদের চিনিয়ে দিয়েছে জগতের কাছে! বিজয়ের উৎসবে স্বাধীনতা আমাদের হলো! আমরা বিজয়ী! আমরা স্বাধীন! আমাদের একটি নিজস্ব ভূগোল আছে! নিজস্ব ভূখণ্ড আছে। আছে একটি মুক্ত আকাশ! নিজস্ব ভূগোলে দাঁড়িয়ে মুক্ত আকাশ ওড়ায় আমাদের লাল-সবুজ পতাকা! প্রবল দক্ষিণা যখন দোলায় পতাকাটি আহা কী আনন্দইনা উৎসারিত হয় বুকের ভেতর! আপ্লুত হয় মনের গহিন! দেখলেই মন উড়তে থাকে পতাকার মতোই পতপত!
মহান বিজয়ের মাধ্যমে পতাকাটি আমাদের হলো! ভূগোলটি আমাদের হলো! ভূখণ্ডটিও!
সূর্যের চোখ দেখে বিজয়ের উৎসব বুঝেছি। বুঝেছি কিভাবে আলো সরিয়ে দেয় রাতের অন্ধকার। কিভাবে সকাল আসে জয়ের আনন্দ নিয়ে। কি প্রভাব বিস্তারি আলো! কী যে উদ্ভাসন আলোর দিগন্তে! আকাশ উপত্যকা থেকে স্বচ্ছ করে পৃথিবীর বুক। যদি আঁধারের ওপর বিজয় না হতো আলোর আকাশ তবে তো পৃথিবীতে রাতই স্থায়ী হয়ে যেতো! রাতই শাসন করতো জগতের সকল কিছু। হয়তো নক্ষত্রও ক্লান্ত হয়ে যেতো তখন! কখনো দিন আসার সুযোগই হতো না।
এভাবে আলোর ওপরও অন্ধকার জয়ী হয়। নামে রাতের গভীর কালো। দিনকে ঢেকে দেয় অনায়াসেই। কোথায় লুকিয়ে তখন সূর্যের মুখ! কিভাবে হারায় রাতের গহনে! এভাবে আলো আঁধারের ওপর! আঁধার আলোর ওপর বিজয়ী হয়।
নদী নিজের বিজয় আনে সাগর ছুঁয়ে। মোহনা নির্মাণ করে সমুদ্রে। পাহাড় থেকে নেমে ছুটতে ছুটতে চলতে থাকে। চলতে চলতে সৃষ্টি করে বাঁক। বাঁক থেকে আরও নতুন বাঁক। ভাঙে পৃথিবীর বুক। ভাঙে ফসলের মাঠ। কী কৌতূহল থাকে নদীর। কী থাকে নদীর বুকের ভেতর। থাকে প্রবল স্রোতের টান। ছুটে চলার তীব্র গতি। এভাবেই নদী পেয়ে যায় নিজের বিজয়। নিজস্ব বিজয়।
সমগ্র তারকা রাজ্যের ওপর বিজয় পায় পূর্ণিমা চাঁদের জোছনা। গোটা আকাশ ছেয়ে থাকা তারকার চোখ যেনো মৃদু হয়ে ওঠে তখন। রাতের অন্ধকার কী অদ্ভুত আনন্দে স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। জোনাকির জ্বলজ্বলে আলো! এই জ্বলা, এই নেভার কাহিনি! এভাবে আঁধার ভেদ করে নিজেদের বিজয় ঘোষণা করে জোনাকি!

মানুষ উৎফুল্ল হয় তার স্বপ্ন বিজয়ে। তার আশা জয়ের উল্লাসে! তার নতুন পাওয়ার খুশিতে। তার আগামীর স্বপ্ন বিভোরে! বাধাহীনতার আনন্দ কে না উদযাপন করে! কে না ভাবে জীবনের তাবৎ সাফল্যের কথা! এভাবে কথার বিজয়! কাজের বিজয়! দেশের বিজয় এবং জীবনের বিজয় মানুষকে এগিয়ে যাওয়ার তুমুল প্রেরণা জোগায়!

বিজয়ের যেকোনো গল্পই আনন্দের! যেকোনো গল্পই সুখের, উল্লাসের। কেননা বিজয় মানেই নতুন অর্জন। নতুন পাওয়া। নতুন সুখের অনুভব! নতুন উল্লাসের উপলক্ষ! জোগায় আনন্দের ঢেউ। জাগায় সুখের জোয়ার! যে জোয়ারে ভাসার অনুভূতিও অন্যরকম!
আমাদের বিজয় তেমনই অনুভূতির এক অন্যরকম উত্তাপ! ভালোলাগার অন্য আনন্দের লীলা! অন্য সুখের উষ্ণতা!
মানুষের জীবন অতি গুরুত্বপূর্ণ! ভীষণ দামি! জীবন আছে তো সব আছে! জীবন নেই তো কিছুই নেই! জীবনের তুল্য কিছু নেই পৃথিবীতে! কিছু নেই তার বিকল্প! কী হতে পারে জীবনের বদল! না তেমন কিছু সৃষ্টি করেননি মহান আল্লাহ তায়ালা! জীবন এমনই অলঙ্কারময় যে কেবল নিজের তুলনা নিজেই!
তবে এতো গুরুত্বপূর্ণ জীবনে যদি স্বাধীনতা না থাকে!
যদি স্বাধীনতা লুট করে কেউ, যদি স্বাধীনতা হরণ হয়ে যায়, তবে? তবে এটিই দুর্ভাগ্যের, দুঃসহ, দুরবস্থার! তাহলে বুঝতেই হবে স্বাধীনতা কেমন গুরুত্ববহ!
একই সাথে বুঝতে হবে ব্যক্তিস্বাধীনতা খুব দরকার।
ব্যক্তিস্বাধীনতা মানেই স্বপ্নের স্বাধীনতা। কল্পনার স্বাধীনতা! আগামী জীবনের স্বাধীনতা! নিজের মতো করে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা! নিজের জাতীয় স্বাধীনতা কোনো অর্থেই কম দরকারি নয়! বরং ব্যক্তি ও জাতীয় স্বাধীনতা দুটোই সমান্তরাল। দুটি দুই বাহু। ছোটে সমানে সমান। একটি দুর্বল তো অন্যটি কোনোভাবেই সবল হয় না। হবে না। হতে পারেও না। কারণ এক বাহুর মানুষ সবল হবে কী করে! সুতরাং দুই বাহু সমানে সমান যখন, কেবল তখনই সুঠাম বলার সুযোগ ঘটে। ব্যক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতা যথার্থ হলেই কেবল বলা যাবে স্বাধীনতা বেশ সুঠাম!
এই সুঠাম স্বাধীনতা নিশ্চিত করে মহান বিজয়! আমরা সে বিজয় পেয়েছি। পেয়েছি অনেক রক্তের বিনিময়ে। পেয়েছি অসংখ্য জীবন ক্ষয়ের মাধ্যমে। একটি চূড়ান্ত লড়াই যাকে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রাম বলি। এই স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নির উত্তাপ এখনো জেগে আছে আমাদের ইতিহাসের দেহে। পাতা উল্টালেই উপচে পড়ে তারই আঁচ! সে আঁচে উদ্দীপ্ত হই আমরা! স্বপ্ন দেখি নতুন করে। নতুন আয়োজনে। নতুন সম্ভাবনায়!
আমাদের পথগুলো ছুটে যায় নতুন দিগন্তের দিকে।

আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসের সেরা ঘটনা এই মহান বিজয়! মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম! আমরা তার নাম রেখেছি অগ্নিঝরা মার্চ! উত্তাল সব মিছিলের এক জ্বলন্ত প্রতিনিধি! পৃথিবীর ইতিহাসে এ এক বিস্ময়! মাত্র নয় মাসে স্বাধীন হয় একটি দেশ! নয়টি মাসের সংগ্রামের ফল আমাদের মহান বিজয়!
এ বিজয় আমাদের চিনিয়েছে কিভাবে মুক্তমনের মানুষ হতে হয়! কিভাবে উদারতার উপমা সৃষ্টি করতে হয়! কিভাবে সাহায্যের হাত দীর্ঘ করে দিতে হয়।
ভালোবাসার মূল্যটি আমরা সকলেই জানি। হয়তো মানিও। কিন্তু দেশকে ভালোবাসার মূল্য কি ভেবেছি, নাকি ভাবতে পেরেছি? অথবা ভাবছি এখন! এর কোনোটির জবাবই মন খুশি করার মতো নয়! তবে? তবে কি আমাদের এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি নয়! আমরা কি হচ্ছি সচেতন! নাকি জায়গা দিচ্ছি বুকের ভেতর, মুখের ভাষা মধুর আমাদের, কাজের ভাষা কেনো এতো তিতে, আমরা তো দেশপ্রেমে নিজেদের উৎসর্গ করে দেয়ার কথা বলি, অথচ বাস্তবে কি দেখি! দেখি আমরা দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়ার আয়োজনে বেশ দক্ষ!
না। এভাবে নয়! এভাবে দেয়া যায় না দেশের প্রতি ভালোবাসার উপহার! বরং দেশকে ভালোবাসতে হবে হৃদয় থেকে! মনের গভীর থেকে অনুভব করতে হবে! ভেতরের গানই যেনো বেজে ওঠে বাইরের দিকে! বাইরের সুর যেনো গুঞ্জন তোলে হৃদয়ে হৃদয়ে!
বিজয়ের একটি অর্থ- নিজেকে ভালোবাসার উপযোগী করে তোলা! ভালোবাসার সান্নিধ্যে নিজেকে জাগিয়ে রাখা! ঠিক নিজের মতো করেই ভালোবাসতে হবে দেশকেও!
তবেই বিজয় ভাষা পাবে বিজয়ের! তবেই অর্থপূর্ণ হবে বিজয় শব্দটি! তবেই হবে বিজয়ের যথার্থ আনন্দ!
সুতরাং বিজয় শব্দটি চিরকাল আমাদের থাকুক!

Share.

মন্তব্য করুন