সেবার আমরা পাড়ায় ফুটবল টিম করতে গিয়ে ভারি বিপদে পড়লাম। আমাদের দলে একটাই গোলকিপার থাকবে। কিন্তু পাড়ার মুন্না, হীরা ও মুর্শেদ বায়না ধরলো ওরাই দলের গোলকিপার হবে। প্রত্যেকেই বলছে আমরা দলের সেরা গোলকিপার।
আর কেউ গোলকিপার হিসেবে বাদ পড়লে শুধু দলই নয়, আমাদের সাথে মেলামিশা বন্ধ করে দেবে বলে সাফ জানিয়ে দিলো। এদের মধ্যে হীরাটা ছিল ত্যাদোড়। সেই বললো মুন্নাটা ভারি বেয়াদব। আমি গোলকিপার হবো শুনেই আমার পেছনে লেগেছে। এখন বলছে আমিই গোলকিপার হবো। বুঝলি আনু এটা ঘোরতর ষড়যন্ত্র। আমি কোনো কিছুই বুঝলাম না। হীরার কথা শুনে মুন্নাও বেশ রেগে গ্যালো। বললো, দ্যাখ যা মুখে আসবে তাই বলবি না। আমি বরাবরই দলের গোলকিপার হিসেবে খেলি। আর তুইতো বলে শর্ট মারতেই পারিস না। তুই গোলকিপার হলে দল পঞ্চাশ গোল খাবে।
দুজনের মধ্যে প্রায় মারামারির মতো অবস্থা। আমি আর শহীদ দু’জনকে কোনরকম থামালাম। ওদের কাণ্ড দেখে আমিও বেশ ভড়কে গেলাম। ইদানীং আমাদের পাড়ার বন্ধুবান্ধবদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এর মধ্যে তিনজন যদি দল ছেড়ে চলে যায় তাহলে আমার পক্ষে দল গঠন করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এই বিষয়টা মীমাংসা করা দরকার হয়ে দাঁড়ালো। অনেক ভাবনা চিন্তা করে একটা উপায় বের করলাম। খেলার সময় একজনই গোলকিপার হিসেবে থাকবে। তিনজনকে তিন দিক নামালে কোনো সমস্যা হবে না। বাকি দুইজন সাধারণ খেলোয়াড় হিসেবে দলে খেলবে।
আমার এই প্রস্তাব শুনে জিনজনেরই সোজাসাপ্টা না জবাব। প্রত্যেকেই আবার বললো, তারাই দলের গোলকিপার হবে।
এই তিনজনের ভাবসাব দেখে আমার মাথা খারাপ হবার জোগাড়। বলে কি সব বদমাইশ। আমি ওদের বারবার বুঝালাম। আমাদের পাড়ার একটা প্রেসটিজ আছে না। তোরা তিনজন যদি এইভাবে গণ্ডগোল করিস তাহলে এবার আমাদের ফুটবল টিম গঠন করাটা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। প্রত্যেকেরই একই রা। সেই দলের গোলকিপার হবে।
একবার মনে হলো অন্য পাড়ার কয়েকটা ছেলে নিয়ে ফুটবল টিমটা গঠন করে ফেলি। কী দরকার বাবা এত ঝক্কি-ঝামেলার। আবার ভেবে দেখলাম এর মধ্যেও রয়েছে আরেকটা বিপদ। পাড়ার বড়রা এতে আমাদের সাহায্য করতে চাইবে না।
কী করবো সেটাই ভাবছিলাম। এমন সময় শহীদ বললো, তুই ক্লাবে একটা জরুরি মিটিং ডাক।
আমি বললাম, সেটা কী রকম?
শহীদ বললো, তুই সবাইকে একটা জরুরি চিঠি দে। আলোচনার বিষয়বস্তু হবে ফুটবল টিম গঠন। আর কারা কোন দিকে খেলবে তা বলার জন্য। সবার মতামত নিয়েই গোলকিপার ঠিক করা হবে। এতে দল গঠন হোক আর নাই হোক, তোর কোন দোষ হবে না। আমি শহীদের প্রতি উত্তরে বললাম, ওরা যদি না আসে।
তাহলে তো আমাদেরই সুবিধা। তুইতো বলতে পারবি আমিতো সবাইকে ডেকেছিলাম।
শহীদের মতামত আমার কাছে খারাপ লাগলো না বটে। আমার চিন্তা হলো অন্য জায়গায়। ওরাতো আমার ভালো বন্ধু ছিলো। নিশ্চয়ই এদের কেউ উসকে দিয়েছে। হয়তো আমাদের কেউ চাইছে না আমি দলটাকে গঠন করি।
বাড়ি এসে মনটা খুশি হয়ে গেলো। দেখলাম আমার ফুটবলার মামা মানে তমাল মামা এসেছেন। তমাল মামা বলতে গেলে দারুণ এক ফুটবল-পাগল মানুষ। আমাকে দেখেই তমাল মামা বলল, কিরে আনু, তোর ফুটবল টিমের কতদূর হলো?
মামার কথা শুনে আমার মনে পড়ে গেল আমি একবার মামাকে পাড়ার ফুটবল টিম গড়ার কথা বলেছিলাম। মামার সেটা মনে ছিলো বলেই হয়তো এইসময় আমাদের বাড়ি এসেছেন। মনে মনে বললাম, ভালোই হলো। মামার বুদ্ধিটা কাজে লাগানো যাবে। মামা আবার জিজ্ঞাসা করলো, তোর চোখ মুখ ফ্যাকাসে ক্যানোরে?
আমি বললাম, মামা, বিপদ হয়েছে।
মামা বিপদের কথা শুনে যেন আরো উৎসুক হয়ে উঠলেন। কী বিপদরে আনু? তমাল মামা খুব করে জানতে চাইলেন।
আমি বললাম, আর বলবেন না মামা। আমাদের তিনজন সদস্য দলের গোলকিপার হতে চাচ্ছে।
মামা বললেন, তাই নাকি! কুচ পরোয়া নেই। সময় এলেই বিপদের পথ বাতলে দেবো।
মামার কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম। মামা ব্যাপারটাকে খুব সহজ বলে মেনে নিয়েছেন। তাই মামার দিকে অবাক চোখে চেয়ে রইলাম। মামা আমার দিকে সেটা বুঝতে পারলেন। আমার সমস্যা হয়তোবা জটিল। আমি মামাকে শান্ত করার জন্য বললাম, পরে কথা হবে। তুমি এখন বিশ্রাম নাও।
আমি ফিরে এসে লেখার টেবিলেই জরুরি মিটিংয়ের বিষয়টা লিখতে বসে গেলাম। অনেক কষ্টে মথাটা খাটিয়ে লিখলাম,
সুজনেষু,
আপনি আমার সালাম নেবেন। আপনি আমাদের ক্লাবের সম্মানিত সদস্য। আপনার জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই প্রতি বছরের ন্যায় এবারও আমরা ফুটবল টিম গঠন করবো বলে মনস্থ করেছি। কিন্তু এইবার এক ঘোরতর সমস্যা উপস্থিত হয়েছে। মুন্না, হীরা ও মুর্শেদ প্রত্যেকেই গোলকিপার হতে চাচ্ছে। তাদের মধ্যে কেউ গোলকিপার মনোনীত না হলে ক্লাব ত্যাগ করার হুমকি প্রদান করেছে। বিষয়টা জটিল। আপনি ফুটবল টিমের কোন পজিশনে খেলবেন সভায় উপস্থিত হয়ে জানাবেন।
ইতি
আহ্বায়ক

বিকেল বেলায় তমাল মামাকে চিঠির খসড়াটা দেখালাম। মামা চিঠিটি পড়ে বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বলিস কিরে আনু তোদের টিমে তিনজন গোলকিপার। তাহলে প্লেয়ার পাবি কোথায়?
আমি বললাম, সেটাইতো সমস্যা মামা।
তমাল মামা আবারও বললো, কুচ পরোয়া নেই। সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। তোদের মিটিংয়ে আমি থাকবো।
মামার কথা শুনে আমার স্বস্তি এলো।
পরের দুদিন আমার বেশ ঝামেলায় কাটলো। শহীদ আর আমি ক্লাবের সদস্যদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিঠি বিলি করলাম। প্রত্যেককে বললাম সময় মতো আসতে।
সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। আসলে আমাদের ক্লাবের সদস্যরা ঐরকমই। কোন বিষয়ে সিরিয়াস হয় না। মিটিংয়ের আগের দিনগুলো খুব উত্তেজনার মধ্যে কাটতে লাগলো। কারণ শহরের অন্য পাড়ার ফুটবল টিম গঠনের খবর কানে আসতে লাগলো। কোনো কোনো দল ইতোমধ্যে প্র্যাকটিসও আরম্ভ করে দিয়েছে। আর আমরা বোকা হাঁদারাম আঙুল চুষছি। গতবার ছয়টা খেলার মধ্যে তিনটি খেলায় জিতেছিলাম। এবারতো মনে হচ্ছে সব খেলায় ভরাডুবি হবে। আর কটা গোল খেতে হবে খোদা মালুম। ভাবতেই মাথা গরম হচ্ছে আমার। মিটিংয়ের আগের রাতে মামা ঘরে এলেন। বললেন, তোদের গোলকিপার সমস্যা সমাধানের একটা পরিকল্পনা আমার মাথায় এসেছে। তবে এখন ফাঁস করছি না। হীরা, মুন্না আর মুর্শেদকে মিটিংয়ে থাকতে বলবি। বলেই তমাল মামা হো হো করে হেসে উঠলেন।
আমি বললাম, তাতো বলবোই।
ক্লাবের মিটিংটা বসলো সকাল সকাল। সকালে ছুটি থাকায় সবাই মিটিংয়ে এসেছে। হীরা, মুন্না ও মুর্শেদ আলাদা আলদা ভাবে বসেছে। মামা আমাকে বললেন ওদের তিনজনকে একসাথে বসতে বল দেখি।
আমি বললাম, সেটা বোধ হয় সম্ভব হবে না। এক সাথে বসতে বললে ওরা মিটিং ছেড়ে চলে যাবে। তাহলে আরো বিপদ হবে।
মামা আমার উত্তর শুনে মুখে কুলুপ আঁটলেন। সভার কাজ আরম্ভ হলো বটে। কিন্তু মুন্না, হীরা ও মুর্শেদের একই কথা তারাই প্রত্যেকেই দলের গোলকিপার হবে। আমি আর শহীদ বেমালুম বিপদের মধ্যে পড়ে গেলাম। কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছি না। এমন সময় তমাল মামা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমি হীরা, মুন্না আর মুর্শেদের পরীক্ষা নিতে চাই। এদের মধ্যে যে পাস করবে সেই দলের গোলকিপার হবে।
সভার মধ্যে থেকে মতি উঠে দাঁড়ালো। জিজ্ঞাসা করলো, পরীক্ষাটা কী মামা?
তমাল মামা বললেন, আমি তিনজনকে গোলপোস্টারের সামনে দাঁড় করাবো। যে আমার শর্টে বল ধরতে পারবে সেই হবে দলের গোলকিপার। কী বল তোমরা?
তমাল মামার ঘোষণায় মিটিংয়ের মধ্যে পড়লো জমজমাট হাততালি। বোঝা গ্যালো মামার প্রস্তাবটা মোটামুটি সবার মনে ধরেছে। কারণ, তমাল মামা ফুটবলার হিসেবে যতটা বিখ্যাত তার চেয়ে বিখ্যাত তাহলো গোল মুখে তীব্র শটের জন্য। এই জন্য মামার পায়ের শটকে অনেকে জ¦লন্ত গোলাবল বলে। একবার নাকি তার শটে গোলবারের বাঁশ ভেঙে চাকনাচুর হয়ে গিয়েছিল। তমাল মামার প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে হীরা, মুন্না ও মুর্শেদের দিকে তাকালাম। তিনজনই মাথা নিচু করে বসে আছে। হঠাৎ দেখি মুন্না হাত উঠিয়ে বললো, আমি রাজি।
মামা আবার হাততালি দিয়ে বললো, ভেরি গুড। তুমি খুব সাহসী ছেলে দেখছি। আর হীরা, মুর্শেদ তোমাদের খবর কী?
নজরে পড়লো হীরা আর মুর্শেদ বেজার মুখে মিটিং ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সবাই তাদের আবার বসিয়ে দিলো।
তবে শেষমেশ মুন্নাকে গোলকিপার হওয়ার জন্য তমাল মামার কাছে পরীক্ষা দিতে হয়নি। কারণ, মুন্নাই তো বরাবর আমাদের ফুটবল টিমের গোলকিপার ছিলো। হীরা ও মুর্শেদও বাধ্য হয়ে খেলেছে দলের অন্য পজিশনে।

Share.

মন্তব্য করুন