[গত সংখ্যার পর]

ইশকুল খুলতে বেশিদিন বাকি নেই আর। এই বন্ধের মধ্যেও পরীক্ষার কোনো কোনো বিষয়ের রেজাল্ট ফাঁস হচ্ছে। রাকিব নিজের ব্যাপারে কিছুই জানতে পারেনি। তবে মাইনুদ্দিন স্যারের কাছ থেকে শওকতের অংক বিষয়ের রেজাল্ট জেনেছে। স্যার বলবে না বলবে না এরকম একটা ভাব করতে করতেও বলে ফেলেছেন। শওকত সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে। বোঝা গেল এই ব্যাপারটায় স্যার নিজেও বেশ কৌতূহলী। ছেলেটা এত অল্প সময় ক্লাস করেও এত ভালো করেছে, তাও আবার অংকে! প্রাইভেটে গিয়ে এটা জানার পর শিমু, শাকিল আর রাশেদ- তিনজনেরই মন খারাপ হলো। অঙ্কে শুধু নয়, প্রায় সব সাবজেক্টেই এরা তিনজন ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড হয়। শিমুর রোল বরাবরই এক থাকলেও দুই-তিন একটু এদিক-সেদিক হয়। এই প্রথম ওদের বলয়ের ভেতর এক নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীর উপস্থিতি ভাবিয়ে তুলেছে ওদের। রাকিব ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, চাপ নেই। কিন্তু শওকত মাত্র অল্প ক’দিন ক্লাস করে একটা সাময়িক পরীক্ষায় অংকে এত ভালো করবে, তা সেও ভাবেনি। এখন বাড়িতে সে একটু চাপে পড়ে যেতে পারে। বাবা-মা নিশ্চয়ই তাকে তিরস্কার করবে। এত বছর যেভাবে চালিয়ে যাচ্ছিলো তা বুঝি আর চলবে না এখন থেকে। তবু তার ভেতরে ভেতরে এক ধরণের আনন্দ কাজ করছে শওকতের সাফল্যে। খবরটা শওকতকে গিয়ে বলতে হবে। সে প্রাইভেটে আসে না। পরীক্ষার পর থেকে প্রাইভেট পড়বে। তবে এসব নাকি তার ভালো লাগে না। তার নাকি ক্লাসের পড়াই যথেষ্ট। তেমন সিরিয়াসও না, কারো সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মানসিকতাও দেখা যায় না তার ভেতর। রোলও কখনও এক-দুই হয়েছে বলে শোনা যায় নাই। কিন্তু অংকে সে এতো ভালো! তাকে নিয়ে যে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই, সেকথা শিমু-রাশেদ-শাকিলদের কে বোঝাবে! তবে হ্যাঁ, হতে পারে এবার সে বিপর্যয়কর কিছুই করে ফেলবে- যা কারো ধারণাতেই নেই।

রাকিব বাড়িতে ফিরে ওদের পড়ার ঘরে ঢুকে দেখলো শওকত তখনও ঘুমাচ্ছে। রাকিব ডাকলো, ‘শওকত, এই শওকত!’
শওকতের চোখে প্রচুর ঘুম। ডাক শুনে একবার পাশ ফিরে আবার ঘুম দিলো সে। রাকিব আবার ডাকতে যাবে এমন সময় দরজার সামনে এসে মা ডাকলেন, ‘এই, ওকে ঘুমাতে দে। গতকাল কই কই গেছিলো ছেলেটা। শইল অনেক ক্লান্ত। কই কই গেছিলো কে জানে! নাহ, এইভাবে করলে তো বিপদ। কাইল বিকালটা কত চিন্তাভাবনা আর ভয়ের ভিতর দিয়া গেছে। ওর বাপ-মা জানলেও তো টেনশন করতো। এইবার আইলে বলমু- তোমরার পোলারে তোমরা নিয়া যাও। এই পোলা কই যায়, কী করে তার কোনো ঠিক নাই। আবার নাকি গাছটাছও বায়। এগুলা কি রে বাপ! তুই খাবিদাবি, পড়াশোনা-খেলাধুলা করবি- ভালো থাকবি, তা না, নানান কাণ্ডকারখানা করবে সে। এখন ঘুমাক। ওরে ডাকিস না। শহরেও তো ওইরকম ঘুমায়। এইসব অভ্যাস ভালো না। আর শোন, তুই যা, রান্নাঘরে রুটি রাখা আছে প্লেটে। হরিণের মাংস আছে। নিয়ে-থু’য়ে খাইস। শওকতের জন্য রাখিস। আমি গরু-ছাগলডি নাইড়া দিয়া আসি।’
রাকিব দরজা টেনে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। হরিণের মাংশ দিয়ে রুটি খাবে। এই খাওয়াটা রাতে সবাইকে নিয়ে বসে একসঙ্গে খাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু শওকতের চিন্তায় এবং ওর খোঁজাখুঁজিতে লেগে সবই এলোমেলো হয়ে গেছে। রাকিব রান্নাঘরে গিয়ে আবার ফিরে আসলো। শওকতকে ছাড়া সে কিছুতেই হরিণের মাংস দিয়ে রুটি খাবে না। একসাথে খাবে। তাছাড়া হরিণ শিকারে তো রাকিব যায়নি, গিয়েছিলো শওকত। দুইটা হরিণ ধরা পড়ছিলো গতকাল। জালে আটকা পড়া আহত হরিণ জবাই করতে বলা হয়েছিলো সফর আলি নামের একজনকে। চাকমারা জানেন, মুসলমানরা জবাই না করে কিছু খায় না। জবাই করার পর যে গোশত পাওয়া গিয়েছিলো তা সমান ভাগ করে প্রত্যেককে একভাগ করে দেয়া হয়েছে। শওকতকে না পেয়ে ওর ভাগটা জসিমকে দিয়ে বাড়ি পাঠানো হয়েছিলো। অথচ শওকত এখনও এসবের কিছু জানেই না। রাতে এসে না খেয়েই ঘুম দিয়েছে। রাকিবের আম্মু বেশ কয়েকবার ডেকেও তুলতে পারেনি ওকে। ঘুমের মধ্যেই মাঝে মাঝে কাশছিলো সে। আন্টি বকতে বকতেই ঘর থেকে গিয়ে তেলের শিশি নিয়ে আসেন। হাতের তালুতে সরষের তেল ঢেলে ওর মাথায় দিয়ে দেন।
শওকত ঘুম থেকে ওঠে অনেক বেলা করে। আন্টি এখনও ঘরে ফেরেননি। গরু-ছাগল নাড়তে গেছিলেন সকালে। সেখান থেকে গেছেন করলা ক্ষেতে। করলা ক্ষেতের মাচানের নিচে লালশাক আর মরিচের গাছ আছে। সেগুলোতে নিড়ানি করে দেন। রাকিবের বাবা বাড়ির কাজ প্রায় করেনই না। তিনি প্রতিদিন সকালেই চলে যান তার ব্যবসার কাজে। বাজারে দোকান আছে তার। সকালে গিয়ে দোকান খুলতে হয়। দুপুরের খাবারটা রাকিবের ছোটবোন দিয়ে আসে। বাড়ি ফেরেন ঠিক রাত করে। রাত দশটারও পরে। সে হিশেবে বাড়ি বলতে গেলে ফাঁকাই থাকে। এই যেমন এখন ফাঁকা। পুরো বাড়িতে এক শওকত ছাড়া আর একটা কাকপক্ষিও নেই।

শওকতের পেটে ভীষণ ক্ষুধা। রাতেও কিছু খায়নি। গতকাল বন থেকে বেরিয়ে আসার পর সন্ধ্যার আগে আগে যখন মধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিলো- মধু তাকে একটা মুড়ির মোয়া খেতে দিয়েছিলো। ও-ই খাওয়া। রাতে ক্ষুধায় একবার ঘুম ভেঙে গেলেও আর খেতে যায়নি। অত রাতে কাকে জাগাবে! এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার ঘুম দেয়। সেই ঘুম থেকেই এইমাত্র উঠলো। প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে রান্না ঘরে গিয়ে সে বুঝলো- হরিণের মাংশ ঝোল ঝোল করে রান্না করে রেখেছে আন্টি। একটা বড় বাটিতে ঢেকে রাখা আছে আতপ চালের রুটি। লোভনীয় খাবার। শওকত বুঝতে পারলো- এখনও কেউ খায়নি। এ বাড়ির নিয়ম হলো- ভালো খবার রান্না হলে সবাই একসঙ্গে বসে খায়। শওকতের পেটে ভীষণ ক্ষুধা। সে রাকিবের নাম ধরে ডাকলো। পাহাড়ের নিচের করলা ক্ষেত থেকে জবাব দিলো আন্টি- ‘শওকত, এই শওকত!’
‘জি আন্টি।’
‘এই, পাকঘরে হরিণের মাংশ আছে পাতলে, আর রুটি আছে গামলায়- ভাতের প্লেট দিয়ে ঢাকা। তুই খাইয়া নে। রাইতে তো কিছু খাও নাই। খাইয়া নে বাজান। আমি আইতেছি।’
শওকত আবার রান্নাঘরে গেল। সে কি একা একা খেয়ে নেবে? একা খাওয়ার কি কোন আনন্দ আছে! নাহ, রাকিবদের ছাড়া সে কিছুতেই খাবে না সে। আন্টি বেড়ে না দিলে একা একা নিয়েথু’য়ে খাওয়ার মাঝে কোনো আনন্দ নেই। অবশ্য এক কারণে ভেতরে ভেতরে কিছুটা আনন্দও যে হচ্ছে না, তা নয়। সে গতকাল শিকারে গিয়েছিলো, আর সেজন্যই তো এই মাংশের ভাগ! তাছাড়া পরিশ্রমও তো কম যায়নি। অবশ্য পিছে পিছে এত ছোটার পরও হরিণটাকে যে আর পাওয়াই গেল না, সেটা ভেবে একটু খারাপও লাগলো তার। এদিক থেকে নিজেকে কিছুটা ব্যর্থই মনে হচ্ছে। এসময় চট করে তার মনে পড়ে গেল বন থেকে সেই কুড়িয়ে আনা জিনিশটার কথা; সেই সাথে বনে দেখা হওয়া মানুষটার কথাও। শওকত ঘরে চলে গেল। একি, জিনিশটা গেল কোথায়! টেবিলে ছিল না?নাহ, খোঁজাখুঁজি করে পাওয়া গেল না। রাকিবের কাজ নিশ্চয়। জিনিশটা কোথায় রাখতে পারে সে? যাকগে, রাকিব আসলে ওর থেকে জেনে নেয়া যাবে। তার আগে একটু মধু ভাইর কাছে যেতে পারলে ভালো হয়। মধুর কথাগুলোর মধ্যে একটা সূত্র আছে। অবশ্য সেও সূত্রের কথাই বলেছিলো। কী সেই সূত্র?মধু কি পাহাড়ের ভেতরের খবর কিছু জানে?

মধুকে বাড়িতে পাওয়া গেল না। সে কোথায় গেছে তারও সঠিক তথ্য বাড়ি থেকে পাওয়া গেল না। তবে মধু ভাইদের বাড়িতে গিয়ে একটা উপকার হয়েছে, মধুর মা শওকতকে ঘরে বসিয়ে নাস্তা খেতে দিয়েছে। জালি চালকুমড়ার ভাজি দিয়ে গমের রুটি। খেতে অসাধারণ। এ জিনিশ আগে কখনও খায়নি শওকত। রাকিবরাও খায় না। তারা রেশনের গম সব বিক্রি করে দেয়। সকালে তাদের ঘরে প্রায় দিনই নাস্তা হয় আতপ চালের গুড়ো দিয়ে তৈরি ধবধবে শাদা এক ধরণের রুটি। শহরে থাকতে শওকত কখনও ধরণের রুটিও খায়নি। শহরে হয় তন্দুল রুটি, নয় কম তেলে ভাজা পরাটা। অবশ্য শহরের সেসব খাবারের চেয়ে গ্রামের খাবার যে অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত তা বুঝতে বাকি নেই শওকতের। এখানকার আবহাওয়া তো ভালোই। পাহাড়, ঝর্ণা, নদী, পাখির ডাক, গ্রামের নাড়া ক্ষেতে খৈ ফুটিয়ে খাওয়া, বিকেলে গরু চড়াতে চড়াতে ডাঙগুলি খেলা- সবই অসাধারণ। বাবা-মা তার দেয়াল বাওয়ার শাস্তি হিশেবে গ্রামে নির্বাসনে না পাঠালে এই আনন্দ ও সৌন্দর্যের সাক্ষাৎ সে কোনোদিনও হয়তো পেত না। মনে মনে বাবা-মাকে ধন্যবাদ দেয় শওকত। তবে এমুহূর্তে তাকে সবচেয়ে বেশি যে জিনিশটা আকর্ষণ করে, তা হলো- পাহাড়, ঘন বন। ভেতরে ঢুকলে তার তেমন কিছু ভয় করে না, যতটা ভয় বনে দেখা হওয়া সেই লোকটা দেখিয়েছে। তার মাথায় আবার সেই রহস্য উঁকি দিয়ে উঠলো। নাস্তা খেয়ে সে দেরি করলো না মোটেও। মধুর মাকে সালাম করে নেমে পড়লো রাস্তায়। নাস্তা খাওয়ায় শরীরটা বেশ চাঙ্গা লাগছে। গতকাল সকালের পর আজ সকালে আবার কিছু খেয়েছে। এর মধ্যে শুধু পানি আর মধুর দেয়া মুড়ির মোয়া ছাড়া কিছুই খায়নি সে। মধুর মাও বোধহয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। এটা ভেবে একটু শরম লাগলো শওকতের।
বেশিদূর যেতে হয়নি, পথেই পাওয়া গেল মধুকে।
‘মধু ভাই, কেমন আছো? তোমার কাছেই আসলাম। কই গেছিলা?’ শওকতের কথার কোনো জবাব না দিয়ে মধু বললো, ‘তুই কাইলকা কই গেছিলি ভাই?’
‘তুমি জানলা কেমনে? জসিমরা কিছু বলছে?’
‘হ, রাকিব তোরে খুঁজবার বাইর হইছিলো।’
‘গেছিলাম একজায়গায়। তোমার খবর বলো মধু ভাই।’
‘আমার কী খবর আবার!’ মধু অবাক হয়।
‘আরে তোমারে খুঁজতেই তো বাইর হইছি। তোমাদের বাড়িতে গেছিলাম। আন্টি নাস্তা দিলো, খেয়ে আসলাম।’
‘আমারে ডাক দিতি। দোকানেই তো আছিলাম। কী বিষয় ক।’
‘বিষয় কিছু না তেমন। এমনি আলাপসালাপ করা আরকি।’
‘আমি পাগল মানুষ। আমার লগে আর কী আলাপ করবা!’
‘ধুর, মধু ভাই! কীসব বলো তুমি। চলো, চা খাইগা।’
‘তুই খা। আমি ইক্কনই খায়া উঠলাম।’
‘তাইলে আমিও খামু না। চলো ছড়ার দিকে যাই।’
‘চল।’

শওকত আর মধু ছড়ার পাড়ে বসে বসে অনেক্ষণ ধরে আলাপ করলেও গতকালকের সূত্রটুত্র নিয়ে কিছুই বললো না মধু। বরং গতকাল যে কিছু বলেছে, তা-ই ভুলে গেছে সে। শওকত বারবার মনে করিয়ে দিয়েও কিছু হয়নি। মধু মনেই করতে পারছে না কিছু। একটা সময় শওকতের মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো। সে চট করেই বলে বসলো, ‘চলো মধু ভাই, পাহাড়ে যাবো।’
‘কোন পাহাড়ে?’
‘মোডাই চাকমার টিলায়। একটা হরিণ দেখছি, ওইটা ধরবো। আরও আরও জিনিশ আছে। দেখাবো তোমাকে।’
এইবার কাজ হলো কিছুটা। যদিও মধু যেতে রাজি হলো না একদমই। তবে একটা দারুণ বিষয় বললো সে। বললো, ওই পাহাড়ে নাকি প্রচুর দামি দামি জিনিশ আছে। শওকত জিজ্ঞেস করলো, ‘কী সেই দামি জিনিশ মধু ভাই?’
‘আছে। আমার বিশ^াস হয়, লোকে ওসব বিশ^াস করে না। তবে কারো একা একা যাওন ঠিক না। আর তুমরা তো ছুডু পোলাইন, তোমরা যাইলে পাইতা না কিছু।’
‘কী আছে বনে? কী বিশ^াস করে না লোকে? আর গেলে কী পাবো না?’
‘ধ্যাৎ, খালি কথা বাড়ায়, আমি কি যাইয়া দেখছি? তয় আমার বিশ^াস হয়।’
হুঁ। বিশ^াস তো শওকতেরও হয়। কিন্তু মধুর কাছে সে আসছিলো বাড়তি কিছু জানার জন্য। জানার ইচ্ছেটা মধুই গতকাল উস্কে দিয়েছিল। অবশ্য কিছুই বুঝতো না- যদি সে হরিণের পিছু পিছু সে গহীন বনে ঢুকে যেতে না পারতো। বনে ঢুকলে তার আরেকটা জিনিশ খুবই ভালো লাগে। তা হলো- পাখি আর কাঠবেড়ালিদের গাছে গাছে ওড়াউড়ি, দৌড়ঝাঁপ। অবাক হয় সে। তার পক্ষে কোনোদিনও ওরকম করা সম্ভব নয়।
‘মধু ভাই।’
‘উ।’
‘কও কিছু!’
‘কিতা?’
উঁহু, মধু ভাইর ভেতর গতকালের সেই দার্শনিক ভাবটা একদমই পাওয়া যাচ্ছে না। শওকত জানে, গতকালের কথাগুলোই ঠিক ছিলো মধুর। পাহাড়ে একটা চক্র আছে। ওই চক্র মোকাবেলা না করতে পারলে ওখানকার কোনো রহস্যই উদঘাটন করা সম্ভব না। আবার দলবল নিয়ে ওখানে গেলেও কোনো কাজ হবে না। যেতে হবে একাকী। কিন্তু খালি হাতে গেলে তো চলবে না, দেরি করলেও হবে না। ইশকুল বন্ধ থাকতে থাকতেই পাহাড়ে ঢোকার প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে কি পাহাড়ে আজই ঢুকবে সে! হ্যাঁ আজই। এবং মোটেও দেরি করা চলবে না। খুব সাবধানে এবং কৌশলে যেতে হবে ওখানে। সেদিন যেমন হরিণের পেছন পেছন দৌড়াতে দৌড়াতে ভেতরে ঢুকেছে এবং শিকারে যাওয়া সবাই মিলেই পাহাড়ে হৈ-হল্লা করেছে, তেমনটা তো আজ হবে না। ফলে ভেতরের লোকেরাও নিশ্চয় অতটা সজাগ থাকবে না। এটা ভেবে কিছুটা স্বস্তি পেল সে। মনোবল চাঙ্গা হলো অনেক। তবে সঙ্গে করে আত্মরক্ষার জিনিশ নিতে হবে। জিনিশ জিনিশ জিনিশ…। ‘জিনিশ’ শব্দটা মাথায় আসতেই তার গতকালের কথা মনে পড়লো আবার। বনে দেখা হওয়া লোকটা তাকে বলছিলো, ‘বনে শুধু…অন্য জিনিশও থাকে।’ কী সেই জিনিশ? জিনিশ যা-ই হোক, সে বনে যাবে। লোকটা তাকে ভয় দেখিয়েছে নিশ্চিত। বনে বাঘ-ভালুক যা থাকে থাকুক, তাতে অত ভয় নেই। ভয় কেবল একটা জায়গায়- বন্দুকধারী সেই দস্যুরা। তারা কতজন আছে? বনে তাদের কী কাজ? আর কিইবা আছে ওখানে? বন থেকে কুড়িয়ে আনা জিনিশটার কথা তার আবারও মনে পড়লো। সেই সাথে বনে ঢোকার ইচ্ছেটা আরও চাঙ্গা হয়ে উঠলো। আত্মরক্ষার জন্য সঙ্গে কী নেবে সে? এক দা ছাড়া নেবার মতো তো কিছুই নাই। দা’টা আনতে সে কি বাড়িতে যাবে? না, বাড়িতে গেলে আজ আর বেরোনোর উপায় থাকবে না। হরিণের মাংশ দিয়ে রুটি খেতে খেতেও অনেক সময় চলে যাবে। সেই সাথে গতকালকের বিষয়ে একশোরকম জেরা করবেন আন্টি। নাহ, মধু ভাইর কাছ থেকেই দা’টা নিতে হবে। পাগল মানুষ, ঝুটঝামেলা হবে না। অন্য বাড়িতে গেলেও কেউ তাকে একটা দা দেবে- এমন সম্ভাবনা কম। শওকত গ্রামের ছেলে নয়। ছোটকাল থেকেই শহরে থেকেছে। তার চালচলনেও সেরকম একটা শহুরে ভাব আছে। কথাবার্তাও গ্রাম্য নয়, শহুরে ধরণের। সে কারো বাড়িতে একটা দা চাইতে গেলেই তার কারণ জানতে চাইবে। তার উপর পুরো একদিনের জন্য কেউই তাকে দা দেবে না। দেবার সম্ভাবনা অবশ্য মধু ভাইরও নেই। মধু ভাইর নিজের তো আর দা নেই। শওকতের সঙ্গে কথা শেষ করে মধু বাড়ির পথে হাঁটছিলো। তাদের বাড়িটা এখান থেকে দেখা যায়। পেছন থেকে শওকত মধুকে আবার ডাকলো, ‘মধু ভাই!’
মধু পেছনে ফিরলো। তার মাথা আসলে ঠিক নেই। গতকাল কী কী বলেছিলো, পাহাড় সম্পর্কে তার কী কী জানা আছে- আজ তার কিছুই মনে নেই। তার কাছ থেকে নতুন কোনো তথ্যই উদ্ধার করতে পারেনি শওকত।
‘মধু ভাই, দাঁড়াও।’
‘আবার কী ক’বি?’
‘কিছু না। একটা দাও দিবা?’
‘দাও? দাও দিয়া কী করবি?’
‘যা করি করবো, তুমি দিবা কিনা কও।’
‘আচ্ছা খাড়া তুই। আমি নিআইতাছি।’
‘যাও।’
মধু একটা তাক্কল দা এনে শওকতের হাতে দিয়ে নিঃশব্দে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। দা’টা হাতে পেয়ে শওকতের মনোবল আরও বেড়ে গেল। এরকম একটা জিনিশ হলেই চলে তার। বন্দুকটন্দুকের দরকার নেই অতো। জাস্ট কিছু একটা থাকা আরকি। খালি হাতে যাওয়ার চেয়ে এটা বরং অনেক ভালো।
শওকত মনে মনে পাহাড়ের ভেতরকার পথঘাট মনে করার চেষ্টা করলো। পথ তো আসলে কিছুই না। সে বরং মনে করতে চাইছে- গতকাল সে যেভাবে যেভাবে বনের ভেতরে ঢুকেছিলো সেই দৃশ্যটা। হরিণ শিকার করতে গিয়ে সে যেখান দিয়ে পাহাড়ে উঠেছিলো ঠিক সেই জায়গা দিয়ে কি সে উঠবে? নাকি একটু এদিকওদিক করবে। নাহ, ঘন বনের ভেতর পথ ভুল করার সম্ভাবনা আছে। আগে খুব সতর্কভাবে পাহাড়ে উঠতে হবে। তারপর দরকার পড়লে যথাস্থানে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। শওকত একবার দূরের বন-পাহাড়ের দিকে তাকালো। পাহাড়ের অদ্ভুত সৌন্দর্য তার ইন্দ্রীয়কে অবশ করে দেয়। সে কিছুক্ষণের জন্য তাকিয়ে থাকে পাহাড়ের ঘন সবুজের তরঙ্গিত বিস্তারের দিকে।
শওকতের ভয় করছে। তবে বনে ঢোকার ব্যাপারে ভেতরে কোনো দ্বিধা কাজ করছে না। অল্প কিছু দোয়া-কালাম তার জানা আছে। সেগুলো পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে হাতে ভারী তাক্কল দা’য়ে ভর দিয়ে দিয়ে পাহাড়ে উঠতে থাকলো সে। সেদিন অনেকে মিলে শিকারে আসলেও আজ সে একা। একার অভিযান, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বনের কাঁটা লতাপাতার ফাঁক দিয়ে, কোনো কোনো লতা দা দিয়ে কেটে কেটে খুব সন্তর্পনে পা ফেলে ফেলে হাঁটছে শওকত। আসলেই বনের ভেতরটা ভয়ের। সেদিন এতটা ভয়ঙ্কর কিছু মনে হয়নি, অনেকে মিলে আসার কারণেই যে- তা সে বুঝতে পারছে। কোথাও পাতার মর্মর শব্দ হলেই আচমকা সেদিকে ফিরে দ্যাখে সে। পাতায় ফরফর শব্দ, গাছের ডালপালা প্রায় অকারণেই নড়ে ওঠে। আচমকা সেসবও খেয়াল করে শওকত। হয়তো একটা পাতা উল্টানি পাখি শুকনো পাতার উপর হাঁটছে। গাছের ডালে হয়তো একটা নাম নাজা পাখি এসে বসলো- অমনি ডালটা নড়ে উঠলো। অথবা বনের ভেতর নতুন একজনের উপস্থিতি টের পেয়ে একটা কালো কাঠবেড়ালি ডাল থেকে ডালে লাফিয়ে পড়লো। এসব দেখে দেখে খুব সতর্কতার সাথে হাঁটছে শওকত। পাখি হোক আর যা-ই হোক, সতর্ক থাকতে হবে। কান খাড়া রাখতে হবে। ধীরে ধীরে পৌঁছতে হবে কাক্সিক্ষত জায়গায়। শওকত হাঁটছে। বিচিত্র সব পাখিরা এদিকওদিক উড়ে যাচ্ছে, গান গাইছে। সেসব গানের অর্থ বোঝে না সে। কিন্তু কি এক রহস্যময় উপায়ে সেই গানই তার চেতনার ভাঁজে ভাঁজে নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়ছে।

অচেনা উপত্যকায়

‘কত বেলা হয়ে গেলো, ছেলেটা এখনও এলো না!’ মায়ের উৎকণ্ঠা গাঢ় হয়।
‘কোথায় গেছে ও?’ স্ত্রীর কাছে জানতে চান অবিরাম বাবু।
মালাকা বলেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠেই তো সে নদীর দিকে গেল।’ প্রায় দিনই যায়। কোন কোন দিন দেরি হয় বটে; সেসব দিনে সে তার বন্ধুদের সঙ্গে মাছ ধরে বা ডাঙগুলি খেলে, কিন্তু ফিরে আসে খুব দ্রুতই। ঘরে এসে নাস্তা-পানি খেয়ে ইশকুলে যায়। কিন্তু আজ তো অনেক বেলা হয়ে গেল।
মালাকা আবার বলেন, ‘ইশকুলে যাবার সময়ও তো পার হয়ে গেছে কখন! ছেলেটা আবার পাহাড়ে ওঠেনি তা!’ পাহাড়ের দিকে তাকায় মালাকা। কালো, উঁচু পাহাড়। তাকালে মনে হয় চূড়ার সঙ্গে টক্কর খাচ্ছে শাদা-কালো আর নানান কিসিমের মেঘেরা। যেন মেঘ বিলাসে মেতে উঠেছে উঁচু ঐ পাহাড়টা। যেন আকাশের ক্যানভাসে সবুজ বৃক্ষরাজি আর মেঘের পুঞ্জ নিয়ে থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হরিণাদ্রি পাহাড়টা। ছেলেটা কি ঐ পাহাড়ে উঠলো! বুকটা কেঁপে ওঠে মায়ের। গাঢ় সবুজের তরঙ্গিত বিস্তারে চোখ রেখে কল্পনায় তিনি কতশত চড়াই-উতরাই ভাঙতে থাকেন।
‘আমি তাহলে ওদিকে যাই।’ কাঁধে গামছা ফেলে তাক্কল দা’টা হাতে নিয়ে উঠোনে নেমে আসেন অবিরাম বাবু।
‘যাও, আমিও আশপাশের বাড়িগুলো খোঁজ নিয়ে আসি। খবরদার, ছেলেকে পেলে আবার রাগ-ধমক দেখিয়ো না। পোলাপান মানুষরা ওরকম করে। কিন্তু গেল কই ছেলেটা!’
অবিরাম বাবু মালাকার কথার জবাব দেবার প্রয়োজন দেখেন না। ছেলের জন্য ¯েœহটা তো তারও কম নয়। বোঝে সেটা মালাকাও। তবু মায়ের মন তো!
মালাকাও দরজা ভেজিয়ে দিয়ে পাড়ার দিকে হাঁটা দেন। (চলবে)

Share.

মন্তব্য করুন