ভারতীয় ক্রিকেটে পেস বোলিংয়ের দুর্বলতা আজীবনের। একটা সময় বিশ^ ক্রিকেটে তারা দুর্দান্ত সব ব্যাটসম্যান উপহার দিলেও ভালো মানের পেস বোলারের জন্য হাহাকার ছিলো দলটির। গত কয়েক বছরে সেই ধারা থেকে অবশ্য তারা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড পেসার তৈরির জন্য অনেক রকম পদক্ষেপ নিয়েছে। যে কারণে এখন দলটিতে আছেন জসপ্রিত বুমরাহ, মোহাম্মদ শামি, ভুবনেশ^র কুমারের মতো বিশ^মানের পেসার। তবে এরপরও ভারতীয় ক্রিকেটে আরেকটি জায়গায় ঘাটতি রয়ে গেছে, সেটি হলো দুর্দান্ত গতির একজন ফাস্ট বোলার। বুমরাহ, শামিরা গড়পরতা গতির বোলার; কিন্তু সত্যিকারের ফাস্ট বোলার বা গতি তারকা এখনো পায়নি ভারত। তবে এবার কাশ্মিরের এক তরুণের মাঝে সেই সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে দেশটির ক্রিকেট ভক্তরা।
ছেলেটির নাম উমরান মালিক। বয়স ২১ বছর। ডানহাতি ফাস্ট বোলার। ২০২১ সালের আইপিএলেই মূলত তার লাইমলাইটে আসা। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের জম্মু শহরের এক ফল বিক্রেতার ছেলে উমরান। উমরানের এই আলোচনায় আসাটা অবশ্য হুট করেই। গত আইপিএলে তাকে নেট বোলার হিসেবে দলের সাথে রাখে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ ফ্রাঞ্চাইজি। প্র্যাকটিসের সময় ব্যাটসম্যানদের টানা বোলিং করে যাওয়াই নেট বোলারদের কাজ। এর আগে জম্মু ও কাশ্মির প্রাদেশিক দলের হয়ে একটি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ (ঘরোয়া ক্রিকেটের ৫০ ওভারের ম্যাচ) এবং একটি ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। মনে তখন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে জায়গা পাওয়ার স্বপ্ন। তবে তার আগেই উমরানের জন্য খুলে যায় আইপিএলের দরজা।

টুর্নামেন্টের মাঝপথে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ দলের এক পেসার করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। তার বিকল্প খুঁজতে থাকে টিম ম্যানেজমেন্ট। প্র্যাকটিসে উমরানের বোলিং দেখে মনে ধরে তাদের। স্বপ্ন যেন হাতে ধরা দেয় উমরানের। ৩ অক্টোবর কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিপক্ষে আইপিএলে প্রথম ম্যাচ খেলেন উমরান। প্রথম ম্যাচে উইকেট না পেলেও ২৭ রানে শেষ করেছেন চার ওভারের কোটা। এরপর আরো দুটি ম্যাচ খেলেছেন রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু ও মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বিপক্ষে। দুই ম্যাচে দুটি উইকেট নিয়েছেন। তবে তারচেয়েও বেশি নজর কেড়েছেন পিচে গতির ঝড় তুলে।
এবারের আইপিএলে সবচেয়ে গতিসম্পন্ন বোলার ছিলেন উমরান। প্রথম ম্যাচে কলকাতার বিপক্ষে তার একটি বলের গতি ছিলো ঘণ্টায় ১৫১.০৩ কিলোমিটার। যা এবারের আইপিএলে ভারতীয় বোলারদের মধ্যে সবার সেরা। তবে দ্বিতীয় ম্যাচেই নিজেকে ছাড়িয়ে যান উমরান। সেদিন ব্যাঙ্গালুরুর বিপক্ষে তার একটি বলের গতি ছিলো ঘণ্টায় ১৫৩ কিলোমিটার। যেটি এবারের আইপিএলের সবচেয়ে দ্রুতগতির ডেলিভারি। একজন নতুন বোলারের জন্য অবশ্যই অনেক বড় অর্জন। কারণ আইপিএলে খেলেন বিশে^র অনেক বড় বড় তারকা।
এরপরই ভারতীয় ক্রিকেট জগতে শুরু হয় উমরানকে নিয়ে আলোচনা। খোদ ভারতীয় অধিনায়ক বিরাট কোহলি বলেছেন, এই টুর্নামেন্ট প্রতি বছর অনেক প্রতিভা উপহার দেয়। কোন তরুণ ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে বোলিং করলে তা সত্যিই আনন্দের ব্যাপার।

কোহলি বলেছেন, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড অবশ্যই এমন প্রতিভাকে যত্ন করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের উপযোগী করে তুলবে। এমন কথা উমরানের মনে নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়ে আরো বড় স্বপ্ন বাসা বাঁধতে সাহায্য করবে।
এছাড়া অন্যান্য ক্রীড়া বিশেষজ্ঞরাও উমরানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক ফাস্ট বোলার ইয়ন বিশপ উমরানকে ‘বোলিংয়ের শক্তিশালী অস্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, এ ধরনের সহজাত প্রতিভা এখন খুব একটা দেখা যায় না। ভারতীয় ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলের ভাষায় উমরান মালিক হতে পারেন ‘দুর্ধর্ষ বোলার’।
ভারতীয় মিডিয়া তার প্রতিভা নিয়ে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত। অনেক আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়ও স্থান পেয়েছে উমরানের গতির ঝড় তোলার খবর। এরপর ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সদ্য সমাপ্ত টি-টোয়েন্টি বিশ^কাপে ভারতীয় দলের নেট বোলার হিসেবে উমরানকে নিয়েছিলো। জাতীয় দলের সাথে অনুশীলনের সুযোগ পাওয়াটাও এমন একজন উঠতি বোলারের জন্য নিঃসন্দেহে অনেক বড় ব্যাপার। জাতীয় দলের তারকা ক্রিকেটার আর কোচদের কাছে থাকাটা তার জন্য অভিজ্ঞতা অর্জনের বড় সুযোগ।
২০১৮ সালে জম্মু ও কাশ্মির প্রাদেশিক দলের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পাওয়ার মধ্য দিয়ে মূলধারার ক্রিকেটে পা রেখেছিলেন উমরান। এরপর কাশ্মির সিনিয়র দলের হয়ে সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে টি-টোয়েন্টি খেলার সুযোগ আসে ২০২১ জানুয়ারিতে। পরের মাসে একই দলের হয়ে খেলেন ঘরোয়া এক দিনের ম্যাচের টুর্নামেন্টে।
এ বারের আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ ভালো করতে না পারলেও উমরান মালিক তার সম্ভাবনার জানান দিয়েছেন মাত্র তিন ম্যাচ খেলেই। যে কারণে ভারতীয় দলের নেট বোলার হিসেবে তার বিশ^কাপেও যাওয়ার সুযোগ হয়েছে।

তার বাবা রশিদ মালিক বলেছেন, ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট ছিলো ওর নেশা। একমাত্র ক্রিকেটই ছিলো ভালোবাসা। সব সময় বলতো, আমি একদিন ভারতের হয়ে খেলবো।
এক সময় কাশ্মিরের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে টেনিস বলের টুর্নামেন্ট খেলতেন উমরান। অপেশাদার পর্যায়ের ক্রিকেটে ডাক আসতো নানা জায়গা থেকে। ক্রিকেটের এই নেশার কারণে মাধ্যমিকের পর আর পড়াশোনাও এগোয়নি। তার আগ্রহ দেখে পরিবারও আর বাধা দেয়নি খেলতে। যে কারণে ক্রিকেটার হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।
এখন অপেক্ষা নিজেকে আরো পরিণত করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের উপযুক্ত করে তোলার। ইতোমধ্যেই তাকে ভারতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেখার প্রত্যাশা শুরু হয়েছে ক্রিকেট সমর্থকদের মাঝে। তাই সব কিছু ঠিক থাকলে হয়তো উমরান একদিন ক্রিকেট মাঠে গতির ঝড় তুলবেন। ভারত পাবে তার বহু কাক্সিক্ষত এক গতি তারকা।

Share.

মন্তব্য করুন