যুদ্ধ ও শান্তি বিষয়টি কেমন যেন ঠেকতো আমার সদ্যযৌবনে। লেভ টলস্টয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস পড়ে আমার সে রকমটাই মনে হয়েছিলো। যুদ্ধ করে কিভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেই বিস্ময়, সেই ভাবনাই ছিলো প্রধান। তখন মেলাতে না পারলেও এখন বুঝি যুদ্ধ ছাড়া কোনো রকম শান্তি ও শান্তির পরিবেশ গড়ে তোলা যায় না। বসবাসের পরিবেশ যদি শান্তিপূর্ণ করা যায়, যদি নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি মেলানো যায় চলমান জীবনের সঙ্গে, তাহলে তো কোনো সংগ্রামের প্রয়োজন হয় না। প্রতিবাদী মিছিল করে সরকারকে জানান দেয়ার প্রয়োজন হয়, মিছিলের উত্তাল সংগ্রামী চেহারা দেখে সরকারও বুঝতে পারে, জনগণ কী চায়। আর সরকার যদি না বুঝতে পারে, সরকার যদি গোঁয়ার গোবিন্দ হয়, সরকার যদি বৃহত্তর নাগরিকের দাবিকে মেনে না নেয়, তাহলে অশান্ত হয়ে ওঠে দেশের সার্বিক পরিবেশ। তখন রাজনৈতিক নেতারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের পরমপ্রিয় মানুষদের পক্ষে ঘোষণা করেন মুক্তির সনদ। আর সেটা হচ্ছে স্বাধীনতার প্রশ্ন। কারণ স্বাধীনতা ছাড়া জনগণের মনের মতো শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব নয়। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক সরকার আমাদের ওপর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ না চালালে হয়তো ওই বছরই আমরা স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র কাঁধে তুলে নিতাম না। আমরা, বাঙালিরা অনেক ধৈর্য আর সহনশীল বলে বারে বারে সমঝোতার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতি ও শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করেছি। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক সরকার আমাদের ধৈর্য ও শান্তিপ্রিয়তাকে দুর্বলতা বলে মনে করেছিলো। তারা ভেবেছিলো বাঙালিদের ওপর অস্ত্রের জোর খাটালেই তারা লেজ গুটিয়ে নিয়ে তাদের বাধ্যগত হবে। কিন্তু তারা বাঙালির রাজনৈতিক চেতনার সঠিক পাঠটি নিতে পারেনি। তারা যে দূরদর্শী নয়, ছিলো না, ১৯৭১ সালই তার রাজনৈতিক ও সামরিক প্রমাণ। বাঙালিরা অসীম সাহসী। আমাদের তো তেমন সহায় সম্পদ ছিলো না। যা ছিলো তাও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা নানা অসিলায় লুটে নিয়ে যাচ্ছিল। সেসবের প্রতিবাদ করায়ই বেধে যায় রাজনৈতিক সংঘাত। আমাদের যুবকেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই সশস্ত্র সংগ্রামে, যার নাম মুক্তিযুদ্ধ। আর সেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই আমি ও আমরা বুঝতে শিখি যুদ্ধ ও শান্তির আসল মানে। যুদ্ধ না করলে কখনোই দেশ স্বাধীন করা হতো না। এবং আমাদের রাজনৈতিক অভিপ্রায়ও বিশ্বের কাছে প্রকাশ পেতো না। আমরা স্বাধীনতা কারো দয়ায় পাইনি, তা আমরা রক্ত দিয়ে অর্জন করেছি। তাই এর মূল্য অনেক। তাই এই স্বাধীনতা শান্তির অন্য নাম। আর সেটাই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাজাত ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’। এভাবেই বুঝেছিলাম আমি স্বাধীনতার মানে। বিজয় পতাকার পতপতে উড়ে থাকার মানে।
কিন্তু সেই শান্তি আর স্বাধীনতার বিষয়টি রাজনৈতিক কারণে ঘোলাটে হয়ে গেছে। আমাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বাধীনতা অটুট আছে, কিন্তু ভেতর থেকে কে বা কারা যেন খামচে ধরেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কলিজা। আজ ৫০ বছর হয়ে গেলো আমাদের স্বাধীনতার, আমাদের স্বাধীন সত্তার বিজয়ের। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাদের সেসময়কার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মুক্তি আসেনি। বিষয়টি একটু জটিল। খোলাসা করে বলতে গেলে অনেক সময় ও স্পেস দরকার। কিন্তু আজকের কিশোরদের এই ইতিহাস জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং তাদের হৃদয়ে গেঁথে নিতে হবে ওই স্বাধীনতার মানে। আমি বলবো না যে আমাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বাধীনতা অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে কেবলমাত্র রাজনৈতিক নেতাদের ভুলের কারণে। যে সাম্য সমাজ আমরা গড়তে চেয়েছিলাম, তা আছে সংবিধানে, বাস্তবে তো তা নেই। বরং উল্টো সাম্য সমাজের বিপরীতে পুঁজিবাদী শাসন পোক্ত হয়েছে ধীরে ধীরে, গত পঞ্চাশ বছরে। অবিকশিত পুঁজির অজগর-প্যাঁচ আমাদের হাড়-মাংস গুঁড়ো করে দিয়ে সামনে উন্নয়নের শিখর তুলছে। এই সত্য কিশোর-শিশুদের জানাতে হবে। এর দায় আমাদের সরকারের। দায় দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণির। কিন্তু সরকার ও বুদ্ধিজীবীরা সেই দায়িত্ব পালন করেছে বলে মনে হয় না। যদি সেই সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির আজকের নতুন রূপ পুঁজির সা¤্রাজ্য গড়ে তোলে এবং আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ সেই ফাঁদে পা দেয়, তাহলে কি প্রকৃত লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পারবো? না, পারবো না। সরকার ও পুঁজির মধ্যে সমঝোতা হলে, তার সাপোর্টে সৃজন করা হয় এক ধরনের রাজনৈতিক অনুকারী বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণি, যারা অহর্নিশ সরকারের তাঁবেদারি করবে এবং তাদের নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পের সুনাম গাইবে। বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক সরকারের কিছু বুদ্ধিজীবী সৃষ্টি হয়েছেন, তারা জনগণের মনের কথা না জানলেও তারা সরকারের হৃদয়ের কথাগুলো জানেন। তারা এও জানে না যে প্রকৃত উন্নয়ন কী? তারা জানে না যে গ্রোথ ও ডেভেলপমেন্ট এক জিনিস নয়।
শান্তি, উন্নয়ন, পরিবেশ, শিক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ সবই জানতে হবে শিশু-কিশোর ও যুবসমাজকে। তাহলেই আমরা চিনতে পারবো কোনটা প্রকৃত বিজয়, আর কোনটা নয়। কাকে বলে স্বাধীনতা। বাকি জীবনে শান্তি আর সৌহার্দ্যরে জন্য আমাদের কোন পথে যেতে হবে। কী কী কাজ করতে হবে।

২.

আমাদের দেশের প্রাকৃতিক শোভা দেখবার মতো। আমাদের দেশের বসবাসের গ্রামগুলো সামাজিকভাবে এক ঐক্যবোধের বন্ধনে জড়িয়ে আছে। আমাদের গ্রামগুলো সাংস্কৃতিক চেতনায় সমৃদ্ধ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। গ্রামের বসতি-শৈলীর পেছনে আছে হাজার হাজার বছরের চিন্তার ফসল। তাই দেশকে জানতে হবে আমাদের, চিনতে হবে এর প্রকৃতি ও ফসল উৎপাদনের ঋতুর বৈচিত্র্য। যদিও এখন ঋতুকেন্দ্রিক ফসল ফলানোর কায়দা-কৌশল থেকে বেরিয়ে আসছে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা। এখন যান্ত্রিক চাষাবাদের দিকেই ঝুঁকে পড়েছে কৃষক সমাজ। কারণ মানুষ বেড়েছে বহুগুণ। ১৯৭১ সালে যেখানে ছিলো সাড়ে সাত কোটি, এখন তাদের সংখ্যা ১৭ কোটি। গত ৫০ বছরে দেড়গুণ মানুষ বেড়েছে। এই সব মানুষ যথাযথভাবে তাদের সাংবিধানিক অধিকার পায় না। মানে হচ্ছে সংবিধানে যেসব মৌলিক অধিকার বর্ণনা দেয়া আছে, সেগুলোর কোনোটাই দেয় না রাজনৈতিক সরকার। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও মানবাধিকার, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার দিচ্ছে না। ফলে সরকার ওই সব অধিকারে বিশ্বাসী নয়। তার মানে তারা কি তাদের জাতীয় নেতারা যা কিছু লিপিবদ্ধ করে গেছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য, তাকে অস্বীকার করছেন? অবহেলা করছেন। এগুলো ভাবতে হবে যুব-কিশোরদের, কারণ আগামী দিনগুলোতে তারাই তো সরকারের চালিকাশক্তিতে পরিণত হবে। আমরা চাই, গত ৫০ বছরে যা দেয়া হয়নি, আগামী ২০ বছরে যেন সেসব সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করতে পারে সাধারণ মানুষ।

Share.

মন্তব্য করুন