বরিশাল জেলার স্বরূপকাঠি থানার অন্তর্গত জলাবাড়ি ইউনিয়নের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম কামারকাঠী স্কুল। সপ্তম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণীতে উঠেছে আব্দুল গনী নামে এক কিশোর। শান্ত স্বভাবের আব্দুল গনী ছিলো অন্য দশজন ছেলের থেকে একটু আলাদা। প্রাতের স্নিগ্ধ সমীরণ, সন্ধ্যা নদীর কুলুকুলু ধ্বনি, পাখির কিচিরমিচির কূজন, ফুলের সুবাস সব কিছু আকৃষ্ট করতো চৌদ্দ বছরের এই কিশোরের মন। শ্রেণীতে শিক্ষক যখন পড়াতেন তখন তার মনের কোণে দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় চিত্র ভেসে বেড়াতো। এভাবে নিজের অজান্তে আব্দুল গনী হয়ে ওঠেন দেশপ্রেমিক।
১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালীন সময় অত্র এলাকার যুবকরা মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার জন্য প্রতিদিন বিকেলে বিদ্যালয়ের মাঠে মিলিত হতো। বিশ্বস্ত আব্দুল গনীর সামনে তারা আলাপ আলোচনা করতো। গনী একদিন বলে বসলো আমিও যুদ্ধে যাবো।
বড়দের কাছ থেকে উত্তর এলো তুমি অনেক ছোট। যুদ্ধে যাওয়ার বয়স হয়নি তোমার। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে রক্ত টগবগ করে ওঠে তার। জাতীয় সঙ্গীতের নিবেদন ও সুরের মূর্ছনায় ব্যাকুল হয়ে ঘর ছেড়ে পথে নামে এই কিশোর আব্দুল গনী।
সারাদিন প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম গুছিয়েছে অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া আব্দুল গনী। সন্ধ্যার আঁধার কাটলেই মাকে বলল,
মা যাই !
মা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
এই রাতের বেলা কই যাও বাবা?
মুক্তিযুদ্ধে।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মা ছেলের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। সাত রাজার ধন এক মানিক। এখনো নিজের হাতে খেতে পারে না ঠিকমতো। সে যুদ্ধের কী বেঝে?
রাত ৮টার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের বহনকারী নৌকাটি যখন ছাড়বে ঠিক তখন আব্দুল গনী লাফিয়ে নৌকায় উঠলো। নৌকায় অবস্থানরত সবাই একযোগে বলে উঠলো,
আমরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে যাচ্ছি।
তুমি এক বাবার এক ছেলে তার উপরে অনেক ছোট। তুমি কোথায় যাবে? তুমি বাড়ি ফিরে যাও।
এই কথা বলে তাকে নৌকা থেকে নামিয়ে দেয়ার জন্য খুব টানাটানি করলো। কিন্তু দৃঢ় মনোবলের অধিকারী গনী নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলো। এভাবেই তার যুদ্ধ জয়ের যাত্রা শুরু।

ব্যবসায়ী বাবা মোঃ শফিজ উদ্দিন বেপারী ও মা শহরবানুর ঘরে দুই কন্যার পর জন্ম নেয়া একমাত্র পুত্রসন্তান আব্দুল গনী। বাবা তার বাইরের কাজ সেরে রাতে বাড়ি ফিরে দেখেন স্ত্রী কাঁদছেন। কারণ জানতে চাইলে স্ত্রী শহরবানু হাউমাউ করে কেঁদে বললেন গনী নেই, সে চলে গেছে। বাবার বুঝতে আর বাকি রইলো না ছেলে কোথায় গেছে। তিনি দৌড়ে নদীর পাড়ে গেলেন। ততক্ষণে নৌকা ঘাট ছেড়ে চলে গেছে দৃষ্টির অগোচরে।
পয়সারহাট পৌঁছাতে পৌঁছাতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা একশ ছুঁয়ে গেলো। মা, বোন, দুলাভাইয়ের কাছ থেকে চেয়ে নেয়া সামান্য কয়টা টাকা আর কাপড়চোপড় ভরা ছোট্ট একটি ব্যাগ আব্দুল গনীর সঙ্গী। পয়সার হাট, গোপালগঞ্জ, নড়াইলের কালিয়া হয়ে মধুমতী নদী পার হয়ে ওপারে উঠলো মুক্তিযোদ্ধার দল। সেকান্দার ও ছত্তার নামের দুইজন যুবক ভাগাভাগি করে গনীর ব্যাগটি বহন করলো। চারদিন একটানা হেঁটে তারা সীমান্তে পৌঁছালো। যে রাস্তাটি পার হয়ে ভারতে যেতে হবে ওখানে সব সময় পাক বাহিনীর আনাগোনা। অতঃপর ভারতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পৌঁছে যেতে সক্ষম হলো তারা।

ভারতের অশোক নগরে বাংলাদেশিদের ক্যাম্পে গিয়ে দেখা হলো মতিন নামে কমিউনিস্ট পার্টির একজন নেতার সাথে। তিনি আব্দুল গনীর সম্পর্কে বেয়াই হন। গনীকে দেখামাত্র তিনি চিৎকার দিয়ে উঠলেন,
তুমি ছোট মানুষ, এক বাপের এক ছেলে যুদ্ধে এসেছো কেন? তুমি বোঝো যুদ্ধ মানে কি? যুদ্ধ মানে মরণ খেলা।
তিনি আব্দুল গনীর হাতে ভারতের পঞ্চাশ রুপি দিয়ে বললেন যাও তবে সাবধানে থেকো। সাথে লোকদের বলে দিলেন তাকে যেন দেখেশুনে রাখে।
অতঃপর আব্দুল গনী ট্রেনিং সেন্টার অবধি পৌঁছে যেতে সক্ষম হলো। তাকে দেখে ভারতীয় কমান্ডার জনাব আলমানি বললেন,
এতটুকুন বাচ্চা ছেলে যখন যুদ্ধে এসেছে এ দেশ স্বাধীন না হয়ে পারে না।
সকালে দু’টি রুটি ও এক কাপ চা খেয়ে ট্রেনিং শুরু হতো। ছোট বলে সবাই তার দিকে আদরের দৃষ্টি নিয়ে তাকালেও দৃঢ় মনোবলের কিশোর আব্দুল গনী সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে একজন যোগ্যতাসম্পন্ন যোদ্ধা মনে করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পিচ ঢালাই রাস্তার উপরে ট্রেনিং চলছিলো। সেদিন তাদের রাইফেলসহ ট্রেনিং শুরু। সবার হাতে রাইফল পৌঁছে গেলো। কুইক মার্চ বলার সাথে সাথে রাইফেলের ভারবহন করতে না পেরে ছোট্ট গনী রাস্তার উপর লুটিয়ে পড়ে। এবং হাতের কনুই পায়ের হাঁটুর চামড়া ছিলে গিয়ে আহত হন। তাকে থামতে বলা হলেও তিনি থামেননি। অবশেষে তার ভাবির ভাই শহীদুল ইসলাম রাইফেলটি তুলে নেন এবং আব্দুল গনী খালি হাতে ট্রেনিং করেন।

বিহার ক্যাম্পের চারিদিকের নির্বিঘেœ বিচরণরত বিষাক্ত কেউটে সাপগুলো তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। একুশ দিন কঠোর পরিশ্রমের পর তারা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। শুরু হলো যুদ্ধযাত্রা।
যে হাতে পেন্সিলের ছোঁয়ায় কাগজে ফুটে উঠতো সবুজ বনবনানী, নীল আকাশে ডানা মেলা পাখি, আর রংবেরঙের ফুল। দেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করতে সেই হাতে আজ অস্ত্র তুলে নিলেন এই কিশোর বাঙালি বীর।
শুরু হয় দেশ রক্ষা করার ব্রত নিয়ে পথ চলা। ভারতের বাগুন্দিয়া ক্যাম্পে সাতদিন থাকার পর বাংলাদেশে প্রবেশের পর নয় নম্বর সেক্টরে মেজর এম এ জলিলের বাহিনীতে যুক্ত হন তিনি। শুরু হয় একের পর এক যুদ্ধ পরিচালনা।
কখনো সম্মুখযুদ্ধ, কখনো ব্রিজ ভাঙার জন্য এক্সপ্লোসিভ লাগানো, কখনো আবার মাইন পুঁতে রাখা। সব কাজ রাতের আঁধারেই করতে হয়। পথ চলার জন্য কখনো রাস্তায় উঠতে পারতেন না মুক্তিযোদ্ধারা। জঙ্গলে জঙ্গলে হেঁটে হেঁটে মশা, বিচ্ছু, সাপ উপেক্ষা করে সমস্ত দায়িত্ব পালন করে যান দলনেতার আদেশে। সাতক্ষীরা, কলারোয়া, ঝাউডাঙ্গাসহ বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এই যোদ্ধা।

যুদ্ধবিরতি হলে দেশের জন্য প্রাণ বিলানো বীর বন্ধুদের লাশ কাঁধে বহন করে নিয়ে পরম যতেœ দাফন দিতেন মুক্তিযোদ্ধারা। আব্দুল গনীও সব সময় সকল কাজে অংশ নিতেন। বুকের গহিনে লুকানো বেদনা বাইরে প্রকাশের কোনো অবকাশ ছিলো না। কারণ দেশমাতাকে শত্রুমুক্ত করতেই হবে।
ভাতের সাথে মিশে থাকা কঙ্করগুলো পাতলা ডালে ডুবিয়ে মুখে তুলে দিতে কখনোই দ্বিধান্বিত হননি এই কিশোর যোদ্ধা। বরং প্রতিশোধের নেশায় মনের জোর বেড়ে গেছে বহুগুণ।
পর্যায়ক্রমে সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা, চুপনগর ও শাহপুর স্কুল ক্যাম্প ছিলো তাদের সর্বশেষ অবস্থান। শাহপুর থেকে মিত্র বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে বীরদর্পে সামনে এগিয়ে চলেন যোদ্ধারা। একের পর এক এলাকা স্বাধীন হওয়ার খবর আসতে থাকে। আশপাশে পড়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের লাশের বহর দেখে সেদিন কেঁদে উঠেছিলো কিশোর আব্দুল গনীর কোমল প্রাণ। শুধু মৌনতার আবরণে সকল বেদনা লুকিয়ে রেখেছিলেন আপন হৃদয়ে। লক্ষ ছিলো একটাই স্বাধীনতা। অতঃপর খুলনায় এসে যুক্ত হলেন ক্যাপ্টেন সেলিমের সাথে।

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে। নীল গগনে পত পত করে উড়তে থাকে স্বাধীন দেশের পতাকা। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে গৌরাবান্বিত হয় সমগ্র বাঙালি জাতি। কিন্তু খুলনা তখনো শত্রুমুক্ত হয়নি। খুলনা মুক্ত হওয়ার পর সেখানে অবস্থানরত সকল মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্রসহ সুন্দরবন যাওয়ার আদেশ করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই সম্মিলিতভাবে তা প্রত্যাখ্যান করে এবং যার যার অস্ত্রসহ বাড়ির দিকে রওনা হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। অবশেষে তারা তিনটি বড় নৌকায় (ঘাসি নৌকা) মেশিনগান, স্টেনগান, রাইফেল গ্রেনেডসহ বিপুল পরিমাণে গোলাবারুদ বোঝাই করে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জনাব জাহিদ হোসেন শহীদের সাথে সাতচল্লিশজন মুক্তিযোদ্ধাসহ এক সঙ্গে সন্ধ্যা নদীর বুক চিরে বীরদর্পে এগিয়ে আসেন আপন ঠিকানায়।
বিজয়ের স্বাদ আর বিজয়ী সন্তানের মুখ দুই প্রাপ্তির সুখটুকু উপভোগ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন এই কিশোর যোদ্ধা আব্দুল গনীর মমতাময়ী মা ও বাবা।

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গনী নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে আবার বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করেন। স্কুলের শিক্ষকগণ তাকে নিয়ে গর্ব করতেন। এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীরা তার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকতো। একজন বীর হিসেবে তার সুনাম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। ধীরে ধীরে স্বাধীন বাংলায় একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার সম্মানে সম্মানিত হয়ে গৌরবময় জীবন যাপন করেন তিনি।
ব্যাংকের একজন দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে নিজের কর্মজীবন শেষ করে এখন অবসরে আছেন এই বীর। বর্তমানে তিনি ঢাকায় ১৫০৩ দক্ষিণ ধনিয়ার মিনাবাগে বসবাস করেন। তিনি দুই কন্যা ও এক পুত্রসন্তানের জনক। কিশোর যোদ্ধা বীর আব্দুল গনীর কৃতিত্বে আমরা গর্বিত। তাই আমরা তাকে শ্রদ্ধাভরে স্যালুট জানাই।

Share.

মন্তব্য করুন