কারেন্ট চলে যেতেই সুহা-শাহান চিৎকার জুড়ে দেয়, ‘নানা নানা কারেন্ট চলে গেছে। এখন কি হবে? শাহান বারান্দার ওপাশে খেলছিল। সে তো প্রায় কান্না কান্না ভাব তুলে বলে, ‘আমার তো ভয় করছে নানা।’
শাহান-সুহার আম্মু তো রান্নাঘর থেকেই আওয়াজ তোলে, ‘মা মা আমার মোবাইলটা দিবে একটু; না হলে টর্চটা দাও। রান্না আর একটু বাকি আছে।’
পাশের রুম থেকে সুহার নানী জবাব দেন, ‘চুলাটা বন্ধ করে দে তো মা।’
সুহা আবারও চেচামেচি করতে থাকে, ‘কি পচা তোমাদের বাড়ি। কারেন্ট গেলে তো একদম অন্ধকার। আমাদের বাসায় তো আইপিএস আছে। আমরা বুঝতেই পারি না কখন কারেন্ট এলো কি গেল! ইশ কি সুন্দর কার্টুন ছবিটা দেখছিলাম। পিংকুটা তো সবে মাত্র সুন্দরবনে ঢুকলো। আহা কত কি হিং¯্র প্রাণীর সাথে তার মোকাবিলা! জলে কুমির ডাঙায় বাঘ। ওদের ফাইট দিয়ে বানরের মতো এগাছ-ওগাছ করে বনের শেষ মাথায় সাগর পারে চলে যায়!’
নানা বারান্দায় গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে। এদিক-ওদিক টর্চ মেরে নানা বাইরে দেখছেন। সুহা-শাহীন বারান্দায় নানার কাছে চলে আসে। সুহা বলে, ‘নানা একটা ব্যবস্থা করো না প্লিজ। বিদ্যুৎ অফিসে ফোন করো জলদি। নানা হাতের টর্চ বন্ধ করে বলেন, তোমরা উপভোগ কর। অন্ধকারকে দেখ- চোখ বড় বড় করে তাকাও গাছের দিকে, আকাশের দিকে।’
কদিন আগেই ওরা নানা বাড়ি বেড়াতে এসেছে গ্রীষ্মের ছুটিতে। নানার সাথে দিনভর ঘুরে-ফিরে গাছ-গাছালি দেখে, পুকুর দেখে, নারকেল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ডাব খায়, পুকুরে গোসল করে নানার সাথে। নাান পাখ-পাখালির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। শালিক, দোয়েল, মুনিয়া, টুনটুনি- হঠাৎ হঠাৎ ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া পাখি উড়ে যায় ওদের মাথার উপর দিয়ে। ঝিম ধরে জলাভূমির কিনারে দাঁড়িয়ে থাকে বক। গাছ-গাছালির সাথে নানা পরিচয় করিয়ে দেয় মজা করে- বলে কিনা এটা আঁঠালো গাছ। সুহা বলে, ‘চিনি তো, ওটা কাঁঠাল গাছ। এই তো কাঁটা কাঁটা গা ভরা গোলগাল কাঁঠাল কি সুন্দর ঝুলে আছে গাছে।’

গতকালই নানু একটা পাড়া কাঁঠাল ভেঙে দিয়েছে। শাহীন তো কাঁঠালের আঁঠা হাতে লাগিয়ে ঝট করে দূরে সরে যায়। এক হাত থেকে দু’হাত শেষে মায়ের শাড়ির আঁচলে কাঁঠালের আঁঠা লাগিয়ে সে কি কাণ্ড। তারপর বলে, ‘ওসব আমি খাবো না, শেষে না আবার পেটে আটকে যায়।’ নানু তো হেলে কুটিকুটি।
‘কি বলে আমার শাহীন ভাইয়া। শাহীন তো এখনো স্কুলেই যায়নি। মায়ের কাছে অ-আ, এ-বি-সি-ডি পড়ে।’
‘নানা শুনে তো মহারাগ, বলে কি শাহীন। কাঁঠাল কি কারো পেটে আটকে থাকে।’ নানার কথা শুনে ও দু’হাত পিছিয়ে যায়।
নানা গম্ভীর হয়ে বলেন, কাঁঠাল হলো আমাদের জাতীয় ফল। জাতীয় ফল না খাওয়া মানে জাতীয় ফলের অবমাননা। আর সে অবমাননা হলো শান্তিযোগ্য অপরাধ। আর সে অপরাধের জন্য শাস্তি পেতে হবে তোমাকে।

রান্নাঘর থেকে সুহার আম্মুর কথা শোনা যায়।
‘মা মা টর্চটা দাও না, রান্নাটা সেরে ফেলি।’
সুহার নানু অন্ধকারে রুমে বসে আছেন, জায়নামাজে। আম্মুর উদ্দেশ্যে বলেন, চুলাটা বন্ধ করে চলে আয় না। রান্না পরেও করা যাবে।’

সুহা নানার অবস্থান বুঝে প্রশ্ন করে নানা, ‘বলো না কারেন্ট কখন আসবে?’
‘এসে যাবে, বারান্দায় চলে আস, এখানে বাতাস আছে। একটু আলোও পাবে।’
নানা একটু এগিয়ে এসে টর্চ মেরে সুহা-শাহীনকে দেখেতে পেয়ে বলেন, ‘এককাজ করো, চলো আমরা ছাদে যাই, উপভোগ করি।’
‘কি উপভোগ করবো নানা?’
‘এই যে আলোহীন গ্রাম, আকাশের ঝলমলে তারকারাজি- দেখবে সারা আকাশ জুড়ে তারার মেলা! তোমরা তো শহরে থাক, আকাশ দেখো না, আকাশের তারাকারাজি যে কতসুন্দর, অন্ধকারে খুউব করে দেখা যায়, বোঝা যায়। ঝাড়বাতি, মানে সারা আকাশ জুড়ে ঝাড়বাতির মেলা।’
সুহা ‘গুড আইডিয়া’ বলে, শাহীনকে বলে- ‘চল ভাইয়া, নানার সাথে ছাদে যাব।’ শাহীন শুরুতে একটু মোচড় দিলেও শেষাবধি রাজি হয়। কারণটা সারা ঘরের মধ্যে নানার হাতেই শুধু আলো। আলো মানে টর্চের আলো।
নানা সিড়িতে টর্চের আলো ফেলে বলেন, দেখবে দূরাকাশে কিভাবে তারকারা পিট পিট করে নিচে তাকিয়ে আছে। এখনতো অমাবশ্যা, মানে ঘোর অন্ধকার। খুউব ভালভাবে আমরা আকাশের তারা গুনতে পারবো।
নানা বলেন, ‘তোমরা সিড়ির গোড়ায় একটু দাঁড়াও, আমি একটা পাটি নিয়ে আসছি। ছাদে পাটি বিছিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে আমরা তারা গুনবো।’
সুহা চিৎকার করে বলে, ‘পেয়েছি নানা, পেয়েছি। তুমি তো আগে স্কুল মাস্টার ছিলে, আমার বিজ্ঞান বইতে মহাকাশ চ্যাপ্টার আছে। চল চল আমরা মহাকাশ দেখবো আর তোমার কথা শুনবো।’
নানা ছাদের মাঝখানে পাটি বিছিয়ে ওদের বসতে বলেন। সুনশান নীরবতা। শুধুমাত্র ঝিঁঝিঁ পোকার সুর শোনা যাচ্ছে। সামনে টর্চ মেরে রাস্তায় দু’একজনের চলাচল দেখা যায়। সারা আকাশ যেন ঢাকনির মতো ওদের ঢেকে রেখেছে। আকাশজুড়ে তারার মেলা। পিটপিট করে ওদের দেখছে যেন।
নানা বলেন, ‘এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকো আকাশে। সুহা, শুনতে থাক একদিক থেকে।’ সুহা কতোক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, ‘নানা, অসম্ভব! এত এত তারা গোনা যাবে না। আচ্ছা নানা, বলো তো মহাকাশ কী?’
‘মহাকাশ! আচ্ছা, তার আগে বলো পদার্থ কাকে বলে?’
‘পদার্থ! সহজ কথা, যার ওজন আছে আয়তন আছে তাই তো পদার্থ।’
নানা বলেন, ‘গুড, ভেরিগুড। তবে শোন, মহাকাশ কিন্তু কোন পদার্থ নয়। বলতে পারো ফাঁকা জায়গা বা ফাঁকা অঞ্চল। যে অঞ্চল দিয়ে পৃথিবী, চাঁদ সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্র চলাচল করেন।’
‘তাই বুঝি?’
শাহীন আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘নানা, আকাশের তারাগুলো কি করে পড়ে না? আমাদের গায়ে পড়লে তো…।’ ‘দু’একটা তো পড়বেই, কিন্তু তোমার ভয়ের কারণ নেই। ওগুলোর খণ্ডাংশ যদি ঝরে পড়ে তবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করলেই জ¦লে যায়। কিছু অবশ্য পৃথিবীতে পড়ে, ওগুলোকে বলে উল্কাপিণ্ড।’
সুহা প্রশ্ন করে, ‘নানা, মহাকাশ কত কত উপরে?’
‘বিজ্ঞানীরা অবশ্য এর একটা কাছাকাছি পরিমাপ দিয়েছেন। মহাকাশ সবুজ সমতল হতে ১০০ কি.মি অর্থাৎ ৬২ মাইল উচ্চতায় অবস্থিত। ঐ উচ্চতার নামকরণ করেছেন কার্মান রেখা এবং সেখান থেকেই মহাকাশ শুরু।’
সুহা আবার প্রশ্ন করে, ‘নানা, মহাকাশ অনুসন্ধান কি?’
‘খুবই মজার কথা। শত শত বছর ধরে জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা মহাকাশ নিয়ে গবেষনা করে যাচ্ছেন। মানুষের মহাকাশ সম্পর্কে জানার প্রয়াসকেই মহাকাশ অনুসন্ধান চলে। শত শত বছর ধরে জ্যোতির্বিদ্যার দূরবীক্ষন যন্ত্রের সাহায্যে এ পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে দূরবীক্ষনের পাশাপাশি মানবিক অনুসন্ধান অর্থাৎ মহাকাশযানের সাহায্যে এ অনুসন্ধান চালিয়ে বহু অজানা তথ্য উদযাপন করতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।’

মানুষ মনুষ্যবিহীন রকেটে করে মহাকাশ গবেষনা করে যাচ্ছে। আবার মহাকাশযান লাখ লাখ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে নানান তথ্য ও ছবি পৃথিবীতে পাঠিয়ে নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
‘নানা, তুমি তো দেখি সবই জানো।’
‘খুব মজা লাগছে, তাই না সুহামনি?’
‘দারুণ। নানা, আচ্ছা বলো তো মহাকাশের দূরত্ব মাপা হয় কীভাবে?’
‘তুমি নিশ্চয়ই জান, আলোর গতি কি? যে গতিতে আলো উৎপত্তি স্থল থেকে বেরিয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীদের মতে, আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে ১,৮৬,০০০ মাইল। মহাকাশের ব্যাপ্তি এত বিশাল যে এর হিসাব মাইল বা কিলোমিটারে মাপা সম্ভব নয়।’
মহাকাশের দূরত্বের হিসাব হলো আলোকবর্ষে। অর্থাৎ সেকেন্ডে ১,৮৬,০০০ মাইল বেগে এক বছরে আলো যেখানে পৌঁছায় তাকে আলোকবর্ষ হিসাব বলে। সে হিসেবে এক আলোকবর্ষের দূরত্ব ৫ লাখ ৮৭ হাজার কোটি মাইলের সমান। অর্থাৎ ৯ লাখ ৮৬ হাজার কোটি কিলোমিটার আমাদের প্রতিবেশী চাঁদ, সূর্য মহাকালের অংশ বিশেষ। সূর্যের দূরত্ব পৃথিবী থেকে ৯ কোটি ৮৬ লক্ষ মাইল দূরে, কিলোমিটারের হিসেবে প্রায় পনের কোটি কিলোমিটার। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে মাত্র ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড।’
সুহার প্রশ্ন, ‘আচ্ছা নানা, আকাশ কেন নীল দেখায়?’
‘আসলে আকাশ নীল নয়। পৃথিবীতে যে সূর্যালোক এসে পৌঁছায়, তার সাথে বায়ুমণ্ডলের ধূলিকণার মিশ্রনে নীলরঙ তৈরি হয়। বায়ুমণ্ডলের উচ্চতা পৃথিবী থেকে ১৬০ কিলোমিটার। বায়ুমন্ডলের উচ্চতা পৃথিবী থেকে ১৬০ কিলোমিটার। বায়ুশূন্যতায় কিন্তু কোন জিনিসের ওজন থাকে না। মানুষ সেখানে গেলে শূন্যে ভাসতে পারবে, হাঁটতে পারবে, শূন্যে লাফাতেও পারবে। আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, বায়ুমণ্ডলের উপর থেকে আকাশকে কিন্তু কালো দেখায়। পৃথিবী যে গোলাকার বস্তু তা পৃথিবী থেকে ৫০ থেকে ৭০ মাইল উপর থেকে চমৎকারভাবে দেখা যায়। মানুষ আগে ভাবতো মহাকাশের সীমারেখা আছে। বর্তমান গবেষনায় জানা যায়, মানুষের দৃষ্টিসীমা এমনকি বিচরণক্ষমতার বাইরেও অনেক গ্রহ, নক্ষত্র, ধুমকেতু, গ্যাল্যাক্সি রয়েছে। জীববৈচিত্রে ভরা আমাদের এই পৃথিবী। সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মি থেকে আমাদের রক্ষা করে বায়ুমণ্ডলের এমন একটি স্তর, যাকে ওজোনস্তর বলে। এ স্তরের শুরু ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০ থেকে ৫০ কিলোমিটার ওপরে। সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির ৯৯ শতাংশ এ ওজোনস্তর শোষন করে নেয়। তা না হলে পৃথিবীও বসবাসের উপযোগী হতো না। যেমন আজ পর্যন্ত কোন গবেষনার প্রমাণিত হয়নি যে মহাকাশের কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে।’
সুহা আশ্চর্য হয়ে যায়। বলে, ‘নানা, তুমি এত কিছু জান!’
শাহীন এত কিছু বোঝে না। ও তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে। নানা বলেন, ‘তোমরা নিশ্চয় জানো, পৃথিবীতে নানান রকমের জ¦লানি ও রাসায়নিক প্রভাবে গ্রীনহাউস গ্যাসের প্রভাব সৃষ্টি হয়। গত শত বছরে কলকারখানা ও গাড়ির জ্বালানি পরমাণু বোমার গবেষনায় নানাভাবে উৎপাদিত গ্যাসের প্রভাবে পৃথিবীর ওজোনস্তর ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে পৃথিবীর জীববৈচিত্র এবং মানবকুলের বসবাসের জন্যও হুমকির সম্মুখীন। মহাজগতের ব্যাপ্তি এত বিশাল যে এর শেষ নেই। প্রতিনিয়ত এর পরিধি বাড়ছে। সূর্যের পরে আমাদের কাছের নক্ষত্রের নাম প্রক্সিমা সেন্টিারিই। সেখান থেকে আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে সময় লাগে ৪.২৫ বছর। এবার বোঝ কত দূরে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান!’
এরই মধ্যে কারেন্ট চলে আসে। শাহীন ‘হুররে’ বলে লাফিয়ে ওঠে। পাশের বাড়ির ছেলে-মেয়েদের উল্লাস শোনা যায়।

Share.

মন্তব্য করুন