চন্দ্র বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছি আমরা দু’বছর আগে। আর্মস্ট্রং ও অলড্রিনসহ মোট বারোজন মহাকাশচারী আজ পর্যন্ত চাঁদে পা রাখার গৌরব অর্জন করেছেন। এখন চলছে পৃথিবীর আরেক প্রতিবেশী মঙ্গল গ্রহ জয়ের তোড়জোড়। সেই ১৯৬৪ থেকেই চলছে বিরামহীন প্রচেষ্টা মানুষের। মঙ্গলে মানুষ এখনও পা রাখতে না পারলেও রোবটকে পাঠাতে পেরেছে। প্রথম প্রথম নভোযানগুলো মঙ্গলের কাছাকাছি ভিড়ে ছবি পাঠাতে থাকে। সেসব মনুষ্যবিহীন নভোযানগুলোর পাঠানো ছবি নিয়ে পৃথিবীবাসী কতো না আপ্লুত ছিলো, কতো না স্বপ্ন বোনা-এখন, মানুষ না হলেও রোবট মঙ্গলে নেমে ছবি পাঠাচ্ছে, তথ্য পাঠাচ্ছে প্রতিদিন। সেসব খবর জানতেই বক্ষ্যমাণ প্রতিবেদনটি। একটা খুশির খবর আগেই জানিয়ে রাখছি, মঙ্গলের ভূমি কিন্তু কেনা শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশী এক যুবকও একখণ্ড জমি ক্রয় করেছে। তার মানে মঙ্গল জয়ের উদ্দেশ্য- পৃথিবীর মানুষ সেখানে বসবাস করবে। সেটা কি সম্ভব হবে? সে বিষয়ও আমরা এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য ও ছবির আলোকে যাচাই করতে পারি।

মঙ্গল জয়ের অভিযানে আগে এককভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ‘নাসা’ (ঘঅঝঅ-ঘধঃরড়হধষ অপৎড়নধঃরপং ধহফ ঝঢ়ধপব অফসরহরংঃৎধঃরড়হ) ছিল এগিয়ে। তারাই বিভিন্ন সময় পৃথিবীবাসীকে মঙ্গল সম্পর্কে নানা তথ্য ও ছবি দিয়ে আসছিল। বিগত বছরেও মার্স-২০২০ নামে অভিযান (পার্সিভিয়ারেন্স) মঙ্গলে পাঠিয়ে নানা তথ্য ও ছবি পৃথিবীবাসীকে ওই গ্রহ সম্পর্কে জ্ঞাত করেছে এবং করছে। কিন্তু মঙ্গল অভিযানের কৃতিত্বে আরেকটি দেশ ভাগ বসিয়েছে অতি সম্প্রতি। তারা হলো- চীনাম্যান। শি জিন পিংয়ের দেশ চীনারাই দ্বিতীয় দেশ যারা মঙ্গলে গত ২০ মে (বেইজিং এর সময় রোববার সকালে) কথিত লাল গ্রহে ‘ঝুরং’ নামের রোবটটি মঙ্গলে নামাতে সমর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয় ঝুরংকে দিয়ে চীনারা উল্লেখযোগ্য সময় মঙ্গলে কাজ করাতে পেরেছে। ঝুরং এখন নাসার প্রেরিত পার্সিভিয়ারেন্সের প্রতিবেশী। ঝুরং কাজ করছে মঙ্গল গ্রহের উত্তর দিকে বিস্তীর্ণ এলাকায়। এতে কিন্তু একটি সুরক্ষাধর্মী ক্যাপসুল, একটি প্যারাসুট ও একটি রকেট প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। ‘ঝুরং’ শব্দের অর্থ ‘আগুনের দেবতা’। তিয়ানওয়েন-১ নভোযানে করে মঙ্গলে পাঠানো হয়েছে এ রোবটটি গত ফেব্রুয়ারিতে মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশ করে তিয়ানওয়েন-১। উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালের পর থেকে নাসা ছাড়া আর কোনো মহাকাশ সংস্থা মঙ্গলে অবতরণে সফল হয়নি।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে- ঝুরং নামের রোভার রোবটটির ছয়টি চাকা আছে। এটি এখন মঙ্গলের উত্তরাঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় আছে।
কাজেই চীনাম্যানরা পৃথিবী নামক গ্রহে শুধু নয় মঙ্গলেও মার্কিনিদের টেক্কা দিতে হাজির হয়েছে। কেন এ-ই পাল্লাপাল্লি- পরে বলছি। এখন আমরা দেখি এই দুই রোবট আমাদের জন্য কী কী তথ্য ও ছবি পাঠিয়েছে।
আগেই বলেছি, চীনাম্যানদের আগে ২০২০-এ মঙ্গল অন্বেষণের কার্যক্রম হিসাবে রোভার অভিযান পরিচালনা করে নাসা। যার মধ্যে রয়েছে পার্সিভিয়ারেন্স এবং ইনজেনুয়িটি হেলিকপ্টার ড্রোন। এটি ৩০ জুলাই ২০২০-এ ইউটিসিতে উৎক্ষেপিত হয় এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১-এ মঙ্গলের জিযেরো গহ্বরের ভূমিতে অবতরণ করে।
পার্সিভিয়ারেন্স মঙ্গলে জ্যোতির্জীব বিজ্ঞান সংক্রান্ত অর্থাৎ আদিতে সেখানে জীবের অস্তিত্ব ছিল কি না এবং ভবিষ্যতে জীব বসবাসের সম্ভাবনা কতটুকু ইত্যাদি নিয়ে জরিপ করবে। তথ্য ও ছবি পাঠাবে।
পার্সিভিয়ারেন্স রোবটটি কিন্তু কাজ করেই চলেছে। মঙ্গল গ্রহের ছবি ও নানা তথ্য ইতোমধ্যে পাঠিয়ে পৃথিবীবাসীকে অবগত করাচ্ছে সর্বশেষ পরিস্থিতি। এসব ছবি ও তথ্য কী বলছে তা একটু দেখা যাক।

পার্সিভিয়ারেন্স
রুদ্ধশ^াস অপেক্ষার পর নাসার মহাকাশযান পার্সিভিয়ারেন্সের রোবট সফলভাবে মঙ্গল গ্রহের বুকে নেমে সেখান থেকে ছবি পাঠাতে শুরু করেছে। উল্লেখ্য, মঙ্গল অভিযান ছিল মানবজাতির জন্য কঠিনতম এক চ্যালেঞ্জ। কতো অভিযান এ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে তার কোন হিসাব নেই। কতো মহাকাশযান মহাশূন্যে উড়তে উড়তে ধ্বংস হয়েছে মাঝ পথে-কতো হারিয়ে গেছে তা কেউ বলতে পারে না। অন্তত ৫৬ অভিযানের অর্ধেকই ব্যর্থ হয়ে গেছে মহাশূন্য। কিন্তু কোন দেশ তা স্বীকার করে না। স্বীকার করলে মহাকাশ অভিযান সম্পর্কে হতাশা জন্মাবে মানুষের। কোটি কোটি ডলার খরচও এক, বড় বিষয়। সব দেশের পক্ষে এতো বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচের সামর্থ্যও নেই। তবু অভিযান থেমে নেই।
যা হোক ছয় চাকার নভোযানটি মঙ্গল গ্রহের বিষুব অঞ্চল, যার নাম জেযেরো, তার কাছে গভীর এক গহ্বরে যখন নামানো হয়, উল্লাসে ফেটে পড়েন ক্যালিফোনির্য়ার মিশন কন্ট্রোলের বিজ্ঞানীরা। আগামী দু’বছর পার্সিভিয়ারেন্সের এ রোবটটি মঙ্গল গ্রহে অবস্থান করবে।

নাসার বিজ্ঞানীরা জানালেন, রোবটটি জেযেরোর ব-দ্বীপের মত চেহারার একটি অংশের দুই কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবতরণ করার এলাকাতেই অনুসন্ধান কাজ চালাবে। পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার চওড়া জেযেরোর নামকরণ করা হয় বসনিয়া-হার্জেগোভিনা শহরের নামে। নব্বইয়ের দশকে সমাজতান্ত্রিক দেশ বুলগেরিয়া ভেঙে যাওয়ায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটি বিশে^র মানচিত্রে স্থান লাভ করে। স্লাভিক অঞ্চলের কোন কোন দেশের ভাষায় ‘জেযেরো’ শব্দের অর্থ হলো- হৃদ। জেযেরোতে বিভিন্ন ধরনের পাথর রয়েছে। যার মধ্যে মাটি পাথর এবং কার্বোনেটস। বিজ্ঞানীদের উৎসাহের কারণ হলো, এ ধরনের পাথরের যে কোন রকম অণুজীবের অস্তিত্ব সংরক্ষণের ক্ষমতা রয়েছে। ফলে সুদূর অতীতে এ গ্রহে যদি প্রাণের অস্তিত্ব থেকে থাকে, তাহলে এই পাথরে তার ইঙ্গিত মেলার আশা। প্রাচীন হৃদের যেটা তীর ছিল, সেখানে পলির মত যে সেডিমেন্ট রয়েছে- যাকে বলা হচ্ছে ‘বাথটাব রিং’। বিজ্ঞানীরা সেটা বিশ্লেষণ করতে বিশেষভাবে আগ্রহী। পৃথিবীতে যেটাকে স্টোমোলাইট বলা হয়, এখানে তার সন্ধান চালাবে পার্সিভিয়ারেন্স।

বর্তমানে মঙ্গল গ্রহের আবহাওয়া, বেঁচে থাকার অনুকূল নয়। সেখানে আবহাওয়া এতই ঠাণ্ডা যে পানি সেখানে তরল অবস্থায় থাকতে পারে না। বায়ুমণ্ডলও এতই পাতলা যে চড়া আলোকরশ্মিও বিকিরণ মাটির উপরিভাগের সবকিছু ধ্বংস করে ফেলে। কিন্তু সবসময় মঙ্গলের পরিবেশ এমনটা ছিল না। সাড়ে তিনশ কোটি বছর কিংবা তারও আগে সেখানে পানি প্রবাহ ছিল, তার ছাপ এখনও গহ্বরের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়। ক্ষতিকর বিকিরণ ঠেকানোর জন্য আবহাওয়া মণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘন আস্তরণও ছিল। প্রাণের অস্তিত্বের জন্য পানি গুরুত্বপূর্ণ, তাই মনে করা হয় মঙ্গলে এক সময় জীবন ছিল।
পার্সিভিয়ারেন্স অণুজীবের অস্তিত্বের কোনো নমুনা যদি সংগ্রহ করতে পারে, যা মঙ্গল গ্রহে জীবনের অস্তিত্বের ইঙ্গিতবাহী হতে পারে, তা নিয়ে নিঃসন্দেহে অনেক কাটাছেঁড়া হবে- এসব তথ্য প্রমাণের বিশ^াসযোগ্যতা নিয়ে তৈরি হবে নানা বিতর্ক, ঠিক যেভাবে পৃথিবীতে প্রাণের প্রথম অস্তিত্ব নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। চন্দ্র বিজয় নিয়েও আছে নানা কথা। তাই এ গ্রহে অতীত জীবনের অস্তিত্ব নিয়ে বিজ্ঞানীদের নানা গবেষণা ও তথ্য প্রমাণের চুলচেরা বিশ্লেষণ চলবে আগামী বছরগুলোতে।

এদিকে চীনাম্যানদের রোবট ঝুরং মঙ্গলের উত্তরাঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় কাজ শুরু করেছে। ওদিকে পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলে মঙ্গলের জেযেরো নামের হৃদে মিশন চালাচ্ছে নাসার পার্সিভিয়ারেন্স। প্রতিদিন ছবি পাঠাচ্ছে পার্সিভিয়ারেন্স ও ঝুরং। এখনও তেমন কোন আশার কথা মঙ্গল থেকে পাওয়া যায়নি। এমন কিছু প্রতিকূলতা মঙ্গলে রয়েছে যা জীব বসবাসের জন্য উপযুক্ত নয় বলা যায়, অসম্ভব। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন মঙ্গলের আবহাওয়া কৃত্রিম পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা সম্ভব হলে ভবিষ্যতে (?) জীব বাস উপযোগী হতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা মঙ্গলের ‘ধূলিঝড়’। একবার শুরু হলে কয়েক মাস স্থায়ী হয়। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নেই বললেই চলে।
তাই, বলা যায়, মঙ্গলে এখনও তেমন মঙ্গলজনক কিছু পায়নি মানুষের পাঠানো রোবট।

Share.

মন্তব্য করুন