বারোমাসি খালের পাশে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দুই কিশোর বন্ধু বাবু আর তৌফিক। হাতে গুলতি। উদ্দেশ্য পাখি শিকার করা। হেমন্তের ধান কাটা ইতোমধ্যে শেষ। মাঠ খাঁ খাঁ করছে এখন। মাঠের পাশে সরু রাস্তার ধারে দ-ায়মান গাছগুলোত তখন নানা রকমের পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। বাবু পাখি শিকারে অত্যন্ত দক্ষ। নিশানা খুব কমই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় তার। তৌফিক বাবুর মত অতটা দক্ষ না হলেও বাবুর সংস্পর্শে দিনদিন তার অভিজ্ঞতা শাণিত হচ্ছে।

পাখিদের কিচিরমিচির শুনে খুব সন্তর্পণে দুই বন্ধু রাস্তার ধারের গাছগুলোর কাছে চলে এলো। মেহগনি গাছে দুইটি ঘুঘু পাশাপাশি ডালে বসে আছে। ঘুঘু দু’টোকে দেখে বাবুর যেন আর তর সইছে না। মনের ভেতর আনন্দের ঝিলিক দিয়ে উঠল ঘুঘু শিকারের নেশায়। খুব সাবধান এবং শব্দহীনভাবে মাটির তৈরি মার্বেল গুলতির ভেতর সেট করে নিল। তারপর নিশানা ঠিক করে সপাং শব্দে ছুঁড়ে দিল মার্বেলটা। কয়েক সেকে-ের ব্যবধানে চোখের পলকে নিচে পড়ে গেল ঘুঘুটা। মার্বেলটা সরাসরি পাখির বুকে আঘাত করায় পড়ে যায় সাথে সাথেই।

এক দৌড়ে পাখিটার কাছে চলে এলো তৌফিক। বাড়ি থেকে আনা ব্লেডের টুকরো দিয়ে জবাই করে দিল ঘুঘুটাকে। বাবু তার দক্ষ নিশানাতে সারাদিনে আটটির মত পাখি শিকার করল। তারপর সন্ধ্যার দিকে রওনা হল বাড়ির পথে। বটতলা ক্রস করে দক্ষিণমুখী রাস্তায় আসতেই পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদের ইমামের সাথে দেখা। তাদের দু’জনকে দেখে ইমাম সাহেব সালাম দিলেন। বললেন, ‘তোমরা কি পাখি শিকার করতে গিয়েছিলে?’ বলেই তাদের দু’জনের দিকে তাকালেন।
‘জ্বি।’ সমস্বরে বলে চুপ করে থাকল।
‘প্রতিদিনই কি শিকার করতে যাও?’
‘জ্বি।’
‘প্রতিদিনই কি শিকার করার দরকার পড়ে?’
‘না ভাইয়া।’ জবাব দিলো তৌফিক।
তারপর ইমাম সাহেব হাসিহাসি মুখে বললেন, ‘তোমরা কি জানো অকারণে পাখি শিকার করা সম্পর্কে ইসলাম কী বলে? রাসূল (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি অকারণে কোন পাখি শিকার করবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার হিসাব নেবেন। আর আমরা প্রতিদিন যদি এভাবে পাখি শিকার করি, তাহলে প্রকৃতি কি ভালো থাকবে বলো? প্রকৃতির সৌন্দর্য নষ্ট হবে না? ভাইয়ারা, আশা করি তোমরা এরপর থেকে আর অকারণে পাখি শিকার করবে না, কেমন।’
কথাগুলো শোনার পর বাবু আর তৌফিকের চোখ দু’টো ছলছল করে উঠল। চোখের কোণের পানি পড়তে গিয়েও যেন আটকে রইল।

এক ধরনের অপরাধবোধ আষ্টেপৃষ্ঠে তাদের জড়িয়ে ধরল। আসলেই তো তারা ভুল করছে। তাদের তো উচিতই হয়নি কাজটা করা। নিজেরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তারা পণ করল যে তারা আর কখনোই পাখি শিকার করবে না। আর কাউকে করতেও দেবে না। তাদের এই পণ দেখে প্রকৃতি যেন নিঃশব্দে বলে উঠল, এই বুঝি ফিরে এলো ওরা।

Share.

মন্তব্য করুন