‘আহা, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে!
জি হ্যাঁ, আনন্দে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। এ যে অবিশ্বাস্য ঘটনা। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। বারবার দেখছি হাতের চিঠিটা। গাঢ় আকাশি রঙের খামের ভেতরে হালকা আকাশি চিঠি। আহা! কি শান্তি।’
এই চিঠি লিখেছেন রুশ পরিচালক ক্লিম শিপেনকো। তিনি লিখেছেন- মহাকাশে তিনি একটি সিনেমা তৈরি করতে চান, যার নাম ‘দ্য চ্যালেঞ্জ’। এই সিনেমায় কাজ করবেন হলিউডের জনপ্রিয় অভিনেতা টম ক্রুজ। টম ক্রুজের সাথে অভিনয় করার জন্য তিনি আমাকে নির্বাচন করেছেন। আহা! এও কি সম্ভব? ভাগ্যে থাকলে সবই সম্ভব। আমি মহাকাশের নায়িকা! কী অদ্ভুত! কী অদ্ভুত! আনন্দে আমি আত্মহারা। আমার সাথে আরো একজন রুশ নায়িকা কাজ করবেন, তার নাম ইউলিয়া পেরেসিল্ড। তিনি নাকি ইতোমধ্যে মেকআপ ম্যানের, মানে মেকআপ আর্টিস্ট এবং কসটিউম ডিজাইনার হিসেবে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রশিক্ষণ নিয়ে নিয়েছেন। উহ, জনপ্রিয় অভিনেত্রী ইউলিয়া পেরেসিল্ড আমার মেকআপ করবেন! কি ভাগ্যবতী আমি! সত্যি, এ সুখের নেই কোনো সীমানা। এতদিন কেবল ভারতের আলিয়া ভাটের অভিনয় দেখে দেখে নিজেকে আলিয়া ভাট বানাতে চেয়েছি। কখনো আবার পাকিস্তানের সুন্দরী অভিনেত্রী রেহাম খানকে দেখে দেখে রেহাম খান হতে চেয়েছি। তুরস্কের বিখ্যাত অভিনেত্রী ফাহরিয়াকে ফলো করেছি। মনে মনে সবসময় নিজেকে একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী ভাবতে ভালো লাগে, ভীষণ ভালো লাগে। প্রতি সপ্তাহে একটি মুভি দেখি। বিশ্ববিখ্যাত সব মুভি। একই মুভি বারবার দেখি, অভিনয় শিখি। কে কিভাবে কথা বলে, কোন স্টাইলে হাঁটে, কিভাবে চোখের ভঙ্গিমা করে, এ সবই আমি দেখতে থাকি। সত্যি বলতে, অভিনয় শেখার জন্য সবসময় ব্যাকুল থাকি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় করি, একা একা কথা বলি, একা একা গান করি, নাচ করি, সুন্দর করে মেক-আপও করি মাঝে মধ্যে। সুন্দর চেহারা, স্লিম ফিগার, সুন্দর বাচন ভঙ্গি, মার্জিত ও সুন্দর অঙ্গভঙ্গি, অভিনয়ের সুনিপুণ দক্ষতা এ সব কিছু মিলেই তো হতে হয় একজন দক্ষ অভিনেত্রী। আমি বিশ্বাস করি, অভিনয় এক ধরনের শিল্প। শিল্পকর্ম সবসময় মানসম্মত হওয়া উচিত। মানসম্পন্ন শিল্প গড়ে তোলেন একজন সফল শিল্পী বা আর্টিস্ট। একজন অভিনয় শিল্পীকে অবশ্যই সুরুচিশীল ও মার্জিত পোশাক পরিধান করতে হয়। অদ্ভুত ও বখাটে স্টাইল আমি পরিহার করি। এমন কোনো ফ্যাশন করি না যা দৃষ্টিকটু লাগে বা স্কুলের সহপাঠীরা হাসাহাসি করে। এ কারণেই আমার স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং বন্ধু-বান্ধবরা আমাকে খুব পছন্দ করেন। আশা রাখছি, যখন মহাকাশে শুটিং হওয়া প্রথম সিনেমা ‘দ্য চ্যালেঞ্জ’ এ অভিনয় করব তখন গোটা বিশ্বের অনেকেই আমাকে খুব পছন্দ করবেন। এটা আমার স্বপ্ন। স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। আব্বা বলেন, মানুষ যত বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে সে তত বড় হয়। আলহামদুলিল্লাহ, আমি আমার স্বপ্নের সমান বড় হতে চলেছি। বিশ্বের প্রথম কিশোরী অভিনেত্রী মহাকাশ স্টেশনে। কী আনন্দ! কী আনন্দ! আকাশি চিঠিটা হাতে নিয়ে আমি কাঁদছি। চোখ ভর্তি টলমল জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে বেয়ে। একেই বলে আনন্দাশ্রু। আম্মা আমার দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন। উনার দু’চোখ ভর্তি প্রশ্নের ঘনঘটা, তিনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন কী হয়েছে টুকটুক? কে চিঠি লিখেছেন?
আম্মার প্রশ্নের জবাব দিতে পারছি না।
আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। শুধু স্বপ্ন আর স্বপ্ন। মহাকাশে শুটিংয়ের স্বপ্ন। নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন। মহাকাশ ভ্রমণের জন্য প্রশিক্ষণ নেয়ার স্বপ্ন। আমি এখন মহাব্যস্ত। কত কত কাজ করতে হবে। নিজেকে তৈরি করতে হবে। মহাকাশে অভিনয় করতে হলে কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। এসব শর্ত নির্ধারণ করেছে রসকসমস। শর্তগুলো হচ্ছে :
ওজন হতে হবে ৫০-৭০ কিলোগ্রাম।
বয়স হতে হবে ২৫-৪০ বছর।
বুকের ছাতি চওড়া হতে হবে ১১২ সেন্টিমিটার।
সাড়ে তিন মিনিটে ১ কিলোমিটার দৌড়ানোর দক্ষতা থাকতে হবে।
২০ মিনিট ফ্রি স্টাইলে ১০০ মিটার সাঁতার কাটার দক্ষতা থাকতে হবে।
তিন মিটার উঁচু স্প্রিং বোর্ড থেকে জলে ঝাঁপ দেয়ার দক্ষতা থাকতে হবে।

মহাকাশে ভেসে বেড়াচ্ছি!
মহাকাশ স্টেশনে ভরশূন্য অবস্থায় থাকার স্বাভাবিকতায় আমি বিমোহিত, আপ্লুত। আমার সামনে সবকিছু ভাসছে। ওই তো খাবারের চামচ ঝুলে আছে। স্কুলের মাঠে বিস্কুট খেলার প্রতিযোগিতার সময় মুখের সামনে যে রকমভাবে বিস্কুট ঝুলে থাকে, ঠিক সে রকম করে ঝুলে আছে খাবার ভর্তি চামচ। এই খাবার পৃথিবীর অন্য সব সাধারণ খাবার নয়। এটা বিশেষ ধরনের শুকনো খাবার যা তৈরি করেছে রাশিয়া, জাপান এবং আমেরিকা। আমার কাছে মনে হচ্ছে- এ যেন হ্যারিপটারের জাদুর রাজ্য। হাত দিয়ে খপ করে ধরে ফেললাম খাবারের চামচটি। মুখে পুরে নিলাম। তৃপ্তিভাবে খেলাম বিশেষ ধরনের শুকনো খাবার। মহাকাশ স্টেশনে শুকনা কিশমিশ, কাজু বাদাম অনেক আছে। শুকনো ফল থাকে, কিন্তু তাজা ফল দু’এক দিনের বেশি টেকে না। নষ্ট হয়ে যায়। সত্যি! এ এক জাদুর রাজ্য! তাই মনে হচ্ছে আমার। আমি কেমন করে শূন্যে ভেসে আছি? পাখিরা কি এমন করেই ভেসে থাকে? মেঘেরাও তো এভাবেই ডানা মেলে থাকে! কী অদ্ভুত! কী সুন্দর! এত আনন্দ! এত্ত এত্ত মজা!
একি! আমার আঙুল থেকে পানি তো ঝরে পড়ছে না। হাতের আঙুলে পানি লেগেছে তো সেটা এখন আঠার মতো লেগে আছে। একেকবারে কাঁঠালের আঠা! যতই ঝাড়া দেই ততই যেন আরো বেশি আঠালোভাবে লেগে যাচ্ছে। অবশ্য ব্যাপারটা খুবই এনজয় করছি। সবকিছু ভরশূন্য। সবকিছু ভেসে থাকছে। মানুষ ভাসছে, চামচ, পেস্ট, পানির পাত্র, জিনিসপত্র সব ভেসে বেড়াচ্ছে। ওই তো পরিচালক ক্লিম শিপেনকো ভেসে ভেসে কাজ করছেন। আনন্দে আমার চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে।
টগবগে আনন্দে অভিনেত্রী ইউলিয়া পেরেসিল্ড গোসল করতে যাচ্ছেন। মহাকাশ স্টেশনের গোসলখানা ভীষণ অদ্ভুত। বিশেষ ধরনের একটি ব্যাগে ঢুকে গোসল করতে হয়। গোসল করার সময় মাথায় পানি ঢেলে শ্যাম্পু করা যায় না বলে তাওয়াল দিয়ে চুল মুছে নিতে হয়। চুলগুলো উড়তে থাকে। লম্বাভাবে খাড়া খাড়া হয়ে চুলগুলো ঝাড়–র কাঠির মত শূন্যে উড়তে চায়। দেখে হাসি পায়। পৃথিবীতে আমাদের চুল কাঁধ বেয়ে নিচের দিকে নেমে আসে আর মহাকাশ স্টেশনে চুলগুলো ঝাড়–র কাঠি হয়ে উপর দিকে উড়তে থাকে। ওই তো ইউলিয়া পেরেসিল্ডের চুল এখন ঝাড়–র শলাকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই দৃশ্য দেখে আমার গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে করছে-
আহা! উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে
মহাকাশের জীবনটা ফুরফুরে
মহাকাশ স্টেশনে ভেসে থাকার আনন্দটা অনেক বেশি উপভোগ করলেও একটা ব্যাপার খুবই বিরক্তিকর লাগছে, সেটা হচ্ছে- কানের মধ্যে সব সময় ভোঁ ভোঁ জাতীয় শব্দ। এই শব্দটা সত্যিই বিরক্তিকর। দু’কানে কিছুই শুনতে পারছি না। কাছের মানুষের কথাও শোনা যাচ্ছে না। ভীষণ রাগ হচ্ছে কানের উপর। সারাক্ষণ ভোঁ ভোঁ ভোঁ …
আমি এই ভোঁ ভোঁ শব্দটা এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করছি। শব্দটাকে মোটেও পাত্তা দিচ্ছি না। এতে নিজেকে অভ্যস্ত করতে বা মানিয়ে নিতে সুবিধা হবে। কারণ এখানে আমাকে বহুদিন থাকতে হতে পারে। সিনেমার শুটিং কত দিনে শেষ হবে তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। মহাকাশ স্টেশনের আরও একটি অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে- এর ভিন্ন গন্ধ। এখানে সব সময় বিচিত্র এক গন্ধে ডুবে থাকতে হয়। যে গন্ধের কোনো নাম নেই। পৃথিবীতে এই গন্ধ কখনই পাইনি। আমার মন খারাপ লাগে। মায়ের কথা মনে পড়ে মায়ের গায়ের গন্ধটা খুব মিস করছি। বুকের ভেতরে কেমন যেন করে ওঠে। পৃথিবীর জন্য মায়া লাগছে। কিন্তু কী আর করার আছে? এখন এই বিচিত্র গন্ধ নিয়ে, কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ শব্দ নিয়েই আমাকে থাকতে হবে, ছবির শুটিং শেষ করতে হবে।
এখানে সবচেয়ে হাস্যকর দৃশ্য হচ্ছে- ঘুমিয়ে থাকার দৃশ্য। ওই যে টম ক্রুজ ঘুমাচ্ছেন উল্টো হয়ে। ভেসে ভেসে স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে ঘুমাচ্ছেন তিনি। এত কাছ থেকে হলিউডের এমন জনপ্রিয় একজন অভিনেতাকে দেখতে পাবো, এটা ভাবিনি। কোনো দিনও ভাবিনি। ঘুমন্ত টম ক্রুজকে শিশুর মতো লাগছে দেখতে। একটু ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। ভীষণ ইচ্ছা করছে। মনে মনে গুন গুন করছি-
একটুকু ছোঁয়া লাগে
একটুকু কথা শুনি
তাই দিয়ে মনে মনে
রচি মম ফাল্গুনী …

কী সর্বনাশ! টম ক্রুজের স্লিপিং ব্যাগটা কোথায় ভেসে যাচ্ছে? টম ক্রুজ তো মহাকাশ স্টেশনের বাইরে চলে যাচ্ছেন। ঘুমন্ত নায়ক ভেসে যাচ্ছেন। আমার কলিজা শুকিয়ে আসছে। আমি চিৎকার করে ডাকছি, ‘টম ক্রুজ, টম ক্রুজ, টম ক্রুজ।’
মিসেস সাদিয়া দৌড়ে এলেন টুকটুক! এই টুকটুক। মামণি কী হয়েছে? তিনি মেয়ের গায়ে আলতো হাত রাখলেন।
টম ক্রুজ ভেসে যাচ্ছেন তো!
আমি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকি। আম্মা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছেন। তিনি আমার গায়ে হাত রেখে বললেন- টম ক্রুজ কে?
কেন? তুমি চেনো না? টম ক্রুজের সাথেই তো আমি মহাকাশ স্টেশনে সিনেমার শুটিং করছি।
‘বুঝেছি! সারাদিন ইউটিউব দেখা আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সেই সব স্বপ্নে দেখা। হি হি হি।’
আম্মার হাসির ঝংকারে আমার ঘুমঘোর কেটে গেল। স্বপ্ন ভেঙে গেল। লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে রইলাম। আর মনে মনে বললাম- একদিন বড় হব ঠিক ঠিক। স্বপ্নের সমান বড় হব।

Share.

মন্তব্য করুন