বহু দূর থেকে হুইসেল দিতে দিতে একটা ট্রেন ল্যান্ডমার্ক জংশনে এসে থামে। আশ্চর্য! ট্রেনে কোনো লোকজন নেই। এবং ট্রেন কেউ চালাচ্ছেও না। সে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ট্রেনে উঠে বসে। আকাশ মেঘলা। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। মাঝে মাঝে বিদুৎ চমকে ওঠে। সে জানালার পাশে বসে। ফুরফুরে বাতাস বইছে। উদাস করা দুপুর। ট্রেন চলতে শুরু করে। ঘুম পাচ্ছে তার। সে চোখ বোজে।
ঘুম ভাঙতেই চমকে ওঠে। গাঢ় অন্ধকার। ধীরে ধীরে ট্রেন থেকে নেমে হাঁটে। একটানা গুলির শব্দ। মানুষের আর্তনাদ। সে ভয় পেয়ে দৌড়াতে থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় থামে। তার বুক হাপরের মতো ওঠানামা করে। বড্ড তৃষ্ণা পায়। ব্যাগের ভেতর পানির বোতল। অথচ এক ফোঁটাও পানি নেই। সে উপুড় হয়ে বসে। কতক্ষণ এভাবে বসে থাকে সে নিজেও জানে না।

বসে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙতেই চমকে ওঠে। চারদিকে আলো। মরুভূমির মধ্যে সে। খানিক দূরে একটা পাহাড়। পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে ওপরে ওঠে। পাহাড়ের ওপর সমতল ভূমি। চারদিকে পাথরের দালান। সব সোনালি রঙের। হঠাৎ কোত্থেকে যেন একটা কিশোর ছেলে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। ছেলেটার শরীরের রঙ সোনালি। ছেলেটি মুচকি হেসে বলল, অনেক অনেক দিন পর মানুষ দেখলাম।
ছেলেটির কথা শুনে সে ভয় পায়। তার শরীর কাঁপে। মাথা নিচু করে এক দৃষ্টে জুতো জোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটি বলল, এই নাও তোমার খাবার।
সে সামনে তাকাতেই দেখে সোনার থালায় খাবার আর সোনার গ্লাসে পানি। সে ঝটপট খেয়ে নেয়। ছেলেটি বলল, খুব ক্ষুধা পেয়েছিল না?
হুঁ। একটা টি স্টলের মতো ঘর উড়ে এসে নিচে নামে। সে ঘর থেকে দুইজন লোক বেরিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। একজন বেশ বুড়ো। গলায় মুখে মাংসল ভাঁজ। চুল দাড়ি পাকা। আরেকজন বামন। ইশারায় তাকে উড়ন্ত ঘরে উঠতে বলে। সে উড়ন্ত ঘরে ওঠে। ঘরটি আকাশে ওড়ে। সে নিচে তাকিয়ে দেখে আগুন নদী। খুব একটা বসতি নেই বললেই চলে। বামন লোকটি বলল, তোমাকে আমাদের খুব পছন্দ। কিন্তু…।

বামন লোকটি পুরোপুরি তার কথা শেষ করতে পারে না। সামনের দিক থেকে ছুটে আসা একটি উড়ন্ত ঝুপড়ি ঘর তাদের টি স্টলের সাথে আর একটু হলে ধাক্কা লেগে যেতো। বুড়ো লোকটি বিড়বিড় করে কী যেন পড়ে। সে নিচু গলায় বলল, কী যেন বলতে চেয়েছিলেন? একটু পরিষ্কার করে বলবেন।
টি স্টলটি নিচে নামতেই তারা নেমে পড়ে। চারদিক মেঘাচ্ছন্ন। মাথার ওপর দিয়ে মেঘ উড়ছে। ইচ্ছে করলে ছোঁয়াও যায়। লোক দুটো সামনে এগোতে থাকে। সে তাদের অনুসরণ করে। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় একটি ট্রেন স্টেশনে এসে থামে। স্টেশনটি বেশ পুরনো। এখানে কোন ট্রেন আসা যাওয়া করে বলে মনে হয় না। চারদিকে দুর্গন্ধ। খানাখন্দে পানি। হঠাৎ একটি ট্রেন নড়ে ওঠে। বুড়ো লোকটি বলল, যাও তাড়াতাড়ি ওঠে পড়। এটি শেষ ট্রেন। এরপর পরের ট্রেন ছাড়বে একশ বছর পর। ততদিনে তুমি মরে ভূত হয়ে যাবে।
কিন্তু আমি কোথায় যাবো? সে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।

লোক দুটো তার প্রশ্নের উত্তর দেয় না। পিছনে ঘুরে হাঁটতে থাকে। সে ট্রেনে ওঠে। ট্রেন চলতে শুরু করে। ট্রেন চলতে চলতে একটি গুহার মধ্যে ঢুকে পড়ে। গুহার ভেতর গাঢ় অন্ধকার। ভুতুড়ে পরিবেশ। সে দোয়া-দরূদ পড়ে। কিন্তু দোয়া-দরূদ ভুল হয়ে যায়। গুহা থেকে ট্রেন বের হলে প্রচণ্ড আলো এসে তার চোখে পড়ে। সে চোখ বুজে থাকে। চোখ খুলতেই চমকে ওঠে। ট্রেন ভর্তি লোকজন। মানুষের কথাবার্তা শুনে অবাক হয়ে বাইরে তাকায়। সাইনবোর্ডে লেখা অচিনপুর জংশন। তার সামনে এসে একটি বামন লোক এসে দাঁড়ায়। লোকটি হকার। এবং দেখতে হুবহু ঐ লোকটার মতো। সে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, তুমি এখানে?
চুপ একদম চুপ। যা দেখে এসেছেন সব ভুলে যান। বামন লোকটি বলল।
সে জানালা দিয়ে এক মুহূর্তের জন্য বাইরে তাকায়। এর মধ্যে বামন লোকটি হাওয়া হয়ে যায়। সে পুরো ট্রেন তন্নতন্ন করে খুঁজে ও বামন লোকটিকে পায় না। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে। মেঘ ডাকে। মুষলধারে বৃষ্টি নামে। তার ঘুম পায়। সে হাই তুলতে তুলতে চোখ বুজে। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলতেই চমকে ওঠে। ট্রেনে লোকজন কেউ নেই। ট্রেন দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে।

Share.

মন্তব্য করুন