রাসূল সা. তখন মদিনার রাষ্ট্রপতি। মসজিদে নববীতে প্রায়ই আসর বসতো। তিনি ছিলেন এসব আসরের প্রধান আকর্ষণ! ইসলামের নানা বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতেন তিনি। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ধারণা দিতেন। ইহকাল ও পরকালের সাফল্যের কথা শোনাতেন তিনি। তাঁকে ঘিরে থাকতো তাঁরই সঙ্গী, সাহাবিরা। এ সময় ইসলামের সুমহান বাণী পৌঁছে গেছে গোটা আরব তো বটেই, আরবের বাইরেও। আরবের বিভিন্ন গোত্রের প্রধানগণ সাক্ষাৎ করতে আসতেন। আসতেন রাসূল সা.-এর খেজুর পাতার শাহি দরবারে। অবশ্য যারা আসতো তাদের একেকজনের একেক উদ্দেশ্য ছিলো। কেউ আসতো ইসলামের শীতল ছায়ায় আশ্রয় নিতে। কেউ আসতো নবীর পূর্ণ আনুগত্য স্বীকার করতে। আবার কেউ কেউ আসতো বিদ্বেষ নিয়ে।

একদিনের ঘটনা। আরবের এক গোত্রের প্রধান নেতা এলো মহানবীর দরবারে। তার নাম, আমর বিন তোফায়েল। সে ছিলো খুব প্রভাবশালী নেতা। তার গোত্রের লোকেরা একদিন তাকে বললো, আমর! আরবের প্রায় সবাই তো ইসলাম গ্রহণ করেছে। আমরা কেনো করবো না। চলো আমরাও মুসলমান হয়ে যাই। আর কিসের অপেক্ষা করবো!
আমর ছিলেন ভীষণ অহঙ্কারী! সে জবাবে বললো, আমি তো একটি শপথ করেছি। তা হলো, যতদিন আরববাসী আমাকে তাদের নেতা না মানে এবং আমার বশ্যতা স্বীকার না করে ততদিন আমার মৃত্যু হবে না! আর তোমরা বলছো আমাকে মোহাম্মদের আনুগত্য করতে! আমি এই কোরাইশ যুবকের আনুগত্য করবো?
কিন্তু আমর মুসলমান না হলেও দিন দিন মুসলিমদের সংখ্যা বেড়েই চললো। রাসূল সা.-এর প্রতি আনুগত্য করার লোকও প্রচুর বেড়ে যাচ্ছিলো। তখন সে তার কয়জন ঘনিষ্ঠ লোক নিয়ে রাসূল সা.-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে এলো।
রাসূল সা. সাহাবিদের নিয়ে মসজিদে বসে আছেন। আমর মসজিদে প্রবেশ করলো। এরপর সে বললো, মুহাম্মদ! আমি তোমার সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চাই।

রাসূল সা. চোখ তুলে দেখলেন তাকে। তিনি এ ধরনের দুষ্ট লোকদের বিষয়ে সাবধান থাকতেন সবসময়। তাই তিনি আমরের কথায় না বললেন। সেই সাথে বললেন, যতক্ষণ তুমি এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনছো, ততক্ষণ তোমার সাথে একান্তে কথা বলবো না।
সে আবার বললো, মুহাম্মদ! আমি একান্তে কথা বলতে চাই।
রাসূল সা. এবারও তার কথায় রাজি হলেন না।
কিন্তু সে বারবার একই কথা বলতে লাগলো।
এক পর্যায়ে রাসূল সা. ভদ্রতার খাতিরে রাজি হলেন তার সাথে কথা বলতে। মজলিস থেকে উঠে গেলেন তিনি। একপাশে নিয়ে গেলেন রাসূল সা.-কে।
আমর একটি বিরাট ষড়যন্ত্র করেছিলো। ইরবাদ নামে তার এক অনুচরকে প্রস্তুত রেখেছিলো। ইরবাদের হাতে ছিলো তরবারি। তাকে বলেছিলো, আমি মুহাম্মদকে কথায় ব্যস্ত রাখবো।
তুমি তার এ অমনোযোগিতার সুযোগে তরবারির আঘাতে শেষ করে দেবে তাকে।
একটি প্রাচীরের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন রাসূল সা.।
ইরবাদ তরবারির বাঁটে হাত রেখে অপেক্ষা করছিলো, কখন আসবে সেই কাক্সিক্ষত সুযোগ! হ্যাঁ সুযোগ এসেছেও। কিন্তু যতবারই সে তরবারি কোষমুক্ত করতে যাচ্ছিলো, সঙ্গে সঙ্গে তার হাত অবশ হয়ে আসছিলো। ফলে কিছুতেই সে তরবারি কোষমুক্ত করতে পারলো না।
আমর রাসূল সা.কে কথায় ব্যস্ত রেখে বারবার তাকাচ্ছিলো ইরবাদের দিকে। কিন্তু ইরবাদ যেনো প্রাণহীন জড়বস্তু। তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। নড়াচড়া নেই। রাসূল সা. ইরবাদের দিকে তাকিয়ে দ্রুত বুঝে ফেললেন সে কি করতে চায়। রাসূল সা. আমরকে বললেন, আমর! ইসলাম গ্রহণ করে নাও।
আমর বললো, মুহাম্মদ! আমি ইসলাম গ্রহণ করলে তুমি আমাকে কী দেবে?
রাসূল সা. উত্তরে বললেন, অন্যান্য মুসলমান যেসব অধিকার লাভ করে তুমিও তাই লাভ করবে। অন্যদের ওপর যা বর্তায়, তোমার ওপরও তাই বর্তাবে।

আমর বললো, আমি যদি ইসলাম গ্রহণ করি তাহলে কি তুমি তোমার মৃত্যুর পর এই রাজত্ব আমাকে দেবে?
রাসূল সা. বললেন, না, নেতৃত্ব ও রাজত্ব তোমার জন্য নয়। তোমার সম্প্রদায়ের জন্যও নয়!
এটি শুনে আমর এবার শর্ত কিছুটা শিথিল করলো। বললো, আমি এ শর্তে ইসলাম গ্রহণ করতে পারি যে, আমি হবো পল্লী এলাকার শাসক। আর তুমি হবে শহরের শাসক।
রাসূল সা. এবারও স্পষ্ট বলে দিলেন এটিও হবে না। সম্ভব নয়।
উত্তর শুনে আমর খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লো। রাগে তার চেহারা আগুনের মতো হয়ে গেলো। সে চিৎকার করে বললো, আল্লাহর কসম, মুহাম্মদ! আমি অবশ্যই তোমার বিরুদ্ধে তেজি ঘোড়া আর নওজোয়ান এক পদাতিক বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত থাকবো। প্রতিটি খেজুর গাছের সঙ্গে একটি করে ঘোড়া বাঁধা থাকবে। এক হাজার সুগঠিত সৈন্য দিয়ে গাতফানে তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করবো।
এ কথা বলে রাগে ক্ষোভে গর্জন করতে করতে বেরিয়ে গেলো সে।

রাসূল সা. আমরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর আকাশের দিকে মুখ করে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি আমরের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাও। আর তার সম্প্রদায়কে হেদায়াত দাও।
আমর তার অনুচরদের নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মদিনা ছেড়ে রওনা হলো নিজ এলাকার দিকে। মনে তার ক্ষোভের আগুন দাউ দাউ জ্বলছে। সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করে মদিনা আক্রমণের দৃঢ সঙ্কল্প করছে। এভাবে পথ চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লো আমর। সে এক জায়গায় বিশ্রাম নেয়ার জন্য নেমে পড়লো। সালুলিয়া নামে এক মহিলার তাঁবুতে আশ্রয় নিলো সে। এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো সে। ঘুমের মধ্যেই তার গলায় একটি অর্বুদ নামে টিউমার দেখা দিলো। এ ধরনের রোগ সাধারণত উটের ঘাড়ে হয়ে থাকে। রোগটি হলে উটের কণ্ঠনালি ফুলে যায়। এবং সহসা মারা যায় উটটি।

আমর ভীষণ ভীত ও অস্থির হয়ে পড়লো। সে বারবার গলার টিউমারটি স্পর্শ করতে লাগলো। বলতে লাগলো, হায়! উটের মতো টিউমার আর সালুলিয়ার ঘরে মৃত্যু! বড় অসম্মানের মৃত্যু! বড় অসম্মানের স্থানে মৃত্যু!
তার আকাক্সক্ষা ছিলো, তার মৃত্যু হবে যুদ্ধের ময়দানে। বীরদের তরবারির আঘাতে! কিন্তু তার মৃত্যু হচ্ছে পশুরোগে আক্রান্ত হয়ে। হায় ধিক্কার! হায় লাঞ্ছনা!
সে তার অনুচরদের ডাকলো। তার ঘোড়াটি নিয়ে আসতে বললো। ঘোড়া নিয়ে আসতেই সে লাফিয়ে ঘোড়ায় চড়লো। হাতে তুলে নিলো বর্শা। ঘোড়া তাকে নিয়ে ছুটতে শুরু করলো। অসহ্য যন্ত্রণায় বারবার চিৎকার করছিলো সে। বারবার গলা স্পর্শ করে বলছিলো, হায় উটের মতো অর্বুদ! ঘোড়া তাকে নিয়ে ছুটলো। আর সে যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলো। এক সময় সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলো তার লাশ। অনুচরেরা তার লাশ পথেই ফেলে চলে গেলো।

Share.

মন্তব্য করুন