শিশুর পৃথিবী কেমন! কেমন তার জগৎ! কেমন তার রঙ! কেমন তার ছবি! কী থাকে তার জগতে। কী থাকে না! থাকে যা কেমন তার রূপ! থাকে না যেসব সেসবই বা কেমন! থাকে তো কেমন করে থাকে! কী দৃশ্য তার পৃথিবী জুড়ে? কত বড় তার পৃথিবী! কতটুকু তার পরিধি! কত জিজ্ঞাসা। কত প্রশ্ন। প্রশ্নগুলো খুব খুব ছোট। কিন্তু জবাব কি ছোট? না। জবাব মোটেই ছোট ন। খুব সহজও নয়। তবে অন্যরকম। অন্যধরন।
শিশুর পৃথিবী এক রহস্যময় পৃথিবী। এক অন্যরকম পৃথিবী। চাঞ্চল্যে ভরা। অদ্ভুতও বলা যায়। কিংবা বলা যায় অবাক করার মতো। বড় রঙিন পৃথিবী এটি। এখানে সবকিছু রাঙা। সবকিছু রঙিন! ধূসর কিছু নেই। কালো ও ফ্যাকাশে নেই। আছে লাল নীল সবুজ। সবই তরতাজা। রাঙা রাঙা। আছে মন ভরানো রঙ। আছে ভরপুর রঙ! রঙও আবার নানরকমের! আনন্দের রঙ! বিস্ময়ের রঙ! যখন তখন হাসির রঙ! সামান্যতেই কান্নার রঙ! এটা সেটা বায়নার রঙ! সহজে চাওয়ার রঙ! অল্পতে খুশির রঙ! সামান্যতে অখুশির রঙ! নানরকম আবদারের রঙ! অধৈর্যের রঙ! তাড়াহুড়োর রঙ! খেলাধুলার রঙ! কত কত রঙ! এত রঙের আয়োজনে শিশুর পৃথিবী! এত আয়োজনে শিশুর জগৎ! তাই তার পৃথিবী বড়ই বিচিত্র! বড়ই অদ্ভুত! অদ্ভুত এবং বিচিত্র পৃথিবীতে তার সবকিছু ঝলমলে! জ্বলজ্বলে! আলোকময়! উজ্জ্বল! ঠিক ভোরের স্বচ্ছতার মতো। সকালের কোমল আলোর মতো। ফুলের সুন্দরের মতো!
মূলত শিশুর জগৎ কল্পনার জগৎ। তার পৃথিবী কল্পনার পৃথিবী। যেই সেই কল্পনা নয়! আকাশ কুসুম কল্পনা! উলট-পালট কল্পনা! দিনকে রাত এবং রাতকে দিন করে দেয়া কল্পনা! খুব সহজে বুঝে না আসার কল্পনা! শিশুর কল্পনা জেনে অবাক বড়রা! টাসকি খাওয়া কল্পনা! বড়রা ভাবতে থাকে- কি করে এমন কল্পনা করে একটি শিশু! কেমন করে জাগে এমন কল্পনা! কল্পনা যদিও কোনো যুক্তি মানে না। তবুও শিশুর কল্পনা অযৌক্তিকতাকেও হার মানায়! অবিশ্বাসকেও বিশ্বাস করতে বাধ্য করে!

বড়রাও কল্পনা করেন! কিন্তু তাদের কল্পনায় থাকে বাস্তবতার রেশ! থাকে খানিক যৌক্তিক দিক! কিন্তু শিশুর কল্পনায় যুক্তি বলে কিছু থাকে না। থাকতেও নেই। যুক্তিই যদি থাকলো তো শিশুর কল্পনা কেনো বলবো!
শিশু তো এমনই! যুক্তির ঊর্ধ্বে তার চাওয়া। যুক্তিহীন তার পাওয়া। এবং যুক্তি ছাড়াই তার দাবি! কিন্তু তার চাওয়া সবার কাছে নয়। তার দাবিও সকলের কাছে থাকে না। খুব ছোট সংখ্যক মুখের কাছে থাকে তার চাওয়া পাওয়ার সব। প্রথমত মা। তারপর বাবা। তারপর ভাই বোন। দাদা-দাদী এবং নানা-নানী। এছাড়া খুব কাছের আত্মীয় যদি হয়। যেমন খালা। মামা। চাচা কিংবা তেমন কেউ।
এইতো শিশুর পৃথিবীর নাগরিক। শিশু-জগতের মুখ। এ কটি মুখের কাছে শিশু খোলে তার মনের দুয়ার। এদের কাছেই ব্যক্ত করে মনের সব ইচ্ছের শখ। এদের কাছেই চায় তার চাহিদা। কিন্তু শিশুর চাওয়া আর বড়দের চাওয়া একরকম নয়। শিশু চাইলেই তাকে দ্রুত দিতে হয়। তাড়াতাড়ি জোগাড় করতে হয় তার চাওয়ার বস্তু। নইলে হুলুস্থুল! লঙ্কা কাণ্ড! কেনো? কারণ তার যে ধৈর্য নেই। তার যে অপেক্ষার গুণ নেই। তার যে নেই সবরের শক্তি! কোনো জিনিস কল্পনায় এলেই মন উসকে দেয় তাকে। সে তা চাইতে থাকে। চাইতে থাকে। দম ছাড়ে আর চায়! দম ফেলে আর চায়! বিশ্রামহীন চায়! লাগাতার চায়! বারণ করলেও চায়! এমনকি ধমক দিলেও চায়! আর চাইলেই তা নগদ নগদ দিতে হবে। বাকির কথায় আস্থা নেই শিশুদের। তখন তখন পাওয়ার টান অস্থির করে তোলে। ফলে বারবার চাইতে থাকে। একটু পরপরই জানাতে থাকে দাবি। এতে কেউ বিরক্ত হলো কিনা এ নিয়ে ভাবনা নেই মোটেই। চাওয়ার জিনিসটি দেয়া সম্ভব কিনা তাও ভাববে না ওরা। ভাবতে পারে না।
শিশুর জগৎ রহস্যের জগৎ। সব বিষয়ে এক ধরনের রহস্য ভালোবাসে শিশু। থ্রিল পছন্দের! একইভাবে ভৌতিক বিষয়ে প্রচণ্ড আগ্রহ। রহস্যময় কাহিনির প্রতি খুব আগ্রহ! ভূতের গল্প, জিনের কাহিনি এবং পরীর ঘটনায় মজে থাকে শিশুরা। সমুদ্রের গভীরের জগতে শিশুরা ডুবতে পছন্দ করে। সিন্দাবাদের জাহাজ তাদের ভীষণ আগ্রহের। সিন্দবাদ তাদের অনেক প্রিয়। পরীর দেশের খবর কিংবা রূপকথার রাজ্যের রাজা রানীর গল্পকথায় তারা অবিশ্বাস্য মনোযোগী। আকাশ নিয়েও তাদের জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। চাঁদের আলোয় ওরা পরীর ভুবন কল্পনা করতে ভালোবাসে। তারার চোখে চোখ রেখে তারা গুনতে চায়! এভাবে কল্পনার আনন্দে শিশুরা আনন্দিত! উদ্বেলিত! উচ্ছ্বসিত!

শিশুর জগৎ আনন্দের জগৎ। খুশির জগৎ। উৎসব উৎসাহের জগৎ। সুন্দরকে ভালোবাসার সহজতা আছে শিশুর। আনন্দকে অকপটে গ্রহণ করার বিষয় আছে তাদের। দুঃখ বুঝতে পারে না। বুঝতে চায়ও না। ওদের ধারণা সব দুঃখ বড়দের। আর সব আনন্দ ছোটদের। ওরা ছোট এইতো যথেষ্ট। সুতরাং কষ্টের কথা ওরা শুনবে কেনো। দুঃখের বোঝা কেনো বইবে। তাই শিশুর পৃথিবী সুখের পৃথিবী। শিশুর পৃথিবী রঙিন পৃথিবী। তারা কারো সমালোচনা করতে জানে না। হিংসা পোষণ করে না। বিদ্বেষ রাখে না মনে। কাউকে অবহেলা করা জানে না। ফলে শিশুর হাসি ফুলের মতো সুন্দর! অনাবিল! নিষ্পাপ!
শিশুর জগৎ অকারণ ভয়ের জগৎ। ছোট ভয়ও বড় ভয়ে রূপান্তরের জগৎ। মানুষ দেখেও ভয় জাগে শিশুর মনে। একা হলেও ভয় তাড়া করে তাদের। অল্পতে অধিক ভয় জেগে ওঠে। শিশুর সবচেয়ে বড় ভয় অন্ধকার! অন্ধকারে কোনোভাবেই সহজ থাকে না শিশুরা। থাকবেই বা কি করে! অন্ধকার মানেই তো অজানা। অজানায় ভয় থাকা স্বাভাবিক। ডিসকাভারি অথবা অ্যানিমেল প্লানেট চ্যানেলে শিশুরা দেখে- বনে অন্ধকারে বসবাস করে বাঘ। সিংহ। সাপ ও ভয়ঙ্কর সব প্রাণী। এসব দেখেও তারা ধরে নেয় যে কোনো অন্ধকারেই বুঝি লুকিয়ে থাকে এমন সব হিংস্র পশু ও প্রাণী। যারা হঠাৎ আক্রমণ করে বসবে তাদের।
আমরা জানি অজ্ঞানতার উপমা অন্ধকার। আর জ্ঞানের উপমা আলো। অন্ধকারে যেমন দেখা যায় না কিছুই। জানা যায় না কি আছে ভয়ঙ্কর! তেমনি অজ্ঞতায় থাকে ভয়াবহ অন্ধকার। জ্ঞানহীনতায় জানা যায় না কিছুই। শিশুরা অন্ধকার ভয় করে কারণ তাদের জানার বাইরে এ জগৎ!
শিশুর জগৎ না বোঝার জগৎ। যুক্তি না মানার জগৎ। বাধা বা বিপদ উপেক্ষার জগৎ। ভালো ও মন্দের পার্থক্য না জানার জগৎ। তার জগতে নেই বিবেক। নেই বিচারক। নেই বিবেচনার বিষয়।

কোনটি ভালো কোনটি মন্দ এটুকু বোঝে না শিশু। কোনটি পাওয়া সম্ভব! কোনটি সম্ভব নয় বোঝে না তাও। বোঝে না সাদা-কালোর মাঝখানে কি! সে বুঝও তার প্রয়োজন। তার যা দরকার। অথবা তার মন যা চেয়েছে তাই। এখানেই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর বোধের এ জায়গায় খোঁচা দিতে হয় বড়দের। ধরিয়ে দিতে হয় ভালো-মন্দের দণ্ড। চিনিয়ে দিতে হয় ভালো খারাপের ব্যবধান। দেখিয়ে দিতে হয় সত্য-মিথ্যার সীমানা। তাকে শেখাতে হয় কিভাবে গড়ে তুলতে হয় জীবন। কিভাবে শিখতে হয় জীবনের বাঁকগুলো।
শিশুর মন কাঁচা মাটির মতো। যেমন ইচ্ছে গড়ে নেয়া যায়। যেমন প্রয়োজন তেমন করে বানিয়ে নেয়া যায়। খুব সহজে শেখানোর মন থাকে একটি শিশুর। সুতরাং তাকে যথার্থ জ্ঞান দিতে হবে। সময়োপযোগী করে তুলতে হবে। সত্যিকার মানুষ হওয়ার লোয়াজিমা দিতে হবে। উন্নত মানুষের গুণগুলো আয়ত্ত করার কৌশল শিখিয়ে দিতে হবে। চরিত্র সুন্দর করার গুণাবলি দেখিয়ে দিতে হবে।
শিশুদের শেখানোর কৌশল জানতে হবে। একটি কৌশল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো- শিশুর মন বোঝা। মন না বুঝে শেখানো যায় না। শাস্তি দিয়ে তো নয়ই। গায়ের জোরেও নয়। বল প্রয়োগ করে একদম নয়। তবে? তবে শিশুর পৃথিবীতে ঢুকতে হবে বড়দের। সবকিছু দেখতে হবে শিশুর চোখ দিয়ে। বুঝতে হবে শিশুর মন থেকে। দেখে বুঝে তারপর শেখাতে হবে। এর জন্যও চাই উপযুক্ত পরিবেশ। চাই কোমল হৃদয়। মধুর ভাষা। এবং মন থেকে গভীর ভালোবাসা। চমৎকার শব্দে শেখাতে হবে। শেখাতে হবে আনন্দময় আয়োজনে। এ সময়টিই শিশুর নৈতিকতা শেখার সময়। ভালো গুণাবলি শেখার সময়। শিক্ষার এ সময়টিই শিশুর জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভালো কিছু শেখানোর উপায় হতে পারে এসময়।

শিশুরা খোলা মনের মানুষ পছন্দ করে খুব। হাসিখুশি মুখও তাদের ভীষণ পছন্দের। মিষ্টি করে কথা বলার লোকগুলো শিশুদের দারুণ প্রিয়। আত্মবিশ্বাসীদের ভালোবাসে শিশুরা। কঠিন কথা সহজ করে বলা জরুরি। বলতে হবে গল্পের ভাষায়। রূপকথার গল্পের মতো সত্য বলার কায়দা শিখতে হবে। তবেই শিশুর পৃথিবীতে প্রবেশ করা সহজ হবে। শিশুর সবচেয়ে বড় গুণ রাগ জমিয়ে রাখে না। অল্পতেই কষ্ট ভুলে যায়। আছে প্রচণ্ড আবেগ। আবেগের তোড়ে ভেসে যায় বড়দের রাগ ক্ষোভ বেদনা ও হতাশা। শিশুর মন নতুনের প্রতি আগ্রহী। পুরনো বিষয় নতুন করে দিলেও গ্রহণ করে শিশু।
শিশুর ভাষায় শিশুকে বোঝালে সবই বোঝে সে। শিশু সমালোচনা পছন্দ করে না একদম। প্রবল উৎসাহ দিয়ে শেখাতে হয়। আনন্দের সাথে শেখানো সহজ।
শিশুরা মিথ্যা বলে না। বলতে পারে না। যদি না তারা মিথ্যায় অভ্যস্ত হয়! হয় বড়দের দেখাদেখি। পরিবেশের কারণে। লুকিয়ে-চুকিয়ে কাজ করার প্রবণতাও নেই শিশু জগতে। শিশুরা খোলা বই। সহজে পাঠ করা যায় ওদের। তবে জানতে হয় পাঠ করার তরিকা।
শিশুর জগৎ অবাস্তব! সে অবাস্তব জগৎই শিশুর বাস্তবের পৃথিবী।

Share.

মন্তব্য করুন