শিশু বাংলা ভাষায় এমন একটি শব্দ যা দিয়ে অনেক কিছু প্রকাশ করা হয়। ইংরেজি ভাষায় শিশুর বয়স অনুপাতে নানা শব্দ চালু আছে। যেমন বেবি, চাইল্ড, চিলড্রেন, কিড, ইনফ্যান্ট, চিক, মাইনর ইত্যাদি। বাংলায় আমরা শিশু শব্দ দিয়ে মোটামুটি সব বয়সী শিশুদের বোঝাতে পারি। আরো যে কিছু শব্দ নেই তা নয়। বালক-বালিকা, বাচ্চা, দুগ্ধপোষ্য, খোকা-খুকি, খোকামণি-খুকুমণি, বাছা ইত্যাদির উল্লেখ করা যায়। তবে শিশু শব্দের প্রয়োগই বেশি। ইংরেজিতে বলা হয় : Biologically, a child is a human being between the stages of birth and puberty, or between the developmental period of infancy and puberty. The legal definition of child generally refers to a minor.
কথাগুলো বলা বিশ্ব শিশু দিবস নিয়ে। অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার পালিত হয় বিশ্ব শিশু দিবস। সে হিসেবে ৪ অক্টোবর বিশ্ব শিশু দিবস। বাংলাদেশে এর পাশাপাশি ওই দিন থেকেই সাধারণত পালন করা হয় শিশু অধিকার সপ্তাহ। করোনাকালে হেরফেরও হতে পারে। বিভিন্ন বছরে বিভিন্ন মূল প্রতিপাদ্য বা প্রতিপাদ্য নিয়ে হাজির হয় দিবসটি। প্রতিপাদ্য কঠিন শব্দ হয়ে গেল। এর ইংরেজি হচ্ছে থিম। মানে মূল ভাব বা বিষয়। থিম এর পাশাপাশি স্লোগানও বলা হয়ে থাকে। প্রতি বছর বিশেষ একটি বাক্যকে থিম ধরা হয়, যাতে বিষয়টা নিয়ে সবাই একটু ভাবে। ২০২০ সালে বিশ্ব শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল : ‘শিশুর সাথে শিশুর তরে বিশ্ব গড়ি নতুন করে’। এ বছরের থিম এখনো জানা যায়নি। তোমরা এ লেখা যখন পড়বে তখন হয়তো জেনে যাবে। বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী, বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়ার জন্যই। বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সংগঠন দেশব্যাপী নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করে। শিশুর সুরক্ষা, বিকাশ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক কর্মসূচি সপ্তাহব্যাপী পালন করা হয়। চলমান কোভিড পরিস্থিতির কারণে শিশু অধিকার সপ্তাহের সব অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে।

সচরাচর যে ছেলে বা মেয়ের বয়স ১৮ বছরের নিচে, সে শিশু হিসেবে চিহ্নিত। এটা জাতিসংঘ প্রণীত একটি নিয়ম। দেশে দেশে অবশ্য বয়সের বেশকমও আছে। দেশে দেশে শিশু দিবসও পালিত হয় নানা তারিখে। ইউনিসেফও পালন করে শিশু অধিকার সনদ ঘোষণা তারিখের সঙ্গে মিল রেখে। সে কথায় পরে আসছি। বিশ্ব শিশু দিবস কিভাবে এলো? যুক্তরাষ্ট্রে অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার ন্যাশনাল চাইল্ড হেলথ ডে হিসেবে পালন করে। শিশুদের স্বাস্থ্য, বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্ব দিতে এ উদ্যোগ। ১৯২৮ সালে প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কলিজের শাসনামলে দিনটি পালন শুরু হয়। তিনি একটি ঘোষণাপত্র জারি করলে মার্কিন কংগ্রেস তা গ্রহণ করে। শুরুতে ১ মে দিবসটি পালন করা হতো। ১৯৬০ সালে পরিবর্তন করে অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশও সে নিয়মে পালন করে আসছে দিবসটি।
আজকের শিশুই জাতির ভবিষ্যৎ, আগামী দিনের দেশশাসক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক ইত্যাদি। কবির ভাষায় বলতে হয়- ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’
তাই শিশুকে ভালোভাবে গড়ে তোলার ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। শিশু ফুলের মতো পবিত্র। সে পুত্র বা কন্যা যেই হোক। সেই ফুলটিকে যতেœর সাথে বড় করে তুলতে হবে। তবেই তো সে ভালো হয়ে গড়ে উঠবে, জাতিকে উপহার দেবে সুন্দর আগামী। মানুষের মৌলিক অধিকার- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা এই পাঁচটি বিষয়কে যদি আমরা পুরোপুরিভাবে শিশুদের জন্য নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে আমরা যা চাই তা পাওয়াটা বোধ করি খুব কঠিন হবে না। এক দলা কাদামাটি আর একটা শিশুতে আসলে মৌলিক কোনোই পার্থক্য নেই। নরম কাদামাটি দিয়ে যেমন একজন কারিগর যা ইচ্ছে তাই বানাতে পারেন, ঠিক একইভাবে একটি শিশুকে একই প্রক্রিয়ায় গড়ে তোলা সম্ভব। একজন সাধারণ মানুষের মতোই একটি শিশুর অধিকার সমান। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুর অধিকার বেশি।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ

১৯৮৯ সালের ২০ শে নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়েছে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ। ইংরেজিতে একে Convention on the Right of the Child বলা হয়। সংক্ষেপে CRC. বাংলাদেশ এই সনদে প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশসমূহের অন্যতম। ১৯৯০ সালের ৩ আগস্ট জাতিসংঘে বাংলাদেশসহ ২২টি দেশ এই সনদের প্রতি পুনরায় সমর্থন জানায়। ১০৫টি দেশ সনদটিতে স্বাক্ষরের প্রেক্ষিতে ১৯৯০ সালের ২ সেপ্টেম্বর থেকে জাতিসংঘ গৃহীত ‘শিশু অধিকার সনদ’ সমগ্র বিশ্বের শিশুদের জন্য সর্বমোট ৫৪টি ধারা সংবলিত অধিকারকে স্বীকার ও সংরক্ষণের জন্য আইনগত ভিত্তি তৈরি করে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ ২০ নভেম্বর আন্তর্জাতিক শিশু দিবস হিসেবে পালন করে। শিশু অধিকার সনদ গৃহীত হওয়ার দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতেই এটা করা হয়েছে।

একটি সমাজে পরিবার যেহেতু প্রাথমিক সংগঠন এবং এর সকল সদস্য বিশেষ করে শিশুদের বিকাশ ও কল্যাণের স্বাভাবিক পরিবেশ, সে কারণে তাকে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা এবং সহায়তা দিতে হবে। যাতে সে সেখানে তার দায়িত্বসমূহ পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারে। এ ব্যাপারে আস্থাশীল হয়ে শিশুর ব্যক্তিত্বের পূর্ণ ও সুষম বিকাশের স্বার্থে আনন্দ, ভালোবাসা ও সমঝোতাপূর্ণ পারিবারিক পরিবেশে তাদের বেড়ে উঠতে দিতে হবে। আর সমাজে স্বকীয় জীবনযাপনের জন্য শিশুকে পুরোপুরি প্রস্তুত করে তুলতে হবে এবং জাতিসংঘ ঘোষণায় বর্ণিত আদর্শসমূহের আলোকে বিশেষভাবে শান্তি, মর্যাদা, সহনশীলতা, স্বাধীনতা, সমতা ও সংহতির চেতনায় তাকে গড়তে হবে। মোটামুটি কথা হচ্ছে- এই সনদের শরিক রাষ্ট্রসমূহ শিশুদের বেঁচে থাকা এবং বিকাশের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সর্বাধিক নিশ্চয়তা দেবে। জন্মের পরপরই শিশুর নিবন্ধীকরণ করতে হবে। জন্ম থেকেই তার নামকরণ লাভের, একটি জাতীয়তা অর্জনের এবং যতটা সম্ভব পিতা-মাতার পরিচয় জানার ও তাদের হাতে প্রতিপালিত হওয়ার অধিকার থাকতে হবে- এ সকল বিষয়ই হচ্ছে শিশুর অধিকার। কিন্তু তা আমাদের সমাজে কতটুকু প্রতিপালিত হচ্ছে। হচ্ছে কি? না হলে সমস্যা কোথায় তা চিহ্নিত হওয়া জরুরি।
শিশু অধিকার সনদের ৩২ বছর

১৯৯০ সালে শিশু অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ সনদে (সিআরসি) স্বাক্ষর করার পর থেকে বাংলাদেশ শিশু অধিকার সুরক্ষায় অনেক উন্নতি করেছে। বলছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। এর মধ্যে রয়েছে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার ১৯৯০ সালের প্রতি ১,০০০ জনে ১৫১ থেকে ২০১৯ সালে ৪০-এ নামিয়ে আনা, সম্পূর্ণভাবে টিকা পেয়েছে এমন শিশুর হার বৃদ্ধি পেয়ে তা ১৯৯১ সালের ৫২ শতাংশ থেকে ২০১৬ সালে ৮২ শতাংশে পৌঁছায়, শিশুদের মধ্যে খর্বকায়ত্ব ১৯৯৩ সালে ৭২ শতাংশ থেকে কমে তা ২০১৯ সালে ২৮ শতাংশে নেমে আসে, বিশুদ্ধ খাবার পানি প্রাপ্তির সুযোগ ১৯৯০ সালে ৭৯ শতাংশ থেকে বেড়ে তা ২০১৯ সালে ৯৮.৫ শতাংশে আসে, উন্নত স্যানিটেশনের সুযোগ ১৯৯০ সালে ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৯-এ তা ৮৫ শতাংশে পৌঁছায় এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর হার ১৯৯০ সালে ৬৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৯ সালে ৮৬ শতাংশে উন্নীত হয়।

একই সাথে আরও অনেক কিছুই করা প্রয়োজন, কেননা শিশুদের একটি বড় অংশ এখনও অধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে, যখন তারা স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি, শিক্ষা, সহিংসতা থেকে সুরক্ষা পাচ্ছে না এবং অনেক নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। এখনো ৬-১৫ বছর বয়সের ৪৩ লক্ষ শিশু স্কুলের বাইরে রয়েছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪৪ শতাংশ শিশুরই আনুষ্ঠানিকভাবে জন্মনিবন্ধন সম্পন্ন হয়নি। এছাড়াও পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪৪ লাখেরও বেশি শিশু খর্বাকৃতির শিকার এবং প্রতি ১০ জনে ৯ জন শিশু তাদের প্রতিপালনকারীদের দ্বারা মানসিক কিংবা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। দেশে এখনো অর্ধেকের বেশি বিয়ে হয় ১৮ পেরুনোর আগেই। তাছাড়া এক কোটি ৯০ লাখ শিশুর জীবন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপন্ন। এটা দু’ বছর আগের হিসাব, বর্তমানে সংখ্যা বেশি হবে। সংস্থাটি আরো বলছে বাংলাদেশে গত তিন দশকে যা দেখা গেছে, যথেষ্ট রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সব চ্যালেঞ্জই মোকাবেলা করা যায়।

প্রসঙ্গ শিশুশ্রম : বাংলাদেশে কী অবস্থা

শিশুশ্রম কী? শিশুরা খেলবে লেখাপড়া করবে বড় হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যদি শিশুদের দিয়ে বড়রা যা করে সে ধরনের কাজ করানো হয় তা-ই শিশুশ্রম। শিশুশ্রমের ব্যাপারে বলা হচ্ছে- ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সের শিশুদের বেতন, মুনাফা বা বিনাবেতনে কোনো পারিবারিক খামার, উদ্যোগ বা সংস্থায় কাজের জন্য নিয়োগ করা শিশুশ্রমের আওতায় পড়বে। শিশুশ্রম আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ। তা হলেও এই সমাজে শিশুশ্রমের ব্যাপক বাজার রয়েছে। শিশুদের দিয়ে কাজ করানো একটা গর্হিত কাজ। অর্থনৈতিক টানাপড়েনে বেশির ভাগ পরিবারকে তাদের সন্তানদের উপার্জনমূলক কাজে জড়িত করে থাকে। ১৫ বছরের নিচে বিশ্বের প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ১৫০ মিলিয়ন বা ১৫ কোটি শিশু বিভিন্ন পেশায় যুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে বেশকিছু পেশা ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশে শিশুশ্রমের সাথে জড়িত আছে ১৭ লাখের বেশি শিশু এমনটা ধারণা করা হয়। তাদের প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের বয়স ৬ থেকে ১১ বছরের মধ্যে। এদের বেশির ভাগই ছেলে শিশু। স্বল্প আয়ের পরিবারের মেয়ে শিশুরা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে থাকে এবং তাদের সঠিক সংখ্যা জানা কঠিন। এসব কর্মজীবী শিশুর বেশির ভাগই চরম দারিদ্র্য ও বঞ্চনার মধ্যে বড় হয় এবং বেঁচে থাকে। তারা উন্নত জীবনের জন্য শিক্ষাগ্রহণ ও দক্ষতা উন্নয়নের কোনো সুযোগ পায় না। জীবনের শুরুতেই উপার্জনমূলক কাজে অংশগ্রহণ শিশুদের শিশুত্বকে নষ্ট করে দেয়। একটি শিশুর জীবনের সকল স্বপ্ন-কল্পনার সেখানেই অপমৃত্যু ঘটে। আমাদের দেশে ৫ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের ঘরে, মাঠে এবং কারখানায় কাজ করতে দেখা যায়, যা অনেকটা বিনা বেতনেই বলা চলে। বেতন মিললেও তা অতি সামান্য। কেউ কেউ পেটে-ভাতেই সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। এখানে নানা সভা-সেমিনারে শিশু অধিকারের কথা বলা হলেও বিষয়টিতে প্রকৃত অর্থে সামান্যই গুরুত্ব দেয়া হয়। শিশুরক্ষায় আইন আছে। তার সঠিক প্রয়োগই পারে আমাদের কোমলমতি শিশুদের সকল অধিকার নিশ্চিত করতে।

করোনাকালে ঝুঁকিতে শিশুরা

কোভিড-১৯-এর সময়ে শিশুরা টেলিভিশন এবং মোবাইল ফোনে বেশি সময় দিচ্ছে যা তাদের জন্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা গেম খেলে সময় নষ্ট করে। স্কুল-মাদরাসা করোনার কারণে বন্ধ দেড় বছর। অনলাইন ক্লাসের জন্য মা-বাবা বা অভিভাবক মোবাইল বা কম্পিউটার তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। যারা গ্রামে থাকে, অনেকেরই সঙ্গতি নেই মোবাইল কেনার। তারা লেখাপড়া ত্যাগ করছে। ছেলেরা কাজে যুক্ত হচ্ছে, মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে বলতে গেলে একটি বিপ্লব এসেছিল। করোনা আমাদের পিছিয়ে দিল। তবে স্কুল খোলার পর পরিস্থিতিুর উন্নতি ঘটবে বলে আশা করা যায়।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রধান নাটালি ম্যাককলে বলেন, ‘লকডাউন চলাকালীন শিশুদের টেলিভিশন এবং মোবাইল ফোন ব্যবহার করার পরিমাণ যেমন বেড়েছে, তেমনি শিশুদের জন্য ঝুঁকিও বেড়েছে। তারা ক্ষতিকর বিষয়বস্তু এবং অনলাইন সুযোগ-সন্ধানীর সংস্পর্শে আসার ঝুঁকিতে রয়েছে। শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে সমাজসেবা বিভাগের অধীনে ইউনিসেফের বৃহত্তর কর্মসূচির একটি অংশ হলো শিশু হেল্পলাইন এবং এই হেল্পলাইন অনেক শিশু এবং তরুণের জন্য একটি লাইফলাইন হিসাবে কাজ করে।’ যারা অনাকাক্সিক্ষতর ক্ষতির মুখে ইউনিসেফের সহায়তা ও সমাজসেবা বিভাগের অধীনে পরিচালিত শিশু হেল্পলাইন ১০৯৮-এ ফোন করে তারা নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারে। ৯৯৯ এ ফোন করেও সহায়তা নেয়া যেতে পারে। অনলাইনে সংঘটিত হয়েছে এমন অনেক বিপদ সম্পর্কে ২০১৯ সালে ইউনিসেফ পরিচালিত একটি অনলাইন সমীক্ষায় সতর্ক করা হয়েছে। সমীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩২ শতাংশ শিশু সাইবার বুলিং এবং ডিজিটাল হয়রানির শিকার হচ্ছে। এরই ফলশ্রুতিতে, অনলাইনে সহিংসতা প্রতিরোধ এবং শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা ক্রমশ যেসব ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে সেগুলো কমাতে অনলাইন সুরক্ষা বিষয়ে শিশুদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ কোর্স যৌথভাবে তৈরি করেছে ইউনিসেফ এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। ২০২১ সালের মধ্যে ১০ লক্ষ স্কুল শিশুকে অনলাইন সুরক্ষা সংক্রান্ত সনদপত্র প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দুই লক্ষ ৮০ হাজার শিশু এই অনলাইন কোর্সে অংশ নিয়েছে এবং সনদপত্র পেয়েছে।

নিরাপদ ইন্টারনেট আশু প্রয়োজন

বিপদগ্রস্ত শিশু হেল্পলাইন ১০৯৮-এ যোগাযোগ করে উপকৃত হয়েছে। যেটা না করলে সে আজ হয়তো বেঁচে থাকতে পারত না। হেল্পলাইন কর্মীরা তাকে পরামর্শ দিয়েছে এবং আশ্বস্ত করেছে। করোনা মহামারী এখনও আছে এবং স্কুলগুলো বন্ধ থাকায় শিশুদের জন্য নিরাপদ অনলাইন নিশ্চিত করতে ইউনিসেফ নিরাপদ অনলাইন কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছে। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা বিষয়ক দক্ষতার মাধ্যমে শিশুরা ডিজিটাল যোগাযোগের ইতিবাচক শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে এবং সহিংসতা, হুমকি এবং নির্যাতন থেকে মুক্ত হয়ে একে অপরের সাথে সংযুক্ত হতে পারে। ক্ষতিকর সাইটগুলো বন্ধ করে শিশু-কিশোরদের রক্ষা করতে হবে। তাদেরকে পাঠ্য বইয়ের বাইরে বিভিন্ন বই পাঠে মনোযোগী করতে হবে। এ জন্য স্কুল পাঠাগার ও স্থানীয়ভাবে পাঠাগার গড়ার বিষয় ভাবতে হবে। যেখানে এগুলো বিদ্যমান, সেখানে বই হস্তান্তর করে এগুলোকে সমৃদ্ধ করা যেতে পারে।
শেষ কথা

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ। এখানে বাস সাড়ে ১৬ কোটির বেশি মানুষের। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ, ৬ কোটিরও বেশি শিশু। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশ এখন স্থায়ী উন্নয়নের যুগে প্রবেশ করেছে। উন্নত করা হয়েছে পানি সরবরাহ এবং স্যানিটেশনের খাত। গত দুই দশক ধরে বেড়ে চলেছে নগরায়ণ। দুর্যোগের পাশাপাশি কাজের সন্ধানে শহরে আসে গ্রামের মানুষ। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ও অন্য শহরগুলোতে এখন প্রায় ৫ কোটি মানুষের বসবাস। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ৩০ বছর পর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই বাস করবে শহরে। বাংলাদেশে প্রাথমিক স্কুল পার করে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছানোর হার প্রশংসনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছিল। মাধ্যমিক পর্যায়ে এসে ঝরে পড়ে বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী। মেয়ে শিশুরা নিরাপত্তার অভাব এবং হয়রানির কারণে মাঝে মাঝে পড়ালেখা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। করোনাকালে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। উন্নতির তথ্য ও বাস্তব চিত্রের মধ্যে ফারাকও আছে বেশ। শুধু শিশু দিবস পালন করলেই হবে না, দেশের উন্নয়ন নীতিমালায় প্রতিফলিত হতে হবে কিশোর-কিশোরীদের কথা ও অভিজ্ঞতা। সমাজ বদলেও চাই তাদের পদার্পণ। শিশু অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। শিশু বা শিশু অপরাধীদের নিয়ে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে সংবেদনশীলতার অভাব আছে। এ ধরনের কাজ শিশু বিষয়ে জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রভাব ফেলে বলেই মিডিয়াকে সচেতন হতে হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সিটি করপোরেশন, ইউনিসেফ, সেভ দ্য চিলড্রেন, শিশু একাডেমি, শিশু অধিকার ফোরামসহ দেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা শিশু দিবস ও শিশু সপ্তাহ পালনকালে বিষয়গুলো নিয়ে ভাববে, এমনটা আশা করাই যায়। তবেই শিশু-কিশোররা সমাজের প্রয়োজন পূরণের জন্য নিজেদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারবে। আমরা নিজেরা শিশু অধিকার সম্পর্কে সচেতন হই, কোনো শিশু যেন আমাদের দ্বারা নির্যাতিত, অত্যাচারিত না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখি। সম্ভব হলে তাদের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসবো এই হোক আজকের দিনে আমাদের অঙ্গীকার।

Share.

মন্তব্য করুন