যে দেশেই একজন শিশু জন্মগ্রহণ করুক না কেন, জন্মসূত্রে সে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নাগরিক। এই জন্মগত অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করার অধিকার কারো নেই। নেই বলেই সে স্বাধীন অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে। মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে সূর্যের মুখোমুখি। সাধারণত পৈতৃক সম্পত্তি থেকে পাওয়া ভূখণ্ড তার বাস্তুভিটা। এখানে তার আপন আলয়। জীবনের ঠিকানা। যা এই শহরে পথ-শিশুদের দেখে মনে হয় না। মনে হয় না সে এ দেশের মানুষ। মনে হয় না সে এই দেশের নাগরিক। মনে হয় এ দেশে জন্ম তার মৌলিক অধিকার খর্ব করেছে। তার জন্য কোন আইন নেই। স্বাস্থ্য ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। পৈতৃক সম্পত্তি নেই। নাগরিক অধিকার নেই। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। আছে শুধু টোকাই হয়ে বেঁচে থাকা। প্রতিনিয়ত যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সে ভাবতে থাকে এই রাস্তা আমার নয়। এই বৃক্ষ আমার নয়। এ খেলার মাঠ আমার নয়। এ ভূমি আমার কিন্তু আমি মৌলিক অধিকারহীন। আমি উদ্বাস্তু। নিজভূমে পরবাসী। যেখানে সে মানব অধিকার নিয়ে দাঁড়ায় সেখানে তার জন্য বরাদ্দ থাকে মানুষের খামোশ। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়া হায়েনা হাঁক। যেন পথের কুকুর তাড়াচ্ছে মানুষ অবলীলায়।

যেন পথ-শিশুদের কুকুরের মত তাড়িয়ে এই সমাজেরই একটি স্বাভাবিক নিয়ম। এ নিয়ে কুণ্ঠার কি আছে! একটি স্বাধীন দেশে এমনই লাঞ্ছিত মানুষের অধিকার। ভাবা যায়! অথচ এ দেশেই জন্ম তার। অন্ন বস্ত্র বাসস্থান একজন মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু পথশিশুর এই অধিকার কোথায়! এভাবে সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হতে বেড়ে ওঠা পথশিশু পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে জেনে গেছে ‘এদেশের কোনো কিছুই আমার নয়-এটিই আমার মৌলিক অধিকার।’ না। তুমি বঞ্চিত নও। তোমারও আছে দেশ। স্বাধীন ভূমি। নাগরিক অধিকার। আছে আছে। সব আছে। না, পথশিশুর জন্য আজ এ কথাটি বলারও তার পক্ষে কেউ নেই। অথচ এই দেশে মানুষ কুত্তার অধিকার নিয়ে আমরণ অনশন করে। আড়ালে উদরপূর্তি করে বিরিয়ানি খেয়ে ক্যামেরার সামনে বড় গলায় কথা বলে। উপবাস অভিনয় করে। সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধু ভাইরাল হয়। বাহবা কুড়ায়। আর রাতের আঁধারে ফোটে ওঠে এক লজ্জাহীনা শালুক। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। তোমাকে নয়। আমি আমাকেই ধিক্কার জানাই। আমাদের বিবেক এখন কুকুর আর কুকুররা পথশিশু! কুকুরদের বাংলাদেশে বাঁচার অধিকার আছে। পথ শিশুদের নেই। কুকুরের অধিকারের জন্য যদি আমরা মানুষ রাস্তায় নামতে পারি তবে পথশিশুদের অধিকার নিয়ে কেন নয়? তারাও এদেশের মানুষ। তাদেরও এই ভূখণ্ডে স্বাধীন নাগরিক হয়ে আছে মানুষের মত বেঁচে থাকার অধিকার।

আমাদের সরকার পথশিশুদের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। যতবার পদক্ষেপ নিয়েছে ততবারই কোনো না কোনো কারণে ভেস্তে গেছে তা। বেসরকারিভাবে অনেকেই পথশিশুদের জন্য অনেক রকম পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের পরিকল্পনাও সুদূরপ্রসারী হয় না। তার বড় কারণ দায়িত্ব যথাযথভাবে নেয়া হয় না বলে। কেননা নিম্ন দরিদ্র পরিবার থেকে এদের জন্ম। অভাবের তাড়নায় সংসার ছেড়ে পালিয়ে যান পিতা। অথবা স্বামী মারা গেলে মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। সেখানে সৎ বাবা এই এতিম ছেলেদের দায়িত্ব নিতে চায় না। ফলে এরা হয়ে ওঠে অসহায়। অভিভাকহীন। পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য বাধ্য হয় পথে নামতে। কখনো ফুল। কখনো বেলুন। কখনোবা ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে দেয় জীবিকার তাগিদে। আমার মতে পথশিশুদের অভিভাকত্বহীন রোধ করতে কিছু বাস্তব পদক্ষেপ নিতে পারে সরকার। যেমন-
এক. কোনো পুরুষ যদি একাধিক বিবাহ করে তবে উভয় পরিবারে সমভাবে ভরণ-পোষণ নিচ্ছে কিনা সরকার তা খতিয়ে দেখা এবং এতে তাকে বাধ্য করা। যেন এক পরিবার ফেলে অন্য পরিবার নিয়ে সংসার না করে।
দুই. কোন পুরুষ যদি বিধবা বিবাহ করে সাথে সাথে তার স্ত্রী ও এতিম বাচ্চাদের দায়িত্ব বহন করতে হবে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত।

তিন. পিতা-মাতা উভয়হারা বাচ্চাদের জন্য এতিমখানা নির্মাণ করে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত তাদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে।
চার. বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তিদের অন্তত একটি পরিবারের দায়িত্ব নিতে বাধ্য করা।
পাঁচ. শিক্ষার পাশাপাশি যুব উন্নয়নের মাধ্যমে কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা দেয়া।
এভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার পথশিশুদের সঙ্কট রোধ করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। এত গেল সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন উপায়ের কথা। একবার নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুন, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার নিয়ে কি কখনো ভেবেছি? তাদের পক্ষে দুটো কথা বলেছি? তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে সরকারকে সাহায্য সহযোগিতা বা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি? এত কিছু হয়তো আমরা পারবো না। তাই বলে কি আমরা একটি পথশিশু পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারি না? একটি পরিবার না হোক অন্তত একটি পথশিশুর দায়িত্ব নিতে তো পারি। তাদেরও রয়েছে ভালো পরিবেশে বেড়ে ওঠার অধিকার। আমাদের দেশে কত বিত্তবান মানুষকে দেখা যায় শখের বশে বিদেশি কুকুর লালন করে মাসে মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা তার পেছনে ব্যয় করেন। পথশিশুর চেয়ে কি কুকুর লালন আমাদের বেশি জরুরি? আসুন না আমরা প্রত্যেক বিত্তবান মানুষ একটি পথশিশুর দায়িত্ব নিই। অন্তত একটি পথশিশুর।

Share.

মন্তব্য করুন