আপনার কৈশোরকাল কেমন ছিল?
এককথায় রূপকথাময়। খুব ভোরবেলা আমরা দু’ভাই-বোন পাড়ার সব ক’টা বাগানে ঘুরে বেড়াতাম ফুল কুড়াবার জন্য। তখন সদ্য পূর্ব পাকিস্তান হয়েছে। আমরা কলকাতা থেকে এসে নারায়ণগঞ্জের অভিজাত পাড়া চাষাঢ়ায় উঠেছিলাম। পুকুরপাড়ে বাড়ির সামনের মাঠে নাটক হতো। বন্ধুদের সাথে খুব উপভোগ করতাম সব কিছু।

সেই বন্ধুদের সাথে এখন যোগাযোগ হয়?
শুনেছি দু’একজন এখনো জীবিত আছে। তবে যোগাযোগ নেই কারো সাথে।

কৈশোরে কী কী স্বপ্ন দেখতেন?
কৈশোরে লেখালেখি করতাম। গান গাইতাম, আবৃত্তি করতাম, ছবি আঁকতাম। কিন্তু কোন স্বপ্ন দেখতাম কিনা মনে করতে পারছি না। তবে এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমার বিচিত্র অভিজ্ঞতা আমার না দেখা স্বপ্ন পূরণ করতে সাহায্য করেছে। জীবনের সার্থকতা বুঝতে পারি এখন।

কোনো দুরন্তপনা গল্প মনে পড়ে কি?
দুরন্ত একেবারেই ছিলাম না। শিশু বয়স থেকেই খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে ছিলাম আমি। বরং ভাই-বোনদের দুরন্তপনায় মায়ের বকুনি আমাকে ব্যথিত করতো।
নিপীড়ন কিশোর বিকাশের ক্ষেত্রে কতটা ক্ষতিকর?
মানসিক এবং শারীরিক নিপীড়ন এক একটি কিশোর জীবনকে শেষ করে দেয়। এই সময়টা ওদের বিকশিত হওয়ার। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-নৈতিকতায় সুশোভিত হয়ে জীবন গঠন করার সময়। নিপীড়ন কিশোরদেরকে স্থবির করে দেয়। হরণ করে তাদের বেড়ে ওঠার স্বাধীনতা।

এ ক্ষেত্রে তাদের বোঝানো এবং নৈতিক শিক্ষা দেয়াই কি উত্তম মনে করেন?
যুক্তি দিয়ে বোঝানো তো অবশ্যই দরকার। এক্ষেত্রে পারিবারিক শিক্ষার একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে। বাড়িতে বড়দের চালচলন আদর্শবাদিতা ও নৈতিকতার আবহ থাকা উচিত, যার দ্বারা ছোটরা প্রভাবিত হবে। সেই সুস্থ আবহের পরিমণ্ডল তৈরি করা পিতা-মাতার অবশ্যই কর্তব্য।

কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে পিতা-মাতার কর্তব্য কী হতে পারে?
এ ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ভূমিকা প্রধান। একজন কিশোরের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য সুস্থ পরিমণ্ডল এবং আবহ তৈরি করাটা পিতা-মাতার কর্তব্য। প্রথমত, পিতা-মাতাকে হতে হবে এ বিষয়ে সুশিক্ষিত। তাহলেই তাঁরা পারবেন সন্তানকে ঠিক দিকনির্দেশনা দিতে। পিতা-মাতা এবং পরিবারের অন্যদের সাথে থাকতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ সু-সম্পর্ক। জীবনের অন্যতম একটি প্রধান দিক হচ্ছে বয়সের সন্ধিক্ষণ। যাকে আমরা বলি ‘টিনএজ’। এ সময় শারীরিক এবং মানসিকভাবে একটি অলিখিত পরিবর্তন আসে সবার জীবনে। পিতা-মাতার উচিত তখন তাদের মনকে বুঝতে পারা এবং তাদের পাশে থেকে তাদের সমস্যাগুলো খুব সহজভাবে ভাগ করে নেয়া। সেই জন্যই এ বিষয়ে পিতা-মাতার সচেতন হওয়া কর্তব্য।

আপনাদের কৈশোর আর এখনকার সময়ের কিশোরদের কৈশোর জীবনের পার্থক্য কেমন দেখছেন?
পার্থক্য এখন আকাশ পাতাল। আগে একজন প্রাইভেট টিচারের কাছে সব ভাই-বোনেরা পড়তো। এখন একজন ছাত্রের জন্য লাগে কয়েকজন টিচার। সবচেয়ে দুঃখের কথা হচ্ছে, আমাদের সময়ের বড়ই অভাব এখন। আমাদের কৈশোরকালে একটা আনন্দময় সময় অতিবাহিত করেছি। পরিবারের সাথে মিলে মিশে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়েছি সবাই। বর্তমান সময় হচ্ছে আমাদের কিশোরদের সবচেয়ে দুঃসময়। সন্তান এবং অভিভাবক কারো কাছেই কোন সময় নেই একে অন্যের দিকে ফিরে তাকাবার। যে যার মতে চলছে।

এই দুঃসময় থেকে বেরিয়ে আসতে অভিভাবকের করণীয় কী?
একেবারে শতভাগ কোন সমাধান না থাকলেও হতাশ হওয়ারও কোনো কারণ নেই। প্রথমত সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এই সমস্যার আংশিক সমধান দিতে পারে। তবে এর জন্য দরকার সহনশীলতা। তবেই কাজ হবে।

অনলাইন ক্লাসের জন্য স্মার্টফোন হাতে পেয়ে কিশোররা পড়াশোনা ছেড়ে গেমস্ খেলার দিকে ঝুঁকেছে এবং এতে মাত্রাতিরিক্ত আসক্ত হয়ে কয়েকজন কিশোর ইতঃপূর্বে আত্মহত্যাও করেছে! এই ভয়ঙ্কর আসক্তি থেকে ফেরাতে কিশোরদের জন্য কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?
অনলাইন ক্লাসের জন্য স্মার্টফোন একদিকে যেমন কিশোরদের কিছু কিছু সুবিধা দিচ্ছে, তেমনি ধ্বংসও করে দিচ্ছে বহু অঙ্কুরিত জীবন। স্মার্টফোনের মাধ্যমে বাড়ছে কোমলমতি কিশোরদের অবাধ আড্ডা। অনিয়ন্ত্রিত বন্ধুত্ব, সময় ও অর্থের অপব্যবহার। এ সময় অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে বড়দের। অত্যন্ত বিচক্ষণতা এবং সু-সম্পর্কের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে কিশোরদেরকে।

কিন্তু স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকে তো অস্বীকার করা যায় না?
একেবারেই না। এর ব্যবহারকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। এর জন্য ওদের প্রতি স্ব-যত্ন নজরদারি রাখতে হবে। খেয়াল করতে হবে তারা ইন্টারনেটে কি করছে। দীর্ঘ সময় মোবাইল ব্যবহার করতে না দিয়ে নির্দিষ্ট একটা সময় বেঁধে দেয়া। এর মাঝে খেলাধুলার সময় দিতে হবে এবং পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি যেকোন ভালো বই পড়তে দেয়া। তবে ধর্মীয় বই হলে ভালো হয়। এতে করে তারা নৈতিকতা শিখতে পারবে।

এই আধুনিক সময়ে শিশুরা বই বিমুখ হচ্ছে কেন?
বইয়ের পরিবর্তে এখন অনেক লোভনীয় জিনিস এসে গেছে শিশুদের হাতে। মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার। খুব সহজেই জ্ঞান ও বিনোদনের বহু বিষয়ে জানতে পারছে। পিপাসা অনুভব করার আগেই মিটে যাচ্ছে তৃষ্ণা। কষ্ট করে বই ঘেঁটে জ্ঞান আহরণ করার সময় কোথায় শিশুদের!

কিশোরদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কেমন হওয়া উচিত?
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মান উন্নয়ন করাটা সবচেয়ে জরুরি।

কী ধরনের মান উন্নয়নের কথা বলতে চাচ্ছেন?
শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য প্রথমত বন্ধ করা উচিত মুখস্থ বিদ্যা এবং না বুঝে পড়া।
বড় হতে হলে ও ভালো মানুষ হতে হলে কিশোরদের কী যোগ্যতা অর্জন করতে হবে?
প্রথমত ওদের শিকড়টাকে মজবুত করে দিতে হবে যার প্রধান দায়িত্ব পিতা-মাতার। সব যোগ্যতার জন্য পরিশ্রমের দরকার হয় এবং তার পরই হয় মূল্যায়ন। আমরা কিশোরদেরকে সে সুযোগ দিচ্ছি কোথায়!

বড়দের সাথে কিশোরদের আচরণ কেমন হওয়া দরকার?
বড়দের সাথে কিশোরদের আচরণ অবশ্যই বিন¤্র হওয়া উচিত। আদব কায়দাটাও একটা শিক্ষার বিষয়। এই শিক্ষাটাও পরিবার থেকে আসে। অনেককেই দেখি বড়দের সালামটা দিতেও ওদের কষ্ট হয়।

এ জন্য কি সমাজ বা পারিবারিক শিক্ষা দায়ী?
দুটোই। একজন মানুষের প্রথম শিক্ষার হাতেখড়ি হয় তার পরিবারে। যে পরিমণ্ডলে সে বড় হয়ে উঠবে তাই তো শিখবে। তারপর আসছে সমাজ। যা নাকি ভরে আছে অশিক্ষা আর কুশিক্ষায়। আমাদের এখন সৎশিক্ষার বড় বেশি প্রয়োজন।

পিতা-মাতার কাছ থেকে কোন কিছু বায়না করে না পেলে, কিশোরদের একঘেয়েমি করা কি ঠিক?
কখনোই না। তবে কেন তাকে কোন ব্যাপারে না বলা হচ্ছে, তার সুস্পষ্ট কারণটা তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। যে কোন বাধা মানুষকে যেমন ইচ্ছায় দুর্বার করে তোলে তেমনি সঠিক দিকনির্দেশনা দেয় এবং ওদের বুঝতেও শেখায়।

কিশোররা কেমন স্বপ্ন দেখবে?
আমার মতে সাধারণত কিশোর বয়সে কেউ বিশেষ কোন স্বপ্ন দেখে না। যে পরিবেশে সে বেড়ে ওঠে সেই পরিমণ্ডলকে ঘিরেই চলে ওদের কার্যকলাপ। একেক সময় একেক রকম। বিশেষ কোন স্বপ্নকে সে আজীবনের জন্য লালন করতে পারে না। এটা তাদের স্থান, কাল ও পরিবেশের ওপর নির্ভর করছে।

সচেতন নাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে আমাদের কিশোরদের কেমন শিক্ষা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
অবশ্যই সব বিষয়ে সুশিক্ষা। প্রথমত একজন সৎ মানুষ হওয়া; এটাই হচ্ছে চারিত্রিক দৃঢ়তার মূল শিকড়, যা তাকে সব বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ করবে। দ্বিতীয়ত পরিবার এবং তৃতীয়ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা একজন কিশোরকে আদর্শবান এবং সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে।

আবার যদি কৈশোর ফিরে পাওয়া যায় তবে কী হতে চাইবেন?
মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে প্রকৃতির আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াতাম। সেই ভোরের শিউলীতলায় ফুল কুড়ানো, এক্কা-দোক্কা খেলা, আমডালে দোলনায় বসে আকাশ দেখতে দেখতে আপন মনে আবৃত্তি করা আর লুকিয়ে লুকিয়ে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ পড়া। এসবই ফিরে পেতে চাইতাম। কিন্তু কল্পনা ছাড়া বাস্তবে তো আর সেখানে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই।

Share.

মন্তব্য করুন