বলা হয়ে থাকে, টি-টোয়েন্টি তরুণদের খেলা। চার-ছক্কার এই লড়াইয়ে যারা আউট হওয়ার সম্ভাবনা আছে জেনেও নির্ভয়ে ব্যাট চালাবে। ঝুঁকি নিয়ে সিঙ্গেলস নেবে কিংবা প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যান একের পর এক চার-ছক্কা হাকানোর পরও বিচলিত না হলে বল করে যাবে। অনেকে আবার বলেন, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে গায়ের জোরের চেয়ে বেশি লাগে মনের জোর। যে কারণে এই ফরম্যাটের ক্রিকেটে তরুণ ক্রিকেটারদের বেশি ভালো খেলতে দেখা যায়।
শুরু থেকেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাফল্য খুব বেশি নেই। এর কারণ হিসেবেও মনে করা হয়- তরুণ সাহসী ক্রিকেটারের অভাব। যারা বিশে^র বাঘবাঘা ক্রিকেটারদের সাথে পাল্লা দিয়ে খেলবে ভয়-ডরহীন ক্রিকেট। তবে সেই দিন বুঝি পেছনে ফেলার সুযোগ এসেছে বাংলাদেশের। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে গত মাসে দারুণ এক সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। ৫ ম্যাচের সিরিজে অস্ট্রেলিয়াকে ৪-১ ব্যবধানে হারিয়েছে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের টি-টোয়েন্টি দল।

এই সিরিজে বাংলাদেশ পেয়েছে বেশ কয়েকজন সাহসী তরুণ ক্রিকেটারের দেখা। সাকিব আল হাসান, মোস্তাফিজুর রহমানের পাশাপাশি যারা সিরিজ জয়ে দারুণ ভূমিকা রেখেছেন। এই সিরিজে বাংলাদেশ খেলেছে তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহীমের মতো কয়েকজন সিনিয়র ক্রিকেটারকে ছাড়াই। তাদের অনুপস্থিতে দলে জায়গা পাওয়ার সুযোগটা ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন নাসুম আহমেদ, শরিফুল ইসলাম, আফিফ হোসেনরা।
ক্রিকেট বিশে^ অস্ট্রেলিয়া মানেই বিরাট এক শক্তির নাম; কিন্তু সেই দলটির বিপক্ষে বাংলাদেশের তরুণদের পারফরম্যান্স ছিলো যেমন সাহসী, তেমন নজরকাড়া। সিরিজের প্রথম ম্যাচেই ১৯ রান দিয়ে চার উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন নাসুম আহমেদ। তার বোলিং জাদুতে ১৫ ওভারের মধ্যেই অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর সুবাস পেতে শুরু করে বাংলাদেশ। সেদিন ম্যাচসেরার পুরস্কারও উঠেছে এই বামহাতি স্পিনারের হাতে। পরের প্রতিটি ম্যাচেও দারুণ বোলিং করেছেন নাসুম। দ্বিতীয় ম্যাচে ২৯ রান দিয়ে কোন উইকেট পাননি। তৃতীয় ম্যাচে ১৯ রানে ১ উইকেট, চতুর্থ ম্যাচে ১৭ রানে ১ উইকেট এবং শেষ ম্যাচে মাত্র ৮ রান দিয়ে দুটি উইকেট নেন নাসুম। এ থেকেই বোঝা যায় কতোটা নিয়ন্ত্রিত বোলিং করেছেন তিনি। ১১.৫ গড়ে ৮ উইকেট নিয়েছেন সিরিজে। যেটি অস্ট্রেলিয়ার জশ হ্যাজেলউডের সাথে যৌথভাবে সেরা।
এই সিরিজের আগে ২৭ বছর বয়সী এই স্পিনার বাংলাদেশর হয়ে ৪টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন মাত্র। এ বছর মার্চে নিউজিল্যান্ড সফরে হ্যামিলটনে অভিষেক হয় তার। তবে এখনো পর্যন্ত টেস্ট বা ওয়ানডে খেলার সুযোগ হয়নি জাতীয় দলের জার্সিতে।

বল হাতে ভালো করা আরেক তরুণ ক্রিকেটার শরিফুল ইসলাম। গত বছর অনূর্ধ-১৯ বিশ^কাপ জয়ী বাংলাদেশ যুব দলের এই বামহাতি পেসার তখন থেকেই সম্ভাবনাময় ক্রিকেটার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। লাইন, লেন্থ আর তার আগ্রাসী বডি ল্যাঙ্গুয়েজ সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দারুণ কার্যকর। অস্ট্রেলিয়া সিরিজে ৪টি ম্যাচ খেলে শরিফুল ৭ উইকেট নিয়েছেন। প্রথম তিন ম্যাচে যথাক্রমে ১৯ রানে ২ উইকেট, ২৭ রানে ২ উইকেট ও ২৯ রানে ২ উইকেট নেন। চতুর্থ ম্যাচে দ্ইু ওভার বোলিং করে ৮ রান খরচায় নেন ১ উইকেট। যে চারটি ম্যাচ খেলেছেন সবগুলোতেই অজি ব্যাটসম্যানদের বিরুদ্ধে তাকে দেখা গেছে সাবলীল। এই তরুণ পেসারকে এখন ভাবা হচ্ছে আগামী দিনের বাংলাদেশ পেস আক্রমণের অগ্রসেনানী। ইতোমধ্যেই মোস্তাফিজুর রহমানের কাছ থেকে স্লোয়ার, কাটার ডেলিভারি শিখতে শুরু করেছেন। তাই শরিফুলের কাছ থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আগামী দিনে আরো কার্যকর পারফরম্যান্স দেখতে পাবে বলে আশা করছেন সবাই।

শরিফুল আর নাসুমের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছে একই দিনে। চলতি বছর মার্চে নিউজিল্যান্ডের হ্যামিলটনে। তবে নাসুম এখন পর্যন্ত শুধু টি-টোয়েন্টি খেললেও শরীফুল একটি টেস্ট ও ৪টি ওয়ানডে খেলেছেন। তার টি-টোয়েন্টি ম্যাচ সংখ্যা ১০টি।
বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সিরিজে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় শন মার্শ ও সাকিব আল হাসানের পরই নাম ছিলো আফিফ হোসেন ধ্রুব’র। ৫ ম্যাচে তার ব্যাট থেকে এসেছে ১০৯ রান। আফিফ বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের সম্ভাবনাময় এক অলরাউন্ডার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। অবশ্য এই সিরিজে তাকে বল হাতে দেখা যায়নি। তবে ব্যাট হাতে ছিলেন কার্যকর। প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের রান যখন ১২০ পার হবে কিনা সেটি নিয়ে শঙ্কা ছিলো তখন আফিফ খেলেন ১৭ বলে ২৩ রানের কার্যকর ইনিংস। তার ওই ইনিংসের সুবাদেই দলীয় রান ১৩১ এ পৌছায়।

দ্বিতীয় ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার দেয়া ১২২ রানের টার্গেট তাড়া করতে নেমে ৬৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়েছিলো বাংলাদেশ; কিন্তু সেখান থেকে ব্যাট হাতে শক্ত প্রতিরোধ গড়েন আফিফ, তার সাথে ছিলো আরেক তরুণ নুরুল হাসান সোহান। দুজনের ৪৪ বলে ৫৬ রানের জুটিতে নিরাপদে জয়ের বন্দরে ভিড়েছে বাংলাদেশ। আফিফ একটি ছক্কা ও ৫টি চারের সাহায্যে ৩১ বলে করেন অপরাজিত ৩৭ রান। সোহান অপরাজিত ছিলেন ২১ বলে ২২ রান করে। বিপদের সময়ে দারুণ ওই ইনিংসটি খেলার জন্য সেদিন ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার উঠেছে আফিফের হাতেই। শেষ তিন ম্যাচে তার ব্যাট থেকে এসেছে ১৯, ২০ ও ১০ রান। ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রতিটি ইনিংস ছিলো গুরুত্বপূর্ণ।

বিপিএলে রাজশাহীর হয়ে দারুণ খেলে আলোচনায় এসেছিলেন আফিফ হোসেন। এরপর দ্রুতই জাতীয় দলে ডাক পান। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন এই তরুণ। এরপর ২৩টি টি-টোয়েন্টি ও ৭টি ওয়ানডে খেলেছেন ২২ বছর বয়সী আফিফ।
ব্যাট হাতে এই সিরিজে আরো পারফর্ম করেছেন মোহাম্মাদ নাইম শেখ ও মেহেদী হাসান। দুজনে যথাক্রমে ৯১ ও ৭২ রান করেছেন সিরিজে। এছাড়া মেহেদী বল হাতেও মোট ৪টি উইকেট নিয়েছেন।
সাকিব আল হাসান ও মোস্তাফিজুর রহমানের পাশাপাশি এই সিরিজে তরুণদের এই পারফরম্যান্স বাংলাদেশকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে আগামীতে ভালো একটি দল হয়ে ওঠার। এটা ঠিক যে, এই সিরিজে অস্ট্রেলিয়া তার কিছু সেরা খেলোয়াড়কে ছাড়াই এসেছে। দলে ছিলেন না অ্যারন ফিঞ্চ, স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। তবু অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের বিপক্ষে তরুণ ক্রিকেটারদের এই দাপট তাদের সাহসী করে তুলবে আগামী দিনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের হয়ে বড় কিছু করার। সেই প্রত্যাশা দেশের কোটি ক্রিকেট সমর্থকের।

Share.

মন্তব্য করুন