এই শহরে অনুন নামে এক ভাবুক ছেলে আছে। তোমরা কি কেউ তাকে চেনো? হয়তো বা চেনো না। তবে তোমাদের গ্রামে বা শহরেও থাকতে পারে এমন ছেলে। এমনকি তোমরাও তার মতো ভাবো হয়তো। আসলে ভাবতে কার না ভালো লাগে বলো তো! সবাই ভাবতে পারে। একেকজনের ভাবনা একেক রকম। কেউ নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নদী হতে চায়। কেউ নদীর ঢেউ হতে চায়। কেউবা মাছের অবাধ সাঁতার কাটা দেখে মাছ হতে চায়। কেউ মাছরাঙা কিংবা বকপাখি হতে চায়- ঘুরে ঘুরে দূরের খাল-বিল, নদী-নালা কিংবা সমুদ্র দেখার ইচ্ছায়। কেউ নীল আকাশের বুকে মেঘের অবাধ ছোটাছুটি দেখে মেঘ হতে চায়। প্রকৃতির কাছে গেলে প্রকৃতির মতো হতে চায়। আবার ধরো, তুমি একজন আদর্শবান ভালো শিক্ষকের কাছে পড়ো। তখন তোমার মনের মাঝে গুঁতো মারে- ইস! আমি যদি এমন শিক্ষক হতে পারতাম। ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের কাছে গেলেও তেমন হতে ইচ্ছে জাগে। তাহলে বলো তো, মানুষের ইচ্ছের কি শেষ আছে? নাই, মোটেও নাই।

এমনই ভাবুক ছেলে অনুন ফুলবাগানে হাঁটতে হাঁটতে, ফুলের মিষ্টি গন্ধ নিতে নিতে উৎফুল্ল মনে বলে উঠল, ইস! ফুলগুলো কী সুগন্ধি ছড়াচ্ছে! ওয়াও! কী দারুণ! কী সুন্দর ফুলগুলো! অনুনের কথা শুনে ফুলগুলো লজ্জায় নত হয়ে গেল। নিজের প্রশংসা শুনতে কার ভালো লাগে না বলো? সবারই ভালো লাগে। তবে মাঝে মধ্যে বেশি প্রশংসা পেলে সবারও চোখ-মুখ লজ্জায় রক্তজবার মতো লাল হয়ে যায়। অতি আনন্দে, সুখে। তেমনি লজ্জা পেল ফুলগুলো।
কিন্তু ফুলগুলোর মধ্য হতে একজন মাথা উঁচু করে বলল, অনুন, তুমি কিন্তু অনেকখানি বেশি বলে ফেললে। তুমি যতটুকু সুন্দর বলছো, ততটুকু আমরা নই। বরঞ্চ তুমিই আমাদের চাইতে অধিক সুন্দর। ফুলের কথা শুনে অনুনের তো চক্ষু চড়ক! কী বলবে কিছুই বুঝতে পারে না। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। এমন সময় একটা ছোট্ট পাখি বললো, সত্যিই অনুন তুমি তো অনেক সুন্দর। যেমন খাড়া নাক তেমনি চেহারা সুরত।

এবার অনুন কিছুটা ভয় পাওয়ার মতো করে বললো, কে? কে? কে কথা বললো? ফুলগাছের ডালে বসে থাকা ছোট্ট পাখি উত্তর করল, আমি। আমি পবন পাখি। এবার অনুন কোমড়টা বাঁকা করে ফুলগাছের ভেতর তাকিয়ে একটা ছোট্ট পাখি দেখতে পেল। মুচকি হাসি হেসে বললো, ছোট্ট পাখি, তুমি এখানে কী করছো? আর তোমরা সবাই আমার নাম কিভাবে জানলে? ফুল ও পাখি একসাথে বললো, কিছুক্ষণ আগেই তো তোমার মা ‘অনুন’ বলে ডাকছিল। তুমি যেমন সুন্দর, তেমন নামটাও অনেক সুন্দর!
আচ্ছা, বুঝেছি। অনুন মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললো।
ফুলগাছের ঝোপের ভেতর হতে বেরিয়ে এলো ছোট্ট পাখি পবন। ফুলগাছের লম্বা খাড়া ডালটার ওপর বসল অনুনের মুখোমুখি। তারপর বললো, অনুন, তুমি কি আমার বন্ধু হবে?
আরে- শুধু বন্ধু কেন? আমি তো তোমার মতো পাখি হতে চাই। আমার খুব ইচ্ছে পাখি হয়ে সারা পৃথিবীটা ঘুরে ঘুরে দেখার। নিয়ম মানার জীবনটা আমার মোটেও ভালো লাগে না। সকাল হতে রাত দশটা পর্যন্ত পড়া আর পড়া। সকাল হলেই প্রাইভেট টিচার এসে হাজির। তড়িঘড়ি ব্রাশ করে পড়তে বসি। তারপর নাস্তা করে স্কুলে যাই। দুপুরে বাসায় ফিরে আসি। এসে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খাই। খাওয়া শেষ না হতেই না হতে মা বলেন, অনুন ঘুমাতে যাও। একদম বাসার বাইরে যাবে না।
কখনো একটুআধটু ঘুম হয়। আবার কোনোদিন একটুও হয় না। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে সময় পার করি। এরপর বিকেল হতে আরেক প্রাইভেট টিচার আসেন। তিনি গেলেই এসে হাজির হন গানের ওস্তাদ। বিকেলে একটুও খেলাধুলা করার সুযোগ নেই।

সন্ধ্যার পরপরই হোমওয়ার্ক হতে শুরু করে ক্লাসের পড়া, প্রাইভেট টিচারের পড়া করতে হয়। গানেরও তালিম করতে হয় একটু। তারপর রাতে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। এই রুটিনবাঁধা জীবন আমার ভাল্লাগে না। অথচ, তোমরা কতই স্বাধীন! যেখানে ইচ্ছে সেখানেই ঘুরে বেড়াচ্ছো। কতই না সুখের জীবন তোমাদের। এক নাগাড়ে বলতে বলতে গলা ধরে এলো অনুনের।
তোমার মনের কষ্ট বুঝেছি আমি। যদি তুমি আমাকে বন্ধু ভাবো, তাহলে চলো আমার সাথে। পবন পাখি বললো।
তোমার সাথে! কিন্তু কোথায়? চোখ বড়ো বড়ো করে জানতে চাইল অনুন।
ওই দূর নীলিমায় ভেসে ভেসে সারা বিশ্ব দেখবো। নদী-নালা, খাল-বিল, সাগর, উচু উচু পাহাড় আর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করবো। যেটা মনে চাচ্ছে তোমার।
কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? তুমি পাখি, তোমার দুটি ডানা আছে। আমার তো ডানা নেই। আমি কি উড়তে পারবো?
হ্যাঁ, পারবে। মানুষেরা এমন কিছু নেই যা পারে না। তুমিও পারবে। তুমি শুধু ইচ্ছে পোষণ করো। আর আমার ওপর হাত রাখো। দেখবে আমার সাথে তুমিও উড়তে পারছো।
সত্যিই পারবো তো! ঠিক আছে এই তোমার পিঠে…
অনুন ওখানে কার সাথে কথা বলছো। ফুলগাছের কাছে তো কাউকেই দেখছি না। চলে এসো। তোমার গানের ওস্তাদ এসেছে। কিছুটা বাজখাঁই কণ্ঠে ডাক দিলো অনুনের মা।

অনুন পবন পাখির পিঠে হাত দিতে গিয়ে, হকচকিয়ে হাত টেনে ঘুরে তাকায়। অনুন মনে মনে বললো, আজকে ছুটির দিনও কেন গানের ওস্তাদ এলো? ধুর… আমার ইচ্ছেটা পূরণ করতে দিলো না।
আবার অনুন মুমূর্ষু কণ্ঠে পবন পাখিকে বললো, বন্ধু, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। তোমাকে কথা দিয়েও রাখতে পারলাম না। আগামী শুক্রবার ছুটির দিনে আবার এসো। সেদিন সত্যি সত্যিই তোমার সাথে ঘুরতে যাবো।
তুমি মন খারাপ করো না বন্ধু। আমি প্রতিদিনই এখানে আসি। তুমি যেদিন ফ্রি থাকবে সেদিনই নিয়ে যাবো। তুমি মন দিয়ে লেখাপড়া করো। মা-বাবা তো তোমার জন্যই সবকিছু করছে। দেখিও, সত্যি সত্যিই তুমি একদিন আমার মতো পাখি হয়ে আকাশে উড়তে পারবে। আমি বলে রাখলাম।

কিন্তু এটা কি সম্ভব?
হ্যাঁ, সম্ভব। ওই যে আকাশের দিকে তাকাও। কেমন করে পাখির মতো উড়োজাহাজ উড়ে যাচ্ছে। যিনি ওই উড়োজাহাজটি চালাচ্ছে তাকে পাইলট বলে। তিনিও তোমার মতো পাখি হতে চেয়েছিল। তাই তিনি পাইলট হয়েছে। তুমিও একদিন তার মতো পাইলট হয়ে সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে পারবে।
সত্যিই! তাহলে আমিও পাইলট হবো। আর তোমার সাথে উড়ে বেড়াবো।
সেই জন্য অনেক অনেক পড়ালেখা করতে হবে। বুঝেছ? খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করো। আল্লাহ একদিন তোমার মনের আশা পূরণ করে দেবেন।
ঠিক আছে বন্ধু পবন পাখি। আমি তাই করবো।
ওকে, দেরি হয়ে গেল। আবার, তোমার মা বকা দিতে পারে। যাও গিয়ে পড়তে বসো।
অনুন বাড়ির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বারবার বন্ধু পবন পাখির দিকে তাকাচ্ছে। পবন পাখিও হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে অনুনকে।

Share.

মন্তব্য করুন