আকাশে অনেক তারা। ঝুলে থেকে, মিট মিট করে জ্বলে। দিনে ঘুমোয় তারাগুলো, রাত হলে জেগে ওঠে। রাতের আকাশে সাদা সাদা ফুলের মতো ছড়িয়ে থাকে তারাগুলো। তারার যেন মেলা বসে রাতের আকাশে। জোছনা রাতে ভুবনে আলো ছড়াতে চাঁদের সঙ্গী হয় তারারা।
অনেক তারার মধ্যে দুটো তারা একটু আলাদা। তারা দুটো পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের। এজন্য অন্য তারাদের চেয়ে এই তারা দুটো অনেক বেশি উজ্জ্বল। একটা তারা সাদা, আরেকটা পুরোপুরি সাদা না, সোনালি মতো। তারা দুটো খুব কাছাকাছি দূরত্বে থাকে। দু’জন তাই বন্ধুর মতো। অনেক গল্প-সল্প করে দুজন। সোনালি তারা সাদা তারাকে ডাকে- সা, আর সাদা তারা সোনালি তারাকে ডাকে- সো।
‘বন্ধু সা, এভাবে ঝুলে থাকতে আর ভালো লাগে না যে!’
‘ঠিক বলেছো বন্ধু সো। কিন্তু কী করা যাবে!’
‘চলো না একদিন খসে পড়ি!’
‘খসে পড়ে কোথায় যাবে!’
‘পৃথিবীতে। এই একঘেয়ে ঝুলে থাকা আর ভালো লাগে না। পৃথিবীর ঘাসে-গাছে-জলে একটু ঘুরবো। একটু ঘুরে বেড়িয়েই আবার চলে আসবো। কি বলো, যাবে?’
‘অবশ্যই যাবো। আমারও এই একঘেয়ে ঝুলে থাকা আর ভালো লাগছে না।’
‘চলো তাহলে আজকেই যাই।’
‘চলো।’
আকাশ থেকে খসে পড়লো তারা দুটো। নেমে পড়লো পৃথিবীতে। পৃথিবীর ঘাসে-গাছে-জলে ঘুরে বেড়াতে থাকলো তারা দুটো। নেচে নেচে, গেয়ে গেয়ে, খেলে খেলে ঘুরে বেড়াতে থাকলো সো-সা। এতোদিন জোছনা রাতে চাঁদের আলোয় পৃথিবীর ঘাস-গাছ-জল দেখেছে ওরা। আর এখন সেগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনটা ভরে উঠলো ওদের। ঘুরে বেড়িয়ে মন ভরিয়ে রাত ফুরোবার আগেই ফিরে গেলো সো-সা।
এরপর থেকে প্রতিদিনই তারা দুটো আকাশ থেকে খসে পড়ে। নেমে আসে পৃথিবীতে। একেক দিন পৃথিবীর একেক দিকে ঘুরে বেড়ায়। ঘুরে বেড়িয়ে মন ভরলে আকাশে ফিরে যায় ওরা। রাত ফুরোবার আগেই ফিরতে হয়। রাত ফুরোবার আগে ফিরতে না পারলে মারা পড়তে হবে ওদের।
জানালায় বসে তৃণা লক্ষ করে বিষয়টা। সন্ধ্যায় আকাশে কাছাকাছি দুটো উজ্জ্বল তারা থাকে। একটু রাত হলেই আকাশ থেকে খসে পড়ে তারা দুটো। পরের দিন সন্ধ্যায় একই জায়গায় আবার দেখা যায় তারা দুটোকে। একটু রাত হলেই আবার খসে পড়ে। তৃণা প্রতিদিন জানালায় বসে অবাক হয়ে দেখে।
তারা দুটো ঘুরতে ঘুরতে একদিন হাজির হয় তৃণার জানালার পাশের মাঠে। তারা দুটোকে দেখে তৃণা প্রথমে চমকে ওঠে। প্রথমে তার মনে হলো সে ঠিক দেখছে না। যখন বুঝতে পারলো সে ঠিকই দেখছে, তারা দুটো সত্যিই তার জানালার পাশে তখন সে তারা দুটোকে ডাকলো, ‘এই, এই যে শোনো।’
তারা দুটো ভেবেছিল কেউ তাদের লক্ষ করে না। তৃণার ডাক শুনে তাই ওরা চমকে উঠে ফিরে তাকালো। কোনো জবাব না দিয়েই ব্যস্ত হয়ে চলে যেতে নিচ্ছিল ওরা। তৃণা আবার ডাকলো, ‘ওমা! কী হলো! পালাচ্ছো কেন! একটু শুনে যাও!’
আবার ফিরে তাকালো ওরা।
সাদা তারা বললো, ‘কী বলতে চাও তুমি?’
‘আমি প্রতিদিন তোমাদের দেখি, আকাশ থেকে খসে পড়ো। কী করো তারপর?’
‘সেটা জেনে কী করবে তুমি?’ সোনালি তারা বললো।
‘এমনিই জানতে ইচ্ছে করছে।’
‘ঘাসে-গাছে-জলে ঘুরে বেড়াই। আকাশে ঝুলে থাকতে একঘেয়ে লাগে, এজন্যই ঘুরতে আসি।’ তারা দুটো একসঙ্গে বললো।
তৃণারও একঘেয়ে জীবন। প্রতিদিন স্কুল, হোম টিউটর, হোম ওয়ার্ক- একই রুটিন। বাবা-মা’র ব্যস্ত কর্মজীবন। একটু যে তৃণাকে বাইরে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবে তেমন কেউ নেই! তৃণার সঙ্গে খেলবে তেমনও কেউ নেই! তৃণার তাই তারাগুলোকে হিংসে হয়! ওদের মতো তারও মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে হয়।
তৃণা আবদার করে, ‘আমাকে তোমাদের সঙ্গে নেয়া যাবে?’
‘কেন! তুমি আমাদের সঙ্গে আসবে কেন!’ সাদা তারা বললো।
‘আমারও একা বসে থাকতে একঘেয়ে লাগে। তোমাদের মতো ঘুরে বেড়াতে চাই।’
‘কিন্তু তুমিতো এভাবে আমাদের সাথে ঘুরে বেড়াতে পারবে না! আমাদের সাথে আমাদের মতো করে ঘুরে বেড়াতে হলে তোমাকেও তারা হতে হবে!’
‘তবে তাই হোক না! আমিও তারা হয়ে যেতে চাই।’
‘ভেবে বলছো তো! একবার তারা হয়ে গেলে আর কিন্তু মানুষ হতে পারবে না!’ সোনালি তারা বললো।
‘হুম, ভেবেই বলছি। আমি তারাই হয়ে যেতে চাই। তবু তোমাদের সঙ্গে ঘুরতে চাই। আমাকে তোমাদের সঙ্গে নাও না!’
তারা দুটো একে অপরের দিকে চেয়ে ঈশারায় কী কী যেন আলাপ করলো। তারপর তারা দুটো একসঙ্গে বললো, ‘ঠিক আছে, এসো।’
আকাশ থেকে নেমে আসা তারাদের ইচ্ছে পূরণের অনেক ক্ষমতা থাকে। সেই ক্ষমতা থেকেই তারা দুটো তৃণাকে সঙ্গে নিলো। তারা হয়ে গেলো তৃণা।
আকাশের সেই জায়গাতে এখন তিনটা তারা। সাদা আর সোনালি তারা দুটোর মাঝে তৃণা। সন্ধ্যায় জেগে ওঠে ওরা। একটু রাত হলে খসে পড়ে। নেমে আসে পৃথিবীতে। ঘাসে-গাছে-জলে ঘুরে বেড়ায়। রাত ফুরোবার আগেই আবার ফিরে যায়। এখন ওদের আর একঘেয়ে লাগে না। ভালোই আছে ওরা…।

Share.

মন্তব্য করুন