সুকুমার রায় বহু প্রতিভার অধিকারী একজন শক্তিমান শিশুসাহিত্যিকের নাম। তিনি মজার মজার ছড়া লিখেছেন ছোটদের জন্য। মজার মজার ছড়ার পাশাপাশি লিখেছেন ব্যঙ্গাত্মক ও শিক্ষণীয় ছড়া। সুকুমার রায় বাংলা শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ছেলে। তিনি জন্মেছিলেন বাঙালি নবজাগরণের স্বর্ণযুগে। তার পারিবারিক পরিবেশ ছিল সাহিত্যানুরাগী। এটা তার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন শিশুতোষ গল্পকার, জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও শৌখিন জ্যোতির্বিদ। উপেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরু সুকুমার রায়কে সরাসরি প্রভাবিত করেছিলেন।
সুকুমার রায় তাঁর লেখার ভিতর দিয়ে সবার মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। চমৎকারভাবে কিশোর মনের ভাবনাগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন তার ছড়ায়। সেরকমই একটি ছড়া ‘এমন যদি হতো’। এ ছড়ায় যেমনিভাবে প্রকাশ পেয়েছে প্রজাপতি কিংবা পাখির হওয়ার ইচ্ছে, তেমনি জগৎ আলোময় করার ইচ্ছে কিংবা প্রকাশ পেয়েছে চাঁদ ও গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে গিয়ে রহস্য উদ্ঘাটন করার প্রবল আগ্রহ।
এমন যদি হতো
ইচ্ছে হলে আমি হতাম
প্রজাপতির মতো
নানান রঙের ফুলের পরে
বসে যেতাম চুপটি করে
খেয়াল মতো নানান ফুলের
সুবাস নিতাম কতো।

কিংবা
এমন হবে কি?
একটি লাফে হঠাৎ আমি
চাঁদে পৌঁছেছি!
গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে
দেখে শুনে ভালো করে
লক্ষ যুগের অন্ত আদি
জানতে ছুটেছি ।
[এমন যদি হতো]

ছোটদের প্রিয় লেখক সুকুমার রায়ের আরও একটি মজার ছড়া ‘হনহন পনপন’। এই ছড়ায় প্রিয় এই ছড়াকার আমাদেরকে খুব ভালোভাবে বিভিন্ন বিষয়ের ক্রিয়াফল তুলে ধরেছেন। এবার ছড়াটি পড়া যাক-

চলে হনহন/ ছোটে পনপন/ ঘোরে বনবন/ কাজে ঠনঠন
বায়ু শনশন/ শীতে কনকন/ কাশি খনখন/ ফোঁড়া টনটন
মাছি ভনভন/ থালা ঝন ঝন।
[হনহন পনপন]

আমাদের পৃথিবীটা অনেক বড়। প্রকৃতভাবে আমরা যখন চোখ মেলে তাকাই যখন ঠিক উপলব্ধি করতে পারি। বিখ্যাত ছড়াকার সুকুমার রায় ছড়ায় ছড়ায় খুব মজা করে একটি ইঁদুর ছানার বড় এই পৃথিবী দেখার অভিমত প্রকাশ করেছেন-

ছোট্ট সে একরতি ইঁদুরের ছানা,
ফোটে নাই চোখ তার, একেবারে কানা।
ভাঙা এক দেরাজের ঝুলমাখা কোণে
মার বুকে শুয়ে শুয়ে মার কথা শোনে।

যেই তার চোখ ফোটে সেই দেখে চেয়ে-
দেরাজের ভারি কাঠ চারিদিক ছেয়ে।
চেয়ে বলে মেলি তার গোল গোল আঁখি-
“ওরে বাবা! পৃথিবীটা এত বড় নাকি?”
[কত বড়]

এরকম অসংখ্য চমৎকার সব ছড়া লিখেছেন সবার প্রিয় ছড়াকার সুকুমার রায়। ছড়াকে জনপ্রিয় করে তোলায় এক অসামান্য অবদানও রেখেছেন তিনি। তাঁর আরও কিছু মজার ছড়া পড়তে পারি আমরা-

আম পাকে বৈশাখে, কুল পাকে ফাগুনে,
কাঁচা ইট পাকা হয় পোড়ালে তা আগুনে।
রোদে জলে টিকে রঙ পাকা কই তাহারে।
ফলারটি পাকা হয় লুচি দই আহারে।
হাত পাকে লিখে লিখে, চুল পাকে বয়সে,
জ্যাঠামিতে পাকা ছেলে বেশি কথা কয় সে।
লোকে কয় কাঁঠাল সে পাকে নাকি কিলিয়ে?
বুদ্ধি পাকিয়ে তোলে লেখাপড়া গিলিয়ে!
কান পাকে ফোঁড়া পাকে, পেকে করে টন্টন্-
কথা যার পাকা নয়, কাজে তার ঠন্ঠন্
রাঁধুনী বসিয়া পাকে পাক দেয় হাঁড়িতে,
সজোরে পাকালে চোখ ছেলে কাঁদে বাড়িতে।
পাকায়ে পাকায়ে দড়ি টান হয়ে থাকে সে।
দুহাতে পাকালে গোঁফ তবু নাহি পাকে সে।
[পাকাপাকি]

(যদি) কুম্ড়োপটাশ নাচে-
খবরদার এসো না কেউ আস্তাবলের কাছে;
চাইবে নাকো ডাইনে বাঁয়ে চাইবে নাকো পাছে;
চার পা তুলে থাকবে ঝুলে হট্টমূলার গাছে!
[কুম্ড়োপটাশ]

সন্দেশের গন্ধে বুঝি দৌড়ে এল মাছি?
কেন ভন্ ভন্ হাড় জ্বালাতন ছেড়ে দেওনা বাঁচি!
নাকের গোড়ায় সুড়সুড়ি দাও শেষটা দিবে ফাঁকি?
সুযোগ বুঝে সুড়–ৎ করে হুল ফোটাবে নাকি?
[সন্দেশ]

অসাধারণ সব ছড়া দিয়ে পাঠকের মন জয় করেছেন ছড়ার বরপুত্র সুকুমার রায়। তার ব্যতিক্রমী অনেক ছড়ার মধ্যে একটি ছড়া ‘জীবনের হিসাব’। এই ছড়াটি আমাদের মানসজগতে পরিবর্তন ঘটায়। কাউকে কখনো ছোট ভাবা ঠিক নয়। বিদ্যান মশাই নৌকায় চড়ে মাঝিকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে লজ্জা দিতে থাকেন। শেষমেশ যখন ঝড় ওঠে তখন মাঝি জানতে চায়, বাবু সাঁতার জানেন কি না। বাবু মাথা নাড়েন-

খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন, নৌকাখানি ডুবলো বুঝি দুলে!
মাঝিরে কন, “একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুবলো নাকি নৌকা এবার? মরব নাকি আজি?”
মাঝি শুধায়, “সাঁতার জানো?”- মাথা নাড়েন বাবু,
মূর্খ মাঝি বলে, “মশাই, এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!”
[জীবনের হিসাব]

ছোটদের বড় এই লেখক ছোট-বড় সবার মন জয় করেছেন তাঁর লেখা দিয়ে। তাঁর ছড়ায় খুঁজে পাওয়া যায় নতুনত্ব। অভিনব সব ছড়া লিখে পাঠকমনে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। ছড়াকার বাদেও তিনি একাধারে শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও সম্পাদক। বাঙালি শিশুসাহিত্যিক ‘ননসেন্স রাইমের’ প্রবর্তক হিসেবে ধরা হয় তাঁকে। তাঁর লেখা কবিতার বই ‘আবোল তাবোল’, গল্প ‘হ-য-ব-র-ল’, গল্প সংকলন ‘পাগলা দাশু’ বিশ্বসাহিত্যে অন্যতম সেরা ‘ননসেন্স’ ধরনের ব্যঙ্গাত্মক শিশুসাহিত্য বলে মনে করা হয়। ৩০ অক্টোবর এই জনপ্রিয় লেখকের জন্মদিন। ১৮৮৭ সালের এই দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর অল্প বয়সে তিনি মারা যান। মৃত্যুর বহু বছর পরেও তিনি বাংলাসাহিত্যে সমান জনপ্রিয় একজন শিশুসাহিত্যিক। ক্ষণজন্মা এই বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়ে তাঁর বিখ্যাত ছড়া ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ পড়তে পড়তে আপাতত বিদায়-

বাবুরাম সাপুড়ে,/ কোথা যাস বাপুরে
আয় বাবা দেখে যা,/ দুটো সাপ রেখে যা –
যে সাপের চোখ নেই,/ শিং নেই, নোখ নেই,
ছোটে না কি হাঁটে না,/ কাউকে যে কাটে না,
করে না কো ফোঁসফাঁস/ মারে নাকো ঢুসঢাস,
নেই কোন উৎপাত,/ খায় শুধু দুধভাত,
সেই সাপ জ্যান্ত,/ গোটা দুই আন তো,
তেড়ে মেরে ডাণ্ডা/ ক’রে দিই ঠাণ্ডা।

Share.

মন্তব্য করুন