সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘরের বাইরে এসে সুহা দেখে একি আয়োজন! ফরিদ ভাই উঠানে শীতল পাটি বিছিয়ে একোণ-ওকোণ টেনে সমান করছে। নানাও হাত লাগিয়ে বলছেন, ‘ফরিদ, জোড়া মিলে নাই। টেনে দে আরেকটু। ওখানে রোদ লাগবে।’
পৌষের মজার শীত রোদের সাথে শীতপিঠার আয়োজনে ব্যস্ত সুহার নানী। তিনদিন আগে সুহা আর শাহান নানাবাড়ি এসেছে মা-বাবার সাথে।
নানা মসজিদে ফজর নামাজ সেরে হাঁটাহাটি করে ফিরেছেন একটু আগে। সুহাকে এগিয়ে আসতে দেখে বললেন, ‘শাহান কি ওঠেনি? আজ সকালের নাশ্তা আমরা সূর্যলোকের ভিটামিন ডি’র মিষ্টান্ন মাখিয়ে খাবো।’
শাহান দরজার আড়াল থেকে ‘কি মজা, কি মজা’ বলে বেরিয়ে আসে। সুহাও ফিক্ করে হেসে ওঠে। ওর ভেতরও আনন্দ, পুলকিত হচ্ছে আয়োজন দেখে।

শাহানকে আদর করে নানা বলেন, ‘আজ আমরা মজার মজার পাটিসাপ্টা পিঠা শীতল পাটিতে বসে বসে খাবো।’
নানার বলার অঙ্গভঙ্গি দেখে শাহান লাফাতে থাকে- ‘মজা মজা’ বলে।
সুহা ঢাকার বনশ্রী আইডিয়ালে ক্লাস থ্রিতে পড়ে। শাহান আগামী বছর স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাবা অফিসে গেলে দুই ভাইবোন ওদের মা’র মোবাইল নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে। কেউ গেমস খেলবে, আর কেউ নানার লাইফ নিয়ে ব্যস্ত হয়। এদের কাড়াকাড়িতে মা’র তিনটে মোবাইল ভেঙ্গে যায়। এবারের স্কুল ছুটিতে মা’র ইচ্ছেতেই বাবা রাজি হয়ে যায় গ্রামে বেড়াতে যেতে।

২.

রান্নাঘরে সুহার নানু পাটিসাপ্টা পিঠা বানাচ্ছেন। পিঠার মৌ-মৌ গন্ধে ঘরে বাইরে বাতাস ভরপুর। সুহার আব্বু দ্রুত শীতল পাটিতে জায়গা করে নেন। পকেট থেকে লুকিয়ে মোবাইলটা বের করে সময় দেখে ভাবেন- বেশ আগেই আজ নাশ্তা হবে। মোবাইলটা দ্রুত পকেটে গুঁজে লক্ষ্য রাখেন শাহানের চোখ পড়লো কিনা!
না, শাহান আজ ব্যস্ত। মা’র হাতের প্লেটটা টেনে নিজেই বসে পড়ে বাবার সাথে।
বড় খালা অনেকগুলো পাটিসাপ্টা পিঠা এনে প্লেটে রাখেন। নানা বলেন, ‘বাহ্ বাহ্।’ নাক টেনে লম্বা দম নিয়ে হাসতে হাসতে বলেন, ‘আজ মনে হয় সবটাই আমি খাবো।’
সুহা নাক টেনে বলে, ‘আর আমরা হাওয়া খাবো!’
নানা বলেন, ‘সুহা সূর্যের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসো। তোমরা খাবে ভিটামিন ডি’। থাকো তো শহরে দালানের ভেতর দালান। সূর্যের আলো দেখতেও পাও না, খেতেও পাও না।’ এবার জোরে হাঁক মেরে বলেন, ‘কই, তোমরা সবাই আসো। আজ একসাথে সবাই মিলে খাবো।’

শাহান প্রশ্ন করে, ‘একসাথে কেন?’
‘একসাথে, হ্যাঁ একসাথে বসে খেলে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব কমে যায়। আল্লাহর রহমত হয়, খাবারে বরকত হয়।’
‘নানা নানা, আল্লাহর রহমত কী’
‘আল্লাহর করুণা, আল্লাহর দয়া। আল্লাহর রহমত ছাড়া আমরা কোনো ভালো কাজ করতে পারি না।’
সুহার আব্বু এর মধ্যে গরম গরম পাটিসাপ্টা পিঠা ধোঁয়া এড়িয়ে মুখে হা করে খাচ্ছেন। দেখাদেখি সুহাও খেতে থাকে মজা করে।

নানা উচ্চস্বরে ডাকেন, ‘কহিনুর, তোমার মাকে নিয়ে এসো।’
শাহান দেখে, উঠানের দক্ষিণ কোণে দুটি শালিক হাঁটাহাটি করছে। ওদের হেলে-দুলে হাঁটার মধ্যে কেমন রাজকীয় ভাব। ও খুব মনযোগ দিয়ে ওদের হাঁটাহাটি দেখছে।
শীতসকালের রোদের মিষ্টি তেজ ওরা খুব উপভোগ করে। নানুকে প্রায় জোর করে এনে সুহার আম্মু শীতল পাটিতে বসিয়ে দেয়। মেয়ে জামাইর সামনে বসতে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করেন তিনি। নানা হাসতে হাসতে বলেন, ‘তুমি তো নেপথ্যের নায়িকা, আজ সামনেই বসে পড়ো। আমরা আমরাই তো।’
মেয়ে-জামাইর পাত খালি দেখে সুহার নানু বলেন, ‘তোমার প্লেট খালি কেন?’
‘না মা, আজ অনেক খেয়েছি। দারুণ হয়েছে। শোকর আলহামদুলিল্লাহ।’
নানা মেয়ে-জামাইর ওঠার লক্ষণ বুঝে বলেন, ‘বসো, আজ চা এখানেই খাবো। শীতের রোদের সাথে ধোঁয়া ওড়ানো চা দারুণ মজাদার।’

শাহান এতোক্ষণ ধরে শালিক দু’টার হাঁটাহাটি দেখছিল। এবার নানাকে প্রশ্ন করে, ‘নানা ওরা কি পিঠা খায়?
না না ওরা খায় পোকামাকড়।’
উঠানের কোণে দুটি দোয়েল উড়ে এসে বসে। নানা আমড়াগাছের ডালের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘দেখেছো, জাতীয় পাখি দোয়েল এসেছে তোমাদের দেখতে।’
কয়েকটি চুড়–ই পাখি শাহানের মাথার ওপর আমড়াগাছের ডালে বসে কিচিরমিচির শুরু করে দিয়েছে। শাহান সেদিকে তাকিয়ে বলে, ‘নানা, ওরাও?’
‘হ্যাঁ, তোমাদের নতুন দেখেছে কিনা। জানো নানাভাই, পাখপাখালি আমাদের প্রকৃতির অলংকার। এছাড়াও ওরা যদি পোকামাকড় না খেতো, আমরা সুস্বাদু ফলফলাদি খেতে পেতাম না অনেকটাই। পেতামনা। পোকামাকড় ওসব খেয়ে নষ্ট করে দিতো।’
শাহানের নজর শালিক দু’টোর হেলেদুলে হাঁটার দিকে। ও খাবার ছেড়ে ওদের মত হেলেদুলে হাঁটতে গেলে ওরা উড়ে চলে যায়।

নানু চামচ দিয়ে পিঠা খেতে গেলে পিঠার টুকরাটা নিচে পড়ে যায়। হো হো করে হেসে উঠতেই নানা বলেন, ‘তোমার নানুর ইয়া বড় একটা চামচ দরকার। এবার শাহীন সুহা দু’জনেই হেসে ওঠে।’
সুহা ছড়া বানায়-
‘পাটিতে বসে পাটিসাপটা
নামুর মুখে আঁচল ঝাপটা।’
নানু বলেন, ‘দারুণ হয়েছে তোমার ছড়া। বড় হলে তুমি বড় কবি হবে। কবিদের আমার খুব পছন্দ।’
‘কেন নানু?’
‘কবিরা এতটুকুন ঘটনাকে রাঙিয়ে বড় করে ফাটিয়ে দেয়।’ নানার দিকে তাকিয়েই নানু কথাটা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
এবার সবাই মিলে একতালে হেসে ওঠে।
বাড়ির দু’টো কুকুর অনেক্ষণ যাবত উঠানের শেষ কোণে শুয়ে ছিল। ওদের হাসিতে কুকুর দু’টো ঘেউ ঘেউ করে তাদের অবস্থান জানিয়ে দেয়। নানা একটা পাটিসাপ্টা পিঠা দু’ভাগ করে ওদের দিকে ছুঁড়ে দেয়। ওরা লাফিয়ে উঠে মজা পেয়ে শাহান ও ওদের দিকে দু’টুকরা পিঠা ছুঁড়ে দেয়।
নানা এবার উঠে গায়ের চাদর ঝাড়া দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ফরিদ, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। পশ্চিমের পুকুরে জেলেরা আজ জাল ফেলবে, জানিস তো?’

ফরিদ পিঠায় শেষ কামড় বসিয়ে বলে, এতোক্ষণে নিশ্চয় জেলেরা এসে গেছে দাদু। আমি যাই…।
সুহার নানা বলেন, ওদিকে আমরাও যাবো। সুহা-শাহান তৈরি হয়ে নাও।’
দু’জনেই সমস্বরে চিৎকার করে বলে, ‘ইয়েস নানা।’
সুহার আম্মুর মোবাইল যেন রেগে ওঠে। ফোনের শব্দ আড়াল করতে দ্রুত ছুটে যায় ঘরের ভেতর। পাছে মোবাইলের শব্দ পেয়ে ওরা না আবার মোবাইলের জন্য ছুটে আসে। একটু পরেই উঠানে মায়ের মুখোমুখি হয়। মা বলেন, ‘কিরে, তোরা নাকি কাল চলে যাবি চাকায়?’
‘তোমায় জামাই তো তাই বললো।’
মা বললেন, ‘আরো ক’দিন থেকে যা। ওদের স্কুল খুলতেও তো দেরী আছে।’

পুকুর পাড়ের দিকে ছুটতে ছুটতে নানার গলার আওয়াজ শোনা যায়, ‘ফরিদ, তুই তাড়াতাড়ি যা। আজ পুকুরের বড় মাছটা রাখতে বলবি আমার নাতি-নাতনীর জন্য।’
সুহা ছুটতে ছুটতে বলে, ‘নানা, আগে বলোনি কেন? আমরা আরো আগে পুকুর পাড়ে যেতাম। টানা জালে মাছের লাফালাফি দেখতে। টানা জালে মাছের লাফালাফি দেখতে দারুণ। শাহানও যোগ করে, ‘হ্যাঁ দারুণ।’
সুহার আব্বু পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়। পাঞ্জাবির শেষ বোতামটা লাগাতে লাগাতে বলে, ‘ভাবছিলাম বাজারে যাবো।’
সুহার আম্মু কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, ‘আর যেতে হবে না। পশ্চিমে পুকুরে জাল ফেলেছে। বাবা বড় মাছের পুরোটাই আজ জামাই বাবাজিকে খাওয়াবেন।’
সুহার নানী আঁচলে মুখ ঢেকে হাসেন।

সুহার আব্বু বলেন, ‘তাহলে আমিও সেদিকে যাচ্ছি।’
সুহার নানী মন খারাপ করে বলেন, ‘আমি বলি কি জামাই বাবাজিকে বল- ছুটি এক সপ্তাহ বাড়িয়ে নিতে। তোর বাবাকে দেখেছিস, নাতিন-নাতনি নিয়ে সারাক্ষণ কিভাবে মেতে আছে। ওদের গাছগাছালি দেখায়, পাখপাখালি চিনায়। কলার ছড়ি কেটে আনে ওদের নিয়ে। এপাড়া-ওপাড়া যায়, ওদের পরিচয় করিয়ে দেন গর্ব করে। ওরাও তো খুব খুশী।’
সুহার আম্মু মায়ের ঘাড়ে মাথা রেখে বলেন, ‘মা, মাগো আমি যে এ কটাদিন কত শান্তিতে আছি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না।’

‘কেন রে মা কী হয়েছে?’ মা’র জবাব।
সুহার আম্মুর চোখে পানি ছলছল করছে। গত ক’দিনে ওরা কেউ একবারও আমার বা ওদের বাবার মোবাইল চায়নি, কাড়াকাড়ি করেনি। ওদের মারপিট করেও মোবাইল ছাড়া করতে পারি না। রাতদিন ভাইবোনের ঝগড়া। সুহা এখন খালি চোখে কিছুই পড়তে পারে না, ওর চোখের রে খারাপ হচ্ছে। শাহানও মোবাইল না পেলে এটা-ওটা ভাঙচুর করে। অথচ এ ক’দিন বাবার সাথে, তোমার সাথে কতই না আনন্দে মেতে আছে। আমার যে কতই না ভাল লাগছে। সুহার আম্মু আঁচলে চোখ মুছে নেয়।’
নানু বলেন, ‘ওদের পৃথিবীটা তোমরা বড় করে দাও। ওদের শৈশব ফিরিয়ে দাও। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’

Share.

মন্তব্য করুন