ঘুমিয়ে পড়েছে জিতু। অথচ তখনও ডান হাতে মোবাইলটি ধরা। ঠিক মাথার ডানপাশে বালিশের ওপর হাতটি। ডাটা অন করা মোবাইলে। ঘড়ি দেখলেন জিতুর বাবা। রাত দুটো। নিঃশব্দ রাত। সবাই ঘুমিয়ে। জিতুও ঘুমিয়েছে। কিন্তু ওর হাতে মোবাইলটি এখনো। কেনো? এমন প্রশ্ন জাগতেই হাত থেকে সাবধানে টেনে নিলেন মোবাইলটি। ওপেন বাটনে চাপ দিলেন। দেখলেন শেষ দেখা হয়েছে রাত ১টা ৩৫ মিনিটে। বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে গেলো তার! এতো রাত পর্যন্ত মোবাইলে চোখ ছিলো ছেলেটির! ঘুমিয়েছে মোবাইল দেখতে দেখতে! এখনো হাতে মোবাইল ধরে আছে। তার মানে ঘুম ভাঙলেই আবার দেখা শুরু হবে। ভাবতেই অবাক লাগছে জিতুর বাবার।

মোবাইলটি নিয়ে লাইট অফ করে দিলেন। তার কক্ষে এসে শুয়ে পড়লেন তিনি। শুয়েই নানান ভাবনায় জড়িয়ে গেলেন। কত চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে মনে। ভাবছেন- ছেলেটি কেনো এত রাত জেগে মোবাইল দেখে! কখন থেকে দেখে! কেনো মোবাইলে এতো আসক্তি! অতিরিক্ত মোবাইল দেখার ফলে কত রকম ক্ষতি হয়ে যায়। কত রকম অসুখ দেখা দেয় শরীরে। মন অস্থির হয়ে ওঠে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। ব্যবহার খারাপ হয়ে ওঠে। অল্পতেই মেজাজ দেখায়। অকারণ চেতে ওঠে। কারো সাথেই ভালো ব্যবহার করার মন থাকে না। লেখাপড়ায়ও মন বসে না। ব্রেইন সমস্যা দেখা দেয়। চোখের অসুখতো আছেই। এমনকি অন্ধও হয়ে যায়। কালই তো একটি পত্রিকায় খবর বেরুলো- একটি ছেলে রাতের পর রাত জেগে মোবাইল দেখে কি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে পড়েছিলো। মনে পড়লো খবরটির কথা। ঘটনাটি এমন- একটি ছেলে রাত জেগে মোবাইল দেখতো। নানারকম ছবি, গেমস্, কার্টুন এবং নানান বিষয়ে ভিডিও এসব ছিলো ছেলেটির দেখার বিষয়। দেখতো সকাল দুপুর বিকেল এবং সন্ধ্যায়। দেখার এ খবর জানতো ছেলেটির বাবা-মা। কিন্তু রাত জেগে দেখতো এ খবর ছিলো না তাদের কাছে।

ছেলেটি পড়াশোনা করে এগারোটার দিকে শুয়ে পড়তো। লাইট অফ। বাবা মা ভাবতো- ঠিক ঠিক ঘুমিয়েছে ছেলেটি। কিন্তু তাদের ছেলে শুয়ে অপেক্ষা করতো কখন ঘুমায় বাবা-মা। যখনই ও বুঝতো বাবা-মা এখন ঘুমিয়ে। বাস্ তখনই জ্বলে উঠতো ওর মোবাইলের চোখ। অন্ধকারে মোবাইলে জেগে থাকতো ও। শুরু হতো গেমস্ দিয়ে। তারপর কার্টুন। তারপর নানা ধরনের ভিডিও। এসব দেখতে দেখতে রাত কখন ভোর হয়ে যেতো টেরই পেতো না ছেলেটি।
ঠিক চারটা সাড়ে চারটার দিকে ঘুমাতো ও। এদিকে সকাল নয়টা দশটা বাজে। ছেলে ঘুম থেকে ওঠে না। মা ডাকে বাবা ডাকে। উঁহু কারো ডাকেই ওঠে না। এরপর ধমকধামক শুরু। এক দুই ধমকেও কাজ হয় না। এরপর কঠিন ধমক। সেই কঠিন ধমকের পর ওঠে ছেলেটি। ওঠার পর শুরু হয় অন্য কাহিনি। বিছানায় বসে থাকে অনেকক্ষণ। আবার ঝাড়িঝুড়ি শোনে। তারপর ওয়াশরুমে ঢোকে। কোনোরকম চোখে মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে আসে। মা তাকিয়ে দেখে ছেলেটির চোখ বেশ লাল।

কাছে এসে দেখে মা। জিজ্ঞেস করে- কি হলো তোমার চোখে। এত লাল কেনো? কোনো জবাব দেয় না ছেলেটি। চুপ। মুখ নিচু করে চেয়ে থাকে মেঝেতে। ছেলের অবস্থা দেখে মা খুব চিন্তায় পড়ে যান। গত বেশ কদিন এই চিত্র ছেলটির। ছেলের বাবার সাথে শেয়ার করেন মা। দুজনই চিন্তায় পড়ে গেলেন। কি হলো ছেলেটির! ভাবলেন- মানসিক কোনো সমস্যা নয় তো!
এভাবে গেলো আরও কদিন। এর মধ্যে একদিন ছেলেটি ঘুম থেকে উঠলো। উঠলো মানে উঠানো হলো। উঠে ছেলেটি চোখ ডলাডলি করছে। ডলা শেষ হয়। আবার ডলে। আবার শেষ করে আবার ডলে। নিচের দিক থেকে ওয়ালের দিকে তাকালো। ওয়াল থেকে ছাদের দিকে। ছাদ থেকে আবার নিচের দিকে। এবার হাউমাউ করে কান্না। কান্নার শব্দে দ্রুত ছুটে এলেন মা। এসেই জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে। বললেন- কি হলো বাবা!
মায়ের আদর পেয়ে আরও বেড়ে গেলো কান্নার আওয়াজ। কেঁদে কেঁদেই বললো- মা আমি চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

শুনে মায়ের ভেতরটি ধক করে উঠলো। বললেন- কি হলো বাবা আমার। কেনো দেখছো না? যাও চোখে একটু পানি দিয়ে আসো। এই বলে ছেলেকে বেসিনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেন। দাঁড়িয়ে বেসিনের কল হাতায় ছেলে। ঠিক যেমন হাতায় একজন অন্ধ! ভীষণ চমকে উঠলেন মা! ভয় জেগে উঠলো মনে। নিজেকে নিজেই জিজ্ঞেস করলেন- কি হলো ছেলেটির! নিজে কল ছেড়ে ছেলের চোখে পানি দিয়ে দিলেন। একবার দু’বার বেশ কবার। তারপর মুছে দিলেন মুখ। ধরে নিয়ে বসালেন খাটে।
ছেলে চোখ খুলে তাকায় চারিদিক। জিজ্ঞেস করলেন মা- কেমন দেখছো এখন?
কিছুই দেখতে পাচ্ছি না মা! বলেই আবার কান্না জুড়ে দিলো ছেলেটি।
মা ভাবলেন, ব্যাপারটি মোটেই ভালো নয়! ছেলের বাবাকে জানালেন। বাবা তখন অফিসে। শুনে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। বাসার পাশেই একটি ক্লিনিক। ছেলেকে ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন বাবা। আর দেরি করলেন না মা। ছেলের হাত ধরে নিয়ে গেলেন ক্লিনিকে। ইমার্জেন্সি ডাক্তার দেখলেন। দেখে দুটি টেস্ট করার কথা বললেন ডাক্তার। টেস্ট করালেন। রিপোর্ট নিয়ে চক্ষু স্পেশালিস্ট দেখালেন। চোখের ডাক্তার রিপোর্ট দেখে জানালেন- দীর্ঘ দিন রাত জেগে মোবাইল দেখার ফল হলো এ অবস্থা! এটি প্রায় অন্ধত্ব! অনেক দিন চিকিৎসা লাগবে। তবুও দৃষ্টি ঠিক হয় কিনা বলা যাবে না। বিস্মিত কণ্ঠে বললেন ছেলেটির মা- রাত জেগে ও মোবাইল দেখলো কখন? ও তো ১১টায় ঘুমিয়ে পড়ে প্রতিদিন।

ডাক্তার বললেন- ছেলেকেই জিজ্ঞেস করুন।
জিজ্ঞেস করলেন ছেলেকে। ছেলেটি চুপ। নিচের দিকে ফিরে আছে। আবারও জিজ্ঞেস করলেন মা। বললেন-
কি ঘটনা এটি? রাত জেগে মোবাইল কখন দেখলে? কিভাবে দেখলে?
ছেলেটি তখনও চুপ।
কথা বলিস না কেনো? বল কি ঘটনা?
ক্ষীণকণ্ঠে বললো ছেলেটি- আমি এগারোটায় শুয়ে যেতাম ঠিক। কিন্তু ঘুমাতাম না। তোমরা শুয়ে গেলে আমি মোবাইল দেখতাম। দেখতে দেখতে সকাল হয়ে যেতো।
শুনে ছেলেটির মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বললেন- এই বুঝি ছিলো আমার কপালে!
এ গল্পটির কথা মনে পড়লে ভীষণ ভয় জেগে উঠলো জিতুর বাবার। এসব চিন্তা করে আর ঘুমাতে পারলেন না তিনি। সকালবেলা ঘুম এলো চোখে। কিছুক্ষণ। তারপর উঠ গেলেন। ছেলের রুমে গিয়ে দেখলেন- তখনও ঘুমাচ্ছে ছেলেটি।
নাস্তার টেবিলে ছেলের সাথে কথা বললেন জিতুর বাবা। সঙ্গেও তার মাও আছেন। বললেন- জিতু বাবা তুমি কি নিয়মিত রাত জেগে মোবাইল দেখো?

জিতু মুখ নিচু করে চুপ। আবারও জিজ্ঞেস করলেন বাবা।
আমতা আমতা জবাব দিলো জিতু। বললো-
বাবা আমি আর এমন করে মোবাইল দেখবো না। বলে নিচের দিকে ফিরে আঙুল খুঁটছিলো।
জিতুর বাবা তখন ছেলেকে উপরের খবরটি শোনালেন! গল্পটি বলা শেষ হলেই হঠাৎ নিচের দিক থেকে মুখ তুললো। তার চোখ দুটি বেশ বড় হয়ে উঠলো। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো- বাবা আমি আর কখনো রাত জেগে মোবাইল দেখবো না। দিনেও লম্বা সময় থাকবো না মোবাইলে। বাবার হাত চেপে বললো- আমাকে মাফ করে দাও বাবা।
মাফ করে দাও। সত্যি বলছি- আমি আর প্রয়োজনের বেশি মোবাইল দেখবো না। একদম না। আমি ভুল করেছি বাবা। বলেই কেঁদে ফেললো জিতু।

জিতুর মা দাঁড়ানো ছিলো। বসলেন জিতুর পাশে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন- দেখো বাবা চোখ তো তোমার নাকি! মনও তোমার। শরীরও তোমারই। কেনো অকারণ এসব নষ্ট করবে! অসুস্থ হলে কষ্টও তো তোমাকেই করতে হবে। চোখের ওপর অতিরিক্ত চাপ দিলে চোখ তা সইবে কেনো!
তুমি কথা দিয়েছো। তোমার কথা যেনো ঠিক থাকে। জিতুর বাবাকে বললেন- তোমার ছেলেকে ক্ষমা করে দাও। আশা করি এমন কিছু করবে না ও।
বাবা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন- কথাটি সারাজীবন যেনো মনে থাকে।

Share.

মন্তব্য করুন