মেঘ হলো বৃষ্টির উৎস। আকাশে মেঘ না জমলে বৃষ্টি হয় না। বৃষ্টিপাতের জন্য প্রথমেই দরকার পড়ে জলীয় বাষ্প। এই বাষ্প তৈরি হয় নদী ও সমুদ্রের জল থেকে। সূর্যের তাপে জলীয় বাষ্প বাতাসের সাথে মিশে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে থাকে। উঠতে উঠতে উষ্ণতর হতে থাকে ও সেই সাথে হালকা হতে থাকে। সেই জলীয় বাষ্প হালকা হওয়ার কারণে ওপরে গিয়ে বাতাসের ধূলিকণা, বালুর কণা, ঠাণ্ডা বাতাসের সংস্পর্শে এসে তৈরি হয় মেঘ। এভাবে মেঘের আকৃতি বড় হতে হতে যখন ভারী হয়ে যায়, তখন এই মেঘ থেকেই বৃষ্টি হয়। কিন্তু মরুভূমি এলাকায় জলীয় বাষ্প ওপরে ওঠার আগেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ফলে জলীয় বাষ্প কখনোই বাতাসের ওপরের স্তরে ঠাণ্ডা বাতাসের সংস্পর্শে আসতে পারে না এবং মেঘও তৈরি হয় না।

বৃষ্টিপাত মাপার ক্ষেত্রে বৃষ্টির ধারাকে মিলিমিটারে গণনা করা হয়। তারপর স্কেল অনুযায়ী পরিমাপ করে হালকা, ভারী, অতি ভারী ও চরম বৃষ্টিপাতের হিসাব দেয়া হয়। এক্ষেত্রে ঘণ্টায় ০.২৫ মিলিমিটার থেকে ১ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতকে হালকা, ৪ মিলিমিটার থেকে ১৬ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতকে ভারী, ১৬ মিলিমিটার থেকে ৫০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতকে অতি ভারী এবং ৫০ মিলিমিটারের অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতকে চরম বৃষ্টি আখ্যা দেয়া হয়। এ হিসেবে পৃথিবীর কোন দেশে বৃষ্টির পরিমাণ কেমন এবং কত মিলিলিটার হারে বৃষ্টি হয় তা জেনে নেয়া যাক।

ললর, কলম্বিয়া
দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম অংশে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র কলম্বিয়া। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে আছে নয়নাভিরাম সমুদ্রসৈকত, পর্বতমালা এবং নিবিড় সবুজ অতিবৃষ্টি অরণ্য। দেশটির তুতুনেন্দু এলাকায় অবস্থিত পর্বত ঘেরা উপকূলীয় সমভূমির শহর ললর। কলম্বিয়ার ললর অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ সময় ১১-১২ দিন টানা বৃষ্টি হয়। টানা বৃষ্টি দিনের সংখ্যা কখনো ২০-এ গিয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হওয়া অঞ্চলগুলোর মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে কলম্বিয়ার ললর। এই শহরে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৩ হাজার ৩০০ মিলিমিটার।

মৌসিনরাম, ভারত
পৃথিবীর মধ্যে অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয় চেরাপুঞ্জিতে। কিন্তু এখন আর সেটা নেই। বৃষ্টির ক্ষেত্রে চেরাপুঞ্জি এখন পিছিয়ে গেছে। ভারতে বিশ্বের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয় মৌসিনরাম নামক একটি গ্রামে। পাহাড় পর্বতের ঘেরা মৌসিনরাম পশ্চিমবঙ্গের উপত্যকা অঞ্চলে অবস্থিত। বিশ্বের সর্বোচ্চ বৃষ্টির তালিকায় এই গ্রামটি এখন দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। ভারতে সর্বাধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত হওয়ার জন্য গিনিস ওয়ার্ল্ড বুক অফ রেকর্ডসে এই গ্রামের নাম রযেছে। মৌসিনরাম বছরে ১১,৮৭১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। যা চেরাপুঞ্জিতে হওয়া বৃষ্টিপাতের থেকে ১০০ মিলিমিটার অধিক।

মাউন্ট ওয়ালিয়ালো, হাওয়াই
হাওয়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য। এর রাজধানীর নাম হনলুলু। এটি যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে, প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত। বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয় হাওয়াই দেশের মাউন্ট ওয়ালিয়ালোয়। সবুজ ঘেরা মাউন্ট ওয়ালিয়ালো অনেক আকর্ষণীয় স্থান হাওয়াইতে। প্রতি বছর কয়েক লাখ পর্যটক আসে শুধু বৃষ্টিভেজা সৌন্দর্য দেখতে। এখানকার উপকূলীয় নিম্নভূমিতে ঊর্ধ্বগতির বাতাস সবসময় তীব্রভাবে বয়ে যায়। যার সর্বোচ্চ বেগ এক হাজার ৫৬০ মিটার। বৃষ্টিপাতের কারণে সারা বছরই আর্দ্র থাকে এই এলাকা। তবে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় এপ্রিল মাসে। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১১ হাজার ৫০০ মিলিমিটার ও সর্বোচ্চ মোট বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় ১৯৮২ সালে ১৭ হাজার ৩০০ মিলিমিটার।

দিবংসা, ক্যামেরুন
সর্বোচ্চ বৃষ্টি হওয়া অঞ্চলের চতুর্থ স্থানে রয়েছে আফ্রিকার পশ্চিম ভাগের দেশ ক্যামেরুনের দিবংসা গ্রাম। নিরক্ষরেখার কাছের এ গ্রামটির অবস্থান একেবারেই ক্যামেরুন পর্বতের ধার ঘেঁষে। ক্যামেরুন পর্বতের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার মিটার বা ১৩ হাজার ফুট। ক্রান্তীয় জলবায়ু হওয়ায় বর্ষা মৌসুম শুরু হয় মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। এসময় কালো মেঘ যেন ঘিরে রাখে গ্রামটিকে। আকাশ ভেঙে নামে ঝুম বৃষ্টি। দেশটির দক্ষিণ আটলান্টিক উপকূলের এ গ্রামে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় ১৯৭২ সালে ১৪ হাজার ২৭০ মিলিমিটার। এখানকার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১০ হাজার ৩০০ মিলিমিটার বা ৪০৫ ইঞ্চি।
মাউন্ট বেল্লেন্দেন কের, অস্ট্রেলিয়া
গরমের জন্য বিখ্যাত একটি দেশের নাম অস্ট্রেলিয়া। তবুও বিশ্বের পঞ্চম বৃষ্টিবহুল অঞ্চল এই দেশটির মাউন্ড বেল্লেন্দেন কের অঞ্চল। মাউন্ড বেল্লেন্দেন কের এটি দেশটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম। এখানে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। এখানে বর্ষা মৌসুম শুরু হয় এপ্রিল থেকে চলে মধ্য ডিসেম্বর পর্যন্ত। উদ্ভিদ বিজ্ঞানী বেল্লেন্দেন কোরের নামানুসারে এ পর্বতের নামকরণ করা হয়। একদিকে কোরাল সাগরের উপকূল, অন্য তিন দিকে পর্বতঘেরা এ এলাকা সব সময় ঘিরে থাকে কালো মেঘের ছায়া। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক হাজার ৬০০ মিটার উঁচু এলাকায় বৃষ্টি যেন নিয়মিত ব্যাপার। মাউন্ট বেল্লেন্দেন কেরে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৮ হাজার ৬৩৬ মিলিমিটার বা ৩৪০ ইঞ্চি। ২০০০ সালে এখানে রেকর্ড ১২ হাজার ৪৬১ মিলিমিটার বা ৪৯০ ইঞ্চি বৃষ্টি হয়।

মিলফোর্ড সাউন্ড, নিউজিল্যান্ড
বছরে যে হারে বৃষ্টিপাত হয় তা সারা পৃথিবীর মধ্যে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে নিউজিল্যান্ডের মিলফোর্ড সাউন্ড। মিলফোর্ড সাউন্ড অবস্থিত ওয়েস্ট কোস্ট দ্বীপে। এখানে সারা বছর বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে দর্শনীয় একটা সমুদ্রিক খাড়ি রয়েছে। তাই নিউজিল্যান্ডবাসীর ছুটি কাটানোর অন্যতম প্রিয় স্থান মিলফোর্ড সাউন্ড। মিলফোর্ড সাউন্ড ও কুইন্সটাউনের মধ্যবর্তী সড়ক মিলফোর্ড ট্র্যাক বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত ও দর্শনীয় হাঁটার ট্র্যাক। এখানে বলতে গেলে বছরের প্রতিদিন বৃষ্টি হয়। তবে পরিমাণে একটু বেশি হয় ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে। মিলফোর্ড সাউন্ডে বছরে গড় বৃষ্টিপাত হয় ছয় হাজার ৮১০ মিলিমিটার বা ২৬৮ ইঞ্চি। সর্বোচ্চ বৃষ্টির রেকর্ড ১৯৯৭-৯৮ সালে ১৮ হাজার ৪৪২ মিলিমিটার বা ৭২৬ ইঞ্চি।

কিররি, পাপুয়া নিউগিনি
এ দেশের ছোট্ট গ্রাম কিররি বিশ্বের অষ্টম বৃষ্টিবহুল এলাকা। গ্রামটির একদিকে পাপুয়া উপসাগর, অন্যদিকে পর্বতমালার সঙ্গে ঘন রেইন ফরেস্ট। সারা বছর বৃষ্টি হলেও ভারী মাত্রায় বৃষ্টি হয় ডিসেম্বর থেকে মধ্য মে পর্যন্ত। এখানে বছরে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৫ হাজার ৮৪০ মিলিমিটার বা ২৩০ ইঞ্চি। সর্বোচ্চ বৃষ্টির পরিমাণ রেকর্ড করা হয় ১৯৯৩ সালে ১০ হাজার ২৭০ মিলিমিটার বা ৪০৪ ইঞ্চি।

য়াকুশিমা, জাপান
বিশ্বের শীর্ষ বৃষ্টিপাত হওয়া অঞ্চলের মধ্যে দশম স্থানে রয়েছে য়াকুশিমা। য়াকুশিমা জাপানের কিয়ুশুর দক্ষিণ প্রান্তের দ্বীপ। সারা বছর এখানে বৃষ্টি হলেও মূলত বৃষ্টির মৌসুম শুরু হয় মে থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত। ৫০০ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপে ১৩ হাজার লোকের বাস। এ দ্বীপের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ৪ দশমিক ৮২৬ মিলিমিটার এবং সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের পরিমাণ রেকর্ড করা হয় ১৯৯৪ সালে ৭ দশমিক ৭৬০ মিলিমিটার।

মনরোভিয়ার, লাইবেরিয়া
লাইবেরিয়ার খোদ রাজধানী শহর মনরোভিয়ারতে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়। আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলের এই দেশটিতে রয়েছে নজরকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। আটলান্টিক মহাসাগর ও মেসুরাদ নদীর মধ্যবর্তী একটি উপদ্বীপে এ শহর অবস্থিত। এখানকার ঋতুচক্র তিন ভাগে বিভক্ত। জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে কম বৃষ্টি হয় এবং মে থেকে অক্টোবর অত্যন্ত আর্দ্র থাকে। এখানে বছরে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৫ হাজার ১০০ মিলিমিটার বা ২০০ ইঞ্চি। সর্বোচ্চ বৃষ্টির পরিমাণ রেকর্ড করা হয় ১৯৮৩ সালে ৮ হাজার ৪৩০ মিলিমিটার বা ৩৩২ ইঞ্চি।

লালাখাল, বাংলাদেশ
এপ্রিল-অক্টোবর বর্তমানে এই ৭ মাসে বেশি বৃষ্টিপাত হয় বাংলাদেশে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য আবহাওয়ার বেশ পরিবর্তন এসেছে ফলে আগেকার মতো শুধুমাত্র বর্ষাকালে বেশি বৃষ্টি হয় এমনটি আর নেই। বিশ্ব বৃষ্টিপাতের তুলনায় বাংলাদেশে অবস্থান কততম এটি জানা যায় না। বাংলাদেশে অঞ্চলভেদে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের ১০-২৫ শতাং হয় বর্ষাপূর্ব উষ্ণ মৌসুমে (মার্চ-মে), বায়ুকোণ থেকে আগত কালবৈশাখীর অনুষঙ্গ হিসেবে ঘটে থাকে। এ মৌসুমে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দেশের পশ্চিম-কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ২০০ মিলিমিটার (মিমি) এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৮০০ মিমি। মেঘালয় পর্বতের প্রভাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অধিক বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়। পশ্চিম-কেন্দ্রীয় অঞ্চলে এর পরিমাণ ১৫০০ মিমি, উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে ৩০০০ মিমি। সুরমা উপত্যকা এবং পার্শ্ববর্তী পাহাড়ি অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের হার অতি বেশি। সিলেটে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪১৮০ মিমি। মেঘালয় মালভূমির পাদদেশ সংলগ্ন সুনামগঞ্জে এর পরিমাণ ৫৩৩০ মিমি। বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত ঘটে থাকে লালাখালে। লালাখাল (জৈন্তিয়াপুর উপজেলা) নামক স্থানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৬৪০০ মিমি।

Share.

মন্তব্য করুন