দুলির মা সকাল ও বিকাল মিলে প্রতিদিন প্রায় পনেরো-ষোলো কেজি করে দুধ পৌঁছে দেয়। তাদের মালিক দুলির মা-র পালান চিপে চিপে সমস্ত দুধ বের করে নিয়ে যখন দুলিকে দুধ খাওয়ার জন্য ছেড়ে দেয় তখন পালানটা চিবানো আখের ছোবড়ার মতো চিমটে মেরে যায়, পালানে গুঁতো দিয়েও এক ফোঁটা দুধ পাওয়া যায় না। খিদের চোটে দুলি তার মা-র শূন্য পালানে যখন একের পর এক গুঁতো মেরে চলে, ব্যথায় দুলির মা চাটি মেরে সরিয়ে দেয় তাকে। দুলির মনটাই খারাপ হয়ে যায়। প্রচণ্ড খিদেয় তার কচি পেটটা চুই চুই করতে থাকে। তার মার মতো এখনও খড়-বিচলি খেতে শেখেনি সে। বেচারা দুলি মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার জীবনের দুঃখের কথা ভাবতে থাকে এক মনে।
মালিকের বউ এসে তার কপালে হাত বুলিয়ে দেয় আর ‘দুলি দুলি’ বলে আদর করতে থাকে। রাগে তার সারা শরীর রি রি করে জ¦লে। এ-মানুষগুলো ভীষণ স্বার্থপর, সে ভাবে। এরা মোটেই বুঝতে চায় না, গায়ে হাত বুলানোর আদর চায় না তারা, তারা চায় পেটভরা খাবার। পেট ভরলো তো তাদের দুঃখ শেষ। খুশিভরা মনে তখন লেজ নাড়ানো, জাবর কাটা, নাচানাচি করা, হাঁটা কিংবা ছোটা সবই এমনি এমনি হতে থাকে। তখন কেউ এসে যদি নরম করে গায়ে একটু হাত বুলিয়ে দেয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
কুমারপাড়া বটতলার ছোট্ট একটা টিনের ছাপড়ার ভিতর কোনো রকমে দাঁড়িয়ে-বসে দিনাতিপাত করে অবলা দুটি প্রাণী। দুলি ও দুলির মা। শহরের এক প্রান্তে পদ্মানদীর পাড় ঘেঁষে এই জায়গাটা। লোকেরা বটতলা বলে, আবার ঘোষপাড়াও বলে। ঘন বসতি। পাকা রাস্তার পাশেই দুলিদের টিনের ছাপড়াটা। ছাপড়ার সাথেই মালিকের একতলা বাড়ি। এ ছাপড়ায় সূর্যের মুখ দেখার কোনো সুযোগ নেই। মাথার উপর প্রায়সময়ই বিদ্যুতের একটা বাল্ব জ¦ালানো থাকে। মালিক রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দরজা বন্ধ করে লাইট অফ করে দিয়ে যায়। কেবল তখনই একটু চোখ বুজতে পারে দুলি।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে দেখতে পায় দুধপ্রার্থী মানুষের আনাগোনা। সাতসকালে এসে ভিড় করে তারা দুধের জন্য। লোকগুলো যেন বর্গীর মতো তার স্বর্গীয় আহার কেড়ে নেয়ার জন্য একত্রিত হয়েছে। দেখে মনটাই খারাপ হয়ে যায় তার। মুখ ভারী করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার দীর্ঘশ^াস ছড়িয়ে দিতে থাকে সে ভোরের বাতাসে।
দুলির মা বলে, “সবসময় ওরকম মন খারাপ করে থাকিসনে তো।”
দুলি বলে, “কেন থাকবো না? ওরা যে আমার খাবারে ভাগ বসাতে এসেছে। প্রতিদিনই তো ওরা কেড়েকুড়ে নিয়ে যায় আমার আহার। আমি যে একটা বেবি, সেদিকে ওদের কোনো নজর নেই। আসলে ওরা খুব নিষ্ঠুর আর স্বার্থপর।”
দুলির মা একগাল হেসে দিয়ে বলে, “ছিঃ! ওরকম করে বলে না। আমরা তো হলাম ইতরপ্রাণী। ওরা মানুষ। ওদের কত ক্ষমতা। পৃথিবীটা চালায়ই তো ওরা। ওদের বিরুদ্ধে কথা বলে লাভ আছে?”
দুলি ক্ষেপে ওঠে, “তাই বলে ওরা আমাকে খেতে না দিয়ে তোমার সবটুকু দুধ নিয়ে চলে যাবে? ওদের কি বেবি-টেবি বলে কিছু নেই?”
দুলির মা আবারও হেসে বলে, “আছে না? আছে বলেই তো ওরা সাতসকালে ছুটে আসে। ওদের বেবিরা মায়ের দুধ খেতে পায় না। আমার দুধ নিয়ে গিয়ে জ¦ালিয়ে ফিডারে ভরে ভরে ওদের বেবিদের মুখে তুলে দেয়। বড়রাও অবশ্য আমার দুধ খায়। ওরা বলে, দুধ হলো আদর্শ খাবার। কত সভ্য ওরা।”
“সভ্য না হাতি! আসলে ওরা খুব লোভী আর স্বার্থপর।” বলে রাগে-দুঃখে লেজ নাড়াতে থাকে দুলি।
দুলির মা বলে, “আরে, তা হবে ক্যান্। দেখ না কত আদরযত্ন করে খেতে দেয় আমাকে। আমি তো খেয়েই পারি না, বলা যায়।”
দুলি মুখ ঝামটি মেরে বলে, “তুমিও একটা স্বার্থপর।”
দুলির মা দুলির কষ্টের কথা বুঝতে পেরে বলে ওঠে, “আরে, কিছুদিন পর তুইও খাবি। তোকেও তো ওরা খেতে বলে। কত সাধে। তুই তো খাস না। আরেকটু বড় হলে ঠিকই আমার মতো খেতে পারবি।”
“ওসব খড়-ভূষি আমার ভালো লাগে না। আমার চাই শুধু তোমার দুধ।”
“পাগলি মেয়ে!” বলে হাসতে থাকে দুলির মা।
রাতের বেলাও মায়ের দুধ খাওয়ার জো নেই। হাড়-কিপটে মালিকটা তাদের দুজনকে দুটো আলাদা খুটোয় এমন খাটো করে বেঁধে রাখে যে, মার পালানে মুখ দেওয়া তো দূরের কথা, ঠিকমতো নড়াচড়া করারও কোনো উপায় থাকে না। সেদিন রাতে সে তার মাকে বলে, “তুমি কি কখনো আলো-বাতাসে থাকোনি?”
দুলির মা বলে, “থেকেছি না? কত থেকেছি। এখানে আসার আগে আমার মালিক ছিলো রসুলপুর গ্রামের এক মধ্যবিত্ত চাষী। খোলামেলা এক গোয়ালঘরে রাখতো আমাকে। বাড়ির সবাই মিলে আমার সেবা-শ্মশ্রƒষা করতো। খড়-ভূষির সাথে তরতাজা ঘাসও খেতে দিতো আমাকে। প্রায়সময়ই আমাকে নিয়ে যেতো খোলা মাঠে। খোলা আকাশ আর বিশাল পৃথিবী দেখে অভিভূত হয়ে যেতাম আমি। কি-আনন্দের জীবনই না ছিলো সেখানে!”
দুলি বলে ওঠে, “ওখান থেকে তুমি এখানে আসতে গেলে কোন্ দুঃখে?”
“আমি কি সাধে এসেছি রে?” দীর্ঘশ^াস ছেড়ে বলে দুলির মা, “আমার সেই মালিক অভাবে পড়ে শেষ পর্যন্ত বিক্রি করে দেয় আমাকে এই লোকটার কাছে। তখন তুই আমার পেটে। এখানে আসার পর তো তুই হলি।” কথা বলতে বলতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে তারা। ঘুমের মধ্যে দুলি স্বপ্ন দ্যাখে, সে তার মায়ের সাথে আগেকার মালিকের বাড়িতে চলে গেছে, তারা এখন খোলা আকাশের মুখ দেখতে পারছে, যখন খুশি তখন সে প্রাণভরে তার মার দুধ খেতে পারছে আর ফুর্তিতে দৌড়ে বেড়াচ্ছে চারদিকে।
তাদের জীবনে স্বপ্নের যে কোনো মূল্য নেই, দুলির তা জানা ছিলো না। দুলির দুঃখ সেইদিনই পূর্ণতা পেলো যেদিন, এর মাস দেড়েক পর, তার মাকেও তার কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হলো। একদিন সকালবেলা তাদের ছাপড়ার পাশের নারকেল গাছটায় একগাদা কাক এসে জটলা করছিল আর উচ্চকণ্ঠে চিৎকার-চেঁচামেচি করছিল। হঠাৎ দুলি দেখতে পেলো, কয়েকজন কসাই এসে নিয়ে গেল তার মাকে। সে কান পেতে রইলো বাইরে। সে স্পষ্ট শুনতে পেলো তাদের মালিক, মালিকের বউ ও কসাইদের কথোপকথন। মালিক বলছে, “না রে ভাই, আরো পাঁচ শ দেন। এত লাভ করবেন না।” একজন কসাই বলে উঠলো, “না, না, ভাই, এক পয়সাও দিতে পারবো না আর। যে-দামে কিনলাম, আসলটাও তুলতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না।” তারা চলে গেলে মালিকের বউ মেকি কান্না জুড়ে দিলো এই কথা বলে, “সবই কপাল! কপাল! তা না হলে হঠাৎ করে ও দুধ দেওয়া বন্ধ করে দেবে কেন? কত ওষুধপত্তর খাওয়ালাম, কিছুতেই কিছু হলো না। কপাল! সবই কপাল!” বলতে বলতে সে যখন দুলির কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল, দুলির তখন মনে হচ্ছিল একটা গুতো মেরে মাটিতে ফেলে দেয় তাকে।
এ মানুষগুলো কী রকম স্বার্থপর! স্বার্থ ছাড়া এক পা-ও নড়ে না এরা। স্বার্থ আছে তো গায়ে হাত বুলাবে, নেই তো বিক্রি করে দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না। বড় হয়ে দুলিও একসময় তার মার মতো দুধ দেবে, সেই ভরসায় ওকে লালনপালন করে যাবে এরা। মুখ গোমড়া করে দুলি ভাবতে থাকে গরু-জন্মের গূঢ় রহস্যের কথা, গরু-জীবনের দুঃখকষ্ট ও ভোগান্তির কথা। ততই তার মনে পড়ে যেতে থাকে তার মাকে। রাগে, ক্ষোভে ও কষ্টে তার দুচোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে ফোঁটা ফোঁটা পানি। মালিকের বউ তাই দেখে চিৎকার করে বলে ওঠে, “দ্যাখো, এসো সব দেখে যাও আমাদের দুলি কিভাবে কান্না জুড়ে দেছে দ্যাখো।” দুলি এবার সত্যিসত্যিই একটা গুতো মেরে বসে মালিকের বউয়ের পেটে।

Share.

মন্তব্য করুন